Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ১৯

শেষ নাহি যে

মেয়েকে নিয়ে আবার অন্য হাসপাতালে যেতে হবে জেনে বিরক্তি ও হতাশ হয়ে পড়েন সাম্যব্রত। মন্টুর ঘুষ নেওয়ার কথা তিনি জানিয়ে দেন ডাক্তারদের।  

ছবি: শুভম দে সরকার

ছবি: শুভম দে সরকার

ইন্দ্রনীল সান্যাল
শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

পূর্বানুবৃত্তি: মেয়েকে নিয়ে আবার অন্য হাসপাতালে যেতে হবে জেনে বিরক্তি ও হতাশ হয়ে পড়েন সাম্যব্রত। মন্টুর ঘুষ নেওয়ার কথা তিনি জানিয়ে দেন ডাক্তারদের।

ডক্টর সেন পা সরিয়ে নিয়ে বললেন, “টাকাটা আগে ওঁকে ফেরত দাও। তার পর ক্ষমা চাও।”

“ঠিক আছে ম্যাডাম,” সুড়ুৎ করে উঠে দাঁড়িয়েছে মন্টু। সাম্যব্রতর হাতে তিনটে দু’হাজার টাকার গোলাপি নোট ধরিয়ে দিল। দরিয়ার পাশে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “মা জননী! কেন এই পাপ কাজ করেছি, তা যদি জানতিস! একমাত্র মেয়েটার বিয়ে আটকে গিয়েছে!”

দরিয়া মন্টুর দিকে তাকাবে না ঠিক করেছে। সে চোখ বন্ধ করে বলল, “তুমি বলেছিলে তোমার নাতি নাতনি আছে। বলেছিলে, বয় আর গার্লের ঠাকুরদা হয়ে গেছ, কিন্তু ওয়ার্ড বয় উপাধিটা রয়ে গেছে।”

ডক্টর ঘোষ হাসতে হাসতে বললেন, “আমি এমার্জেন্সিতে গিয়ে হৃষিকেশকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

ওয়ার্ডমাস্টার বললেন, “আমিও চললাম ম্যাডাম।”

মন্টু বলল, “আমি যাই?”

ডক্টর সেন বললেন, “আজ ডিউটি শেষ করে বাড়ি যাওয়ার আগে আমার চেম্বার ঘুরে যাবে। শো কজ লেটার আমার টেবিলে রাখা থাকবে।”

মন্টু বলল, “ম্যাডাম! এটা কিন্তু আপনি ঠিক করছেন না।” তার বলার ভঙ্গিতে প্রচ্ছন্ন হুমকি আছে।

“যাও!” গলা চড়িয়ে ধমক দিলেন ডক্টর সেন, “নিজের কাজ করো।” সিস্টারকে বললেন, “মেয়েটির ব্লাড ট্রান্সফিউশন শেষ হয়ে গেলে একটা নর্মাল স্যালাইন চালিয়ে ট্রলিতে তুলে দেবেন। ওয়ার্ডবয়কে বলবেন, যেন অ্যাম্বুল্যান্সে তুলে দেয়।” তার পর সাম্যব্রতকে বললেন, “আমি রেফার কার্ড লিখে দিচ্ছি। ওয়ার্ডমাস্টার আপনার অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা করে দেবেন।”

সবাই যে যার কাজে চলে গেল। বেডে শুয়ে আছে দরিয়া। তার পাশে এখন কেউ নেই।

চোখ বন্ধ করে দরিয়া। তার মনে পড়ে যায়, অনেক বছর আগের এক শীতকালের কথা। যখন সে এই বঙ্গবাসী হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে এসেছিল। প্রথমবার দেখা হয়েছিল বিহানের মা শ্রীরূপার সঙ্গে।

****

যে দিন ‘ডিডিএলজে’ দেখার কথা ছিল, তার পরের দিন দরিয়া কলেজে যেতেই মণিদীপা চেপে ধরে বলল, “হ্যাঁ লা বকুলফুল। সত্যি কতা বল দিকি। কাল থেকে তোর মোবাইল ফোন বন্দ কেনে? একটা মজার কতা বলতে ফোন করেছিলুম। বিএস ম্যাডামের না কি ডিভোর্স হয়ে যাচ্চে।”

গতকাল সিনেমা দেখতে যাওয়ার কথা মণিদীপাকে বলেনি দরিয়া। বললেই আজেবাজে প্রশ্ন করত। শিক্ষিকা সংক্রান্ত গসিপে জল ঢেলে দিয়ে দরিয়া বলল, “মোবাইলটা গন্ডগোল করছে। সারাতে দিয়েছি। এখন কয়েকদিন আমাকে ফোনে পাবি না।”

“কী হয়েচে বল দিকিনি,” দরিয়ার চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করেছে মণিদীপা, “তোর চোখমুখ বাপু ভাল ঠেকচে না। বরের সঙ্গে ঝামেলি হয়নি তো?”

একেবারে বর-বৌ তে চলে গিয়েছে। এই জন্যই মেয়েটাকে কিছু বলতে চায় না দরিয়া। সে বলল, “বাজে না বকে কাজের কথা বল। কাল প্রক্সিটা ঠিকঠাক দিয়েছিলি?”

“ওতে আমার কোনও গন্ডগোল হবেনি,” চোখ মেরে বলল মণিদীপা, “তুই আজ আমারটা মেরে দে। একটা মিনসে পাকড়েছি। নাম সুদীপ্ত। বডি বিল্ডার। তোর ভাতারের কলেজে পড়ে। ওর সঙ্গে ‘ডিডিএলজে’ দেকতে যাব।”

যাক! আজকের মতো আপদ বিদায় হল। মণিদীপার প্রক্সি দিয়ে মন দিয়ে সব ক্লাস করল দরিয়া। তার মধ্যে এক ফাঁকে দেখে নিল, কলেজের গেটের বাইরে বিহান দাঁড়িয়ে আছে।

রাগের চোটে দরিয়ার মাথায় আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ হচ্ছে। লাভা গড়িয়ে পড়ছে সারা শরীর বেয়ে। আড়চোখে দেখল বিহান ইশারায় দেখাচ্ছে, মোবাইল কোথায়?

ক্লাসে ঢুকে গেল দরিয়া। কলেজ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে বিএস ম্যাডামের স্পেশ্যাল ক্লাস করল। এত ক্ষণে যদি আপদটা দূর হয়ে থাকে। ক্লাস শেষ হতে সন্ধে সাতটা। ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। রাতে কনকনে ঠান্ডা পড়বে।

কলেজ গেট থেকে বেরিয়ে দরিয়া দেখল বিহান দেবদাস মার্কা মুখ করে বৃষ্টিতে ভিজছে। পরনে হাফ সোয়েটার। এইসব ন্যাকামোকে একদম পাত্তা দিতে নেই। শালকিয়ার অটো ধরল সে।

পরদিন কলেজে ঢোকার সময়ে দরিয়া দেখল, বিহান ফুটপাথে একই পোশাকে দাঁড়িয়ে এক ট্যাক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে চা আর বিস্কুট খাচ্ছে। দরিয়া চুপচাপ কলেজে ঢুকে গেল। ক্লাসে বসা মাত্র মণিদীপা চোখ গোলগোল করে বলল, “বকুলফুল! তোর কত্তা বাইরে দাঁড়িয়ে কেন লা?”

“বাজে কতা না বলে কেলাস কর,” এক ধমকে বান্ধবীকে থামিয়ে দিল দরিয়া।

সারাদিন ধরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। চাবুক চালাচ্ছে উত্তুরে হাওয়া। সারাদিন ধরে ক্লাস। কলেজ শেষ হয়ে গেলে বিএস ম্যাডামের কাছে স্পেশাল ক্লাস। আজ মণিদীপাও সেই ক্লাস করেছে। তাকে দেখে বিএস ম্যাডাম চোখ কপালে তুলে বললেন, “তুই এখানে? বাবা-মা বাড়িতে ঢুকতে দেননি?”

সাম্যব্রতকে দেখে ওয়ার্ড মাস্টার বললেন, “আপনি যে অ্যাম্বুলেন্সে করে মেয়েকে নিয়ে এখানে এসেছিলেন সেটা এখনও হাসপাতাল চত্বরে রয়েছে। ওটা নিয়ে বেরিয়ে যান।”

“রাজুর অ্যাম্বুলেন্স এখনও আছে?” খুশি হলেন সাম্যব্রত। যাক বাবা! চেনা চালক থাকলে দুশ্চিন্তা কমবে।

ওয়ার্ড মাস্টার সব ব্যবস্থা করে দিলেন। একজন ওয়ার্ড বয় দরিয়াকে ট্রলিতে তুলে অ্যাম্বুলেন্সের কাছে নিয়ে যাচ্ছে। সিস্টারকে ধন্যবাদ জানিয়ে সাম্যব্রত ওয়ার্ড থেকে বেরলেন বিকেল সাড়ে চারটের সময়। করিডোর দিয়ে যাওয়ার সময়ে খেয়াল করলেন, এক কোনে দাঁড়িয়ে মন্টু মোবাইলে উত্তেজিত হয়ে কথা বলছে। সাম্যব্রতকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিল। সাম্যব্রত মন্টুকে পাত্তা না দিয়ে অ্যাম্বুল্যান্সের দিকে এগোলেন।

“আমাকে বাঁচাও ভাইটি!” মোবাইলে কান্নাকাটি করছে মন্টু। “সামনেই রিটায়ারমেন্ট। এখন শো কজ খেয়ে গেলে খুব বিপদ। পেনশন আটকে যাবে।”

“ঘুষ নিয়েছ বলে শো কজ খেয়েছ। এখন আমার কাছে কেঁদে কী লাভ? আমি তোমার জন্য কিছু করতে পারব না,” বলল সনৎ। “আমাদের পার্টি কোনও রকম কোরাপশন বরদাস্ত করে না। আগে দেশ, পরে ব্যক্তি।”

“সব জানি ভাইটি। পার্টি ফান্ডে প্রতি মাসে কত টাকা দিই বলো তো? মাইনের টাকা থেকে কি আর ওই জিনিস হয়?”

“তুমি ঘুষের টাকা পার্টি ফান্ডে ডোনেট করো? ছিঃ!” ঘৃণা ছড়িয়ে পড়েছে সনতের গলায়।

“পার্টি আমার বাপ-মা! তার জন্য আমি সব করতে পারি,” বলছে মন্টু, “সব ঠিক ছিল, জানো ভাইটি। গন্ডগোল পাকালো শয়তান ডাক্তারগুলো। লেবার পেশেন্টের পায়ে বোমা লেগেছে। তাকে কোন ওয়ার্ডে রাখবে, সার্জারি না গাইনি, এই নিয়ে ক্যাচাল শুরু হতে জানাজানি হয়ে গেল।”

“দাঁড়াও দাঁড়াও!” মন্টুকে চুপ করিয়ে বিহান বলল, “প্রেগন্যান্ট পেশেন্ট? পায়ে বোমার টুকরো? নাম কী বল তো পেশেন্টের?”

“সে আমি জানি না।”

“টিকিট দেখে বলো।”

“আমি ওই টিকিটের কাছে আর ঘেঁষব না ভাইটি। ডলি ম্যাডাম শো কজ করেছেন। যদি দেখেন যে আমি ওই মেয়েটার টিকিট ঘাঁটছি, তা হলে সাসপেন্ড করে দেবেন।”

“তুমি শালা ভিতুর ডিম!” সনৎ উত্তেজিত হয়ে বলল, “পেশেন্টের সঙ্গে কে ছিল? মেয়েটার বাবা?”

“বাবাটাই তো কাঠি করল। বদমাশটাকে নকশালদের মতো দেখতে।”

সনৎ খুকখুক করে হাসছে। মন্টু বলল, “হাসছ কেন?”

সনৎ বলল, “নকশালদের মতো দেখতেই শুধু নয়। লোকটা নকশাল ছিল। ওর নাম সাম্যব্রত। মেয়েটার নাম দরিয়া। বাড়ি লিলুয়ায়।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ,” উত্তেজিত হয়ে বলল মন্টু, “ঠিকই বলেছ। মেয়েটার নাম একটু অদ্ভুত টাইপের। অ্যাম্বুল্যান্সটা লিলুয়া থেকেই এসেছে।”

ডাক্তার আর ওয়ার্ড মাস্টারকে বখরা দিতে হবে। এই মিথ্যে কথা বলে মন্টু ছ’হাজার টাকা সাম্যব্রতর কাছ থেকে নিয়েছিল। সনৎও ঠিক সেই কায়দায় ডলি ম্যাডামের নামে মিথ্যে কথা বলে তার থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা নিচ্ছে। মন্টু টাকাটা হজম করতে পারেনি। সনৎ হজম করে নেবে। এই হল বড় নেতার লক্ষণ।

সনৎ বলল, “তোমার খুব কপাল ভাল মন্টুদা। এই বারের মতো তোমাকে বাঁচিয়ে দিচ্ছি। রোববার পার্টি ফান্ডে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে যেও। তার পরে আমি সেন ম্যাডামের সঙ্গে বুঝে নেব।”

টাকার পরিমাণ কমানোর চেষ্টায় মন্টু করুণ গলায় মিনতি করল, “পঞ্চাশ পারব না ভাইটি। একটু কম করো। পার্টির জন্যে জান কবুল।”

উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দিয়েছে সনৎ।

১২

“উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দেওয়ার স্বভাব খুব খারাপ,” নিজের মনে বলল বিহান।

সুদাম গুনগুন করে সুর ভাঁজছিল। সেটা থামিয়ে ভাব বাচ্যে বলল, “কার উপরে রাগ করা হচ্ছে?”

“আমার বন্ধু সনৎ। বারবার ফোন করে খবর নিচ্ছে আমি কোথায়। কিন্তু নিজে কোথায় আছে সেটা বলছে না।”

বিহানের কথা থামিয়ে সুদাম বলল, “ওই দেখো!” তার আঙুল আকাশের দিকে।

উপরে তাকিয়ে বিহান দেখল খুব নিচু দিয়ে উড়ে যাচ্ছে শ্যাওলা রঙের একটা হেলিকপ্টার। এতটাই নিচ দিয়ে উড়ছে যে রোটর ব্লেডের শপশপ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। বিহান বলল, “এয়ারফোর্সের হেলিকপ্টার।”

সুদামের চোখমুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সে কখনও হেলিকপ্টার দেখেনি। অবাক হয়ে বলল, “প্লেন এত নিচ দিয়ে যায় না কি?”

“কী ব্যাপার কে জানে! তাড়াতাড়ি চলো সুদামদা,” হাঁটা লাগিয়েছে বিহান। রেল মিউজ়িয়ামের পাশের রাস্তা দিয়ে একটু হাঁটলেই ফোরশোর রোড। রাস্তায় কোনও লোক নেই। একটি লরি অনেকক্ষণ ধরে পুড়ে কঙ্কাল হয়ে গেছে। জ্বলন্ত লরির ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে আর্মির ভ্যান। ধোঁয়ার কারণে দেখতে পায়নি দু’জনে। সেখান থেকে ভেসে এল, “আব্বে ওয়ে নওটঙ্কি! হাথ উপর!”

সুদামের পোশাক দেখে ওদের মনে হয়েছে যাত্রা দলের অভিনেতা। বিহান দেখল ধোঁয়ার আড়াল থেকে খটখট জুতোর আওয়াজ তুলে এগিয়ে আসছে ছ’ফুটিয়া এক জওয়ান।

বিহান আর সুদাম দু’হাত উপরে তুলে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা এগিয়ে এসে সুদামের হাতের একতারার মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্রের নল গলিয়ে বলল, “ইয়ে কেয়া হ্যায়?”

“এটা একতারা। গান গাওয়ার সময়ে লাগে।” ব্যথাহত মুখে জানাল সুদাম। যেন বন্দুকের নল একতারায় নয়, তার বুকে ঠেকানো রয়েছে।

“ইকতারা!” ঘাড় নাড়ল ফৌজি, “ইসকো লেকে কঁহা যা রহা হ্যায়?”

বিহানের হিন্দি খুব খারাপ। সে বলল, “মেরা বিবিকা তবিয়ত খারাপ স্যর। হাসপাতাল যাচ্ছি স্যর। শি ইজ প্রেগন্যান্ট স্যর।”

বিহানের হিন্দি শুনে ফৌজি হাসছিল। শেষটা শুনে হাসি মুছে বলল, “জলদি বিবিকে পাস যাও।”

চিৎকার শুনেই বিহান আর সুদাম দৌড় দিয়েছে। দু’জনে চলে এসেছে বঙ্গবাসী হাসপাতালের পিছনের গেটে।

ক্রমশ

অন্য বিষয়গুলি:

Novel Series
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy