নাগ— ঠোঁটটা গোল করে, শব্দটা একটু টেনে উচ্চারণ করলেন হিলাল খান। লাল চকে, যেখানে খবরের কাগজের দফতর, তার দক্ষিণ কোণে খানের পত্রপত্রিকার দোকান, ‘খান নিউজ় এজেন্সি’। প্রতি সকালে কাশ্মীর পরিস্থিতি নিয়ে সেখানেই বসে আড্ডা, চা সহযোগে। সেই খান নিউজ় এজেন্সির হিলাল খান জিজ্ঞেস করলেন, ‘নাগ শব্দটির অর্থ আমি জানি কি না। বললাম, সাপ। ‘না,’ খান বললেন, ‘মাটি ফুঁড়ে জলের যে ধারা তীব্র বেগে বেরিয়ে আসে, তাকে কাশ্মীরিতে বলা হয় নাগ।’’ হিলাল খানের মতে, সেই নাগের উপরে অতিকায় এক দৈত্য পা রেখে দাঁড়িয়ে আছে। বললেন, ‘‘আব দেখতে হ্যায় কি নাগ পহেলে ফাটতা হ্যায় কি জিন প্যার হঠাতা হ্যায়।’’ এখন দেখা যাক, মাটির নীচ থেকে বেরোতে না পেরে যে জল ফুটছে, সেই জল প্রথমে ফেটে বেরোয় না দৈত্য আগে পা সরায়। খান অবশ্য পরিষ্কার করে ভাঙলেন না, কে নাগ আর কে-ই বা দৈত্য!
সেপ্টেম্বরের গোড়ায় সপ্তাহ দুয়েকের কাশ্মীর সফরে, কাশ্মীর নিয়ে যত বিশ্লেষণ শুনলাম, মনে হল, খানের তিন লাইনের চিত্রকল্প তার মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। এই সময়ের কাশ্মীরে কে ফেটে বেরোবে, আর কেই বা পিছনে হাঁটবে... নাগ না জিন? সাধারণ মানুষ না ভারত রাষ্ট্র? এই প্রশ্নটাই হিলাল খান তুলে দিলেন তাঁর প্রাতঃকালীন চায়ের আড্ডায়।
অগস্টের ৫ তারিখে, কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের পরে কেউই সম্ভবত বুঝে উঠতে পারছেন না, উপত্যকায় কোথাকার জল কোন দিকে গড়াচ্ছে। মাসের পর মাস স্কুল, কলেজ, দোকান, বাজার বন্ধ থাকাটা কাশ্মীরে কোনও নতুন ঘটনা নয়। যেটা নতুন সেটা হল, কেউই বিশেষ মুখ খুলছেন না, প্রতিবাদও করছেন না। খুব কম সংখ্যক মানুষই এখনও পর্যন্ত সংঘর্যে মারা গিয়েছেন—সাত জন। এমনটাও বলা যাবে না যে, ওঁরা সবাই নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষেই মারা গিয়েছেন।
এটা দেখেই হয়তো কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের কেউ কেউ বলছেন, কাশ্মীরে তিন চতুর্থাংশ মানুষ বিশেষ মর্যাদার প্রত্যাহার চেয়েছিলেন। কিন্তু তা যদি হবে, প্রায় মাস দুয়েক পরেও কেন মোবাইল ফোন বা ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখতে হচ্ছে?
আধাসামরিক বাহিনীর এক পদস্থ কর্তা বললেন, মাথাপিছু মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট ডেটা ব্যবহারে কাশ্মীর দেশের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে। মোবাইল নেটওয়ার্ক চালু থাকলে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতানেত্রী থেকে জঙ্গি সংগঠন সকলে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ছেলেমেয়েদের সংগঠিত করে রাস্তায় নামিয়ে আনে।
‘‘আর, তার পরই হয় বিপদ,’’ পানীয়ে চুমুক দিয়ে ওই অফিসার জানালেন, ‘‘ছেলেমেয়েরা পাথর ছোড়ে আর আমাদের ছররা বন্দুক চালাতে হয়। এর প্রধান ক্ষতিটা হল আন্তর্জাতিক স্তরে ‘ব্যাড প্রেস’, ফলে আপাতত ইন্টারনেট চালু না হওযাই ভাল।’’
নেটনির্ভর উপত্যকাকে এর জন্য কী মাশুল দিতে হচ্ছে, উদাহরণ দিলেন ‘কাশ্মীর চেম্বার অব কমার্স’-এর সভাপতি শেখ আসিফ আহমেদ, ‘‘ইন্টারনেট না থাকার ফলে এই বছরে বিদেশের ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগই করা গেল না। ব্যবসাটা মার খেল পুরোপুরি।’’ ব্যবসা বলতে কাশ্মীরি শাল, কার্পেট আর আসবাব রফতানির ব্যবসা। বড়দিন আর নতুন বছরের বরাতটা এই সময়েই আসে ই মেল মারফৎ। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় শুধুমাত্র এই তিনটি ক্ষেত্রেই দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকা লোকসানের আশঙ্কা করছেন চেম্বারের সভাপতি। ওঁর মাথার পিছনের দেওয়ালে দেখলাম, পিন দিয়ে আটকানো রয়েছে জম্মু কাশ্মীরের লাল সাদা পতাকাটি। জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম, ওই পতাকার তো কোনও মূল্যই থাকবে না ৩১ অক্টোবর রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা খারিজ হয়ে যাওয়ার পরে, তখনও কি ওটা অফিসে রাখবেন? কিন্তু সভাপতি অন্য কথা বলতে শুরু করলেন, ‘‘এই লোকসানের ফলে দেড় লক্ষ মানুষ কাজ হারাবেন, এক লক্ষ শুধুমাত্র পর্যটন শিল্পে।’’ কয়েক দিন পর, কলকাতায় ফিরে শুনলাম প্রায় এক প্রতিধ্বনি। মধ্য কলকাতার মিষ্টির দোকানে কেজি দুয়েক নরমপাক কিনতে কিনতে কাশ্মীর পর্যটনের উপ-অধিকর্তা ওয়াসিম রাজা বললেন, ‘‘পুজোয় বাঙালি টুরিস্টই ভরসা। সেটা শেষ।’’
বেকবাগান থেকে সীমান্তবর্তী বারামুলা জেলার সোপোর। ফলের ব্যবসায়িক কেনাবেচার বিশাল বাজার। অবিশ্বাস্য মনে হলেও, দিল্লির আজাদপুরের পর এটাই ভারতের সবচেয়ে বড় ফলের ‘মান্ডি’। শ্রীনগর থেকে ৫০ কিমি দূরের এই বাজারে বহু কষ্টে পৌছে দেখলাম, মান্ডির অধিকর্তা নিজেকে তালা বন্ধ করে রেখেছেন। কথা বলবেন না বলে তাঁর এক ‘মুলাজিম’জানালেন। ছোটখাটো চেহারার সেই মুলাজিমই পরে দয়াপরবশ হয়ে জানালেন, ‘‘গত বছর সোপোর থেকে ভারতের ৯০টি বাজারে আপেল গিয়েছিল, এখন যাচ্ছে নয়টি বাজারে। ওই যে লরিগুলি দেখছেন, ও গুলি এই সিজনে আর চলবে না,’’ ভদ্রলোক বন্ধ করে দিলেন অফিসের দরজা।
বিপদে আপদে অবশ্য ব্যবসাবাণিজ্যে অনেক সময় একটা চাঙ্গা ভাব লক্ষ্য করা যায়। যেমনটা আছে বিলাল আহমেদের ক্ষেত্রে। বিলাল উত্তরপ্রদেশের বিজনৌরের মানুষ, পেশায় ক্ষৌরকর্মী। গত ১৬ বছর ধরে উত্তর শ্রীনগরের হায়দরপোরার বাসিন্দা। সেখানকার গুলবার্গ কলোনির খুপরি ঘরে তাঁর তিন চেয়ারের সেলুন। বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের তিন দিন আগে এক সরকারি বিজ্ঞপ্তি পর্যটকদের ‘ফিরে যাওযার’ পরামর্শ দেওয়ার পরে বিলালের পেশার মানুষেরা বিজনৌর ফিরে যান। ভারতে যেমনটা হয়, এক প্রান্তের মানুষজন অন্য রাজ্যে গিয়ে সেখানে বিয়ে-থা করে ‘সেটল’ হয়ে যান। বিজনৌরের ক্ষৌরকর্মীরা কাশ্মীরের অলিগলিকে ‘ছোটা বিজনৌর’ বানিয়ে ফেলেছিলেন কারণ কাশ্মীরের মানুষ ক্ষৌরকর্ম ছেড়েছেন কয়েক দশক আগে।
গোল বাধালো দোসরা অগস্টের বিজ্ঞপ্তি আর ৫ অগস্টের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের ঘোষণা। দোকানমালিক এসে বিলালকে বললেন, ‘ভাই, তোমাকে রাখি কী ভাবে? যদি দোকানে কেউ ভাঙচুর করে?’’ কলোনির লোকেরা অবশ্য বিলালকে আশ্বস্ত করেন, ‘‘আরে, তুই গেলে চুল কাটব কোথায়? তুই চুপচাপ বসে থাক, সব ঠিক হয়ে যাবে। ওঁদের ভরসাতেই থেকে গেলাম,’’ আয়নার দিকে তাকিয়ে বলছিলেন বিলাল। নিজে থেকে গেলেও বৃদ্ধ পিতাকে অবশ্য পাঠিয়ে দিয়েছেন বিজনৌরে।
বিলালের উদ্বেগ এক ধরনের— কাশ্মীরের প্রতিবেশীদের নিয়ে। আর কাশ্মীরের মানুষের ভয় ৫ অগস্ট পাশ হওয়া বিল নিয়ে, যা এখন আইন...জম্মু কাশ্মীর পুনর্গঠন আইন, ২০১৯। কিছুটা শেখ আব্দুল্লার ভূমি সংস্কারের আদর্শে আর কিছুটা বিশেষ মর্যাদার জোরে কাশ্মীরে বহিরাগতদের জমি কেনাবেচা ও হস্তান্তরের উপরে নিষেধাজ্ঞা চেপেছিল এতদিন, বিভিন্ন রাজ্যস্তরের আইনের মাধ্যমে। ২০১৯-এর আইন এই রাজ্য স্তরের আইনগুলির বিভিন্ন ধারা ও উপধারাকে বিলুপ্ত করে বাইরের লোকের জমি কেনাবেচার উপরে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। এর ফলে কাশ্মীরে নানা প্রশ্নের জন্ম হয়েছে গত এক মাসে। বাইরে থেকে বিলালের মতো কাজ করতে আসা মানুষ কি তবে জমি, বাড়ি কিনে ‘সেটলার’ হয়ে যাবেন? ধীরে ধীরে কাশ্মীরের জনবিন্যাস কি তবে পাল্টে যাবে?
এই ভয় কাটাতে রোজ কাশ্মীরের কাগজে প্রথম পাতায় বিজ্ঞাপন দিচ্ছে রাজ্য সরকার। বলছেন, ‘‘জমি ও সম্পত্তি হারানোর ভয় পাবেন না। মালিকানার পরিবর্তন করা হবে না।’’ তবে এই ভয় থেকে যে প্রতিরোধ গড়ে উঠতে পারে তা কাশ্মীরের মানুষ তো বটেই, প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরাও জানেন। ১৯৮৭-তে এমনটাই হয়েছিল। নির্বাচনের কারচুপিকে কেন্দ্র করে রটে গিয়েছিল ভারত আসছে কাশ্মীর দখল করতে। এর ফলে ১৯৯০-তে গড়ে উঠেছিল জনবিদ্রোহ যা পাকাপাকিভাবে কাশ্মীরকে পৃথিবীর ‘কনফ্লিক্ট ম্যাপ’ এ জায়গা করে দিয়েছে। সেই আশঙ্কা যে এবারেও রয়েছে এমনটা বলেছেন ভারতের সাবেক গোয়েন্দাপ্রধান এ এস দৌলত। ফলে কোনও অবস্থাতেই সশস্ত্র বাহিনীর সংখ্যা কমানোর ঝুঁকি নিতে পারছে না প্রশাসন। ‘‘এই মুহূর্তে কাশ্মীরে যে ফোর্স রয়েছে তা এক কথায় ঐতিহাসিক। অতীতে কোনও সময়ে একসঙ্গে এত বাহিনী উপত্যকায় ছিল না,’’ জানালেন নিরাপত্তাবাহিনীর এক উচ্চপদস্থ কর্তা। তবে মোটামুটিভাবে সরকারপক্ষের লোকজন খুশি যে সংঘর্ষ ও মৃত্যু এড়ানো গিয়েছে ২০১৯-এর কাশ্মীরে।
নিরাপত্তাকর্মী পরিবেষ্টিত এক পুরনো দিনের লাল রং করা ইট আর কাঠের বাড়ির বাগানে বসে কাশ্মীর পুলিশের এক বড়কর্তা বলছিলেন, কেন তাঁরা তাঁদের ‘পারফরমেন্সে’ সন্তুষ্ট। ‘‘২০১৬-য় যখন জঙ্গিনেতা বুরহান ওয়ানি মারা যায়, প্রথম ৩৬ ঘণ্টায় ১৬ জন নিহত হয়েছিলেন। পরের তিনমাসে ১০০ জন। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ হাতের বাইরে চলে গিয়েছিল। এবারে সেটা হয়নি।’’ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার দায়িত্বটা এবার মূলত বর্তেছিল কাশ্মীর পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল স্বয়মপ্রসাদ পাণির উপরে। জম্মু কাশ্মীর ক্যাডারের এই আইপিএস অফিসার যে আপাতত কাজটি ভালই উতরেছেন তা নিয়ে তাঁর বিরোধীরাও একমত। আদতে ওড়িশার মানুষ পাণি দশ বছর কাটিয়েছেন গোয়েন্দাগিরি করে। এনআইএ এবং কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার ইন্সপেক্টর জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরে গত দেড় বছরে দুটি কাজ অন্তত মন দিয়ে করেছেন পাণি। ‘‘একটা হল, যারা ঝামেলা পাকাতে পারে তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া,’’ এই অফিসার জানালেন, ‘‘ব্যাপারটা অনেকটা পুজোর আগে পশ্চিমবঙ্গে সমাজবিরোধীদের তুলে ফেলার মতো।’’
এখানে কিন্তু কাদের তোলা হল সেটা বুঝতে আপনাকে ডাললেক সংলগ্ন যে রাস্তাটা নেকলেসের মতো বেঁকে চশমে শাহি গিয়েছে সেখান দিয়ে হেঁটে রাস্তার বাঁ হাতের হোটেলটাতে যেতে হবে, সেন্টুর। ১৯৯০-এর আন্দোলনের সময় স্থানীয় জনতা, শিকারাওয়ালাদের ঘেরাটোপে প্রায় বন্দি হয়ে পড়েছিলেন রাজীব গাধী। এখন রয়েছেন এমন নেতানেত্রীরা, যাঁরা কিছুদিন আগেও মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। এই মূলস্রোতের নেতারা গণ্ডগোল করতে পারেন এই আশঙ্কায় এদের ‘পাবলিক সেফটি অ্যাক্ট’-এ হোটেলবন্দি করা হয়েছে। শুধু এঁরাই নন, কাশ্মীরের লেখক, শিল্পী, বিদ্বজ্জনদের একটা বড় অংশকে হোটেলবন্দি করা হয়েছে। আসিফ আহমেদ বললেন, তাঁর চেম্বারের সদস্যদেরও আটক করছে পুলিশ। এই লাগাতার গ্রেফতারের সবচেয়ে বড় নেতিবাচক দিক হল গুজব। গ্রেফতারি নিয়ে রোজ নতুন গুজব ছড়িয়ে পড়ছে। কেউ বলছেন, দু’ হাজার মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে তো কেউ বলছেন বিশ হাজার। পুলিশের ওই কর্তা অবশ্য বললেন, ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাত্র দু’হাজার মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে এই সংখ্যাটা বিশ্বাস করা মুশকিল। কেন, তার একটা কারণ বলা যাক।
দক্ষিণ কাশ্মীরের অনন্তনাগে সাদের পুলিশ ফাঁড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়ে একদিন লক্ষ করলাম জনা আট-সাত মধ্যবয়স্ক পুরুষ সেখানে বসে। ঠিক ফাঁড়ির উল্টোদিকের ফুটপাতে। গত কয়েকদিন ধরেই এটা লক্ষ্য করছিলাম, উত্তর থেকে দক্ষিণ কাশ্মীরের সব থানার সামনেই ডজনখানেক মহিলা ও পুরুষ বসে। আমার বন্ধু বললেন, বেশিক্ষণ এখানে বাইক দাঁড় করিয়ে কথা বলা যাবে না। তবু আমরা নামলাম। দাড়িতে হালকা মেহেন্দি করা বছর পঞ্চাশের এক ভদ্রলোক বললেন, গত দু’সপ্তাহ ধরে তাঁরা এখানে বসে রয়েছেন। সকালে আসেন আর বিকেলে পাঁচ কিলোমিটার দূরে তাঁদের গ্রাম বলুবুলে ফিরে যান। এই গ্রামের বছর পনেরোর ছ’টি ছেলেকে পুলিশ তুলে এনেছে সপ্তাহ দুয়েক আগে। তাঁরা বললেন, স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট ছেলেদের ছাড়ার নির্দেশ দিলেও, পুলিশ জানিয়েছে, বুলবুল থেকে ষাটজনকে আসতে হবে মুচলেকা দেওয়ার জন্য। তাঁদের লিখতে হবে যে, ছেলেরা আর পাথর ছুঁড়বে না। ‘‘প্রতিটি ছেলের জন্য ৫০ জন মুচলেকা দেওয়ার লোক এই সময়ে এখানে নিয়ে আসাটা কতটা কঠিন বুঝতে পারছেন?’’ বললেন, মলিন কুর্তা-পাজামা আর কালো জহর কোর্ট পরা এক বৃদ্ধ। পুলিশের এক কর্তা অবশ্য বললেন, কাজটা ‘আইন মোতাবেক’ হচ্ছে। যত বেশি মানুষ মুচলেকা দেবেন, তত বেশি পাথর ছোড়া রোধ করা যাবে। এমন একটা যুক্তিও দিলেন পুলিশকর্তা। দাড়িতে মেহেন্দি করা ভদ্রলোক বললেন, প্রতি রাতেই বাড়ি ফিরে তাঁরা ছেলেদের মায়েদের বলছেন, আর একটা রাত অপেক্ষা করতে।
দু’সপ্তাহের কাশ্মীর সফরে এরকম আরও দুটি অভিজ্ঞতা হল যখন একগুচ্ছ ছেলেকে আটকে রাখা হয়েছে পাথর ছোড়া নিয়ন্ত্রণ করতে। কাশ্মীর শান্ত রাখতে এটাও একটা কৌশল, সম্ভাব্য ‘স্টোন পেল্টার’দের আটকে রাখা। একটা অঞ্চলের এক দল ছেলেকে সপ্তাহখানেক আটকে রাখা, তার পর তাঁদের ছাড়ার পরে আবার এক দলকে আটক করা। এই প্রক্রিয়াকে বলা হচ্ছে ‘রিভলভিং ডোর মেকানিজম’। একটি জাতীয় দৈনিকের সংবাদদাতা বিষয়টি নিয়ে লেখার পরে পুলিশ তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ও তাঁর সোর্স সম্পর্কে জানতে চায় বলে ওই সংবাদদাতা আমাকে জানান। পরে দেখলাম কাশ্মীরের প্রেস ক্লাব এই ‘জিজ্ঞাসাবাদ’-এর বিরোধিতা করে একটি বিবৃতিও দিয়েছে। কাশ্মীরের স্থানীয় কাগজ অবশ্য সরকারি বিবৃতির বাইরে প্রায় কিছুই ছাপছে না। তাদের সম্পাদকীয়তে দেখলাম কখনও হংকং-এর বিক্ষোভ, তো কখনও উপত্যকায় প্লাস্টিক ব্যবহারের অপকারিতা । এ সব নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনা করে ফেরার আগের রাতে প্রেস ক্লাব থেকে বেরনোর সময়েই একটা ঘটনা ঘটল।
প্রেস ক্লাবের সামনেই আড্ডা দিচ্ছিলেন জনা কয়েক সাংবাদিক। পুলিশ এসে জবরদস্তি তাদের প্রেস কার্ড নিয়ে গেল। কোনও কারণ ছাড়াই। সব রিপোর্টার— বড়, মেজ, ছোট সবাই মিলে দৌড়াল ক্লাবের পিছনে কোঠিবাস থানায়। আমিও গেলাম। থানার দরজার দিকে তাকিয়ে বসে রইলাম উল্টো দিকের ফুটপাথে। বসে থাকতে থাকতে আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু, সাংবাদিক হিলাল মির বললেন, ‘‘এই হল কাশ্মীর। বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম, পুলিশ ধরে নিয়ে এল।’’ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে সিগারেট ধরালেন হিলাল, ‘‘বসনিয়ার লেখক আলেকজান্ডার হিম্স লিখেছেন, বসনিয়া পৃথিবীকে দিয়েছে ব্যবহৃত গাড়ির বাজার আর বিষণ্ণতা। আমার মনে হয়, কাশ্মীর দিয়েছে আপেল আর বিষণ্ণতা,’’ তাঁর নিজের গলাও ধরে এল বিষাদে।
এই বিষণ্ণতা, ক্ষোভ ও উদ্বেগ জমতে-থাকা পাহাড়স্তূপ কোনও সমাজের জন্যই যে মঙ্গলজনক নয়, অনস্বীকার্য। এখন উৎকণ্ঠা একটাই...‘নাগ’ আগে ফাটে না দৈত্য আগে পা সরায়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy