Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব ২৮

পরিক্রমণ

একমাত্র এক জন পাগল মানুষই পারে নিজের মনের কষ্ট যন্ত্রণার ভার বুকে পাথরচাপা করে না রেখে নিঃসঙ্কোচে সেই যন্ত্রণাকে মুক্তি দিতে, আকাশের কাছে মাটির কাছে জলের কাছে অথবা অপর এক জন মানুষের কাছে।

ছবি: রৌদ্র মিত্র

ছবি: রৌদ্র মিত্র

রাজশ্রী বসু অধিকারী
শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

পূর্বানুবৃত্তি: গঙ্গার ধারে বসে থাকা উদ্দালকের চিন্তায় ছেদ ফেলে একটি দৃশ্য। সে দেখে, তিয়াষা ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে ক্রমশ নীচে নেমে যাচ্ছে। উদ্দালক অনেক কষ্টে মনে করে তিয়াষার নাম। সে পিছন থেকে ডাকে তাকে। তিয়াষা চিনতে পারে উদ্দালককে। সে হাত বাড়িয়ে দেয় তিয়াষার দিকে। মুখ দেখে উদ্দালক বুঝতে পারে, এই মেয়েটির চামড়ার তলায় ফুটে উঠেছে মনখারাপের চিহ্ন। সে জানে একমাত্র ভালবাসায় আঘাত পেলে, অসময়ে স্বপ্নভঙ্গ হলে এমন মনখারাপ হয়।

এই ঝরনাধারার মতো মেয়ের মুখে এই অসময়ের যন্ত্রণার ছাপ উদ্দালকের গবেষণাব্যাপ্ত মনকে এক তীব্র ব্যথায় ভরে তোলে। কখনও না পাওয়া এক অব্যক্ত দুঃখবোধ উদ্দালকশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় নামের এই মানুষটির বুকের মধ্যে থেকে শঙ্কা পাগলার অস্তিত্ব মুছে দিয়ে এক নিরালম্ব বায়ুভূত নতুন মানুষের জন্ম দেয়। কিন্তু মনকে সঠিক ভাবে প্রকাশ করতে পারে না উদ্দালক। শুধু ব্যাকুল ভাবে নীচের ধাপের সিঁড়িতে বসে উন্মুখ তাকিয়ে থাকে তিয়াষার মুখের দিকে। ক্রমাগত কাঁপতে থাকা ঝুলে আসা ঠোঁটদুটো থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে আসা শব্দগুলো তার কানে আর আসে না। হলে পরে শোনা যেত একটাই প্রশ্নের ভিন্ন ভিন্ন রূপ...কী হয়েছে ... কী করে হয়েছে... কেন হল ... কবে হল।

সেই প্রশ্নের ছিন্ন মুকুল মালা তিয়াষার কানে ধরা দেয়, কিংবা দেয় না। সে শুধু ঢেউয়ে ভেসে যাওয়া কিছু শুকনো ফুলের মালা আর উল্টে পড়ে থাকা খড় মাটির মূর্তির কাঠামোর দিকে তাকিয়ে নিজের মনে বলে চলে কিছু কথা। যা হয়তো কোনও প্রশ্নের উত্তর নয়, শুধুই স্বগতোক্তি।

“সে আর আসে না... সে আমার ফোন ধরে না ... সে আমার মেসেজেরও রিপ্লাই দেয় না ... সে আমাকে ভুলে গিয়েছে... আমার সব আলো নিভিয়ে দিয়েছে ... আমার সব গান বন্ধ করে দিয়েছে... আমাকে একটু একটু করে প্রতিদিন প্রতিদিন সে খুন করছে। কেন? আমি জানি না। সব কিছু কি ভুল ছিল? আমি জানি না। আমার কি দোষ ছিল? আমি জানি না। আমাকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে সে চলে গিয়েছে।’’

“চুপ করো... চুপ করো তুমি...’’ উদ্দালক চেঁচিয়ে উঠে দু’হাতে কান চাপা দেয়। দু’পায়ের ফাঁকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। গোঙানির মতো কিছু আওয়াজ বেরিয়ে আসতে থাকে গলা দিয়ে। লালাতে থুতুতে মাখামাখি হয়ে সেই শব্দেরা ছড়িয়ে পড়ে গঙ্গার সর্বদ্রষ্টা সর্বদুঃখবিনাশিনী অমলিন স্রোতের উপর, ভেসে যায় দূর-দূরান্তরে।

যারা পাগল হয়, তাদের মনের আগল থাকে না। একমাত্র এক জন পাগল মানুষই পারে নিজের মনের কষ্ট যন্ত্রণার ভার বুকে পাথরচাপা করে না রেখে নিঃসঙ্কোচে সেই যন্ত্রণাকে মুক্তি দিতে, আকাশের কাছে মাটির কাছে জলের কাছে অথবা অপর এক জন মানুষের কাছে। সেই মুক্তিবোধকে নিজের মধ্যে প্রত্যক্ষ করে উদ্দালকের এই প্রথম মনে হয়, উদ্দালকশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে নয়, সত্যিই সে এই মুহূর্তে শঙ্কা পাগলার কাছে ঋণী হয়ে গেল।

১৭

“প্লিজ়... প্লিজ় তিয়াষা... ফর গড’স সেক... এমন চুপ করে থাকিস না তুই। কিছু তো বল, সেই থেকে আমি কত কিছু জানতে চাইছি। একটা কথারও রিপ্লাই দিচ্ছিস না। স্পিক আউট তিয়াষা... ইউ হ্যাভ টু...” অস্থির হয়ে তিয়াষার দুই কাঁধ ধরে জোরে জোরে ঝাঁকুনি দেয় শিমরন। আজ প্রায় আট দিন হল তিয়াষা অফিস যাচ্ছে না। এত দিন চাকরিতে এই ইতিহাস প্রথম। এমনকি এডিটরেরও চোখে পড়েছে ব্যাপারটা। মোবাইল সমানে সুইচ অফ করেই রাখছে মেয়েটা। অফিসে এই সমস্ত নিয়ে কানাঘুষো শুরু হয়েছে। শিমরন ছিল না কলকাতায়। ন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল কভার করতে চেন্নাই গিয়েছিল। ফিরে এসে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন কমেন্টের মধ্যে বসেই ও মাইন্ড সেট করে এখানে আসার। তিয়াষার সেলিমপুরের অ্যাড্রেস চেঞ্জ হয়েছে, এখন ও দমদমে আছে, সেটা সারা অফিসে একমাত্র শিমরনই জানে। কে জানে কেন কিছু একটা ভেবে তিয়াষাই প্রেজ়েন্ট অ্যাড্রেসটা জানিয়ে রেখেছিল শিমরনকে। সেটা নিশ্চয়ই এই রকম একটা দিনের কথা ভেবে নয়। শিমরন মনে মনে ভাবে। চট করে যেন এক পলক দেখতেও পায় সেই সে দিনের তিয়াষাকে। খুশি আর আনন্দে টইটম্বুর একটা মুখ, উজ্জ্বল দুটো বড় বড় চোখ, ভিতরের হঠাৎ জ্বলে ওঠা রোশনাইকে চাপা দিয়ে রাখার ব্যর্থ চেষ্টায় অতিগম্ভীর ভাব, সব মিলিয়ে মনে দাগ কাটার মতো একটা অ্যাপিয়ারেন্স। ফাইলে চোখ রেখে যেন হঠাৎ মনে পড়ে গিয়েছে এমন ভাবে বলেছিল, “শিমরন, আমি দমদমে শিফট করে যাচ্ছি। নতুন ঠিকানাটা তোমাকে দিয়ে যাচ্ছি। ইটস ওনলি ফর ইউ। অন্য কাউকে দিও না।’’ একটা কার্ড এগিয়ে দিয়েছিল তিয়াষা।

“ওহ মাই গড... ইটস ইয়োর নিউ ফ্ল্যাট?’’

“আরে না না ... ইটস অব অভিরূপ।’’

চোখ গোল করে তাকিয়েছিল শিমরন, “ইউ মিন... ডক্টর অভিরূপ মুখার্জি? ও মাই গড, আই কান্ট বিলিভ দিস...’’ স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে তিয়াষার টেবিলে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল শিমরন, “বল না, বল না বাবা একটু ডিটেলসে বল। তোকে দেখেই আমার মনে হয়েছিল, অ্যান্ড ইউ ডিনায়েড... হু হু বাবা আ আ... আমি তোর চেয়ে সিনিয়র এটা তো মানবি।”

তিয়াষা চারদিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বলেছিল, “ওকে ওকে... মানছি... এ বার একটু চুপ কর... আমি চাই না এই সব নিয়ে আলোচনা হোক এখনই!’’

“হু বুঝলাম। একবারে পার্টি দিবি তাই তো? বেশ আমি কাউকে কিচ্ছু বলছি না বাবা... কিন্তু আমাকে তো আর একটু বলবি খুলে না কি? কী করে কী হল? কবে হল ?’’

“কী করে হল এটা কি বলা যায়? জাস্ট হয়ে গেল। অভিরূপ আমায় নিয়ে এসেছে ওর দমদমের ফ্ল্যাটে। উই আর লিভিং টুগেদার দেয়ার। ওর কেসটা মিটে গেলেই সেটলড হয়ে যাব।’’

কোনও দিনই তিয়াষা খুব একটা বেশি কথা বলার মেয়ে নয়। কিন্তু সে দিন ও অনেক বেশি বলেছিল। বোঝাই যাচ্ছিল সেই কথার স্রোত ওর মধ্যে ঘুরে মরছিল, তাকে মুক্তি দিতে পেরে ও নিজেকেই রিলিফ দিতে পারছে। শিমরন কথা রেখেছিল। কথাটা নিজের মধ্যেই রেখেছে। অফিসে কাউকেই রাষ্ট্র করে বেড়ায়নি। তাই এখনও পর্যন্ত কেউ জানেও না তিয়াষার অ্যাড্রেস চেঞ্জের কথা। অফিস রেকর্ডেও এসেনশিয়াল চেঞ্জটা করা হয়নি। তিয়াষা নিজেই সবাইকে ইনফর্মেশন উইথ ইনভিটেশনটা দেবে, এই ভেবে চুপ করেছিল শিমরন। কিন্তু আজ খুঁজে খুঁজে এখানে এসে এই অবস্থায় মেয়েটাকে দেখে কী ভাবে রিয়্যাক্ট করবে ভেবেই পাচ্ছে না। অমন সুন্দর মুখটায় কেউ যেন কালিমাখা হাত বুলিয়ে দিয়েছে। চোখের নীচে পুরু কালি। গায়ে ঢলঢল করছে একটা ক’দিনের বাসি কচলানো হাউসকোট। ক’দিন স্নান করেনি, খায়নি কে জানে। কোমর পর্যন্ত চুলগুলো এলোমেলো জট পাকানো অবস্থায় পড়ে আছে পিঠ ছাপিয়ে। খাটের মাথার দিকে তিনখানা বালিশ জড়ো করা, তাতে হেলান দিয়ে আধশোয়া পড়ে আছে ঝড়ে ভাঙা ডিঙি নৌকার মতো। হাল নেই পাল নেই, কোথায় কোন দিকে যাবে তার কোনও পথনির্দেশ নেই। খাটের উপর ছড়িয়ে আছে অজস্র ডায়েরি ফাইল ল্যাপটপ আর ডকুমেন্টস। বোঝা যাচ্ছে, বারবার নিজের কাজগুলোয় ডুবে যেতে চেয়েও ফেল করেছে মেয়েটা। হালছাড়া নাবিকের মতো গতিহীন উদ্দেশ্যহীন শূন্যতায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত ও এখন। শিমরন হুল্লোড়ে মেতে থাকে দিনের বেশি সময়। প্রয়োজনের চেয়েও অনেক অনেক বেশি কথা বলে, অনেক অনেক হাসি মজায় মেতে থাকে। কিন্তু শিমরন স্থূল নয়। শিমরনের মধ্যে রয়েছে সেই বিরল রিসেপটর যা দিয়ে ও তিয়াষার এই মুহূর্তের না বলা কথাগুলো আলতো আঙুলে ছুঁয়ে যায়।

“এ ভাবে বসে থাকলে হবে না। ওঠ... উঠে স্নান করতে যা। তোকে অফিস যেতে হবে। আমি দেখছি কিচেনে, খাওয়ার মতো কিছু আছে কি না!’’

তিয়াষা নিরুত্তর। ওকে দেখে বোঝা যায় না কথাগুলো কানে গেল কি না।

“কী রে? ওঠ,’’ তিয়াষার কাঁধে হাত রেখে ডাকে শিমরন। সেই হাতখানা জড়িয়ে ধরে শিমরনের মুখের দিকে তাকায় তিয়াষা, ‘‘আমি বুঝতেই পারলাম না গো কী হল। পিয়াসটাও আমাকে এত বড় শাস্তি দিয়ে গেল। আর অভি... আমার অভিরূপ... সেও আমাকে ছেড়ে যাচ্ছে ... আমি কী দোষ করেছি শিমরন?’’

পিয়াসের কথা শিমরনের অজানা। কোন এক পিয়াস সংক্রান্ত কিছু একটা ঘটনাতেও তিয়াষা বিপর্যস্ত, এটা অনুমান করতে পারে সে। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তিয়াষা প্রবল ভাবে মাথা নাড়ে। নিজের মনেই বলে চলে, “হয়তো আমি পাপ করেছিলাম পিয়াসের প্রতি। ওকে তো কষ্ট দিয়েছি আমি। ওকে ছেড়ে চলে এসেছি নিষ্ঠুরের মতো। ও তো পাগলের মতোই ভালবাসত আমাকে। ওকে আঘাত দিয়েছি আমি। কাউকে আঘাত দেওয়া পাপ? বল? তাই ও কোথায় হারিয়ে গিয়ে শাস্তি দিল আমাকে। আর সে জন্যই কি ঈশ্বর অভিরূপকেও এ ভাবে আমার থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন?’’

শিমরন জানে না কী ঘটেছে। তবু ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে প্রতিবাদ, “পিয়াসের সঙ্গে তোর যা হয়েছে সেটা আলাদা ব্যাপার। অভিরূপের সঙ্গে ওকে কেন মেলাচ্ছিস তুই?’’

তিয়াষা অবুঝ স্কুলগার্লের মতো মাথা নাড়ে। যেন ওর বলতে পারা সঠিক উত্তরটা কেটে দিয়ে কোনও স্কুলের দিদিমণি অত্যন্ত ভুল করেছেন। অনেক অনেক কথা বলে বোঝাতে চেষ্টা করে ওর বক্তব্যে ভুল নেই কোনও।

“না, শিমরন, তুমি জানো না। এর মধ্যে অনেক কিছু ঘটে গিয়েছে। পিয়াস কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ কোথায় চলে গিয়েছে। অফিসেও কোনও খবর নেই। আমাকে চিরজীবনের মতো অপরাধী করে গিয়েছে। বালুরঘাট থেকে আঙ্কল-আন্টি, আমার মা-বাবা সবাই এসেছিল। ওরা সবাই মিলে আমায় অনেক বাজে কথা বলে গেল। পিয়াসের দিদি রিচা, মাই ক্লোজ় ফ্রেন্ড, সে পর্যন্ত ফোন করে যা তা বলেছে, সব নাকি আমার দোষ। আমাকেই ওরা দায়ী করেছে পিয়াসের জন্য। আমি কাউকে বোঝাতে পারিনি আমার কিচ্ছু করার ছিল না। আমি কি জানতাম বলো যে পাগলটা আমার জন্য এতখানি ভালবাসা জমিয়ে রেখেছিল ? আর... আর...

শিমরনের চোখের উপর দিয়ে একটা একটা করে পর্দা সরে গেল যেন।

অন্য বিষয়গুলি:

Novel Rajashree Basu Adhikari
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy