Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
ছোটগল্প

চন্দনবন

বয়স তো কম হল না। বন্ধুদের কেউ কেউ মহাশূন্যে পাড়ি দিয়েছে। স্বামীও তো সাত তাড়াতাড়ি চলে গিয়েছে সেই পথে।

ছবি: তারকনাথ মুখোপাধ্যায়

ছবি: তারকনাথ মুখোপাধ্যায়

দোলনচাঁপা দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ১৮ অগস্ট ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

মোবাইলে পর পর দুটো মেসেজ। চমকে উঠল মল্লিকা।

‘শরমিন, কেমন আছ? চন্দনবন মনে পড়ে?’

একটু হলেই সিঁড়ি থেকে পড়ে যেত মল্লিকা। মোটে তিনধাপ সিঁড়ি একতলা বাড়ির। চেনা, মুখস্থ। আজ চল্লিশ বছর ধরে ওঠানামা করছে। স্টেপ ভুল হওয়ার তো কথা নয়। কিন্তু চমকে উঠতে হলই নামটা শুনে। এই নাম তো অন্য কারও জানার কথা নয়। বাবা তার নাম রেখেছিলেন মল্লিকা। মা ডাকতেন ছুটকি। ভাইবোনদের সবার ছোট, তাই।

বয়স তো কম হল না। বন্ধুদের কেউ কেউ মহাশূন্যে পাড়ি দিয়েছে। স্বামীও তো সাত তাড়াতাড়ি চলে গিয়েছে সেই পথে। মাত্র তেরো বছরের বিবাহিত জীবন তার ভাস্করের সঙ্গে। চলন্ত বাসের চাকা মাথার উপর দিয়ে চলে গিয়েছিল। মল্লিকা তখন তেত্রিশ, ছেলে ভুবনদীপ বারো বছর। কী ভাবে যে পিতৃহীন পুত্রকে আগলে আগলে বড় করেছে, সে-ই জানে।

ভাস্কর জানত না এই নামের কথা। কেউ কিছুই জানত না। মল্লিকা নিজেই ভুলেই গিয়েছিল।

কৈশোরে বড্ড বেশি লাজুক ছিল। কথা ফুটত না মুখে। ডাগর চোখে ছিল ভাবের ইঙ্গিত। ফিরোজ পড়ে নিয়েছিল সেই অব্যক্ত ভাষা। ‘শরমিন’ নামের অর্থ লাজুক সুন্দরী। ফিরোজ এই নামেই ডাকত তাকে।

মাধ্যমিকের পরে ক্লাস পালিয়ে প্রায়ই তারা চলে যেত পদ্মদিঘির মাঠে। ও পারে ধোঁয়া ধোঁয়া। কী আছে জানতে ইচ্ছে করত মল্লিকার। আর প্রতি বারই তার কৌতূহলে জল ঢেলে ফিরোজ বলত, “জঙ্গল।”

“মোটেই না। আসলে তুই নিয়ে যেতে চাইছিস না ফিরোজ।”

“সাপখোপের বাসা। পরিত্যক্ত কারখানা। ওখানে মানুষ যায়?”

মল্লিকার বায়নায় ফিরোজ এক বার নিয়ে গিয়েছিল সাইকেলে। পথেই ঝমঝমে বৃষ্টি। ভিজে চুপচুপে দুই তরুণ-তরুণী পরস্পরের উত্তাপ নিয়েছিল সে দিন। ফেরার সময় অরণ্যের পথ আর্দ্র। শুকনো মড়মড়ে পাতা সজীব হয়ে উঠেছিল। পাতার টলটলে জলবিন্দু, দিঘির লালপদ্মের দুলুনি, আকাশের মোহময়ী নীলিমা মাতাল করে দিচ্ছিল তাদের।

“সোঁদা গন্ধ পাচ্ছিস শরমিন?” ফিরোজ তাকে সামনে বসিয়ে সাইকেল চালাচ্ছিল। এক পশলা বৃষ্টির পর মাটি থেকে উঠে আসছিল এক অদ্ভুত ঘ্রাণ।

“আমি তো চন্দনের বাস পাচ্ছি,” সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরা একজোড়া হাতে গাল ছুঁইয়ে বলেছিল মল্লিকা।

“আমিও। জানিস, টিপু সুলতানের প্রাসাদের আসবাবগুলোয় চন্দনের গন্ধ। সব কিন্তু চন্দনের নয়।”

“তাই?”

“হ্যাঁ রে। এ বার যখন মাইসোর বেড়াতে গেলাম, আব্বা ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন আর বলছিলেন যে ভাল জাতের চন্দনগাছ দুষ্প্রাপ্য। অরণ্যে একটা চন্দনগাছ থাকলেই আশেপাশের গাছগুলোতে চন্দনের গন্ধ হয়।”

‘‘সত্যি?’’

‘‘বিলকুল। অত রাশি রাশি চন্দন কাঠ পাওয়া যায় না কি বাস্তবে?’’

সে দিন বাড়ি ফিরেও বার বার গন্ধটা পাচ্ছিল মল্লিকা। চন্দনের সুরভি। মাঝেমধ্যেই চন্দনবনে চলে যেত তারা। ফিরোজ বলেছিল, ‘‘একটু ধৈর্য ধর। সমাজ হয়তো মানবে না, কিন্তু আমরা ঠিক পারব। আগে নিজের পায়ে দাঁড়াই।’’ শ্যামবর্ণ ফিরোজের স্বপ্নিল চোখ। কোঁকড়া চুল। ছ’ফুট উচ্চতা। মল্লিকা উন্মাদিনীর মতো হয়ে গিয়েছিল যে দিন ফিরোজ কথা দিয়েও এল না। সিদ্ধান্ত হয়েছিল আগেই। বাড়ির অমতে নতুন সংসার পাতবে তারা। ফিরোজ দশ হাজার টাকা দিয়ে রেখেছিল তার হাতে। দু’বছর ধরে তিলতিল করে জমানো টাকা ফিরোজের। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে। টাউনে টিউশনি করে ক’টাকাই বা হয়!

“ওদের সঙ্গে আমাদের কোনও ভাবে মিলবে না। মিলতে পারে না ছুটকি, এই সম্পর্ক ছাড়। ভুলে যা ওকে,” ভয়ার্ত গলায় বলেছিলেন মা। বাবা রেগে গিয়ে থাপ্পড় মেরেছিলেন। ভাইবোনদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট সে। বাবার আদরের দুলালি। জীবনে সেই প্রথম বার মার খেয়েছিল কনিষ্ঠা। কাঁদেনি, বরং রোখ চেপে গিয়েছিল। মুখে মুখে তর্ক করেছিল।

“কেন? মেলালেই মেলে। জঙ্গলে ভিনজাতের গাছেরা কি জড়াজড়ি করে থাকে না?”

“ছি ছি! এই তোমার স্বাধীনতার অপব্যবহার!” বাবার কোঁচকানো ভুরু দেখেও ভয় পায়নি মল্লিকা। দিন দশেক পরে এক সকালে গিয়েছিল চন্দনবনে। এখানেই আসার কথা ফিরোজের। হাতব্যাগে অগোছালো জামাকাপড়, বইখাতা, চিরুনি। হাতঘড়ি দেখছিল বারবার। দু’ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে শেষমেশ বসে পড়েছিল মাটিতে। দুপুর পেরিয়ে বিকেল। জলের বোতল ফাঁকা হয়ে গেল। গলা শুকিয়ে কাঠ। ফিরোজ এলই না।

সূর্য ডোবার আগে উঠে এসেছিল মল্লিকা। রাগে গা কাঁপছিল। মনে হচ্ছিল, পদ্মদিঘির জলে গলা ডুবিয়ে বসে থাকলে কেমন হয়! কেউটের আনাগোনা। আরও একটা ছোবল মারুক তাকে। বিষে বিষে বিষক্ষয় হবে। নিশ্চুপে বাড়ি ফিরেছিল মল্লিকা। কেউ কিছু টের পায়নি।

ফিরোজ কেন এল না, বার বার ভেবেছে সে। শয়নে, স্বপনে, জাগরণে। ভেবে কূল পায়নি। সে দিনের পরে ফিরোজ আর কলেজেও আসেনি। তাদের ছোট্ট শহর থেকে একেবারে উধাও হয়ে গেল ফিরোজ। এক বন্ধু জানিয়েছিল, মেসবাড়ি ছেড়ে, বনগাঁ পেট্রাপোল সীমান্ত পেরিয়ে ফিরোজ চলে গিয়েছে তার ভিটেতে। বাংলাদেশ। সেই যদি যাবেই, তবে এত চন্দনের ঘ্রাণ ছড়ানো কেন? কেন? হাজার বার প্রশ্ন করেও উত্তর পায়নি মল্লিকা।

বিয়ের পরে ভাস্করের সঙ্গে কলকাতায় চলে আসে মল্লিকা। জীবনের নতুন অধ্যায়ে হারিয়ে গেল সেই পদ্মদিঘি, চন্দনবন। ফিরোজের চিঠিগুলো শুধু ছিল। নীল রেশমকাপড়ে মুড়ে ট্রাঙ্কে রেখেছিলেন শাড়ির ভাঁজে। এ সব জায়গা সবচেয়ে সুরক্ষিত। কেউ হাত দেয় না। ভাস্কর কখনও তাঁর ব্যক্তিগত পরিসরে অযথা উঁকি দেয়নি।

মেসেজ বার বার পড়লেন মল্লিকা। তার নম্বর পেল কোত্থেকে ফিরোজ? এই লোকটা ফিরোজই তো? নাকি অন্য কেউ ফিরোজের নামে... কিন্তু শরমিন নাম তো অন্য কারও জানার কথা নয়। এই গ্রহের এক জন মাত্র মানুষ তাকে এই নাম দিয়েছিল। ট্রাঙ্কের ডালা খুলে শাড়ি বার করলেন মল্লিকা। চিঠিগুলো আগের মতোই নীল কাতানসিল্কের মধ্যে তন্দ্রাচ্ছন্ন। এক বার চন্দনবন গেলে কেমন হয়? বাবা মায়ের কেউই বেঁচে নেই। দাদারা প্রবাসী। ভাড়াটে অধ্যুষিত বাপের বাড়ির আর কী-ই বা টান থাকে! বিধবা হওয়ার পরে এমনিতেও বেশি যোগাযোগ রাখতেন না মল্লিকা। আত্মমর্যাদা তাঁর বরাবরই প্রবল। নয়তো ফিরোজের জন্য অপেক্ষা না করে ছ’মাসের মাথাতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতেন না। ছিঃ ফিরোজ! অপারগতার কথাটা মুখে এক বার বলতে পারতে অন্তত। দশ হাজার টাকা দিয়ে কি প্রেম কেনা যায়! সে টাকা আর ছুঁয়েও দেখেননি মল্লিকা। তারা আজও নীল রেশমে গুটিপোকা হয়ে ঘুমোচ্ছে। ফিরোজের সঙ্গে দেখা হলে না আসার কারণটা জিজ্ঞেস করতেন মল্লিকা। টাকাটাও ফেরত দিতেন। সে আর হল কোথায়!

এক বার কি মেসেজ করবেন? দুরুদুরু বুকে চার-পাঁচবার মেসেজ লিখলেন। ফোন টিপে টিপে। প্রতি বারই ডিলিট করে দিলেন। নাহ, কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। এর চেয়ে একটা ফোন করলে কেমন হয়! সরাসরি কথা হওয়াই বাঞ্ছনীয়। না কি ছেলে ভুবনদীপকে জানাবেন! সে বেচারা এখন বেঙ্গালুরুর অফিসে শেষ মুহূর্তের গোছাগুছিতে ব্যস্ত। আমেরিকায় প্রোমোশন পোস্টিং হয়েছে। তাকেও পাকাপাকি নিয়ে যাওয়ার জন্য ঝোলাঝুলি শুরু করেছে ছেলে, কিন্তু মল্লিকা ছেলের উপর কখনও নির্ভরশীল হবেন না। থাক, ছেলেকে ফোনে ব্যতিব্যস্ত না করাই ভাল। গা শিরশির করছিল। ভ্যাপসা গরমেও শীত করছিল মল্লিকার। কে করল মেসেজ চল্লিশ বছর পর!

শেষ পর্যন্ত ছেলেকে ফোন করলেন মল্লিকা। আর সব কথা হল, কিন্তু পদ্মদিঘি, চন্দনবন আর ছোটবেলার কথা বলি বলি করেও বলতে পারলেন না। অথচ ছেলে তাঁর সবচেয়ে বড় বন্ধু। না জানানোর কোনও মানে হয় না। নোটের বান্ডিলটা বহু দিন পরে খুললেন মল্লিকা। চল্লিশ বছর আগের নোট এখন কি চলবে? নাকি তামাদি? গুনে গুনে দেখলেন। নাহ, দশ হাজারই আছে। ভাস্কর মারা যাওয়ার পরে শত অর্থকষ্টেও এখানে হাত দেননি।

দু’ঘণ্টা ধরে টোটোতে ঘুরেও পদ্মদিঘি খুঁজে পেলেন না। একটা বহুতল আবাসন। সুইমিং পুল, শপিং কমপ্লেক্স। কংক্রিট দখল নিয়েছে সবুজের। উত্তর-পূর্বে একটুখানি জায়গা চেনা চেনা ঠেকল। এই তো সেই গাছটা। যার তলায় অপেক্ষা করেছিলেন চল্লিশ বছর আগে! বাকলে ঠেসান দিয়ে ও কে দাঁড়িয়ে? মল্লিকা থতমত খেলেন। আর একটু হলে টোটোর ভাড়া না দিয়েই চলে যাচ্ছিলেন ভুল করে। চালকের ডাকে চমক ফিরল। মল্লিকা হতাশ। এই বুড়ো লোকটা কিছুতেই ফিরোজ হতে পারে না। কাঁচাপাকা দাড়ি, ভাঙা তোবড়ানো গাল। সারা শরীরে জীবনসংগ্রামের ছাপ স্পষ্ট। এ নিশ্চয়ই ফিরোজের থেকে তার কথা জেনেছে। কত রকম প্রবঞ্চক লোক থাকে সমাজে!

টোটোটাকে দাঁড়াতে বললেই বোধহয় ভাল হত। আবার কতটা হাঁটতে হবে ফেরার জন্য। মল্লিকা ব্যাগ থেকে রুমাল বার করে ঘাম মুছলেন, আর তখনই বুড়ো লোকটা তার দিকে ফিরে ডেকে উঠল, “শরমিন!” গলার স্বরে চিনে ফেললেন মল্লিকা। অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল।

“এ কী চেহারা হয়েছে ফিরোজ?”

“সব নসিব,” ফিরোজ হাসছে।

মল্লিকার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। চল্লিশ বছর ধরে তিনি কি কখনও এই মুহূর্তটার আশা করেছিলেন? লালন করেছিলেন হৃদয়ের গোপন গহনে, অবচেতনে? নয়তো অনায়াসে কী ভাবে ছুড়ে দিলেন অমোঘ প্রশ্নটাকে!

“সে দিন এলে না কেন ফিরোজ?”

“কুমিল্লা থেকে খবর এসেছিল, আব্বাজান অসুস্থ। বাড়ি ফিরে দেখলাম, আমার বিয়ের বন্দোবস্ত পাকা। আসলে আমার বাড়িতেও সবাই জেনে গিয়েছিল। তীব্র আপত্তি ছিল বাড়ির। জানোই তো, আমার নানা মৌলবি ছিলেন। ওঁরই পরিকল্পনায় এ সব হয়েছিল। আমার হাত পা বেঁধে রাখা হয়েছিল শরমিন।”

“তার পর?”

“আর পড়তে দেওয়া হয়নি। চাষের কাজ করতে বাধ্য হয়েছি। চেষ্টা করেছিলাম কলকাতায় পালিয়ে আসতে। ধরা পড়ে গিয়েছিলাম।’’

“এখন কোথায় থাকো?” মল্লিকা বাধো-বাধো সুরে প্রশ্ন করলেন।

“ধরে নাও মুসাফির,” ফিরোজ ম্লান হাসলেন।

“তোমার স্ত্রী?”

“মারা গিয়েছেন তিন বছর আগে। অসুখে ভুগে ভুগে খুব কষ্ট পেয়েছে শেষটায়। আমার একটা মাত্র ছেলে। ওই আমার গর্বের জায়গা। নিজে তো কিছু হতে পারিনি।”

“তুমি আমার নম্বর পেলে কোত্থেকে ফিরোজ?”

“আমি?”

“হ্যাঁ।”

“তুমিই তো আগে মেসেজ করেছ, চন্দনবনের নাম করে।”

এ বার মল্লিকার অবাক হওয়ার পালা। “কক্ষনও না!”

“বিশ্বাস না হয়, দেখ...” মোবাইলের স্ক্রিন সামনে ধরলেন ফিরোজ।

ইংরেজি ফন্টে গোটা গোটা লেখা, ‘ফিরোজ, পদ্মদিঘির ধারে, চন্দনবনে এখনও তুমি আস?’

হতবাক হয়ে গেলেন মল্লিকা, “বিশ্বাস করো ফিরোজ, এ সবের বিন্দুবিসর্গ জানি না আমি।”

মিনিট তিনেকের অসীম নীরবতা। ফিরোজ আর মল্লিকা পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে। পাশাপাশি নিজেদের মোবাইল দুটো ঝরা পাতার উপর রাখলেন ফিরোজ। মল্লিকা সে দিনের মতোই বসে পড়েছেন মাটিতে। বিমূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। কী আশ্চর্য! তাদের দু’জনকে মেসেজগুলো পরপর ছাড়া হয়েছিল একই মোবাইল থেকে। আরও বিস্ময়ের ব্যাপার, সেটা এক দিনে, এক সময়ে।

“অচেনা নম্বর দেখে সে দিন ফোন করেছিলাম কয়েক বার। সুইচড অফ,” বলল ফিরোজ।

মল্লিকাও হাতব্যাগ থেকে ঝটিতি বার করলেন নীল রেশমখণ্ড। মোড়ক খুলতেই চিঠিগুলো বেরিয়ে এল।

কিন্তু গোনাগুনতি বিয়াল্লিশটা চিঠির মধ্যে আজ যেন কয়েকটা নেই বলে মনে হচ্ছে! আঙুল দিয়ে উল্টেপাল্টে দেখলেন। খান সাতেক উধাও। যে চিঠিতে প্রথম শরমিন বলে সম্বোধন করেছিল ফিরোজ, সেটায় গোলাপের পাপড়ি আঠা দিয়ে লাগানো ছিল। তন্নতন্ন করে খুঁজেও পেলেন না মল্লিকা। অথচ গত বছর ট্রাঙ্কের শাড়ি রোদে দেওয়ার সময়ও চিঠিটা যথাস্থানে ছিল। কালো হয়ে যাওয়া শুকনো পাপড়ি দেখেছিলেন মল্লিকা।

ফিরোজ হঠাৎ কাকে যেন ফোন করে বসল। চলভাষের ও পারে কার সঙ্গে কথা বলছে ফিরোজ। চোখমুখের ভাব পাল্টে যাচ্ছে।

“ভুবনদীপ তোমার কে হয় মল্লিকা?”

মল্লিকার গলায় কী যেন আটকে গিয়েছে।

“এই ছেলেটাকে চেনো?”

ফিরোজ তার মোবাইলের

ফোটো গ্যালারি খুলেছে। ফোটো দেখেই চমকে উঠলেন মল্লিকা। এ

তো মনা! ছেলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ভাল নামটা মনে পড়ছে না। বেঙ্গালুরুতে ছেলের সঙ্গে চাকরি করছে আজ দু’বছর হল। গত বার তার কলকাতার বাড়িতেও এসে থেকে গেল।

খুব প্রাণবন্ত ছেলে। তাকে মা বলেই ডাকছিল। তার হাতের রান্না খেল চেটেপুটে।

“মোনাজাতুর আমার ছেলে। সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, কিন্তু বড্ড নরম মনের গো।”

মল্লিকার চোখ বাষ্পাচ্ছন্ন। ধরা গলায় বললেন, “ভুবন, আমার ভুবন।”

“দেখেছ কাণ্ড!” ফিরোজ মাথা চাপড়াচ্ছেন। “বাচ্চাগুলো তলায় তলায় কী সব ফন্দিফিকির করেছে! ওরা তো আমাদের বাপ মা হয়ে গেল। কী পরিণত চিন্তাভাবনা!”

মল্লিকার বুকের মধ্যে কী হচ্ছে তিনিই জানেন। হাজার হাজার পদ্ম পাপড়ি মেলছে। যেন পদ্মদিঘি।

ভুবনদীপ গত এক বছর ধরে বলে যাচ্ছে, “মা, তোমার একাকিত্বের জন্য খুব কষ্ট হয় আমার।” কেন বলেছিল, এখন বুঝলেন মল্লিকা।

অস্ফুটে বললেন তিনি, “ঠিক বলেছিলে ফিরোজ। আগাছার অরণ্যে একটা দুটো খাঁটি চন্দনগাছ থাকলেও সব গাছে চন্দনের ভুরভুরে গন্ধ হয়।”

ফিরোজের শীর্ণ হাতদুটো ধরে পরিতৃপ্তির শ্বাস টানলেন মল্লিকা।

অন্য বিষয়গুলি:

Short Story Literature
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy