Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
ছোটগল্প

ডেটিং অ্যাপ

ঝটপট নীচের মেসেজ বক্সে ট্যাপ করে টাইপ করতে গেল রৌনক। কিন্তু লিখবেটা কী? স্রেফ ‘হাই’ বা ‘হ্যালো’ লিখলে মেয়েটি যে সাড়া দেবে না, সৃজনের দৌলতে রৌনক এটা ভালই জানে।

ছবি: কুনাল বর্মণ

ছবি: কুনাল বর্মণ

কৌশিক পাল
শেষ আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

ফোনটা সাইলেন্ট করে ঘুমোতে যাচ্ছিল রৌনক, ঠিক সেই মুহূর্তে স্ক্রিনে ভেসে উঠল মেসেজটা! ‘ইউ হ্যাভ আ নিউ মেসেজ’! সোয়াইপ করতে খুলে গেল ডেটিং অ্যাপটা! ছোট্ট সার্কলের ভিতর শর্টস-টি-শার্ট পরা একটি মেয়ের ছবি, তলায় লেখা ‘শ্রেয়া’। নীচে স্পেস দিয়ে মেসেজ, ‘ইয়োর নিউ ফ্রেন্ড’।

ঝটপট নীচের মেসেজ বক্সে ট্যাপ করে টাইপ করতে গেল রৌনক। কিন্তু লিখবেটা কী? স্রেফ ‘হাই’ বা ‘হ্যালো’ লিখলে মেয়েটি যে সাড়া দেবে না, সৃজনের দৌলতে রৌনক এটা ভালই জানে। এখন রাত বারোটা তেতাল্লিশ। ‘মধ্যরাতের ম্যাচ! ইন্টারেস্টিং!’ লিখে, পাঠিয়ে দিল শ্রেয়াকে। এ বার অপেক্ষা উত্তরের। রৌনক বুঝতে পারল, তার ঘুমের আমেজটা উধাও!

ছোট্ট গোলের মধ্যে থাকা ছবির উপর ট্যাপ করতে হুশ করে বড় হয়ে গেল! শ্রেয়ার ‘ইন্ট্রো পেজ’। সোয়াইপ করে দেখল, তিনটে ছবি। একটা ক্লোজ় আপ, বাকি দুটো অন্য পোশাকে। মেয়েটা দেখতে মন্দ নয়। সেক্সি ও স্টাইলিশ! শ্রেয়ার ইন্ট্রোটা পড়তে লাগল। আইআইটি খড়গপুর-এর প্রাক্তনী! রৌনক এতটাও আশা করেনি। মেয়েটি লিখেছে, গত পাঁচ দিনের এই অ্যাপের অভিজ্ঞতায় সে রীতিমতো বিরক্ত। তার পর রোমানে অল ক্যাপসে লিখেছে, ‘তুমি যদি হুক-আপ অথবা সেক্স চ্যাট-এর জন্য লালায়িত হও, তা হলে আমি দুঃখিত, তোমাকে হতাশ করার জন্য। আই অ্যাম নট দ্যাট ওয়ান, ইউ ক্যান গো টু আ ব্রথেল ইনস্টেড। হ্যাঁ, আমার বয়স ৩১ বছর, মানসিক ভাবে এখনও অসুস্থ নই। তবে তোমার ক্ষুদ্র মন যতটা কল্পনা করতে পারে, তার তুলনায় ঢের বেশি স্মার্ট, কুল... কর্মজীবনে যথেষ্ট সফলও বটে!’

কী ঝাঁঝ! পুরো ফিদা হয়ে গেল রৌনক। আসলে এই ডেটিং অ্যাপে সে নেহাতই আনকোরা। গতকালই ডাউনলোড করেছে সৃজনের পাল্লায় পড়ে। রৌনকের মোবাইলে এটা নেই শুনে সৃজন তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলেছিল, ‘‘বাবুসোনা আমার! ৩৪ পেরিয়েও তুই শালা মদনই রয়ে গেলি! এটা এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় ডেটিং অ্যাপ। জাস্টিন বিবারও এখান থেকেই মেয়ে তোলে চাঁদু...’’ তার পর হাসতে হাসতে রৌনকের গাল টিপে দিয়েছিল সৃজন।

রৌনক হতাশ গলায় বলেছিল, ‘‘ডেটিং অ্যাপে ম্যারেড লোকেদের কি আর কেউ পাত্তা দেবে ভাই?’’

‘‘এ রকম ক্যালানে মুখ দেখলে হলফ করে বলতে পারি, দেবে না।’’

‘‘টিটকিরি মারছিস? তা মারতেই পারিস। তোর মতো কপাল কি আর আমার রে? পেয়েছিস তনয়ার মতো বৌ। কোনও কিছু নিয়েই হুল দেয় না তোকে। পড়তিস আমার বৌ সৌমীর পাল্লায়... বুঝতি, লেডি শার্লক কাকে বলে...’’

প্রায় পঁচিশ মিনিট হয়ে গেল। এখনও কোনও উত্তর এল না শ্রেয়ার দিক থেকে। এক রাশ বিরক্তি নিয়ে ঘুমোতে যাওয়ার আগে সৃজনকেই একটা মেসেজ করল রৌনক, ‘ঢপের অ্যাপ আর তার ঢপের লোকজন।’

******

ঘুম ভাঙল রান্নার মাসির কলিং বেলে। সৌমী বাপের বাড়িতে। ও থাকলে দরজা খোলা, কী রান্না হবে, টিফিনে কী নিয়ে যাবে, সে সব নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না রৌনককে। এখন উপায় নেই। আধবোজা চোখে টলতে-টলতে কোনও রকমে দরজাটা খুলে, আবার এসে শুয়ে পড়ল খাটে। তপতীদি পুরনো লোক। জানে কোথায় কী রাখা আছে। নিজের মতো করে ঠিক কিছু একটা রেঁধে দেবে। একটু এদিক-ওদিক গড়াগড়ি খেতে গিয়ে মনে পড়ল গত রাতের কথা। বালিশের তলা হাতড়ে দ্রুত মোবাইলটা বার করে আনল রৌনক। ফ্লাইট মোডটা অফ করতেই, পিড়িং-পিড়িং শব্দে স্ক্রিনে ভেসে উঠল পরপর তিন-তিনটে মেসেজ। প্রত্যেকটিরই পাশে লেখা, ‘নিউ মেসেজ ফ্রম শ্রেয়া’। নিমেষে ঘুম উড়ে গেল রৌনকের। ‘‘তপতীদি, একটু চা বসাও,’’ বলেই খুলল প্রথম মেসেজটা। রৌনক দেখল, সকাল ৭টা ৩২ মিনিটে একটা ‘হ্যালো’ লিখেছে শ্রেয়া। তার দু’মিনিট পর ‘গুড মর্নিং’ এবং প্রায় তার সঙ্গে সঙ্গেই লিখেছে, ‘গত রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম’।

লেখার মধ্যে অনুতাপের চিহ্ন নেই! রৌনক যে একটা উত্তরের আশায় রাতের আধ ঘণ্টা ঘুম নষ্ট করল, সে জন্য নেই কোনও অনুতাপ! যাকগে, এখন অভিমান করার সময় নয়। সৃজনের কথায়, এই সময়টা নাকি আসলে চার সাজানোর।

এখন ৮টা ১৫। রৌনক লিখল ‘গুড মর্নিং’, সঙ্গে একটা স্মাইলি। তার পর লিখল ‘ইটস ওকে’।

এখন ব্যক্তিত্ব ধরে রাখতে হবে। তাই আঙুলগুলো নিশপিশ করলেও, আর একটি শব্দও লিখল না রৌনক। হাজার হোক আইআইটি-র প্রাক্তনী, বেশি হ্যালহ্যাল করলে ফুটিয়ে দেবে।

আরও পনেরো মিনিট কেটে গেল, কিন্তু কোনও উত্তর এল না! রৌনক মনে মনে ভাবল, মেয়েটার বড্ড ঘ্যাম! ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে না কি? অফিসেরও দেরি হয়ে যাচ্ছে। কাঁহাতক হাঁ করে ফোনের দিকে তাকিয়ে বসে থাকা যায়?

যাকগে, সৌমীকে রুটিন ফোনটা করতে হবে। সকালে রৌনকের

কাছ থেকে এই ফোনটা পেলে খুব খুশি হয় ও। ওর বাবার শরীর খারাপ, তাই গত সাত দিন ধরে মেয়েটা আসানসোলে। ভদ্রলোকের মাইল্ড হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। ডাক্তার বলেছে, তেমন চিন্তার কিছু নেই। তবু রৌনক সকালে ফোন করে শ্বশুরমশাইয়ের খোঁজ নিলে সৌমী শান্তি পায়। মিনিট পাঁচেকের একটা ফোনই তো, তাই রুটিনে ছেদ দেয় না রৌনকও। সৌমীকে ফোন করে, তপতীদিকে ভাত বাড়তে বলে স্নানে চলে গেল ও।

কিন্তু সৃজন কেন এখনও ফোন করল না? কাল রাতে পাঠানো মেসেজটা কি দেখেনি!

******

১০টা ২৩। অফিসে ঢোকার মুখে শ্রেয়ার মেসেজটা ঢুকল। ‘কাজে বেরোলাম। কিছু মনে করবেন না তো, যদি পরে কথা বলি?’

এর উত্তরে ‘না, না’ বলা ছাড়া আর কী-ই বা করা যায়! তবু সঙ্গে-সঙ্গে উত্তরটা দিল না রৌনক। পার্সোনালিটি ধরে রাখতে হবে। নিজের ডেস্কে পৌঁছে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল। আজ হাতে তেমন কোনও স্টোরি নেই। দু’-একটা ফোন করতে হবে শুধু। সৃজনের সিট ফাঁকা। হাতঘড়িটা উল্টে দেখল রৌনক, ১১টা ১০। শ্রেয়ার মেসেজ আসার পর পেরিয়ে গিয়েছে আধ ঘণ্টারও বেশি। এবার সে শ্রেয়াকে লিখল, ‘না, না, কিছু মনে করার প্রশ্নই নেই। আসলে আমিও জাস্ট অফিসে ঢুকলাম।’

একটা ‘থামস আপ’ পাঠিয়েছে শ্রেয়া। এর পর আর কথা বাড়ানো চলে না। কিন্তু শ্রেয়ার সঙ্গে না হোক, সৃজনের সঙ্গে অভিজ্ঞতাটা শেয়ার করার জন্য পেটের ভিতর শ’পাঁচেক প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে। হাজার হোক, প্রথম এক্সট্রা-ম্যারিটাল। ‘পরকীয়া’, এই বাংলা শব্দটা বেশি ভাল লাগে রৌনকের। কত দূর সম্পর্কটা এগোবে কে জানে! কিন্তু ভাবতে দোষ কী?

ফোন করল সৃজনকে। কেটে দিল ও। মেসেজ এল, ‘ইন আ মিটিং, কল ইউ লেটার’। কিছু ক্ষণ পর পিঠের উপর হুমদো হাতটা পড়তেই রৌনক বুঝল, এটা সৃজন। মিটিমিটি হাসছে ওর দিকে তাকিয়ে। রৌনক কিছু বলতে যাওয়ার আগেই সৃজন বলল, ‘‘বল বাবা বল, হয়েছেটা কী? এত উতলা কেন!’’

‘‘এখানে নয়। চল বাইরে। কফি খেতে খেতে বলছি সব,’’ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রৌনক।

কাল রাত থেকে আজ সকাল পর্যন্ত শ্রেয়ার সঙ্গে যেটুকু কথা হয়েছে, সৃজনকে বলল রৌনক। শুনে সৃজন বলল, ‘‘সাব্বাস মেরে শের! এক্কেবারে আইআইটি প্রাক্তনী জুটেছে কপালে! তবে তুই একদম ঠিক পথেই এগোচ্ছিস। উতলা হওয়ার যেটুকু দৃশ্য, সব স্ক্রিনের এ পাশেই রাখবি। বাড়তি হ্যাংলামি একদম না। আর শোন, সপ্তাহখানেকের মধ্যে শোওয়ার কথা ভুলেও বলতে যাবি না। তা হলেই হড়কে যাবে। দ্বিতীয় সপ্তাহে দেখবি, মেয়েটা নিজেই বলছে, উইকএন্ডে তোমার কী প্ল্যান!’’

‘‘শোওয়া! তুই কি পাগল!’’

‘‘ওরে আমার গুলুপুষু রে! ডেটিং অ্যাপে মেয়ে তুলে, তুমি কি তাকে পুজো করবে না কি!’’

‘‘তুই যে আমাকে কোন পথে ঠেলছিস...’’

‘‘ন্যাকা! দে, ফোনটা দে, অ্যাপটা ডিলিট করে দিই...’’

‘‘ওফ! রাগ করছিস কেন? আমি কি সেটা বললাম!’’

সৃজন রৌনকের পেটে একটা খোঁচা মেরে বলল, ‘‘শোন, আগ বাড়িয়ে ফোন নম্বর চাইতে যাবি না। মেয়েরা এটা ভীষণ অপছন্দ করে।’’

******

সাড়ে ছ’টায় অফিস থেকে বেরোনোর সময় শ্রেয়াকে আর একটা মেসেজ করল রৌনক, ‘হে! হোয়াটস আপ!’

উত্তর এল রাত ৯টা ৪ মিনিটে। পর পর দুটো মেসেজ, ‘হাই’, ‘অফিস থেকে জাস্ট ফিরলাম।’

তিন মিনিট পর রৌনক লিখল, ‘আমি ফিরেছি আধ ঘণ্টা আগে।’ তার পর টাইপ করতে লাগল দ্রুত, ‘তোমার ইন্ট্রোটা আমি আর এক বার ভাল করে পড়লাম... তোমাকে একটা কথা জানানো দরকার... না হলে আমাকে ভুল বুঝতে পারো... আমি বিবাহিত। এখানে... জাস্ট টু এক্সপ্লোর লাইকমাইন্ডেড পিপল।’ তার পর লিখল, ‘এ বার তুমি ঠিক করো, আমার সঙ্গে চ্যাট করতে চাও কি না। তোমার সিদ্ধান্ত মেনে নেব।’ সঙ্গে একটা স্মাইলি।

শ্রেয়া লিখল, ‘ওহ! সততার জন্য ধন্যবাদ।’ মেসেজটা লাইক করে রৌনক একটা স্মাইলি পাঠিয়ে লিখল, ‘এটুকু তো থাকা উচিত। না হলে নিজেকে মানুষ বলি কোন মুখে!’

‘হা হা হা। থ্যাঙ্কস।’

‘যাক! তা হলে সম্পর্কটা টিকে গেল?’

উত্তর সরাসরি না দিয়ে শ্রেয়া লিখল, ‘কিন্তু বিবাহিত লোক এই অ্যাপে কী করছে?’

‘আমার তো মনে হয় না এটা জাস্ট একটা ডেটিং অ্যাপ।’

‘দেখো, আমি কিন্তু এখানে আছি একটা সিরিয়াস রিলেশনশিপের সন্ধানে, অফকোর্স যদি তার মধ্যে কোনও সারবস্তু থাকে, তবেই।’

রৌনক লেখার আগেই শ্রেয়ার মেসেজ, ‘তুমি কি প্রফেশনাল কনট্যাক্ট বিল্ডিং-এর জন্য? গুড, আমার সঙ্গে তা হলে এক জন সাংবাদিকের আলাপ হল। প্রয়োজন পড়লে সাহায্য চাইব...’

রৌনকের আঙুল কম্পিউটারের কি-বোর্ডে দ্রুত চললেও, মোবাইলে অতটা দ্রুত নয়। বোধ হয় এই অসহায়তার কথা আঁচ করতে পেরেই শ্রেয়া পরের মেসেজটা না পাঠিয়ে অপেক্ষা করল। রৌনক যে সাংবাদিক, এটা শ্রেয়া জেনেছে ওর প্রোফাইল ইন্ট্রো পড়ে। তার মানে রৌনককে মনে ধরেছে শ্রেয়ার। যাই হোক, একটু সময় পেয়ে রৌনক গুছিয়ে লিখল, ‘ঠিক সে রকমও নয়। আসলে পরবর্তী উপন্যাসের জন্য একটা প্লটের সন্ধানে আছি...’

বেশ একটা অন্য রকম উত্তর দেওয়া গিয়েছে! মনে মনে খুশি হল। তার পর ব্যাক স্ক্রোল করে শ্রেয়ার মেসেজগুলো এক বার পড়ে নিল। আসলে দেখতে চাইল, শ্রেয়ার আর কোনও বক্তব্যের উত্তর দেওয়া বাকি রইল কি না। দেখল, শ্রেয়া ‘সিরিয়াস রিলেশনশিপ’-এর কথা লিখেছে। এই পয়েন্টটা ধরেই রৌনক লিখল, ‘স্যরি টু সে, সিরিয়াস রিলেশনশিপের সন্ধানে থাকলে, আমার মনে হয় তুমি ভুল জায়গায় এসেছ!’

উত্তর এল দ্রুত, ‘হ্যাঁ, দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু তোমার দুঃখিত হওয়ার কোনও কারণ নেই, আমি এখন জাস্ট এটার ফিল নিচ্ছি! কিন্তু কী উপন্যাস লিখছ? তাও আবার এখানে গল্পের সন্ধানে? তোমরা সাংবাদিকরা না...’ সঙ্গে, হাসতে-হাসতে চোখ দিয়ে জল বেরোনোর তিনটে ইমোজি।

যে উত্তরটা দিয়ে নিজেকে বেশ তালেবর মনে করছিল রৌনক, সেটা নিয়ে যে শ্রেয়া এ ভাবে মজা করবে, সে আশাই করেনি। এ বার নিজেকে আর একটু জাস্টিফাই করা দরকার। রৌনক লিখল, ‘বলতে পারো, এখানে লোকজনের সঙ্গে কথা বলে আমি একটা চরিত্র খোঁজার চেষ্টা করছি।’

‘ভেরি ফানি! তার উপর ভিত্তি করে তুমি একটা উপন্যাস লিখবে?’

‘আসলে আমার নায়িকা কী রকম হবে, সেটাই ভাবছি। আচ্ছা, তুমি তো আইআইটিয়ান!

রেসপেক্ট ম্যাডাম,’ কথা ঘোরানোর জন্য এ বার একটা ‘নমস্কার’ করার জিফ ফাইল পাঠাল রৌণক। উপন্যাস নিয়ে বেশি এগোলে, ল্যাজেগোবরে হওয়ার সম্ভাবনা। কখন সত্যিটা বেরিয়ে যাবে, ইজ্জতের ফালুদা

হয়ে যাবে!

বিষয়টা বোধ হয় মনে ধরেছে শ্রেয়ার। এই অ্যাপে এমন কথা হয়তো এর আগে তাকে কেউ বলেনি! সে লিখল, ‘নায়িকা? নায়ক কেন নয়?’

এ তো মহা মুশকিল! মেয়েটা তো ওই বিষয়টা থেকে বেরোতেই চাইছে না! রেহাই পেতে সে লিখল, ‘নায়ক তো হবে আমার মতো। তাকে আমার চেয়ে ভাল আর কে চেনে?’

‘ডেটিং অ্যাপ থেকে উঠে এল নায়ক-নায়িকা! বাহ্‌, গ্রেট স্টোরি!’

‘থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ। দেখা যাক কী দাঁড়ায়!’ যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল রৌনক। তবে সে মনে-মনে খুশিই হল। অচেনা কারও সঙ্গে সে দিব্যি বাক্যালাপ চালিয়ে যেতে পারে! এত দিন ভাবত, এই কাজ শুধু সৃজনই পারে। তার মানে সৃজনের ভাষায়, ‘এই মেয়েটা উঠলেও উঠতে পারে’। তার পর নিদেনপক্ষে একটা কফি ডেট তো বাঁধা! প্রথম পরকীয়া! উত্তেজনায় কান দুটো একটু গরম হয়ে উঠেছে কি? না, উত্তেজনায় ভেসে গেলে চলবে না। বাক্যালাপ স্বাভাবিক ছন্দে চালিয়ে যেতে হবে। রাত সাড়ে এগারোটা! ভাবনার সুতোটা কেটে গেল শ্রেয়ার মেসেজে, ‘তুমি কী ধরনের জার্নালিজ়মের সঙ্গে যুক্ত?’

‘জলের সমস্যা, ডেঙ্গি, ভাঙা রাস্তা, ত্রিফলা... এই সব!’

‘বাংলা কাগজ, নাকি ইন্‌জিরি?’

‘নিখাদ বাংলা।’

‘আনন্দবাজার পত্রিকা?’

‘না, দিনের বার্তা।’

‘ওকে।’

‘কখনও হাতে নিয়ে দেখছ কাগজটা?’

‘না। খবরের কচকচানি এমনিতেই ভাল লাগে না। আর সময়ও নেই।’

‘হুমমমম...’

‘তুমি কিসে আছ?’

উত্তর না দিয়ে, আবার পুরনো টপিকে ঢুকে গেল মেয়েটা! লিখল, ‘একটা গল্পের আইডিয়া পেলাম, তোমার উপন্যাসের জন্য। বলব?’

রৌনক এ বার একটু অবাকই হল। তার মানে, মেয়েটা ওর কথা সিরিয়াসলি নিয়েছে। বেশ বেশ! অযাচিত ভাবে একটা গল্পের আইডিয়া যদি পাওয়া যায়, মন্দ কী! উপন্যাস লেখার কথা কোনও দিন চিন্তা না করলেও, গল্প লেখার সুপ্ত বাসনাটা যে তার একেবারে নেই, এমনও তো নয়... সে তাড়াতাড়ি লিখল, ‘প্লিজ়...’

শ্রেয়া লিখল, ‘গল্পটা শুরু হচ্ছে এই ভাবে— ‘রোজকার একঘেয়ে জীবন থেকে বেরোতে পাপ্পু একটা অ্যাকাউন্ট খুলল ডেটিং অ্যাপ-এ। কিন্তু দুষ্টুমি করার মতলবে এবং কিছুটা ইমেজের কথা মাথায় রেখে সে নিজের পরিচয় গোপন রাখল। রাখল না কোনও প্রোফাইল পিকচার। একটা ইন্ট্রো লিখল...’

শ্রেয়াকে উৎসাহ দিতে রৌনক লিখল, ‘বাহ্‌! তার পর!’

‘পাম্মিও বেশ বুদ্ধিমতী, সে-ও কোনও প্রোফাইল পিকচার রাখল না। ঘটনাচক্রে পাপ্পু এবং পাম্মির পরিচয় হল। চলতে থাকল কথা। তিন দিন পরে তারা ঠিক করল, মিট করবে একটা কফি শপে। কিন্তু কফি শপে এসে পাপ্পু দেখল, পাম্মি ওর নিজেরই স্ত্রী!’ হাসিতে কান্নার তিনটে ইমোটিকন দিয়ে শ্রেয়া আরও লিখল, ‘খুবই কমন স্টোরি, তবে আমার মনে হয়, এটা হিট হয়ে যাবে! কারণ এই অ্যাপে এমনটাই হচ্ছে আকছার! আমরা বুঝতে পারছি না...’

এ বার তিনটে অট্টহাস্যের ইমোটিকন পাঠাল রৌনক।

শ্রেয়া লিখল, ‘ভাল না?’

‘একটু প্রেডিক্টেবল। কিন্তু মিষ্টি আইডিয়া। অ্যান্ড ইউ আর টু সুইট টু মি!’ এ বার রৌনক সঙ্গে জুড়ল লজ্জায় লাল হওয়ার ইমোটিকন।

শ্রেয়া লিখল, ‘প্রেডিক্টেবলই তো করেছি ইচ্ছে করে। আমি কৌনসা থ্রিলার লিখছিলাম!’

শ্রেয়ার খারাপ লাগতে পেরে ভেবে রৌনক লিখল, ‘সেটা সত্যি।’

শ্রেয়া এ বার লিখল, ‘আচ্ছা রৌনক, তুমি যদি তোমার স্ত্রীকে এ ভাবে এখানে খুঁজে পাও, কী হবে?’

প্রথমে একটু চমকে গেলেও, সামলে নিয়ে হাসতে-হাসতে কান্নার চারটে ইমোজি পোস্ট করল রৌনক। তার পর লিখল, ‘ভগবান সহায়!’ সঙ্গে ‘নমস্কার’ এর জিফ ফাইল।

‘এ কী! হাসছ কেন?’

‘বিপদের ভয়ে।’

‘হতেও তো পারে, সে-ও এই অ্যাপে আছে আর তুমি জানো না!’

রৌনক লিখল, ‘আচ্ছা, গল্পটা তো এটাও হতে পারে! সত্যিই তুমি আমার বৌ! অ্যাপে আছ একটা পরকীয়া করার জন্যই। এখানে আমাকে দেখে, নিজেকে বদলে নিলে! মানে, ‘পাম্মি’ না, আমার বৌ আসলে ‘শ্রেয়া’র ছদ্মবেশটাই নিয়েছে! আর আমি গোড়া থেকে গাধার মতো ‘রৌনক’ হয়েই বসে আছি! কী, কেমন?’

কোনও রিপ্লাই নেই! পাঁচ মিনিট... দশ মিনিট...

এ বার রৌনক লিখল, ‘অ্যাই, শোনো, তুমি আমার সত্যিকারের বৌ নও তো!’

উত্তর নেই!

‘সিরিয়াসলি, এ বার কিন্তু আমার ভয় করছে! রেগে গেলে না কি? আরে, জাস্ট কিডিং!’

সৃজনের টিপস এখন আর মাথায় নেই। এটাও মাথায় নেই যে, ঘড়ির কাঁটা বারোটা তেতাল্লিশ পেরিয়ে চুয়াল্লিশের ঘরে। মধ্যরাত অতিক্রান্ত!

অন্য বিষয়গুলি:

Short Story Kaushik Pal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy