ছবি: রৌদ্র মিত্র
পূর্বানুবৃত্তি: বিলাস অপারেশন থিয়েটারে যাওয়ার পরে অনেকটা সময় কেটে যায়। এক সময় অমলকে ডাকে ডাক্তাররা। ঘরে গিয়ে দেখে শুধু ডাক্তার নেহা বা কুলকার্নি নয়, আছে আরও দু’জন লোক। যাদের সে চেনে না। সেখানে অমল জানতে পারে বিলাস মারা গিয়েছে। পঞ্চাশ হাজার টাকার টোপ দিয়ে ডাক্তাররা তাকে বলে চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ জানাতে পুলিশের কাছে।
এখন আগে এই পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা ঠিকঠাক পকেটে ঢোকানো দরকার। এরা নিজেদের মধ্যে রেষারেষি চক্রান্ত করে মরছে মরুক, অমলের লাভটুকু যেন ফস্কে না যায়।
বিলাসের কথা ভুলে গিয়ে নিজের সোনালি ভবিষ্যতের কথা ভাবতে ভাবতে এগোচ্ছিল অমল। হঠাৎ উল্টো দিক থেকে হুড়মুড় করে দৌড়ে আসে বনানী। শাড়ির আঁচল অর্ধেক খুলে গিয়ে মাটিতে লুটোপুটি। খোঁপা খুলে পিঠময় এলো চুলের বন্যা। বনানী অমলকে দেখতে পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর ওপর।
“ওগো অমলদা গোওওও ... সে মানুষডা বুঝি আর বেচি নেই গোওওও... ওগো সে কোতায় গেল গোওওও... এত চেষ্টা করিও তারে রাকতে পাল্লামনি গোওওও ...।’’
অমল হকচকিয়ে যায়। তার পরেই বুঝতে পারে, ওরা অমলের সঙ্গে কথা হওয়ার জন্যই এত ক্ষণ খবরটা ডিসক্লোজ় করেনি। এ বারে সিগন্যাল পেয়ে নার্সরাই বলেছে হয়তো। বনানীকে ধরে রাখা মুশকিল হয়। সে যে ভাবে মেঝেতে গড়িয়ে পড়েছে, অমল পলকের জন্য দিশাহারা হয়ে পড়ে। তার পরেই বনানীকে টেনে তুলে পাশের চেয়ারে বসায়, “ওঠো... ওঠো বনো... আগে আমায় বলো তুমি কোথা থেকে কী শুনলে। কে তোমাকে বলল...”
বনানী কেঁদে ককিয়ে কী বলতে থাকে তা বোঝা যায় না। অমল দ্রুত মাথা চালায়। সেই সঙ্গে মুখও।
“এটা তো বললেই হবে না। এত টাকা খরচা করলাম এত দিন ধরে, আজ সকাল পর্যন্ত বলল রুগি ভাল হয়ে যাবে। এখন বললেই হল মানুষটা নাই? না না বনো এটা ছেড়ে দেওয়া যায় না, এটা হাসপাতালের গাফিলতি।”
বনানী কাঁদতে কাঁদতেই বলে, “লেভারের তো টিডমেনই হলনি।’’
“আমরা ছাড়ব না বনো, আমরা থানায় যাব, পুলিশে কমপ্লেন করব। ওরা কী ভেবেছে কি? জেলার মানুষ বলে আমরা বোকা?’’
“থানা! পুলিশ! কী বইলছো গো অমলদা? এত বড়ো কলকাতা শহর তায় এত বড়ো বড়ো সব মানুষজন...আমাদের কথা কে শুনবে? তা ছাড়া যে চলে গেল সে তো আর ফিরবেনি গোওওও...” আবার মাটিতে লুটিয়ে পড়তে চায় বনানী। অমল ওকে পড়ে যেতে দেয় না। সে সুযোগের ব্যবহার করতে জানে। এক হাতে শক্ত করে বনানীকে ধরে রেখে আর এক হাতে ওর সামনে মেলে ধরে আগে থেকে লিখে রাখা কমপ্লেনখানা, “নাও, সই করো দেখি... তার পর হাসপাতালকে আমি দেখছি।’’
১১
বাঁ হাতের পাতায় গালের ভর দিয়ে মাথাটা সম্পূর্ণ বাঁ দিকে হেলিয়ে বসেছিল তিয়াষা। সামনের দেওয়াল জোড়া কাচের জানলা কাছে এনে দিয়েছে অনেক দূর আটতলা নীচের ওই পাটকিলে-রঙা পৃথিবী, যার জায়গায় জায়গায় ঘন সবুজের মায়াবী বিস্তার। কালো ফিতে রাস্তাগুলো উদাসী দুপুরে ক্ষণিক জীবন্ত হয়ে উঠছে খেলনা গাড়ির চলমান প্রক্ষেপে। চারপাশ জুড়ে আগ্রাসী এক পালতোলা মেঘের নৌকা কোনও অনির্দিষ্ট গন্তব্যের হাতছানিতে ভেসে চলেছে, ভেসেই চলেছে।
এমন ভরপুর কাজের সময়ে গালে হাত দিয়ে প্রকৃতির শোভায় মগ্ন থাকা মানায় না ওকে, এ কথা জানে তিয়াষা। কিন্তু নিজের মধ্যে থাকলে তবেই তো সব জানাগুলো কার্যকরী হতে পারবে। ও যে নিজেকেই খুঁজে পাচ্ছে না! কাল সন্ধে থেকে কখন কোন অসতর্ক মূহূর্তে যে ওর আমিটা হারিয়ে গেল! কিছুতেই সেই পুরনো চেনা মেয়েটাকে খুঁজে পাচ্ছে না। তিয়াষা নিজেকে বকে ধমকে চোখ রাঙিয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে এখন বসে আছে। এক জোড়া অন্তর্ভেদী দৃষ্টি এ ভাবে শরীর-মন বিবশ করতে পারে! এমন নয় যে কোনও কথা দিয়ে বশ করেছে সে। তার আচারে ব্যবহারে কোথাও এতটুকু আশ্লেষ প্রকাশ পায়নি। নিতান্ত কেজো কথা আর ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য আদানপ্রদান। তিন কাপ আধখাওয়া কফি আর কিছু নিঃশব্দ মুহূর্ত। এইটুকুই মাত্র। এইটুকুতেই তিয়াষার ভিতরটা এমন ওলটপালট হয়ে গেল কী করে! নিজেকে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে করেও কোনও উত্তর পায় না। কেবলই লোকটাকে এত মনে পড়লে ও বাকি কাজগুলো করবে কী করে? ভারী বিরক্ত মুখে উঠে গিয়ে কাচের জানলার পর্দা টেনে দিয়ে নিজের টেবিলে ফেরে তিয়াষা। এ বার হাতের কাজটা শেষ করতেই হবে। সেই লোক নিশ্চয়ই হাজার হাজার পেশেন্ট নিয়ে ব্যস্ত। তার চিন্তার দূর দূর অবধি কোথাও তিয়াষা নেই নিশ্চয়ই। সারা কলেজ লাইফ, ইউনিভার্সিটি কারও কথা না ভেবে এখন এই বয়সে এসে একতরফা কাউকে নিয়ে ভেবে মরতে পারবে না ও। গম্ভীর মুখে ফাইলটা টেনে নিয়ে ল্যাপটপ খুলে বসে।
“কী রে, দিনে দুপুরে অন্ধকার করলি কেন? আকাশটা কি তোর রিপোর্টিংয়ে বিরক্ত করছে? বকে দেব?” হাসতে হাসতে শিমরন এসে বসে চেয়ার টেনে। তিয়াষার চেয়ে চার বছরের সিনিয়র। এই অফিসে তিয়াষার একমাত্র বন্ধু। ও লাইফ ডেলির ফিল্ম পেজ-এর দায়িত্বে। যখন তখন এসে সেলেব্রিটিদের নানা অচেনা সাইডের মজাদার গল্প ফেঁদে বসতে ওস্তাদ। ফাঁকা টাইমে বেশ ভাল টাইমপাস শিমরন। কিন্তু আজ তিয়াষার মুড নেই। সেটা শিমরনও বুঝেছে। ঝুঁকে এসে বলে,
“কী রে, খুব কিছু প্রবলেমে পড়েছিস মনে হচ্ছে?’’
উসখুস করে তিয়াষা। কিছু কি বলবে ওকে? বললে কতটা বলবে? আর বলার মতো আছেই বা কী? এক জোড়া চশমা পরা উজ্জ্বল চোখ ওর সামনে বার বার ভেসে ভেসে আসছে আর সব কিছু ঝাপসা করে দিচ্ছে, কোনও কাজে মন লাগছে না, এটা কি একটা বলার মতো কথা হল? তিয়াষা কি ক্লাস সেভেনের দুই বিনুনি কিশোরী? দূর...! নিজেকে মনে মনে আরও এক বার ধমকে সহজ হওয়ার ভান করে ও।
“না না, কোনও প্রবলেম নেই। তোমার কী খবর বলো? আজ তো সোনি সিংয়ের স্টেজ শো কভার করার কথা ছিল। যাওনি?”
“না, আইভিকে পাঠালাম। আমার অন্য কাজ পড়ে গেল, পালাব ভাবছি। তুই একটু হেল্প কর,”চোখ নাচায় শিমরন।
তিয়াষা বোঝে কী ওর অন্য কাজ। নিশ্চয়ই রামানুজ এসেছে কোচি থেকে। এ বার দু’তিন দিন শিমরন পাখির ডানায় উড়ে যাবে সব কাজ ফেলে। পড়ে থাকবে স্বামী, সংসার, তিন বছরের মেয়ে। এত দিন ওর কাছে গল্প শুনেছে তিয়াষা। শুনে হেসেছে। কী এমন টান থাকতে পারে যে শিমরন পাগল হয়ে যায় এই রামানুজের জন্য! তিয়াষা কখনও বোঝেওনি, বুঝতে চায়ওনি। আজ হঠাৎ মনে হয়, কিসের টানে এমন ছুটে ছুটে যায় মেয়েটা! গিয়ে কী পায়! শিমরনের দিকে তাকিয়ে থেকে আনমনে এক সময় প্রশ্ন করে, “খুব দেখতে ইচ্ছে করে রামানুজকে? সব সময় ওর মুখটাই মনে পড়ে? সব কাজে ভুল হয়ে যায়? কিচ্ছু ভাল লাগে না? একেই কি প্রেম বলে?”
শিমরন অবাক হয়ে দেখছিল তিয়াষাকে । যে মেয়ে পারতপক্ষে কাজের কথা ছাড়া এমনকি দু-একটা লুজ় টকও করে না, কখনও অন্যদের পাল্লায় পড়ে আড্ডায় মাতলেও সুযোগ খুঁজে নিয়ে সরে আসে নিজের টেবিলে, তার মুখে এতগুলো ভিন জাতের কথা অবিশ্বাস্য। বেশ কিছু ক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থেকে শিমরন এসে জড়িয়ে ধরে তিয়াষাকে, ‘‘ওহ মাই সুইটি পাই, অ্যাট লাস্ট ইউ হ্যাভ ফলেন ফর সামবডি। টেল মি...প্লিজ়...প্লিজ় প্লিইইইজ়...হু’জ দ্যাট গাই...এনিওয়ান ফ্রম দিস অফিস? অর অ্যান আউটসাইডার?”
এত ক্ষণে খেয়াল হয় তিয়াষার। ঘোরের মাথায় কী সব বলে ফেলেছ ও। ইসসসস! এখন শিমরন জ্বালাবে বেশ কিছু দিন। তীব্র বেগে মাথা নাড়ায়, “আরে না না, সে রকম কিছু না। তুমি তো জানোই আমার অ্যালার্জি আছে এ সব ইরোটিক রিলেশনে। এমনি জিজ্ঞেস করলাম।’’
এত তীব্র প্রতিবাদের পরে আর কিছু না বলে টেবিলের উল্টো দিকে ফিরে যায় শিমরন। কিন্তু ওর মুখ দেখে বোঝাই যায় মন থেকে সন্দেহ যায়নি। মুখে বলেও ফেলে, “আমাকে বোকা বানিয়ো না। আমার সিক্সথ সেন্স বলছে সামবডি ইজ় নকিং অ্যাট ইয়োর ডোর। আমি তোমার চেয়ে বড়, অভিজ্ঞতাও বেশি। তাই অ্যাডভাইস করব, নিজেকে ফর নাথিং ডিপ্রাইভ কোরো না। গো অ্যাহেড, এনজয়!”
শিমরন চলে গিয়েছে বেশ কিছু ক্ষণ। ওর কথাগুলো ঘরের ফাঁকা দেওয়ালে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে যত প্রতিধ্বনি হচ্ছে ,ততই বেশি করে তিয়াষা নিজেকে কাজের মধ্যে ডুবিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এর ভিতরে বার দুই এসে ঘুরে গেল চিফ এডিটর সাধনদার পিওন। প্রেসে পাঠানোর জন্য কাগজ ছাড়ার আর মাত্র এক ঘণ্টা বাকি। এমন কখনও হয়নি যে তিয়াষাকে তাগাদা দিতে হয়েছে। সে সব সময়ই সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকে। কিন্তু আজ ওকে দু’বারই পিওনকে খালি হাতে ফেরাতে হল। ঝড়ের বেগে আঙুল চালিয়েও রিপোর্টটা মনের মতো করে শেষ করতে পারে না ও। কেবলই মনে হয় আরও কিছু কথা যেন জেনে নেওয়ার ছিল। কেবলই একের পর এক প্রশ্ন এসে সামনে দাঁড়ায়, যেগুলোর উত্তর একমাত্র অভিরূপ ছাড়া কেউ দিতে পারবে না। অভিরূপের সঙ্গে আর এক বার দেখা হওয়া খুব দরকার। খুব খুব খুউব দরকার। তিয়াষার রিপোর্টার সত্তা যতই এই প্রয়োজনকে আঁকড়ে ধরছে, বুকের অনেক ভিতর থেকে অন্য কোনও এক জন যেন মাথা তুলে পাল্টা প্রশ্নে ওকে জেরবার করছে, সত্যিই কি শুধু কাজের জন্যই দেখতে চাও অভিরূপকে? কাল দু’ঘণ্টা কথা বলেও যে কাজ শেষ হল না তা কি আর এক দিন দেখা করলে শেষ হবে? কেন চাইছ বার বার ওই কাজপাগল মানুষটাকে সামনে এনে দাঁড় করাতে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy