ছবি: পিয়ালী বালা
তা ওখানে এখন শীত কেমন?”, নিজের ঘরে ঘুরে চলা পাখাটার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন দেবাশিসবাবু।
“নভেম্বর ঢুকে গেছে। ইট ইজ গেটিং কোল্ডার এভরিডে। অলরেডি জিরোতে নেমে গেছে টরন্টোতে।”
দেবাশিসবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “কলকাতায় এখন নভেম্বরেও গরম। জোর করে এসিটা বন্ধ করে দিচ্ছি। না হলে তোদের মায়ের যা শরীর, এক্ষুনি আবার বাতের ব্যথায় কাতরাবে। বিল্টু, তোকে কাল তোর মায়ের দু’খানা ছবি হোয়াটসঅ্যাপ করেছি, দেখেছিস?”
ফোনের ও পাশে কী রকম যেন একটা শব্দ হল। বিল্টু কি হাসল? একটু নার্ভাস গলায় দেবাশিসবাবু বললেন, “বিল্টু, হ্যালো...”
“হ্যাঁ বাবা, শুনতে পাচ্ছি। বলছি কী, এখানে এখন বেশ রাত। শুতে যাব। বাবলি ঠিক আছে তো?”
“ঠিকই আছে,” দীর্ঘশ্বাস চেপে বেশ প্রত্যয়ের সঙ্গে বললেন কথাটা, “সব বাজারহাট প্রায় নিজেই করে ফেলছে। শুধু বেনারসিটা কেনার সময়ে তোর মাকে নিয়ে গিয়েছিল।”
“সে কী! তোমাকে নিল না?” বিল্টুর গলায় একটা হাল্কা খোঁচা।
“বলল, তুমি তো চিরকাল প্রাইস ট্যাগ দেখে জামা কেনো, তোমাকে নিয়ে গেলে তাঁতের শাড়ি পরে বিয়ে করতে বসব। ভাব!”
দেবাশিসবাবুর কথা শুনে বিল্টু এক চোট হেসে নিল। তার পর বলল, ‘‘ আচ্ছা, এবার ফোন রাখছি।’’ কিন্তু ফোন রাখা হল না দেবাশিসবাবুুর প্রশ্নে, “তোরা কবে যেন আসছিস?”
“আমি নাইন্টিন্থ আসব। বিয়ের চার দিন আগে। এর চেয়ে বেশি ছুটি ম্যানেজ করতে পারছি না। আর জানোই তো, মানালি আসতে পারবে না। একটা বড় প্রোজেক্ট হেড হয়েছে, কেরিয়ারের এই টাইমে চট করে এ রকম সুযোগ তো পাওয়া যায় না। তা ছাড়া জানুয়ারিতেই ওর এক ছোটবেলার বন্ধুর বিয়ে আছে, ওখানে যাবে। তাই...”
“রিমলিটাকে এক বার দেখার ইচ্ছে ছিল রে,” এ বার দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখার কোনও চেষ্টা করলেন না।
“আমারও... খুব ইচ্ছে ছিল ওকে একটা বাঙালি বিয়ে দেখানোর। কানাডায় জন্মানো ইস্তক তো দেখেনি। আমাদেরটাও মিস করেছিল,” বলে হাসল বিল্টু।
দেবািশসবাবুও হাসলেন, অনেক ক্ষণ পরে মন হাল্কা করে। বিল্টু হাসলে ভাল লাগে।
ফোনটা রেখে চুপ করে কিছু ক্ষণ বসে রইলেন দেবাশিসবাবু। সকালের রোদ্দুর ফ্ল্যাটবাড়ির খাঁচা-ঘেরা জানালা দিয়ে উদ্ধত প্রেমিকের মতো ঘরের অন্ধকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আরও কিছু দিন গেলে, এই রোদই শীতকালে ভীরু প্রেমিকের মতো ধীরে ধীরে চুপিসারে অল্প অল্প উষ্ণতায় মেঝেকে তাতিয়ে তুলে ঘরের মধ্যে সোনালি সকালের জন্ম দেবে। কার্তিক মাস শেষ হতে চলল, এখনও যেন গরম কমেনি। সবই কী রকম যেন পাল্টে গেল, সবই। যে বিল্টু বাবলিকে আগলে রাখত, হাতে করে অঙ্ক শেখাত, ক্রিকেটের শট বোঝাত, হাতে করে পাকামিও শিখিয়েছে অনেক, সেই বিল্টু বাবলির বিয়েতে মাত্র চার দিন আগে এসে উপস্থিত হবে! যে বাবলি দাদাকে সঙ্গে না নিয়ে কলেজে অ্যাডমিশন নিতে অবধি যেতে চায়নি, সে একটা গোটা বিয়ের বাজার প্রায় একা হাতে করে ফেলল! মাঝে মাঝে দেবাশিসবাবুর মনে হয়, প্রতিটা মানুষেরই পরিবর্তন দেখা ও সেটা মেনে নেওয়ার একটা সীমা আছে। সেটা আছে বলেই মানুষের আয়ুরও একটা স্বাভাবিক সীমা আছে। এক জীবনে এত পরিবর্তন জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে অসহ্য লাগে দেবাশিসবাবুর। বাড়ির বৌয়ের চাকরি করা, তাও বিদেশে, মা-বাবা বলে না ডেকে কাকু কাকিমা বলে যাওয়া, ছেলের প্রায় চার বছর বাড়িতে না আসা, মেয়ের নিজে থেকে এগিয়ে এসে ভাবী স্বামীর সঙ্গে আলাপ করানো... দেবাশিসবাবুর পক্ষে মেনে নেওয়া রোজই কঠিন ক্রমশ হয়ে পড়ে। এক সময় বাবার কথায় দিদির প্রেমিককে ঠেঙিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়েছিলেন তিনি। মাঝে মাঝে আকাশের দিকে হাত তুলে বলে ওঠেন, “এই পুরনো কলকব্জাওলা লোকটাকে এ বার মুক্তি দাও ভগবান। এয়ার কন্ডিশনের যুগে খসখস চলে না।”
দেখতে দেখতে বিয়ের দিন এসে পড়ল। ঝক্কি-ঝামেলা সামলে নিল বাবলি, তার বেশ কিছু বান্ধবী ও ছেলে-বন্ধু, যাদের মধ্যে কয়েকজনের সঙ্গে বাবলির সম্পর্ক আছে বলে ধরে নিয়েছিলেন তিনি। আজ যখন তাদের অনেককেই হাসিমুখে কোমর বেঁধে বাবলির বিয়েতে নেমে পড়তে দেখলেন, তখন মনে হল, না... তিনি বেশ সেকেলেই হয়ে গিয়েছেন। বিল্টু এসেই নেমে পড়ল কাজে, তার পর আত্মীয়-স্বজনের হইহইতে কোথা দিয়ে যে বিয়ের কাজগুলো হয়ে গেল, দেবাশিসবাবুকে তেমন ভাবতেও হল না। বিয়ের আসরে নিজের দিদি সুছন্দাকে হাসিমুখে আড্ডা দিতে দেখলেন সবার সঙ্গে, সেলফি তুললেন জামাইবাবু, দিদিকে নিয়ে মকটেল কাউন্টারের সামনে। পুরনো দিনের লুচির গন্ধমাখা বিয়েবাড়িগুলো মনে করার চেষ্টা করলেন দেবাশিসবাবু, তেমন ভাবে মনে পড়ল না। বার্ধক্যের স্মৃতিশক্তিতে ধুলো জমতে শুরু করে দিয়েছে। সবই আসলে বদলে গিয়েছে, সবই।
“খুশি থাকিস। কম ঝগড়া করিস ছেলেটার সঙ্গে,” দিদির কথাগুলো কানে এল দেবাশিসবাবুর।
“এমন করে বলছ যেন আমি খুব ঝগড়ুটে,” কপট অভিমান দেখিয়ে বলল বাবলি।
কনের ঘরটা একটু ফাঁকা হয়েছে এই সময়। বর দেখতে অধিকাংশ লোকই এখন নীচে। দেবাশিসবাবুও নীচে যাচ্ছিলেন, শুনতে পেলেন দিদি বলছে, “না রে। ছেলেটা ভাল। তুই যাকে ভালবেসেছিস তাকেই বিয়ে করেছিস। সবাই পারে না রে।”
শেষ দুটো কথা বলার সময় দিদির গলাটা কেমন কেঁপে গেল। তার পর কিছু ক্ষণ কোনও কথা শুনতে পেলেন না দেবাশিসবাবু। ভিতরে ঢোকার সাহস পেলেন না কিছুতেই। নিজেকে কেমন যেন ভীষণ ছোট লাগল। আজ পঁয়ত্রিশ বছর বিবাহিত জীবন কাটানোর পরেও, দুই সন্তানের জননী সুছন্দা ভুলতে পারেনি তার প্রেমিককে?
একটু পরে বাবলি যখন বাইরে এল, তখন যেন প্রথম বার কনের সাজে মেয়েকে ভাল করে দেখলেন দেবাশিসবাবু। সারা ক্ষণ জিন্স, কুর্তি পরা মেয়েকে আজ বেনারসিতে দেখে ভারী ভাল লাগল দেবাশিসবাবুর। তার সদা আত্মবিশ্বাসী মেয়েটি আজ বাবার চোখে যেন চোখ রাখতে পারল না, মুখ নামিয়ে নিল অল্প হেসে।
শুভদৃষ্টিতে পাঁচ বছরের প্রেমিক অঞ্জনের দিকে তাকানোর সময় বাবলি কিছুতেই যেন সোজা তাকাতে পারেনি। নিজেকে কাঠিন্যের চাদরে মুড়ে ফেলা, সব কাজ একা হাতে করা মেয়েটা বিদায়ের সময় নিজের চোখের জল আটকাতে পারেনি, পারেনি সিঁথির সিঁদুরে নিজের মুখের মায়াময় রূপটা বদলে দিতে। যখন মেয়েটা চলে গেল, বারান্দায় দাঁড়িয়ে সবার অলক্ষে চোখদুটো মুছে নিতে গিয়ে দেবাশিসবাবুর হঠাৎ মনে পড়ল, পঁয়ত্রিশ বছর আগে তাঁর পৈতৃক বাড়ির বারান্দায় এ ভাবেই দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর বাবা— তাঁর দিদির বিয়ের দিন।
রিমলির জন্য ফ্রক ছাড়াও, একটা বাসন্তী রঙের শাড়ি কিনলেন দেবাশিসবাবু। বিল্টু এক বার চোখ তুলে বলেছিল, “শাড়ি তো ও পরে না।” দেবাশিসবাবু কিছু বলেননি। বিল্টুর স্মার্টফোনে চার বছরের নাতনির আধো-আধো আমেরিকান উচ্চারণে, “ডাডু আই লাভ ইউ”-এর উত্তরে বাঙালি টানে বলেছেন, “আই অ্যাম সেন্ডিং ইউ আ সারপ্রাইজ দিদিভাই।” নাতনিটি বাংলা বলতে পারে না। দেবাশিসবাবুর স্ত্রী তো ফোনে শুধু “ওমা আমার গুলুগুলু” বলেই ক্ষান্ত দেন।
বিল্টু চলে যাওয়ার পর অখণ্ড নীরবতা দিয়ে ঘেরা ফ্ল্যাটের এক চিলতে বারান্দায় বসে বিকেলের চা খাচ্ছিলেন দেবাশিসবাবু। সূর্য পশ্চিমের দিকে ঢলে গিয়েছে অনেকটা, নানা রঙে তুলি ভিজিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো আকাশে টেনে যাচ্ছে প্রকৃতি। সিগারেটে একটা টান দিয়ে পশ্চিমের দিকে চেয়ে ভাবলেন, পশ্চিম! আর কতটা পশ্চিমে গেলে তবে বিল্টুদের নাগাল পাওয়া যায়! নিজের হাতে রিমলির জন্য প্যাকিং করেছেন দেবাশিসবাবু। প্যাকিং করেছেন বিল্টুর বৌয়ের জন্যও। প্রায় দু’দিন হতে চলল বিল্টু টরন্টোয় পৌঁছেছে, এখনও কি ওরা প্যাকেটটা খোলেনি?
ফোনটা বেজে উঠল হঠাৎই। কাঁপা-কাঁপা হাতে, একটু সময় নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ কল রিসিভ করলেন দেবাশিসবাবু। বিল্টুর ফোন। সামান্য উত্তেজনা-মাখা চাপা গলায় বললেন, “হ্যালো, বল।”
“বাবা...” বিল্টুর গলা যেন সামান্য অন্য রকম।
“বল।”
“তুমি রিমলির সঙ্গে কথা বলো।”
“তোরা কি প্যাকেটটা...” কথাটা শেষ করার আগেই দেবাশিসবাবুর মনে হল ফোনটা রিমলিকে দিয়ে দিয়েছে বিল্টু।
“ডাডু। আই, আমি রিমলি। টুমি খেমন আছে?”
দেবাশিসবাবু কিছু ক্ষণ কোনও উত্তর দিতে পারলেন না। তাঁর মনে হল রিমলি যেন ও পারে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। কোনও রকমে ধরা গলায় বললেন, “আমি ভাল আছি দিদিভাই। তুই কেমন আছিস?”
রিমলি বলল, “সরি?”
দেবাশিসবাবু বললেন, “হাউ আর ইউ? ইয়র ড্যাডি...”
রিমলি সুর করে বলল, “ওয়েট ডাডু। আমি রিমলি, আমি রিমলি...”
বিল্টু ফোনটা ধরে বলল, “লুকিয়ে সহজ পাঠ! বাসন্তী শাড়ির ভাঁজে?”
দেবাশিসবাবু হাসলেন, “বাসন্তী কেন বল তো?”
বিল্টু বলল, “সরস্বতী পুজো আসছে। হাতেখড়িটা দিয়ে দিই তা হলে? কাল থেকে একটু একটু বাংলা শেখানো শুরু করেছি।’’ ফোন রেখে দেবাশিসবাবু সূর্যহীন আকাশটার দিকে চেয়ে রইলেন। সব বদলায় না। সব বদলে গেলেও ওই আকাশটা বদলাবে কি? কাল সকালে আবার পুব দিকে নরম কমলা রঙ নিয়ে পাপড়ির মতো চোখ মেলবে। বদলায় না বিয়ের আসরে চোখ মোছা বাঙালি মেয়ে, বদলায় না প্রথম প্রেমের অকালে ঝরে যাওয়ার দুঃখ, বদলায় না সংস্কৃতির মূল সুর। তার যতটুকু বীজ দেবাশিসবাবুর মতো পুরনো মানুষেরা রেখে যেতে পারবেন আগামীর দেহে, কালকের সূর্যটা যেন ততটাই লাল হবে, ঠিক ততটাই।
দেবাশিসবাবু দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন, এ বার খুব শান্তিতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy