ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
যাক, লোকটা পেশাদার। নিশ্চিন্ত হলেন রীতেশ। হাতের ঘড়ি দেখলেন। পৌনে বারোটা। ‘দ্য ডিউক’ চেনেন তিনি। বেশি দূরে নয়। ধীরেসুস্থে কফি শেষ করে, দাম মিটিয়ে হাতের কাগজটি সযত্নে মুড়ে নিয়ে যখন রাস্তায় বেরোলেন রীতেশ, মেয়েটি তখনও রাস্তায় লোক চলাচল দেখে যাচ্ছে, আনমনে। সামনে ধূমায়িত কফির কাপ।
‘দ্য ডিউক’ পাবটির একতলাটা বেশ কোলাহলমুখর হলেও দোতলাটা বেশ চুপচাপ। এক কোনায় দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে থাকা, কালো স্যুট আর গাঢ় টাই পরা লোকটি ছোট্ট একটু সম্মতিসূচক কায়দায় মাথা হেলাল। লোকটি যে এমন জায়গা বেছে বসবে যাতে দোতলায় ওঠার সিঁড়িটা পুরো দেখা যায়, এটা আশ্চর্য নয়। মুখোমুখি চেয়ার টেনে বসলেন রীতেশ।
‘গুড আফটারনুন, আমি রীতেশ শর্মা।’
‘গুড আফটারনুন। টাকাটা এনেছেন?’
বেশি কথার লোক নয় মানুষটি। রীতেশ নীরবে কোটের ভিতরের পকেট থেকে একটা সাদা খাম টেবিলের উপরে রাখলেন। খামটি নিয়ে ধীরেসুস্থে টাকা গুনে নিল লোকটি। এক হাজার পাউন্ড। প্রতিটি একশো পাউন্ড নোটের সিরিয়াল নম্বর একটা আলাদা খাতায় টুকে রেখেছেন রীতেশ। যদিও এ লাইনে কেউ কথার খেলাপ করে না।
‘আপনি কী শুধুই শুনবেন, না লিখে নেবেন?’
লোকটি কথা বলছে এমন ভাবে, আশেপাশের টেবিলে বসা কেউ কিছু শুনতে পাবে না। আবার ফিসফিসও করছে না, যাতে কারও কৌতূহল উদ্রেক হয়!
‘শুনব।’
‘তার মানে রেকর্ড করছেন? করুন, আমার আপত্তি নেই। আমার গলা কেউ চেনে না।’
‘বলুন কী বলবেন,’ রীতেশও কোনও রকম তাড়াহুড়ো করছেন না। অন্য কেউ দেখলে মনে করবে, দুই সহকর্মী একসঙ্গে লাঞ্চ করছেন।
‘আমাদের কাছে যা খবর আছে: ভারতে গত ছ’মাসে তিন দফায় চেন্নাই, বেঙ্গালুরু আর কলকাতা দিয়ে ৮৭টা স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন এআর ১৫ সেমি-অটোম্যাটিক বন্দুক ঢুকেছে। অস্ত্রের আন্তর্জাতিক চোরাবাজারে ওই এক একটি বন্দুকের দাম দশ থেকে পনেরো হাজার ডলার। সুতরাং বন্দুকগুলির পিছনে মোট প্রায় দশ লক্ষ ডলার মতো খরচ করা হয়েছে বলে আমাদের ধারণা। অধিকাংশ বন্দুকের ক্রেতা হচ্ছে কাশ্মীরি জঙ্গি সংগঠনগুলি। কিন্তু কয়েকটি মাওবাদী সংগঠনও আছে ক্রেতার তালিকায়। বন্দুকগুলি পাঠানো হয় আমেরিকার তিন-চারটি শহর থেকে— নিউ অর্লিয়ান্স, জর্জিয়া, ফ্র্যাঙ্কফোর্ট আর জ্যাকসন। কারা বেচেছে, তাদের নাম আমি আপনাকে জেনে বলতে পারব, কিন্তু কারা কিনেছে, তাদের নাম জানার কোনও উপায় নেই এই প্রান্ত থেকে। তা-ও চেষ্টা করতে পারি, তা হলে আরও পারিশ্রমিক লাগবে কিন্তু।’
‘কত?’
‘সেটা নির্ভর করবে আপনি কী কী তথ্য চান তার উপর। এ বার আমরা খাবারের অর্ডার দিই? না হলে সন্দেহ হতে পারে কারও। ওয়েটার ইতিমধ্যেই দু’বার ঘুরে গেছে,’ এক নিশ্বাসে বলে গেল লোকটি।
উচ্চারণ শুনে মনে হয় উত্তর ইংল্যান্ডের লোক। চুলে পাক ধরেছে। মুখে অজস্র বলিরেখা। রোগা, লম্বা চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ছে।
‘আমরা সব রকম তথ্যই চাই, তবে আগে আপনার আজকের তথ্য যাচাই করে দেখব আমরা,’ বলতে বলতে মেনুতে চোখ বুলিয়ে নিলেন রীতেশ।
‘সে তো নিশ্চয়ই।’
কাজের দিন হালকা মধ্যাহ্নভোজই রীতেশের পছন্দ। তিনি অর্ডার দিলেন চিকেন সিজার স্যালাড। তাঁর অতিথিটির পছন্দ রিব আই স্টেক। সঙ্গে দুজনেই হালকা রেড ওয়াইন।
নীরবে খাওয়া শেষ করে, ওয়াইন গ্লাসে তৃপ্ত চুমুক দিল লোকটি, ‘শুনুন, এ সব কাজে কম্পিউটার যত কম ব্যবহার করা যায় ততই ভাল। ই-মেল সহজ, কিন্তু ই-মেল চালাচালির ফলে যে বৈদ্যুতিন পদচিহ্নটি তৈরি হয়, তার সাহায্যে কে ই-মেল পাঠিয়েছে, কাকে পাঠিয়েছে, ই-মেলে কখন কী আলোচনা হয়েছে, এ সব কথা পুলিশের পক্ষে ধরে ফেলা আরও সহজ। আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হলে আজ যে ক্যাফেতে আপনি গিয়েছিলেন, সেখানে যে কোনও সোম, বুধ বা শুক্রবার সকাল সাড়ে আটটা থেকে ন’টার মধ্যে যাবেন। এক কাপ ক্যাপুচিনো কফি খাবেন জানলার কাছাকাছি যে কোনও টেবিলে বসে। হাতে সে দিনের টাইম্স কাগজটা নিয়ে ঢুকবেন। বেরোবার সময় কাগজটা অবশ্যই ফেলে আসবেন টেবিলে, পাঁচের পাতায় ভাঁজ করে। আমি সেই দিনের মধ্যেই আপনাকে যোগাযোগ করে নেব কোনও ভাবে। ঠিক করে নেব কোথায় আর কখন আমাদের
দেখা হবে।’
রীতেশ জানেন, এ সব ক্ষেত্রে বেশি কৌতূহল প্রকাশ করে লাভ নেই। চুপ করে শুনে যেতে হবে এবং লোকটিকে যোগাযোগ করতে হলে ঠিক ওই ভাবেই করতে হবে।
‘বিল কি আমরা ভাগাভাগি করে নেব, নাকি...’ প্রশ্ন অসম্পূর্ণ রেখে দিল লোকটি।
‘না না, এই বিল নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। ওটা আমার দায়িত্ব,’ তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন রীতেশ। ‘কিন্তু আপনার নামটাই তো জানা হল না!’
এই প্রথম হাসি ফুটলো লোকটির মুখে। দুটি ঠোঁটের ফাঁকে সরু এক চিলতে হাসি। ‘নাম দিয়ে কী হবে? আপনার পদবি দেখে তো মনে হচ্ছে আপনি উত্তর ভারতীয় হিন্দু। ঠিক বলছি?’
যত দেখছেন লোকটিকে, ততই বিস্মিত হচ্ছেন রীতেশ। অপরাধ-জগতের মানুষ। কিন্তু কথাবার্তা এক রকমের শ্রদ্ধা কাড়ে।
‘হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, আমি হিন্দু।’
‘তবে তো আপনাকে বলে দিতে হবে না, শ্রীকৃষ্ণের একশো আটটা নাম ছিল! আপনার যেটা দরকার তা হল, আরও তথ্য যদি আপনাদের প্রয়োজন হয়, সে জন্য আমার পারিশ্রমিক লাগবে দেড় হাজার পাউন্ড। আর শুধু তথ্য ছাড়া, অন্য কোনও কাজের প্রয়োজন হলে, তার হিসেব আলাদা। আচ্ছা, আজ আসি। গুড ডে।’
রীতেশকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফরসা, রোগা, লম্বা লোকটি সিঁড়ির বাঁক ঘুরে দ্রুত মিলিয়ে গেল।
পাবের বিল মিটিয়ে বাইরে এলেন রীতেশ। বৃষ্টি থেমে গেছে। ছেড়া মেঘের ফাঁকে ফাঁকে সোনালি রোদের ঝিলিক। সামনেই ওয়াটারলু ব্রিজ। সেতু ধরে হাঁটতে আরম্ভ করলেন রীতেশ। টেমসের জলে জোয়ার এসেছে। থইথই করছে ভরা নদী। ও পারের মনোরম ক্যাফেগুলোর একটিতে গিয়ে বসা যাক। মাথাটা একটু পরিষ্কার হওয়া দরকার।
লোকটির আত্মগোপন করার সমস্ত রকম প্রচেষ্টাতেই অত্যন্ত পারদর্শী অপরাধীর ছাপ! তিনি বিদেশি কূটনীতিক। তাই তাঁকে সন্দেহ করা স্বাভাবিক। কিন্তু এই লোকটির হদিশ তিনি তো ব্রিটেনের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা, এমআই ফাইভ-এ তাঁর পরিচিত এক কর্মকর্তার থেকেই পেয়েছেন।
অর্ণব মুখার্জি বলে যে বাঙালি ব্যবসায়ীটি ভারতে ছুটি কাটিয়ে এ দেশে ফিরে এসেছিল বাঁ হাতে একটি বুলেটের ক্ষত নিয়ে, তার থেকেই তো সমস্ত ঘটনার সূত্রপাত। কেনসিংটনের নিউ ক্রস হাউস বলে একটি অভিজাত প্রাইভেট হাসপাতালে অস্ত্রোপচার হয় ভদ্রলোকের। বাঁ হাতের ফুলে যাওয়া অংশ থেকে একটি বুলেট উদ্ধার করার পর, ডাক্তাররাই পুলিশকে জানান। স্থানীয় পুলিশ যখন প্রাথমিক তদন্তে বুঝতে পারে যে গুলিটা স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন এআর-১৫’এর মতো শক্তিশালী বন্দুকের, সেটা তারা উপরমহলে জানায়। সেখান থেকে খবর যায় এমআই ফাইভ-এ। আর সেখানে রীতেশ শর্মার পরিচিত এক গোয়েন্দা জর্জ উইলকিন্স ঘটনাটা তাঁকে জানায়।
ঘটনার গুরুত্ব অনুভব করেই বোধহয় জর্জ আর একটা উপকারও করে। ব্রিটেনের সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা এবং পুলিশ থেকে সমস্ত রকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি তো ছিলই, তার উপরে অপরাধ-জগতের এই লোকটির সঙ্গেও যোগাযোগ করিয়ে দেয় সে। জর্জ উইলকিন্স-এর মতে, লোকটি বেআইনি অস্ত্র বেচাকেনার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, এবং নিজেও একজন ‘কন্ট্র্যাক্ট কিলার’, অর্থাৎ উপযুক্ত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মানুষ খুন করে। এমআই ফাইভ কোনও কোনও ক্ষেত্রে এমন লোকেদের ব্যবহার করে থাকে। শুধু এমআই ফাইভ কেন, এত দিন এই পেশায় থাকার পর রীতেশ শর্মা জানেন, পৃথিবীর সব দেশের গোয়েন্দা সংস্থাই করে।
টেমসের উলটো পাড়ে পৌঁছে গেছেন রীতেশ। আবার একটা ক্যাফেতে ঢুকলেন। কফিতে তাঁর ক্লান্তি নেই।
অর্ণব মুখার্জির সঙ্গে এক বার কথা বলা দরকার। ভাগ্যের কী খেলা! অগ্নিযুগের বিপ্লবীর ছেলে, খোদ ব্রিটেনে বসে ব্যবসা করে লাল হয়ে যাচ্ছেন। রাসায়নিক পদার্থ আমদানি-রফতানি করেন। ভদ্রলোক এখন আবার তাঁর বাবার জন্য জেমস পেডি বলে মেদিনীপুরের এক ইংরেজ জেলাশাসকের জন্মস্থানের খোঁজ করে যাচ্ছেন।
মোবাইলে নম্বর টিপলেন রীতেশ। দু-তিন বার রিং হওয়ার পর অন্য প্রান্ত থেকে ভেসে এল, ‘অর্ণব হিয়ার।’
‘মিস্টার মুখার্জি, গুড ইভনিং। আমি রীতেশ শর্মা, ইন্ডিয়ান হাই কমিশন থেকে। মনে আছে?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ মিস্টার শর্মা। বলুন, কেমন আছেন?’
‘ভাল। আপনি? আপনার জেমস পেডির হদিশ পেলেন?’
‘না এখনও তেমন কিছু পাইনি। তবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ব্যবসার কাজ তো বোঝেনই! সময় বার করতে পারি না।’
‘আচ্ছা মিস্টার মুখার্জি, আপনাকে আর একটু বিরক্ত করি। সেই যে পূর্বা এক্সপ্রেসের ঘটনাটা, আপনার তো ধারণা গুলিটা ওখানেই লেগেছিল, আপনি একটি লোককে চোখের সামনে মারা যেতে দেখে নিজের হাতে ব্যথাটা তখন ঠিক খেয়াল করেননি। তাই তো?’
‘ঠিক তাই।’
‘আচ্ছা, চলন্ত ট্রেনে একটি লোক মারা গেল, আপনি ভাল করে মনে করে দেখুন তো আর কোনও কিছু আপনার চোখে পড়েছিল কি না? যে কোনও ডিটেল, আপাতদৃষ্টিতে অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও আমাদের তদন্তে সাহায্য করতে পারে।’
‘তেমন তো কিছু মনে পড়ছে না মিস্টার শর্মা। আপনাকে বলেছি তো! অত ভিড় কামরা। আর ওখানে তো আমার থাকারই কথা ছিল না। ট্রেনটা ঝাঁকুনি দিয়ে চলতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই লোকটি সামনের দিকে হুমড়ি খেয়ে গড়িয়ে পড়ল। তত ক্ষণে বোধহয় মারাই গেছে বেচারা।’
‘ট্রেনটা চলতে শুরু করল মানে? ঘটনাটা তো ঘটে চলন্ত ট্রেনে?’
‘না, মানে ঠিক চলন্ত নয়। ওই সময় সিগনাল না পেয়ে একটু দাঁড়িয়ে ছিল ট্রেনটা। আবার চলতে শুরু করে। এটা আপনাকে বলিনি?’
‘না, এই ডিটেলটা আমার কাছে নতুন। ঠিক আছে, ধন্যবাদ মিস্টার মুখার্জি। প্রয়োজনে আবার যোগাযোগ করব কিন্তু।’
‘নিশ্চয়ই। আমি আপাতত লন্ডনেই আছি।’
ফোন রেখে দিলেন রীতেশ। এক গাদা প্রশ্ন মনে ভিড় করে আসছে। ট্রেনটা তা হলে দাঁড়িয়ে ছিল? মুভিং টার্গেট নয় তা হলে? এটা নতুন তথ্য। চিত্তরঞ্জন স্টেশনে ঢোকার আগে, ঠিক কোথায় সিগনাল না পেয়ে দাঁড়িয়েছিল কলকাতাগামী পূর্বা এক্সপ্রেস, সেটা বার করা অনেক সহজ হয়ে গেল। কফি শেষ করে তাড়াতাড়ি অফিসের দিকে পা বাড়ালেন রীতেশ শর্মা।
চব্বিশ ঘণ্টার মাথায় ‘র’-এর সদর দফতর হয়ে, দিল্লি ও কলকাতা পুলিশের কোনও কোনও মহলে দুটি খবর ছড়িয়ে পড়ল। এক, অন্তত ৮৭টি অত্যন্ত শক্তিশালী স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন এআর-১৫ সেমি-অটোম্যাটিক বন্দুক ঢুকেছে দেশে, চেন্নাই বেঙ্গালুরু আর কলকাতা হয়ে। আর দুই, জুলাই মাসের একটি বিশেষ তারিখে কলকাতাগামী পূর্বা এক্সপ্রেস চিত্তরঞ্জন স্টেশনে ঢোকার আগে একটি লালবাতির নিষেধে কিছু ক্ষণ দাঁড়িয়েছিল।
আরও চব্বিশ ঘণ্টা পর, দুটি তথ্যই এসে পৌঁছল চিত্তরঞ্জন জিআরপি থানার অফিসার-ইন-চার্জ অলকেশ লাহিড়ীর কাছে।
ক্রমশ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy