Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব ৭

পরিক্রমণ

ভাল হইয়ে যাবে তুমি, কুনো চিন্তা কইরবার দরকারনি। বিলাসকে সাধ্য মতো সান্ত্বনা দিয়ে উঠে বাইরের দিকে পা বাড়িয়েছিল বনানী। পিছন থেকে ডাকে বিলাস। 

ছবি: রৌদ্র মিত্র

ছবি: রৌদ্র মিত্র

রাজশ্রী বসু অধিকারী
শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

পূর্বানুবৃত্তি: বনানীর সঙ্গে তার স্বামী বিলাসের বয়সের ফারাক অনেকটাই। শারীরিক সুখ দিতে না পারলেও স্ত্রীর খাওয়া-পরা, শখ-আহ্লাদের ব্যাপারে বেশ হাতখোলা বিলাস। গরিব ঘর থেকে এসে এতটা পাওয়ার জন্য স্বামীর কাছে কৃতজ্ঞ বনানী। বিলাসের প্রতি তার প্রবল মায়া। আর এই মায়ার তাড়নায় সে সুচিকিৎসার জন্য কলকাতায় নিয়ে এসেছে বিলাসকে।

সুস্থ মানুষ হঠাৎ বিছানায় পড়ে বেহাল অবস্থা। এখন এই ডাক্তার কী বলে দেখা যাক। বনানী মনে মনে প্রস্তুত হয় ডাক্তারের কথা শোনার জন্য। বিলাসের শুকনো মুখ দেখে বুকের ভিতরটা কেমন মায়া মায়া হতে থাকে ওর। আহা! যতই হোক এই মানুষটার জন্যই তো ভালমন্দ খেয়ে-পরে বেঁচে আছে সে। বিলাসের গায়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়।

“ছোট ছাওয়াল না কি তুমি? কানতেছ কেন? যাই দেখি ডাক্তার কী বলে। ভাল হইয়ে যাবে তুমি, কুনো চিন্তা কইরবার দরকারনি। বিলাসকে সাধ্য মতো সান্ত্বনা দিয়ে উঠে বাইরের দিকে পা বাড়িয়েছিল বনানী। পিছন থেকে ডাকে বিলাস।

“বনো...’’

“কী বইলচো?’’

“বইলচিলাম যে টাকার ব্যাগটা সামলে-সুমলে সব্বদা নিজের কাচে রেকো। চাদ্দিকে শ্যাল কুকুর গন্দো শুকতেছে। আমি ছাড়া তোমাকে কেই বা দেকেশুনে রাকে... কী যে ভগমানের ইচ্চা কে

এ জানে!’’

“আচ্চা আচ্চা হইয়েচে... সে আমি সাবোদানেই থাকব’খন। আকুন চুপ যাও দিকি। অত কিচু চিন্তা কত্তে হবে নাকো। যাই দেকি ডাক্তার কী বলে,’’ বনানী পায়ে পায়ে নার্সের দেখানো কেবিনের

দিকে এগোয়।

কেবিনে তখন নাকে চশমা দিয়ে ফাইলে চোখ বোলাচ্ছিল ডাক্তার নম্রতা বেরা। বনানীর মনটা প্রথমেই একটু দমে যায়। মেয়ে ডাক্তার! সে কি পারবে ঠিক মতো চিকিৎসা করতে! মনের ভাব চেপে সামনে রাখা চেয়ারটা টেনে বসে অপেক্ষা করে সে।

“হু...আপনি মিসেস পাল ফ্রম মালদা?’’

মানেটা বোঝা গেছে। মাথা নাড়ে বনানী

‘হ্যাঁ’ বলে।

“শুনুন, আমি প্রাইমারি লুকে যা বুঝলাম, মিস্টার পালকে ইমিডিয়েট কতগুলো টেস্ট করাতে হবে। তার পর আমরা ট্রিটমেন্ট শুরু করব।’’

“কী! কী টেস? ডাক্তারবাবু? “

“সেগুলো আমরা লিখে দিয়েছি। আগে ওর একটা হোল বডি চেকআপ করাব। হার্ট, লাংস কিডনি অ্যান্ড স্টমাক। সেই সঙ্গে কিছু স্পেশ্যাল ব্লাড রিপোর্টস। তার পর বোঝা যাবে কোন পথে ট্রিটমেন্ট হবে।’’

“কিন্তু ডাক্তারবাবু, ওনার তো নাকি লেভার খারাপ। মালদায় তো তাই বইললো।’’

লিপস্টিক মাখানো ঠোঁট দুটো খুব কায়দা করে বেঁকিয়ে হাসে ডাক্তার বেরা, “দেখুন, আমাদের একটা নিজস্ব ট্রিটমেন্ট স্টাইল আছে, আমরা সেটাই ফলো করি। ইউ বেটার ডিসকাস উইথ ফ্যামিলি মেম্বারস।’’

কথা শেষ করে চেয়ার ঠেলে উঠে পড়ে বেরা। বনানী শেষের কথাগুলো বুঝতেই পারে না। এটুকু ও বোঝে যে ডাক্তারের কথা মতো কাজ না করলে ডাক্তার রোগী দেখবেই না। এই রকম সময়টাতেই অমলদাটা কোথায় গিয়ে বসে থাকল! মনে মনে রাগ হতে থাকে বনানীর। এই সব কথাবার্তা বলার জন্যই তো ওকে আনা হয়েছে। প্রথমটাতেই অমল নেই। সাতপাঁচ ভেবে বাইরে বেরিয়ে আসতেই

নার্স মেয়েটা এসে আবার হাতে ক’খানা কাগজ ধরিয়ে দেয়।

“এই যে এখানে টোটাল টেস্টের হিসাব দেওয়া আছে। আপনি পেমেন্ট করে আসুন, আমরা প্রসিডিয়োর স্টার্ট করব।’’

“কত লাইগবে?’’

“বেশি না সাত হাজার টাকা, ব্লাড টেস্টের টাকা এখানে ধরা নেই। ওটা আলাদা দিতে হবে।’’

দিতেই যখন হবে তখন দিয়ে দেওয়াই ভাল। বনানী ব্যাগ খুলতেই যাচ্ছিল। মেয়েটা লাফিয়ে

সরে যায়।

“না...না... আমরা নেব না। আপনি নীচে ক্যাশ কাউন্টারে জমা দিন।’’

এনারা নাকি টাকা হাতে নেন না। সব ক্যাশ কাউন্টারে দিতে হবে। এক সকালের মধ্যে চব্বিশ আর সাতে একত্রিশ হাজার খসে গেল। এখনও চিকিৎসা শুরুই হল না। কী আছে কপালে কে জানে। ভাবতে ভাবতে মুখ শুকনো করে লিফটের দিকেই এগিয়ে যায় বনানী। লিফটের সামনেই মুখোমুখি দেখা হয়ে যায় অমলের সঙ্গে। সে এ দিকেই আসছে।

“তুমি কোতা গেইছিলে অমলদা? ডাক্তারনি কী কী বইললে আমি তো সব বুজতে পাল্লাম না।’’

“সে আমি সব খবর নিয়ে নিয়েছি। এখন আগে তো টাকাটা জমা দিবি চল।’’

“হ্যাঁ, চলো দিতে তো হবেই। বইলাম লেভার খারাপ, সে তো শুইনলনি। আগের রেপোটও কিছুই দেকলনি।’’

“তুই কি ডাক্তার যে তোর কথা শুনে কাজ হবে? ওরা সব নিজে হাতে দেখেশুনে নেবে।’’

কথা বলতে বলতে নীচে নামে ওরা। ক্যাশ কাউন্টারের থেকে একটু দূরে একটা চেয়ারে বনানীকে বসিয়ে ব্যস্তসমস্ত ভাবে বলে অমল, ‘‘দে এখন বারো হাজার টাকা দে দিকি, আগে জমা করি।”

“সে কি ? ওপরে যে বইললো সাত হাজার?’’

“উফফ... এটা আবার কে বলেছে তোকে?’’

“কেন? ওই নাস...”

অমল হাসে, “অ অ অ... ওই নার্সরা আর কি জানবে, আমি অফিস থেকে খবর নিয়ে তবেই তো ছুটতে ছুটতে যাচ্ছিলাম। সর্বমোট বারো হাজার লাগবে এখন। ব্লাড টেস্ট ছাড়াই এই। পরে আরও অনেক লাগতে পারে। তবে দেখি আমি কথা বলে কিছু কমাতে পারি কি না। টাকা তো আর খোলামকুচি নয়। তা ছাড়া কেউ যেন ভাবে না যে জেলা থেকে এসেছি বলে আমরা বুঝি না কিছু।’’

আরও অনেক কিছু বলে যায় অমল, যেগুলো প্রায় কিছুই বনানীর কানে ঢোকে না। সে শাড়ির আড়াল দিয়ে ব্যাগ থেকে টাকা গুনে গুনে বার করতে ব্যস্ত। সেই শাড়ির আঁচলের ভিতরে বাইরে ভেসে বেড়ানো মাসতুতো দাদার লোলুপ দৃষ্টি চোখে পড়ে না বনানীর।

“তিয়াষা মানে কি গো?” কলমের ডগাটা কামড়ে ধরে জিজ্ঞেস করে পিয়াস।

“তিয়াষা? ও ওই তো... তৃষ্ণা। না... না তিয়াষা মানে বোধ হয় ইচ্ছে। দূর... কে জানে ঠিক বললাম নাকি ভুল। ওই হবে একটা কিছু।’’

“মানে? তোমার নামের মানে তুমি জানো না?” চোখ কুঁচকে তাকায় পিয়াস।

“না জানি না। কী করবি ? গর্দান নিয়ে নিবি না কি আমার? নামের মানে থাকতেই হবে বা জানতেই হবে এমন কোনও কথা আছে না কি রে? খালি কাজের সময় বিরক্ত...’’ ঘাড় গুঁজে ল্যাপটপের কি-বোর্ডে আঙ্গুল চালাতে চালাতে বলে তিয়াষা।

পিয়াস কোণের সোফা কাম বেডে আধশোওয়া হয়ে বলে, “আমি তোমায় ডিস্টার্ব করলাম? এত ক্ষণ তো ঘুমোচ্ছিলে। আমি না এলে তো এখনও ঘুমিয়েই থাকতে। কে তোমাকে ব্ল্যাক কফি করে এনে দিল বল? কে তোমার যত্ন-আত্তি করে ভাল করে? আর তুমি হয়েছ কী, একটু পাত্তাও দাও না। অথচ কফিটা কিন্তু খেয়ে নিলে ঠিক।”

“উফফফ... কিছুতেই রিপোর্টটা শেষ করতে দিবি না, না? এত বকবক করিস, মাথা ধরে যায়।’’ ল্যাপটপ বন্ধ করে হাঁটু মুড়ে বসে তিয়াষা, ‘‘নে বল, আসল কথাটা বলে ফ্যাল তাড়াতাড়ি... দশ মিনিট দিচ্ছি। তার পর নো টক...’’

পিয়াস উঠে আসে কোণের সোফা থেকে। পা ভাঁজ করে বসে পড়ে তিয়াষার সামনে। “আমাকে বিয়ে করবে? চল না বিয়েটা করে নিই টুক করে। তার পর আর একটুও ডিস্টার্ব করব না। তুমি সারা দিন কাজ কোরো, আমি তোমার জন্য কফি করব, চাউ বানাবো। মাইক্রোওয়েভে করব চিকেন তন্দুরি। তোমাকে ফেসিয়াল করে দেব, হেয়ার অয়েল মাসাজ করে দেব। আরও যা যা বলবে...’’

“ব্যস ব্যস... ওই পর্যন্ত ঠিক আছে, আর মাসাজে দরকার নেই...’’

“তুমি আমার কোন কথা সিরিয়াসলি নাও না কেন বল তো?’’ তিয়াষার কোলের কাছে মুখটা বাড়িয়ে ধরে বলে পিয়াস। তিয়াষা মুঠো করে ধরে ওর কোঁকড়া চুলের গুচ্ছ। কপালে হাত বুলোয়। নরম আঙুলে ছুঁয়ে দেয় চোখের পাতা। একটু মায়াভরা হাসে।

“কেন এ রকম পাগলামি করিস বল তো? আমি কত বড় তোর থেকে জানিস?’’

তিয়াষার হাতটা গালের সঙ্গে চেপে ধরে বলে পিয়াস, “জানি তো, চার বছর তিন মাস একুশ দিন আগে জন্মেছ তুমি। এটা কোনও ব্যাপার নয়। আমি তো যে দিন জন্মেছি সে দিন থেকেই জানি আমার বৌ হতে পারবে একমাত্র এই মেয়েটা।”

“এই দিদিটা বল। এ রকম পাগলামি করলে কিন্তু আমি তোর মাকে সব জানিয়ে দেব। তোকে আর রাখব না এখানে...’’

“ধুসসস... মা তো সব জানেই। আমি নিজেই বলেছি।’’

এ বারে আঁতকে ওঠে তিয়াষা, “কী বলেছিস মাকে? কী সর্বনাশ! তাই আন্টি আমার ফোন ধরেনি দু’দিন। তোর জন্য তো আমার বন্ধুবিচ্ছেদও হয়ে যাবে। রিচা যদি জানতে পারে... ইসসস ছি ছি ছি...”

এ বার রীতিমতো বাবু হয়ে ঘাড় সোজা করে বসে পিয়াস, “মাকে বললাম, আমি তিয়াষাকে বিয়ে করতে চাই।”

“দিদি বল,” চোখ পাকায় তিয়াষা।

“দিদি! মাই ফুট। নিজের প্রেমিকাকে দিদি বলব, গান্ডু না কি আমি?’’

“আবার মুখখারাপ করছিস?’’

“হ্যাঁ করছি, একশো বার করব। তুমি যে আমার জীবন খারাপ করে দিচ্ছ সেটা কিছু নয়?’’

না! আর সম্ভব নয় ঘরে বসে থাকা। পাগলটা আজ রীতিমতো খেপে আছে।

ক্রমশ

অন্য বিষয়গুলি:

Novel Rajashree Basu Adhikari
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy