ছবি: রৌদ্র মিত্র
পূর্বানুবৃত্তি: ডাক্তার অভিরূপ মুখোপাধ্যায়ের হাতে আসে এক রোগিণীর দীর্ঘ চিঠি। চিঠির বক্তব্য মৃত্যু। এক জন অসুস্থ মানুষ এই রকম চিঠি লেখার সুযোগ পায় কী ভাবে! কাজের গাফিলতির জন্য নার্স বকুনি দেয় ডাক্তার। মধ্যরাতে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে ডাক্তার রোজ দেখে এক বেহালাবাদককে।
খাওয়ার টেবিলে মুখ গোঁজ করে বসেছিল বাপ্পা। সামনে কেক, পাউরুটি, দুধের গ্লাস, ডিমসেদ্ধ, আপেল, কলা। সুন্দর করে গোছানো নয়। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। খাবারের প্রাচুর্য দেখে বোঝা যায়, আমদানির কোন অভাব নেই এ বাড়িতে। বাজার উজাড় করে জিনিস আসে। অভাব শুধু পরিবেশনে। ষাট হাজার দামের ডাইনিং টেবিলের উপর সস্তা লাল-নীল প্লাস্টিকের প্লেটে যেমন-তেমন করে খাবারগুলো রাখা। একটু দূরে রাখা টোস্টার। সেটা শেষ কবে ব্যবহার করা হয়েছে বলতে গেলে ক্যালেন্ডার দেখতে হবে! গ্যাসের উপর ফেলে পাউরুটিগুলো অযত্ন নিয়ে সেঁকা। আধপোড়া টোস্টগুলো দেখে মুখ বেঁকিয়ে বসে আছে বাপ্পা। কিছুতেই পোড়া পাউরুটি টিফিনে নিয়ে যাবে না ও। ওর ওই টিফিন দেখে বন্ধুরা তাকে ভয়ঙ্কর খেপায়। কেকের কোম্পানিটাও তার নাপসন্দ। মায়ের কাছে বায়না করেছিল পঞ্চাশ টাকার জন্য, আজকের দিনটা ক্যান্টিনে খাবে। কিন্তু বিপাশা ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়েছে। টিফিনবক্সে রোজকার বরাদ্দ পাউরুটি, ডিমসেদ্ধ, কলা পুরে দিয়ে সেটা ব্যাগে ঢোকানোও হয়ে গিয়েছে। এখন বাপ্পা কিচ্ছু না খেয়ে মুখ গোঁজ করে বসে আছে। টিফিনবক্স ব্যাগ থেকে বার না করলে স্কুলেই যাবে না।
বিপাশা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে খানিকটা রণচণ্ডীর মূর্তিতে। গত রাত্রের চটকানো নাইটি গায়ে, চুল অগোছালো। হাতে দুধ-কর্নফ্লেক্সের বাটি। সেটা ছেলের সামনে ঠকাস করে নামিয়ে দেয়। জ্বলন্ত গলায় বলে, “খাবে তো খাও, না খাবে তো পেটে গামছা বেঁধে থাকো। পারব না আমি নিত্য অত সাধ্যসাধনা করতে।’’
অরুণ বেডরুম থেকে তৈরি হয়েই বেরিয়ে এসেছিল ব্রেকফাস্ট টেবিলে। এত ক্ষণ বাথরুমে থাকার জন্য আজকের উপাখ্যানটা সে জানতে পারেনি। কিন্তু তাই বলে একটুও অবাক হয় না। এগুলো চেনা অধ্যায়। ছেলের পাশে বসে গলায় আদর এনে বলে, “কী হয়েছে বাপ্পা? রাগ করেছিস?’’
বাবাকে পাশে পেয়ে এত ক্ষণে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে ন’বছরের ছেলে, “আমি পোড়া পাউরুটি নিয়ে যাব না...”
অরুণ বাকিটা বুঝে নেয় নিজের মতো করে। বলে, “আচ্ছা আচ্ছা আমি দেখছি...দাঁড়া তোকে সুন্দর করে টোস্ট দিচ্ছি।”
ভিতর দিক থেকে ঘর মুছতে মুছতে আসছিল বছর কুড়ির মনিকা। অরুণ আনমনে ডেকে ফেলে, “এই মনিকা... ওই টোস্টারটা একটু মুছে এখানে দে তো। আর রান্নাঘর থেকে চার পিস রুটি নিয়ে আয়।’’ এক গাল হেসে মনিকা টোস্টার নামায়। মুছে নিয়ে আসে টেবিলের উপর। প্লাগে লাগায় তার। তার পর রান্নাঘরে ঢোকে রুটি নিতে। ছেলের কান্না বন্ধ হয়ে মুখে হাসি ফুটেছে। অরুণ চটপট এক চামচ দুধ-কর্নফ্লেক্স বাপ্পার মুখে ঢুকিয়ে দেয়। “ব্যস এ বার বাকিটা নিজে খেয়ে নে। আমি চট করে টোস্ট করে দিচ্ছি। তার পর বেরোব। তোকে স্কুলে নামিয়েই আমাকে আজ আগে নার্সিংহোম যেতে হবে, বেশ কয়েকটা সার্জারি আছে।’’
“বাপি...”
“কী রে?’’
“বাপি আমি সার্জারি দেখব!”
“দূর বোকা ও ভাবে দেখা যায় নাকি? তার জন্য আগে ডাক্তার হতে হবে,” কলায় কামড় দিয়ে বলে অরুণ।
কিন্তু মুখের কলা আর গিলতে পারে না। তার আগেই একগাদা পাউরুটি উড়ে এসে পড়ে টেবিলের উপর। রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে সেগুলো অরুণের মাথা তাক করে ছুড়েছে বিপাশা। এ বার হাতের প্লেটটাও ছুড়ে ফেলে মেঝের উপর। “এই নাও পাউরুটি... মনিকার কাছে চাওয়া হচ্ছে? মনিকার কাছে? আমি মরে গেছি? নাও...খাও...জন্মের মতো খাও,” দু’হাতে টেনে টেনে টেবিল থেকে কলা, ডিমসেদ্ধ সব ছড়িয়ে ফেলতে থাকে বিপাশা। অরুণের ফর্সা মুখ লাল হয়ে উঠেছে। দেখে নেয় বিপাশার পিছনে দাঁড়িয়ে মনিকা ঠকঠক করে কাঁপছে। বেচারা বুঝতেই পারেনি দাদাবাবুর জন্য পাউরুটি চেয়ে ও কী দোষ করেছে। কেন বৌদি এমন রেগে গেল। বাপ্পা আবার কাঁদতেই যাচ্ছিল। বিপাশার দিকে এক বারও না তাকিয়ে ছেলের হাত ধরে বেরিয়ে যায় অরুণ। স্কুলব্যাগটা নিতে ভোলে না। যেন কিছুই হয়নি এমন ভাবে বলে, “চল আজ মধুর দোকানে কচুরি খাব তোতে আমাতে।’’
গাড়িতে বসে চুপ করে বাপির মুখের দিকে তাকিয়েছিল বাপ্পা। অরুণ শক্ত চোয়ালে ড্রাইভিং করছিল। বেশ খানিক ক্ষণ পর কণ্ঠস্বর নিচু করে বাপ্পা বলে, “বাপি? মা ও রকম করে পাউরুটি ছুড়ল কেন? অত রেগেই বা গেল কেন?”
বিপাশার উপর মেজাজ খারাপ করে কিছু বলতে যাচ্ছিল অরুণ। পর মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে একটু হাসির মতো টেনে আনে ঠোঁটে। ‘‘আরে দূর...ও সব নিয়ে তুই ভাবিস না একদম। মা’র কত কাজ বল তো? মার কি মাথা ঠিক থাকে সব সময়?”
বাপ্পা কী বুঝল জানা যায় না। মধুর দোকান এসে গিয়েছে। বিশাল লোহার কড়াই থেকে ছাঁকা হয়ে উঠছে ফুলকো কচুরি। সাতসকালেও খদ্দের কম নেই। তার মধ্যেই মধু আগে অরুণ আর বাপ্পার দিকে প্লেট এগিয়ে দেয়। “কী ভাগ্য! সক্কাল সক্কাল ডাক্তারবাবুর পদধূলি পইড়ল গরিবের দোকানে।’’
বাপ্পার স্কুলের সময় হয়ে আসছে। সে সময় নষ্ট না করে আলুর দম দিয়ে কচুরি পাকিয়ে খেতে শুরু করে দিয়েছে। অরুণ নিজের প্লেট টেনে নেয়। তার পর তাকায় মধুর দিকে, “কী ব্যাপার মধু, তোমার মেয়ে কেমন আছে এখন? তাকে আর এক বার দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলাম না? অপারেশনের পর তোমরা ফলোআপ ট্রিটমেন্টটা বড় নেগলেক্ট করো। কাল-পরশু এক বার নিয়ে এস।’’
মধু ক্যাশবাক্স ছেড়ে এগিয়ে এসেছে সামনে। তার বাচ্চা মেয়েটার গলব্লাডারে পাথর হয়েছিল। মাত্র দিন দশেক আগেই এই ডাক্তারবাবু প্রায় নামমাত্র খরচে, বলতে গেলে বিনা পয়সায় নিজের নার্সিংহোমে অপারেশন করে দিয়েছেন। সে জন্য মধুর কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। সে হাত দু’খানা জোড়া করে বলে, “পশ্যু দিন তো গেইচিল বিমলির মা বিমলিকে নিয়ে। এক ঘণ্টা বসেচেল। তাপ্পর বৌদি বললেন আমনি নেই কো, বললেন এই মাসেই আমনার টেইম হবে না কো। বিমলির মা পাটিসাপটা নে গেছল।”
বাপ্পার কচুরি আলুরদম শেষ। পাটিসাপটা শব্দটা কানে যেতেই সে ঘাড় নেড়ে বলে, “ইয়েস ইয়েস...আমি খেয়েছি...নাইস পাটিসাপটা।’’ অরুণেরও মনে পড়ে। রাতে খাবারের সঙ্গে দিয়েছিল বিপাশা। কোথা থেকে পেল জিজ্ঞেস করায় হেসে বলেছিল, “কেন আমি কি কিছুই জানি না? এত দিন কি হাওয়ায় ভর দিয়ে সংসার করছি?’’
বিপাশার ব্যবহারে সে দিন কোনও অস্বস্তি ছিল না। স্বাভাবিক হাসিখুশি দেখে অরুণও খুশি হয়েই খেয়ে নিয়েছিল পরপর চারখানা। ও ধরেই নিয়েছিল বিপাশাই বানিয়েছে, সারপ্রাইজ় দেওয়ার জন্য। এখন পুরো ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে যায়। বেচারি মধুর বৌ অসুস্থ মেয়েটাকে নিয়ে অত ক্ষণ বসে থাকল। অরুণের মিটিং ছিল রিপ্রেজ়েন্টেটিভদের সঙ্গে। সেটা এমন কিছু দরকারি তো ছিল না। খবর পেলেই ও এক বার উঠে বিমলিকে দেখে দিতে পারত। বেচারির কপাল খারাপ, ওই দিনই আবার বিপাশার উইকলি ভিজ়িট। চাইল্ড স্পেশ্যালিস্ট নামেই। একখানা চেম্বার রাখা আছে এই পর্যন্ত। ইচ্ছে হলে কোনও দিন যায়, কোনও দিন যায় না। ওই দিনই এসেছিল বিপাশা। বেমালুম মিথ্যে কথা বলে দিয়েছে যে অরুণ নেই। অথচ বিমলির মায়ের হাতের পাটিসাপটা নিতে আটকায়নি। সেটাকে নিজের বলে চালানোতেও লজ্জা করেনি। ছিঃ ছিঃ! পুরো ব্যাপারটা ভেবে মনটা তেতো হয়ে থাকে অরুণের। ওর চোখে ভেসে ওঠে মধুর বৌয়ের চেহারা। বছর বত্রিশের সুস্বাস্থ্যবতী এক জন প্রায় অশিক্ষিত হাসিখুশি মহিলা, যার জীবনটা কেবলমাত্র স্বামী কন্যা নিয়েই। কৃতজ্ঞতাবশত যে ডাক্তারবাবুর জন্য পরিশ্রম করে পাটিসাপটা বানিয়ে নিয়ে যায়, অর্থের দৈন্য ঢেকে দিতে চায় আন্তরিক উপঢৌকনে। অরুণ জানে, বিপাশা শুধু এটুকুই দেখেছে যে মধুর বৌ এক জন মহিলা। আর সঙ্গে সঙ্গে বিপাশার মাথায় একটাই সঙ্কেত কাজ করেছে, কোনও ভাবে যেন অরুণের সংস্পর্শে না আসতে পারে মধুর বৌ। ছিঃ! কী মনে করে বিপাশা ওকে! এ ভাবে সবার কাছে অরুণকে ছোট করে কী আনন্দ পায়! সুন্দর কচুরিটা খাওয়ার পর তেতো মুখে উঠে দাঁড়ায় অরুণ।
“হ্যাঁ। আমি ছিলাম না। আচ্ছা...আজ তা হলে।’’
“ওদের কবে যেতি বলব তা হলে?
“আমার কাছে তো নম্বর আছে তোমার। আমি ডেকে নেব বিমলিকে।” আর না দাঁড়িয়ে এক টানে গাড়ি চালিয়ে এসে বাপ্পার স্কুলের গেটে থামে অরুণ। বাপ্পা ঢুকে যায় গেটে। মাত্রই সকাল আটটা। এরই মধ্যে ক্লান্তি এসে যেন চেপে বসেছে অরুণের শরীরে মনে। স্টিয়ারিংয়ে হাত দিয়ে গা এলিয়ে একটু ক্ষণ বসেছিল অরুণ। স্কুলের গেটের ফাঁক দিয়ে তার চোখ চলে গেল বিশাল সবুজ মাঠটার দিকে। মুহূর্তে মনে পড়ে গেল বর্ধমানের অখ্যাত গ্রাম রানিডাঙ্গা। পালিয়ে যেতে চাওয়া মনটাকে টেনে টেনে ফিরিয়ে আনছিল বর্তমান পৃথিবীতে। তখনই কানের কাছে বেজে ওঠে মিসেস ভাটিয়া, “আরে ডক্টর সাহা। আফটার আ লং গ্যাপ! হাউ আর ইউ?’’
কাষ্ঠ হাসি হাসে অরুণ বলল, “হ্যাঁ ভালই চলছে। ওই আর কী... আপনি? ভাল তো?’’
আরও এক গাল হেসে আরও খানিকটা কাছে এগিয়ে আসে মিসেস ভাটিয়া, প্রায় জানালার মধ্যে দিয়েই ঢুকে যাবে যেন। “এক দিন মিস্টার ভাটিয়াকে নিয়ে আসব আপনার চেম্বারে। কিছু প্রবলেম হচ্ছে...কখন আসব বলুন?”
“ওহ শিওর...এনিটাইম ইউ প্রেফার টু... জাস্ট গিভ মি আ কল বিফোর কামিং...’’ একটু হেসে গাড়িতে স্টার্ট দিতে যাবে অরুণ, এমন সময় এক দল মহিলা এসে দাঁড়ায় গাড়ির সামনে। ‘‘প্লিজ় ডক্টর সাহা...এক বার নামুন... এ বার স্কুলের অ্যানুয়াল ফাংশানে গার্ডিয়ানদের একটা প্রোগ্রাম রাখছি, সেই ব্যাপারে একটু কথা আছে।”
অরুণ নামা মাত্রই বাপ্পার ক্লাসমেটদের মায়েরা সব ছেঁকে ধরে। ভিড়ের মধ্যে বাবাও আছে দু’এক জন, তবে তা সংখ্যায় নগণ্য। দেরি হয়ে যাচ্ছে, তবু এত জন মানুষের ডাক উপেক্ষা করে চলে যাওয়ার অভদ্রতাটা অরুণ করতে পারে না। বাপ্পার বন্ধু শ্রীময়ীর মা একটু ন্যাকা। তিনি আব্দারের সুরে বলেন, “দাদা, এ বার কিন্তু আমরা একটা শ্রুতিনাটক করতে চাই, আপনি কিন্তু ঠিক করে দেবেন কোন নাটকটা আমরা করতে পারি।”
“ওই বসে বসে শ্রুতিনাটক? না... না! তার চেয়ে বরং একটা গণসঙ্গীতের অনুষ্ঠান হোক। আমরা সবাই গাইব,’’ প্রস্তাব রাখেন অনমিত্রর বাবা। ভদ্রলোক সঙ্গীতশিল্পী। মাঝেমাঝেই ছোটখাটো টিভি চ্যানেলে ওঁকে দেখা যায়। নিন্দুকেরা বলে থাকে উনি নাকি নিজে থেকে পেমেন্ট করে প্রোগ্রামের ব্যবস্থা করেন। সে যাই হোক, উপস্থিত মহিলাকুলের প্রবল আপত্তিতে অনমিত্রর বাবার প্রোপোজ়াল দাঁড়াতে পারে না। নাটকের দিকেই ভোট পড়ে বেশি। কিন্তু মুশকিল হল, একটা শ্রুতিনাটক করতে যে সময় লাগবে, সে সময় পাওয়া যাবে কি না, সে নিয়ে কেউ কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। সময় কেটে যায়। অরুণ ঘড়ি দেখতে দেখতে বলে, “আমার মনে হচ্ছে এ ভাবে সিদ্ধান্তে আসা যাবে না। ভাল হয়, আমরা যদি কোথাও একসঙ্গে বসে আলোচনা করি। আপনারা ডেট, টাইম জানান,আমি পৌঁছে যাব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy