ছবি: রৌদ্র মিত্র
পূর্বানুবৃত্তি: কলকাতার হাসপাতালে এসে ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে বনানী। কিন্তু তাকে ভুল বুঝিয়ে বিলাসের স্বাস্থ্যপরীক্ষার জন্য সাতের জায়গায় বারো হাজার টাকা নেয় অমল। এ দিকে তিয়াষার বন্ধুর ভাই পিয়াস তাকে জানায়, তিয়াষা তার চেয়ে বয়সে বড় হলেও সে তাকে বিয়ে করতে চায়। আর এই ব্যাপারটা সে তার মাকে জানিয়েছে!
অন্য দিন দু’এক কথায় থেমে যায়। আজ তার কোনও লক্ষণই নেই। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ে তিয়াষা। বাইরেও গেল না। সাক্ষাৎকারগুলোও নিল না। বাড়ি বসে থেকে রিপোর্টটা লিখতেও পারল না। এ রকম ফাঁকা সময় কাটানোর সুযোগ নেই ওর জীবনে। তার চেয়ে বেরিয়ে পড়াই ভাল। ইন্টারভিউগুলো এগিয়ে থাকবে।
ইন্টারভিউ শব্দটা মনে হতেই মাথার ভিতরের পর্দা এক পলক ছুঁয়ে যায় মোটা কালো ফ্রেমের চশমা পরা একজোড়া গভীর গম্ভীর উজ্জ্বল চোখ। অসম্পূর্ণ কাজটা আজই নাহয় করে ফেলা যাক। কিছু অপ্রিয় কাজ মন থেকে করতে ইচ্ছে না করলেও কাজের খাতিরে করতেই হয়। এখানে নিজের ভাল বা মন্দ লাগার কোনও দাম নেই। তিয়াষা উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের কোণের কাবার্ড থেকে টেনে বার করে ঘন নীল পালাজো, পেস্তা কালার টপ আর একটা নীল সবুজ প্রিন্টেড স্কার্ফ।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
“আরে আরে... তুমি কি বাইরে বেরোনোর তাল করছ নাকি?’’ বিছানা থেকেই চেঁচিয়ে বলে পিয়াস। তিয়াষা ঢুকেই যাচ্ছিল পাশের ছোট্ট ঘরটায়। ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, “হ্যাঁ, চট করে একটু ঘুরে আসছি। তুই থাক, আমি যাব আর আসব।’’
এক লাফে পিয়াস এসে সামনে দাঁড়ায়। “না ... যাবে না তুমি। এখন চার দিনের আগে বাড়ি থেকে বার হওয়া চলবে না তোমার। আমি বেরোতেই দেব না তোমাকে।’’
“আহ! পাগলামি করিস না। বললাম তো আমি ভাল আছি এখন। আর বেশি ক্ষণ লাগবে না...”, তিয়াষা ছোট ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। বাইরে থেকে বলে যায় পিয়াস। বলে যায়, বলেই যায়, ‘‘আবার সে দিনের মতো হলে কে তোমায় সামলাবে? মণিমাসি তো আমাকেই দোষ দেবে। এ রকম করলে আর তোমায় থাকতে হবে না কলকাতা। চলো কালই তোমাকে রেখে আসব বালুরঘাট।’’
বালুরঘাটে পাশাপাশি বাড়িতে থেকে এক প্রাইমারি স্কুলে পড়ে বড় হয়ে উঠেছে তিয়াষা রিচা আর পিয়াস। তিয়াষার মায়ের প্রাণের বন্ধু পিয়াস আর রিচার মা। দুই বাবার মধ্যে অতটা বন্ধুত্ব না থাকলেও স্বাভাবিক সুসম্পর্কটাও দিন দিন গাঢ় হয়েছে গিন্নিদের এবং ছেলেমেয়েদের ভাব-ভালবাসার সুবাদে। তিয়াষার নাটক-পাগল স্কুলশিক্ষক বাবা এবং রিচা পিয়াসের দাপুটে পুলিশ অফিসার বাবার ব্যক্তিত্বের বিভেদ এই সম্পর্কে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। ওদের ছোটবেলাটা বড় হয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল একটু একটু করে। হিস্ট্রি অনার্স পাশ করতে না করতে বাবার ঠিক করে দেওয়া এনআরআই পাত্রকে বিয়ে করে রিচা চলে গেল দুবাই।
আর অনার্সের রেজ়াল্ট ভীষণ ভাল করে বাবা মায়ের সঙ্গে জেদ করে তিয়াষা এসে ভর্তি হল কলকাতায় জার্নালিজ়ম কোর্সে। ওদের ইচ্ছে ছিল না এই জনকোলাহল পরিপূর্ণ জায়গায় সম্পূর্ণ একা অবস্থায় মেয়েকে ছেড়ে দেওয়ার। বাবার চেয়েও মায়ের আপত্তি ছিল অনেক বেশি তীব্র। বিশেষত, সেই সঙ্গে চোখের জল। অদ্ভুত ভাবে সেই সময়টা তিয়াষাকে সাপোর্ট দিয়েছিল ওর সত্তর বছরের ঠাকুমা। বাবা-মাকে বুঝিয়ে ঠামিই রাজি করিয়েছিল। তিয়াষার কলকাতায় আসার মূলে ঠামি ছিল একমাত্র সহায়। হয়তো ওইটুকুর জন্যই আটকে ছিল তার প্রাণ। আদরের নাতনির কোর্সটা শেষ হওয়া পর্যন্ত আর থাকল না ঠামি। ফাইনাল এগজ়ামের এক মাস আগেই চলে গেল। ওই চলে যাওয়াটা যেন চলে যাওয়া নয়। বারে বারে এক-একটা সাফল্যের মধ্যে দিয়ে নতুন করে ফিরে-ফিরে আসা। অন্তত তিয়াষার তাই মনে হয়। তাই অনেকগুলো দিন বালুরঘাটে কাটিয়ে এসেও জার্নালিজ়মে রেকর্ড মার্কস নিয়ে পাশ করতে আটকায়নি ওর। বরং বুকের ভিতরে কোথাও একটা প্রতিজ্ঞা তৈরি হয়েছিল যে ঠামির ভরসার উপযুক্ত হতেই হবে। তাই ‘দ্য লাইফ ডেলি’র মতো লিডিং নিউজ়পেপারে কোনও রকম অভিজ্ঞতা ছাড়াও এমন সাক্ষাৎকার দিয়েছিল যে সাতাশ জন ক্যান্ডিডেটের মধ্যে ওকেই বেছে নেওয়া হয়েছে। বলতে গেলে নিজের রাজপথ তিয়াষা নিজেই একটু একটু করে বানিয়ে চলেছে। প্রত্যেকটা দিন সেই প্রস্তুতিপর্ব চলে এখনও, চাকরি জয়েন করার চার বছর পরেও।
সেলিমপুরের এই ফ্ল্যাটটা রিচাদের। এটা ফাঁকাই পড়ে ছিল। দুই মা আর দুই বাবা মিলে যুক্তি করে তিয়াষার ভর্তির প্রথম পর্বে ওকে এখানে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। থ্রি-বেডরুম ফ্ল্যাট। অঢেল জায়গা। এত ওর লাগে না। প্রথম দিকে ওঁরা সবাই মিলে বারকয়েক এসে থেকেও গিয়েছেন এখানে। পিয়াস তখন কত ছোট। সবে হায়ার সেকেন্ডারি শেষ করে কলেজে ভর্তি হয়েছে। তিয়াষা মনে মনে তৈরি ছিল, পিয়াস যদি কলকাতার কলেজে পড়তে চায় তবে ওকে ফ্ল্যাট ছেড়ে দিয়ে নিজে একটা পিজি দেখে উঠে যাবে। কিন্তু পিয়াস সে দিক দিয়ে গেলই না। বালুরঘাট কলেজ থেকেই পলিটিক্যাল সায়েন্স নিয়ে পাশ করল ও। তার পর কোনও রকম কোচিং না নিয়ে একা একা পড়াশোনা করে এক চান্সে বিসিএস পাস করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিল। সবাই আরও বেশি অবাক হয়ে দেখল, পিয়াস সাউথ বেঙ্গল পোস্টিংয়ের অপশন দিয়েছে। তিয়াষাও অবাক হয়েছিল, কিন্তু তার চেয়ে বেশি কিছু ওর মনে হয়নি। মনে হওয়া সম্ভবও নয়।
যে রাতে এই ফ্ল্যাটে এসে হাসতে হাসতে পিয়াস জানাল বারাসাত ব্লক ওয়ানে ট্রেনি বিডিও হিসেবে কালই জয়েন করতে হবে, সে দিনই আবার তিয়াষার মনে হয়েছিল, এ বার তা হলে ফ্ল্যাটটা ওকে ছেড়ে দিতে হয়। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে বালুরঘাট থেকে পিয়াসের মা ফোনে বলেছিলেন, ‘‘একটা ঘরে পিয়াসকে থাকতে দিলেই চলবে, আর যদি তিয়াষার অসুবিধে হয় পিয়াস নাহয় পিজি বা মেস খুঁজে নেবে। তিয়াষার বাইরে যাওয়ার দরকার নেই।’’ মনে মনে স্বস্তি পেয়েছিল তিয়াষা। এত দিন এক জায়গায় থেকে ওকে যে হুট করে বাসা বদল করতে হচ্ছে না, এটা ওর কাজের পক্ষে খুবই সুবিধাজনক। নতুন জায়গায় মনোযোগ আনতেই অনেক সময় নষ্ট হত। ফোনটা পিয়াসকে ফেরত দেওয়ার সময় বড় বড় দুই চোখে হাসি মাখিয়ে ও বলেছিল, “প্রবলেম সলভ তো ?’’
“তোদের বাড়ি তুই থাকবি, প্রবলেম আবার কী?” বলেছিল তিয়াষা, “তা ছাড়া ভাইবোনেরা কি থাকে না নাকি এক বাড়িতে?’’
“হ্যাঁ...ভাইবোনেরা থাকে... আরও অনেকেই থাকে,” হেসে হেসে বলেছিল পিয়াস।
সে দিন ওর কথায় গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু এখন বোঝা যায় কী ইঙ্গিত করেছিল ও। আজ তো মনে হচ্ছে, সেই সময়েই বোধহয় আন্টিকে কিছু ভুলভাল কথা বলে থাকবে। নইলে আন্টি বা কেন হুট করে ফোনে ওকে বললেন বাইরে না যেতে! তিয়াষার সন্দেহ হয়, সাউথ বেঙ্গল অপশন দেওয়ার পিছনেও এই একটাই কারণ। এখন তো আর নিজের মনকে রেখে ঢেকে আটকে রাখেনি পিয়াস। বরং রোজ দশ বার করে একই কথা বলে বলে ওর মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। নাহ! এ বার বোধ হয় সত্যিই তিয়াষার একটা পিজি দেখে নেওয়া উচিত।
কিন্তু এখন এ সব ভাবার সময় নেই। তিয়াষা দুর্বল হাতে তাড়াতাড়ি পোশাক বদল করতে শুরু করে। সেই সঙ্গে ঠিক করেই ফেলে, পিয়াসকে ভাল করে বুঝিয়ে বলতে হবে এ সব পাগলামি বন্ধ করার জন্য। বলতে হবে যে ও রিচার ভাই, মানে তিয়াষারও ভাই। ভালবাসা কোন চকলেট বক্স নয় যে পিয়াস আবদার করল আর তিয়াষা তার হাতে তুলে দিল। ও এত বড় এক জন অফিসার হতে পেরেছে, এত কঠিন পরীক্ষা পাশ করতে পেরেছে আর এই সহজ ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না?
সত্যিই শরীরটা এখনও পুরোটা ফর্মে আসেনি। মনে মনে ফিল করে তিয়াষা। লিপস্টিকটা এক বার ঠোঁটে বুলিয়ে বাইরে আসতে যাবে, এমন সময় অস্থির হাতের করাঘাতে দাঁড়িয়ে পড়ে ও।
“কী হল কী! এত ক্ষণ কী করছ? দরজা খোলো।”
দড়াম করে দরজা খুলে দেয় তিয়াষা। চোখে মুখে সুস্পষ্ট বিরক্তির ছাপ।
“কী হয়েছে? দরজা ধাক্কাচ্ছিস কেন? ম্যানার্স জানিস না?’’
মুখটা লাল হয়ে যায় পিয়াসের। কিন্তু অপমানটা গায়ে মাখে না। তিয়াষাকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে আবার চেঁচায়, ‘‘এত সেজেগুজে এই সক্কালবেলা কোথায় যাচ্ছ তুমি? অসুস্থ শরীরে? আর তোমার জন্য আমি ছুটি নিয়ে বসে রইলাম!”
“শোন পিয়াস... তোকে তো ছুটি নিয়ে বসে থাকতে বলিনি আমি। তাই না? আমার কাজের উপর তো তুই হস্তক্ষেপ করতে পারিস না... ইট’স মাই পার্সোনাল... কখন কোথায় যাব না যাব... সে ব্যাপারে নাক গলানোর রাইট কাউকে দিইনি আমি,” থেমে থেমে কেটে কেটে কথাগুলো বলে যায় তিয়াষা। ওর চোখের উপরে একটু একটু করে পিয়াসের মুখটা ছোট হয়ে যেতে দেখেও তাকায় না তিয়াষা।
“কী বললে?’’ কোনও রকমে বলতে পারে পিয়াস।
“যা বলেছি ঠিকই বলেছি। ইউ বেটার নো...”
ব্যাগটা কাঁধে ফেলে ফাইলটা হাতে নিয়ে দড়াম করে দরজাটা টেনে চলে যায় তিয়াষা।
“স্যর...”
দু’মিনিট চুপচাপ। ফাইলে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা মানুষটির কানে ডাক গেল কি না বোঝা যায় না।
একটুখানি ইতস্তত করে আবার ডাকে অঞ্জলি, “স্যর, সেই মহিলা এসেছেন, লাইফ ডেলি থেকে... ডাকব?’’
খবরের কাগজের নাম কানে যাওয়ায় ফাইল থেকে মাথা তুলে জিজ্ঞেস করে অভিরূপ, “আসার কথা ছিল?’’
“না স্যর। উনি তো সেই দিন ও ভাবে মাঝপথে... তার পরে তো রিলিজ় হয়ে গেলেন...’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy