দৃশ্যপট: নাটকের নাম ‘মিসড কল’
ক্লাস এইটে পড়ি তখন। সেই বয়সে এমনিতে তো স্বাধীনতা মেলে না, পুজোতেই স্বাধীনতা। মামা, মাসি-পিসি, বাবা-মা সবাই এক টাকা করে দিতে-দিতে যখন সেটা পাঁচ-ছ’টাকায় গিয়ে দাঁড়ায়, কিছু ইচ্ছেপূরণ হয়। যা খেতে চাই, যা দেখতে চাই, হয়তো রেলের টিকিট কেটে কিছু দূর গিয়ে ফিরে আসতে চাই, তার জন্য কারও দ্বারস্থ হতে হয় না।
সেটা ’৭৮-৭৯ সাল হবে।
এ রকম একটা বয়সে আমার ইচ্ছে জেগেছিল, থিয়েটার নামে যে বস্তুটি আমাদের কলকাতায় হয়, অন্য রকমের থিয়েটার, তা দেখার। ওই যে সব নাম শুনতাম— উৎপল দত্ত, শম্ভু মিত্র, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, এঁদের যেখানে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। এক মাত্র পুজোর সময়েই সেটা হতে পারে। কাগজে দেখলাম, থিয়েটার হচ্ছে ‘শারদীয়ায় নান্দীকার’। তখন পুজোর চার দিন— ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী অ্যাকাডেমিতে নান্দীকার থিয়েটার করত। ৩৩ নম্বর বাসের দোতলায় চাপলে এই পাইকপাড়া থেকে চলে যাওয়া যায় রবীন্দ্রসদন। আমি আর আমার এক বন্ধু মিলে বাসে চেপে পৌঁছে গেলাম অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে। দোতলায় একেবারে পিছনের সারিতে বসে দেখলাম ‘ফুটবল’। ষষ্ঠী বা সপ্তমীর সন্ধ্যা ছিল সেটা।
এর আগে আমি দেখেছি উৎপল দত্তের ‘টিনের তলোয়ার’, তখন ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে উনি নিয়মিত করতেন। সবটা বুঝতে পারিনি। কিন্তু ‘ফুটবল’ দেখে মনে হল অনেকটা বুঝলাম, খানিকটা অধরাও রইল। পরের দিন ‘আন্তিগোনে’। তার সবটা বুঝলাম না। কিন্তু তা এমন অমোঘ টান দিয়ে রাখল যে পরের পুজোয় আবার বোঝাপড়া হবে!
আমার বাবা অভয় হালদার যাত্রাভিনেতা ছিলেন, যাত্রার পয়সাতেই আমাদের রুটি-রুজি, বেড়ে ওঠা। পুজোর সময়ে মাঠে গিয়ে যাত্রা দেখেছি কলকাতার উপকণ্ঠে, ডানলপ ব্রিজ পেরিয়ে। পালা নেমেছে সবে, এখানে এক বার হল, তার পরে দল বেরিয়ে গেল বাংলার গ্রাম-গ্রামান্তরে। কলকাতার কাছে বলে বাবা নিয়ে গেলেন আমাদের চার ভাইকে। তখনও স্কুলে ছুটি পড়েনি হয়তো, কিন্তু মনে আমাদের ছুটি পড়ে গিয়েছে।
যেহেতু আমার বাবা অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, আমাদের ছোট থেকেই অনেক জিজ্ঞেস করত, ‘তোমরাও কি ওই লাইনে যাবে?’ আমাদের শিক্ষক বা বন্ধুদের অভিভাবক অনেকেই ‘লাইন’ শব্দটা ব্যবহার করতেন। না বুঝে আঘাত করতেন। এক জন কেরানির ছেলে বা এক জন ডাক্তারের ছেলেকে এ কথা জিজ্ঞেস করা হয় না। ওই বয়সে আমি কোনও দিনই ভাবিনি যে অভিনেতা হব। বরং ‘ভেবেছিলাম, অন্য কাজ করব। ফুটবলার হওয়ার ইচ্ছে ছিল, লেখালেখি করার ইচ্ছে ছিল।
সে বার যে কষ্টেসৃষ্টে পুজোর দুটো দিন থিয়েটারের জন্য বরাদ্দ করা গেল, আবার পরের বছরের অপেক্ষা। মাঝে তো আর যাওয়ার উপায় নেই স্কুল থেকে বেরিয়ে। থিয়েটার হয় সন্ধেবেলায়। আমাদের তো সন্ধে সাড়ে ছ’টায় বাড়ি ফিরে ঠাকুমার তত্ত্বাবধানে গায়ত্রী মন্ত্র জপ করে পড়তে বসতে হয়। টাকাই বা জোগাবে কে? ওই পুজোতেই এক মাত্র অর্থ, সময় আর স্বাধীনতা এক সঙ্গে পাওয়া যেত। পরে, ক্লাস টেন যখন পাশ করে ফেললাম, তখন অবশ্য অনেকটা স্বাধীন। বাড়িতে বলেই থিয়েটার দেখতে যাচ্ছি। বহুরূপীতে পুজোর সময়ে ছুটি থাকত। ওদের নাটক দেখতাম এমনি সময়ে আর নান্দীকারেরটা তুলে রাখতাম পুজোয় দেখব বলে।
পরে ইলেভেন-টুয়েলভে উঠে লেখালেখি করছি, পত্রিকা করব বলে বন্ধুরা হইহই করছি। পুজো ব্যাপারটাকে অস্বীকার করার চেষ্টা করছি— এই সংস্কার, এই অপচয়! এবং সেই প্রবণতাটা কলেজে গিয়ে প্রায় দ্বিগুণ। আমাদের স্কটিশ চার্চ কলেজে তখন অতি-বাম রাজনীতি চলত, আমি তো ইউনিয়নের সেক্রেটারিও হয়েছি। ফলে, ওই যে প্যান্ডেলে যাব না, ঠাকুর-দেবতার থেকে বা মানুষের থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকব, এই যে উন্মাদনা এর থেকে যে আমি পৃথক, এটা প্রমাণ করার জন্য এক মাত্র থিয়েটারই আর একটা জায়গা। যেখানে ‘নাট্যকারের সন্ধানে ছ’টি চরিত্র’ আসবে। বা ‘মাননীয় বিচারকমণ্ডলী’ বা ইবসেনের ‘নোরা’ যাকে নান্দীকার করেছে ‘নীলা’ বলে। এই সব নতুন নতুন নাটক তখন ওখানে নামছে এবং আমরা দেখছি।
কলেজ থেকে বেরোলাম। বটানি পড়েছি, কেন পড়েছি জানি না। বায়ো সায়েন্সের বন্ধুরা মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরি পেয়ে যাচ্ছে। এই সময়ে হঠাৎই কাগজে দেখলাম, নান্দীকার একটা ট্রেনিং করবে। একটু আলগোছেই গিয়েছিলাম ওখানে। গিয়ে দেখলাম, বিরাট ব্যাপার। ওরা পঁচিশ জনকে নেবে, এসেছে প্রায় সাত-আটশো। ভিতরে গানবাজনা হই-হুল্লোড়, মানে পরীক্ষা হচ্ছে। মন ভেঙে গেল, আমার হবে না, আমার তো কোনও ট্রেনিং নেই! ফিরে আসছি যখন, এক জন বললেন, ‘এসেছেন যখন এক বার দেখা করে যান।’ দেখা করলাম। রুদ্রপ্রসাদ ও স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত ইন্টারভিউ নিলেন, যাঁদের মঞ্চে দেখেছি। সাত দিন পরে জানাবেন বললেন। ঠিক করেছিলাম, যাব না। কিন্তু যেমন ওই পুজোর থিয়েটার, তেমন একটা টানই বোধহয় আমায় হাঁটিয়ে নিয়ে চলে গেল সেই শ্যামবাজারে নান্দীকারের অফিসে। গিয়ে দেখি, আমার নাম আছে! ট্রেনিং শুরু হল। ন’মাসের ট্রেনিং, তার পরে একটা নাটক হবে। কী নাটক? না, ‘ফুটবল’! ছোট পার্ট করেছিলাম। কিন্তু দারুণ অনুভূতি। পুজোরই দিন সেই অ্যাকাডেমিতেই মঞ্চের উপরে দাঁড়িয়ে অভিনয় করলাম। সেই ‘শারদীয়ায় নান্দীকার’!
তখন পুজোয় প্রবাসী বাঙালিরা বেশি করে থিয়েটারে আসতেন। অন্য সময়ে সুযোগ পেতেন না। কলকাতার দর্শকেরাও দেখতেন, কিন্তু পরেও দেখে নিতে পারবেন, এ রকম একটা ভাব। নতুন জামাকাপড়ে রঙিন প্রেক্ষাগৃহ এবং একটা অদ্ভূত গন্ধ চারদিকে ভেসে বেড়াত। সেই গন্ধটা, আমরা যারা গন্ধ মাখতাম না, তাদের গায়েও লেগে যেত। সে দিন মঞ্চে যখন পর্দাটা খুলে গেল, সেই একই গন্ধ পেলাম। শুধু আমার ভূমিকাটা পাল্টে গিয়েছে।
এর পরে পুজোয় বহু অভিনয় করেছি। সেই ’৮৬ সালে নান্দীকারে শুরু। ২০০২ থেকে অন্য নানা দলের সঙ্গেও অভিনয় শুরু করেছি। নানা দল যখন চলে এল, নান্দীকার আর পুজোর চার দিন অ্যাকাডেমি পেত না। এমনও হয়েছে যে নান্দীকার এক দিন পেয়েছে, ওদের সঙ্গে অভিনয় করেছি। বাকি তিন দিন অন্য দলের সঙ্গে করেছি। এ বছরও করব ষষ্ঠী, সপ্তমী আর নবমীতে।
এর মধ্যে এক বার, ২০০৬-০৭ নাগাদ, আমি আর গৌতম হালদার পুজোয় দিল্লি গিয়েছিলাম থিয়েটার করতে। ধরাবাঁধা অডিটোরিয়ামে নয়, পুজো মণ্ডপে। তার জন্য ‘মিসড কল’ বলে একটা নতুন নাটক লিখেছিলাম। ওঁরা খুবই ভাল ব্যবস্থা করেছিলেন ঘেরা-টেরা দিয়ে। নাটক যখন চলছে, কাঁসরঘণ্টা বাজছে, আরতি হচ্ছে, তার শব্দ ভেসে আসছে। অনেকে ওখানে যাবেন, তার আগে থিয়েটার দেখে যাচ্ছেন বা ওখান থেকে ফেরত এসে দেখছেন। আমি প্রসেনিয়াম থিয়েটারের লোক, মঞ্চমায়া তৈরি হলে ভাল লাগে, তাই ওখানে একটু অস্বস্তি লেগেছিল। কিন্তু আমিও পুজোর একটা অংশ, এটাও তো একটা অনুভূতি!
আর এক বার হল কী, চতুর্থী বা পঞ্চমীর দিন কলকাতায় নাটক করলাম, তখন সবে প্যান্ডেলে ঠাকুর এসেছে। ষষ্ঠীতে জামশেদপুরে, ঠাকুর তখন সেজে উঠছে। রাতে ট্রেন ধরে কলকাতা ফিরে প্লেন ধরে লন্ডন। সেখানে তখন সপ্তমীর পুজো হচ্ছে। ভোগ খেয়ে ফেরার ফ্লাইট ধরলাম। কলকাতায় নবমীর অভিনয় সেরে রাতে ট্রেন ধরে বারাণসীতে গিয়ে পৌঁছলাম, তখন বিসর্জন হচ্ছে।
বছরভর নাটকের যে দর্শক তার থেকে পুজোর দর্শক কিন্তু আলাদা। হয়তো একটা মজার কথা বললাম, তার মধ্যে হালকা পানিং আছে, দর্শক সশব্দে হাসে। কলকাতায় এটা কম, তারিফ করার মধ্যেও একটা নৈঃশব্দ। হতে পারে এটা থিয়েটার দেখার ডিসিপ্লিন, আমি নিজেও তো কলকাতার দর্শকের মতোই আচরণ করি। কিন্তু যাঁরা নিয়মিত দেখেন না, তাঁদের সেই দায় নেই। তাই দেখতাম, পুজোর সময়ে হাসির হররা, হাততালির জোর অনেক বেশি। দারুণ লাগত।
আবার কখনও কখনও এই হাসি বা প্রতিক্রিয়া মানুষকে পেয়ে বসে, দর্শক তখন অভিনেতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। প্রতিক্রিয়া পেয়ে অভিনেতা তা আবার পেতে চায়। অভিনয়ে একটু রকমফেরও করে। কিন্তু যখন তেমনটা ঘটে, দেখা যায়, একটা চরম কষ্টের জায়গাতেও কথার মারপ্যাঁচে দর্শক হেসে ফেলেছে। তখন আবার অভিনেতার নিজেকে আহত লাগে।
এখন প্রবাস থেকে আসার ঢল কমেছে। তখন অনেক আগেই হাউসফুল হয়ে যেত। পুজোয় থিয়েটার দেখা যে একটা পবিত্র কাজ, সেটাও হয়তো ততটা আর নেই, ঝোঁক সরে গিয়েছে। হয়তো টিভি একটা কারণ, টিভিতে দিনভর নানা জায়গার ঠাকুর দেখানো হয়।
নাটকের বাইরেও তো নটের অন্য জীবন থাকে। শুনেছি, হাতিবাগানের থিয়েটারে এক নামী অভিনেত্রী এক বার পুজোয় বায়না ধরেছিলেন, যে চরিত্র করতে হবে করবেন, কিন্তু নতুন শাড়ি পরে করবেন। এবং একটা সিনে নতুন তাঁতের শাড়ি পড়ে ঢুকেওছিলেন। এর মধ্যে হয়তো একটা বোকামি আছে, কিন্তু একটা ব্যাপারও আছে। আমাদের থিয়েটারেও দেখেছি, দু’একটি তরুণ-তরুণী হয়তো বেঁকে বসলেন, নতুন প্রেম বা বিয়ে হয়েছে, পুজোর দিনেও অভিনয় করতে হবে? শেষ অবধি তাঁরা আসেন ঠিকই, পুজোর জামা পরে। কিছু বিপ্লবীও আছেন, যাঁরা ভাবেন এত আনন্দ কিসের! সে দিনও হাওয়াই চটি পরেই এলেন। কিন্তু বেশির ভাগই নতুন শাড়ি-জামা, গ্রিনরুমে সে সব ঝোলে।
মঞ্চে: ‘ফেরা’ নাটকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে।
আগেও নাটকের শেষে দল বেঁধে ঘুরতে যাওয়া ছিল। বাইক নিয়ে, যাদের বান্ধবী আছে, তাদের নিয়ে। আমার স্ত্রী যিনি এখন, তিনিও ছিলেন। ঠাকুর দেখছি, ম্যাডক্স স্কোয়ারে আড্ডা মারছি, আবার এক বন্ধুর বাড়ির দোরগোড়ায় একটু আড্ডা মেরে নিলাম। পরে যখন কিছুটা নামডাক হয়েছে, পুজোর সময়েও স্ত্রী আর ছেলেকে সময় দিতে পারিনি। ওরা আমায় মদত দিয়েছে। কিন্তু এই যে আমজনতার বেড়ানোর সময়ে তুমি বেড়াতে পারবে না, এটা পরিবারের মধ্যে চারিয়ে দেওয়া, এর মধ্যে একটা স্বার্থপরতা আছে— ‘তোমরা আমার মতো হয়ে ওঠো, আমাকে বোঝো’। বাবা যেহেতু পুজোর সময়ে বেরিয়ে যেতেন, মাকেও দেখেছি মানিয়ে নিতে, প্রতীক্ষায় থাকতে। আমরাও পুজোয় বাবাকে পাইনি।
বছর চার-পাঁচ আগে এক অদ্ভূত অভিজ্ঞতা হল। সে বার পুজোয় আমার ছোট ভাই ভীষণ অসুস্থ, প্রায় মৃত্যুর মুখে। পিজিতে আইসিইউ-তে ভর্তি। পাশেই অ্যাকাডেমি, রাস্তা পেরোলেই। ওটাও একটা রঙ্গমঞ্চ, এটাও একটা রঙ্গমঞ্চ। রাজা লিয়ার বলেছিলেন না, ‘অল দ্য ওয়র্ল্ড ইজ আ মেয়ার স্টেজ’! যে অভিনেতা একটু পরে ওখানে গিয়ে কাঁদবে, সে এখানে কাঁদার সব উপকরণ নিয়ে বসে আছে। রাস্তায় বেরোলেই দেখতে পাচ্ছি, আলো জ্বলছে, মোটরবাইকে হাওয়া কেটে তরুণ-তরুণীরা চলে যাচ্ছে, নতুন জামা পরে বাচ্চারা যাচ্ছে। আর পাঁচিলের এ পাশে নতুন জামা পরার কোনও অবকাশ নেই। কবিতায় আছে না— ‘এ কলকাতার মধ্যে আছে আর একটা কলকাতা’— এ পুজোর মধ্যে আছে আর একটা পুজো।
অনুলিখন: সোমেশ ভট্টাচার্য
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy