Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Poirot

শতবর্ষে বাস্তুহারা এক গোয়েন্দা

ডিমের মতো মাথা, বেঁটেখাটো গড়ন। আদতে বেলজিয়ান, প্রথম মহাযুদ্ধের পর শরণার্থী হিসেবে চলে আসেন ইংল্যান্ডে। নিজের মিলিটারি গোঁফ আর পোশাক নিয়ে খুঁতখুঁতে। শেক্সপিয়র থেকে ভুল উদ্ধৃতি দেন হামেশাই। আগাথা ক্রিস্টির গোয়েন্দা এরকুল পোয়ারো এ রকমই। এ বছরেই তাঁর আত্মপ্রকাশের শতবর্ষ। নিজের কর্মজীবনে বরাবরই নিজের পোশাক, আদব-কায়দা নিয়ে খুঁতখুতে ছিলেন পোয়ারো

জিজ্ঞাসু: এরকুল পোয়ারোর চরিত্রে অভিনেতা কেনেথ ব্রানা, ‘মার্ডার অন দি ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস’ (২০১৭) ছবিতে

জিজ্ঞাসু: এরকুল পোয়ারোর চরিত্রে অভিনেতা কেনেথ ব্রানা, ‘মার্ডার অন দি ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস’ (২০১৭) ছবিতে

দেবাশিস ঘড়াই
শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০২০ ০১:১১
Share: Save:

অগস্ট ৬, ১৯৭৫ সালের ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’। মূল্য ২০ সেন্ট। ‘লেট সিটি এডিশন’-এ আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হল, দিনে ও রাতে অল্প বৃষ্টি হতে পারে। ‘মালয়েশিয়ার সন্ত্রাসবাদীরা অধিকাংশ বন্দিদের মুক্তি দিয়েছে’-সহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ খবরে ঠাসা সে দিনের কাগজের প্রথম পাতা। কিন্তু একদম নীচের দিকে যে খবরটি বেরল, তাতে টলে গেল বিশ্বব্যাপী গোয়েন্দা-কাহিনি পাঠকের মনের ভিত। খবরটার শিরোনাম ছিল—‘এরকুল পোয়ারো ইজ় ডেড; ফেমড বেলজিয়ান ডিটেকটিভ’!

প্রতিবেদক টমাস লাস্ক লিখলেন, ‘বিশ্বখ্যাত গোয়েন্দা এরকুল পোয়ারোর ইংল্যান্ডে মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স কত হয়েছিল, তা জানা যায়নি। ১৯০৪ সালে বেলজিয়ান পুলিশ বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেছিলেন তিনি। পরবর্তী কালে প্রাইভেট ডিটেকটিভ হিসেবে কাজ করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।’ প্রতিবেদনটি আরও জানাল, শেষ বয়েসে পোয়ারোর আর্থারাইটিস হয়েছিল এবং হৃদ্যন্ত্রের অবস্থাও ভাল ছিল না। নিজের কর্মজীবনে বরাবরই নিজের পোশাক, আদব-কায়দা নিয়ে খুঁতখুতে ছিলেন পোয়ারো (অবশ্য শুধু পোশাকই নয়, যে কোনও বিষয়ের ‘ডিসঅর্ডার’-এ ভীষণ বিরক্ত হতেন পোয়ারো। তাঁর মতে একটি মুরগির ভিন্নাকৃতির ডিম পাড়ার বিষয়টি একদমই সমর্থনযোগ্য নয়। অসম আকৃতির পাউরুটিও খেতে চাইতেন না তিনি।)। তাই অসুস্থ থাকাকালীনও বাইরে যেতে হলে বয়স যাতে বোঝা না যায়, তাই তিনি পরচুলা ও কৃত্রিম গোঁফ ব্যবহার শুরু করেছিলেন।

প্রতিবেদনটি শেষ হল সংবাদপত্রের ১৬ নম্বর পাতায়। আর ওই প্রতিবেদনের মাধ্যমেই ডিম্বাকৃতি মাথার এরকুল পোয়ারো হয়ে উঠলেন প্রথম সাহিত্য চরিত্র, যাঁর মৃত্যুসংবাদ সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় প্রকাশিত হল। প্রতিবেদনটি এও জানাল, পোয়ারোর রচয়িতা আগাথা ক্রিস্টি কোনও মন্তব্য করতে চাননি এই মৃত্যু নিয়ে।

কেন? তিনি কি বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন পোয়ারোর উপরে? ক্রিস্টির বক্তব্য অবশ্য তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে। একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরে পাঁচ ফুট চার ইঞ্চির উচ্চতাসম্পন্ন, শেক্সপিয়রকে হামেশাই ভুল ‘কোট’ করা, অহঙ্কারী, মিলিটারি ধাঁচের গোঁফ নিয়ে ভীষণ স্পর্শকাতর পোয়ারো সম্পর্কে আগাথা ক্রিস্টির মূল্যায়ন ছিল,—‘ডিটেস্টেবল, বোম্বাস্টিক, টায়ারসাম, ইগোসেন্ট্রিক লিটল ক্রিপ’! কিন্তু তার পরও পোয়ারোকে নিয়ে লেখা থামাতে পারেননি আগাথা ক্রিস্টি। কারণ, শার্লক হোমস অধ্যুষিত জগতেও পোয়ারোর উত্তুঙ্গ জনপ্রিয়তা, যা শতবর্ষ পরে, এই ২০২০ সালেও অমলিন!

উদ্বাস্তু পুলিশ অফিসার এবং গোয়েন্দা

‘রাস্তাভর্তি মানুষ। এ যেন অন্তহীন মানুষের ঢল।’ জার্মানির আক্রমণে ত্রস্ত বেলজিয়ান নাগরিকদের দেশ ছাড়ার বর্ণনা দিয়ে নিজের ‘ওয়র ডায়েরি’-তে লিখলেন আইরিন নোগরা নামে এক মহিলা। তারিখটা ১৯১৪ সালের ২৩ অগস্ট। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে প্রায় ১০ লক্ষ বেলজিয়ান নাগরিক জার্মান অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে ইংল্যান্ড-সহ একাধিক দেশে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। অল্পবয়সি, যুবক, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ, অসুস্থ মানুষের ভিড়ে উপচে পড়েছিল রাস্তা। সকলেই যে গন্তব্যে পৌঁছতে পেরেছিলেন তা নয়, বয়স নির্বিশেষে অনেকের মৃত্যু হয়েছিল রাস্তাতেই (করোনা সংক্রমণের সময়ে এখন যেমনটা হচ্ছে পরিযায়ী শ্রমিক ও শরণার্থীদের ক্ষেত্রে)। প্রায় আড়াই লক্ষ বেলজিয়ান উদ্বাস্তু আশ্রয় নিয়েছিলেন শুধু ইংল্যান্ডেই। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তাঁদের সম্পর্কে এখনও পর্যন্ত বিশেষ কিছু জানা যায়নি। শুধু তাঁদের প্রতিনিধি হিসেবে থেকে গিয়েছেন দাম্ভিক সেই এরকুল পোয়ারোই! বেলজিয়াম সরকারের ‘ফরেন অ্যাফেয়ার্স, ফরেন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ সাম্প্রতিক এক গবেষণার উল্লেখ করে জানাচ্ছে, বাস্তবে জ্যাক হর্নেস নামের এক বেলজিয়ান পুলিশ অফিসারের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই ক্রিস্টি গড়ে তুলেছিলেন পোয়ারোকে। জার্মান আক্রমণের সময়ে অন্যদের মতোই দেশ ছেড়েছিলেন হর্নেস। খুব সম্ভবত টর্কে শহরে ক্রিস্টির সঙ্গে দেখা হয়েছিল তাঁর। পরে ক্রিস্টি যখন তাঁর গোয়েন্দা চরিত্র নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেন, হয়তো তাঁর হর্নেসের কথা মনে পড়েছিল। যদিও এর সত্যতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। ক্রিস্টি বলে যাননি পোয়ারো আসলে কে, আত্মজীবনীতে শুধু লিখেছিলেন, ‘আমার হঠাৎ করেই বেলজিয়ান উদ্বাস্তুদের কথা মনে পড়ল।...তা হলে গোয়েন্দাকে এক জন বেলজিয়ানই করা যাক? হাউ অ্যাবাউট আ রিফিউজি পুলিশ অফিসার?

এই চিন্তাসূত্র ধরেই এক উদ্বাস্তু গোয়েন্দা প্রথম বার ঢুকে পড়লেন আর পাকাপাকি জায়গা করে নিলেন ইংরেজি সাহিত্যে। এমনকি, শার্লক হোমসের সর্বময় উপস্থিতি সত্ত্বেও। শার্লক যেখানে ছিলেন ভিক্টোরীয় ইংল্যান্ডের মূর্ত প্রতীক, পোয়ারো সেখানে শেকড়-ছেঁড়া উদ্বাস্তু!

চেয়ারে হেলান দিয়ে চিন্তা

প্রথম উপন্যাস বেরল ১৯২০ সালে। ‘দ্য মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার্স অ্যাট স্টাইলস’। ২০২০ সেই আত্মপ্রকাশেরই শতবর্ষ। উপন্যাসে স্টাইলস কোর্টের ধনী মালকিন খুন হয়েছিলেন। সন্দেহের তালিকায় মহিলার সম্পদের লোভে তাঁকে বিয়ে করা নতুন স্বামী, সন্তান, ডাক্তার, ভাড়াটে সঙ্গী, সবাই রয়েছেন। আসল খুনি কে, সে রহস্য উদ্ঘাটন করলেন পোয়ারো। লেখাটি অবশ্য ১৯১৬ সালেই শেষ করেছিলেন ক্রিস্টি। তখন তিনি স্থানীয় হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবী নার্স। কাজের সুবাদেই নানা ধরনের বিষ ও তার প্রয়োগ সম্পর্কে অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছিলেন। প্রথম উপন্যাসে বিষের প্রয়োগ ও তার সমাধানে পোয়ারোর ‘লিটল গ্রে সেলস’-এর সামনে তিনি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন পাঠককে। সেই যে পোয়ারোর হাত ধরলেন ক্রিস্টি, গোয়েন্দা-সাহিত্যে পোয়ারো-যুগের সূত্রপাত হল।

‘দ্য মার্ডার অব রজার অ্যাকরয়েড’-এ (১৯২৬) ‘কিংস অ্যাবট’-এর এক মহিলার অস্বাভাবিক মৃত্যু। জনশ্রুতি, নিজের স্বামীকে খুন করেছিলেন মহিলা। কারণ, তাঁর সঙ্গে ধনবান রজার অ্যাকরয়েডের গোপন সম্পর্ক ছিল। ব্ল্যাকমেলের ভয়েই মহিলা আত্মহত্যা করেছিলেন বলে চর্চা শুরু হল। কিন্তু ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে না ঘুরতে খুন হলেন অ্যাকরয়েডও। সম্পত্তির উত্তরাধিকার, গোপন সম্পর্ক, চুরি, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রহস্যের সমাধানে নামলেন পোয়ারো। সমাধানও করলেন।

‘মার্ডার অন দি ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস’-এ (১৯৩৪) আবার প্রবল তুষারপাতে আটকে পড়া ট্রেনের কামরায় রহস্যজনক ভাবে একটি খুন। রহস্যের সমাধানে নেমে পোয়ারো দেখতে পেলেন, বেশ কয়েকজন একজোট হয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে খুন করেছেন। কিন্তু কেন? সেই কারণ অন্বেষণ ও তার সমাধানই পোয়ারোকে আরও জনপ্রিয় করে তুলল। কিন্তু তাতে কী? ‘দ্য এবিসি মার্ডারস’-এ (১৯৩৬) পোয়ারোকে এক সিরিয়াল কিলারের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হল। চিঠি পাঠিয়ে খুনি চ্যালেঞ্জ দিল, সে খুন করবে! ক্ষমতা থাকে তো পোয়ারো তাকে আটকে দেখান। শুরু হল এক বাঘবন্দি খেলা। শেষ পর্যন্ত অপরাধ ও অপরাধীকে ডিকোড করতে সফল হলেন পোয়ারো।

কিন্তু যত সাফল্য এসেছে, ততই রহস্যবৃত্তে জড়িয়ে পড়েছেন পোয়ারো। নীল নদের উপরে ভ্রাম্যমাণ এক ক্রুজ়ে একটি খুন হয়। পুলিশের সন্দেহভাজনদের তালিকায় একাধিক যাত্রী। কিন্তু তার পর খুনের বৃত্ত ক্রমশই বাড়তে থাকে। ‘ডেথ অন দ্য নাইল’-এ (১৯৩৭) শেষ পর্যন্ত খুনির সন্ধানে নামতে হয় পোয়ারোকে। যেমন ভাবে তাঁকে নামতে হয়েছিল ‘ইভিল আন্ডার দ্য সান’-এও (১৯৪০)। ইংল্যান্ডের বিলাসবহুল রিসর্টে খুন হল সদ্য বিবাহিত এক তরুণী। রিসর্টে থাকা কোটিপতিদের মধ্যেই কি খুনি লুকিয়ে? এক জন কোটিপতিকে খুনি প্রমাণ করাটা সহজসাধ্য কাজ নয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও পোয়ারোর এক ও অদ্বিতীয় সঙ্গী তাঁর ধূসর মস্তিষ্ককোষ।

শুধু ‘লিটল গ্রে সেলস’-এর ব্যবহারই কি পোয়ারোকে এত জনপ্রিয় করে তুলেছিল? ‘‘মনে হয় না’’, বলছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ‘গোল্ডেন এজ ডিটেকটিভ ফিকশন’ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ক্রিস্টেল ডেভাডসন। ক্রিস্টেলের কথায়, ‘‘রহস্য সমাধানের জন্য বাইরের জগতে দিশাহীন ভাবে সূত্র খোঁজার থেকে নিজের চিন্তাজগতে তোলপাড় চালিয়ে রহস্যের সমাধানের চেষ্টা করতেন পোয়ারো। সেটাই তাঁকে জনপ্রিয়তার আসনে বসতে সাহায্য করেছে।’’

‘ফাইভ লিটল পিগস’-এ (১৯৪২) নিজের তদন্তের ‘মেথডিক্যাল অ্যাপ্রোচ’ নিয়ে পোয়ারো নিজেই বলছেন, রহস্যের সমাধানের জন্য ‘পায়ের ছাপের মাপ নেওয়া, সিগারেটের টুকরো খোঁজা বা ঘাস পরীক্ষার প্রয়োজন নেই আমার। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চিন্তা করাটাই যথেষ্ট।’ আবার ‘দ্য মিস্ট্রি অব দ্য ব্লু ট্রেন’-এ (১৯২৮) আত্মম্ভরী পোয়ারো বলছেন, ‘আমার নাম এরকুল পোয়ারো, সম্ভবত আমিই বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা’!

রহস্য সমাধানে চিন্তাসূত্র ওলটপালট করে দেখা বা এই ‘নির্মল’ আত্মম্ভরিতা ছাড়াও আরও অনেকগুলো কারণ পোয়ারোর তুমুল জনপ্রিয়তায় অনুঘটকের কাজ করেছে বলে মনে করেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী ক্রিস্টেল। তাঁর মতে, ‘‘পরিবার জীবনের প্রতি ‘কমিটমেন্ট’ (যার প্রকাশ ঘটেছিল প্রথম উপন্যাসেই), নবীনদের প্রতি, বিশেষ করে নবীন যুগলের প্রতি তাঁর প্রচ্ছন্ন স্নেহ (‘এলিফ্যান্টস ক্যান রিমেমবার’), ব্যক্তি-শ্রেণি নির্বিশেষে নির্দোষের পাশে দাঁড়ানো (‘কার্ডস অন দ্য টেবল’) সহ একাধিক বিষয় পোয়ারোর আবেদনের সঙ্গে জড়িত।’’

তবে পোয়ারোর তদন্তসূত্র খোঁজা ও তাঁর পর্যবেক্ষণের ক্ষমতাকে একেবারে আলাদা ভাবে ব্যাখ্যা করছেন ইংল্যান্ডের রিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অব সাইকোলজি অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল ল্যাংগোয়েজ সায়েন্সেস’-এর ‘সেন্টার ফর অটিজ়ম’-এর ‘নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড মেন্টাল হেলথ’-এর অধ্যাপক ভীষ্মদেব চক্রবর্তী। তিনি জানালেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, গোয়েন্দার মধ্যে— সে তিনি কাল্পনিক হন বা বাস্তবের— কোনও ঘটনার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের একটা বাড়তি ক্ষমতা থাকে।

ভীষ্মদেবের কথায়, ‘‘এনহ্যান্সড অ্যাটেনশন-এর এই প্রবণতা অনেক সময় অটিজ়ম-আক্রান্তদের মধ্যে দেখা যায়। বিশেষ পর্যবেক্ষণের এই ক্ষমতা জিনের মাধ্যমে আসতে পারে। তার পর পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির উপরে নির্ভর করে সেই ক্ষমতা বাড়তে পারে। পোয়ারোর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।’’ হয়তো সে কারণেই ‘আফটার দ্য ফিউনেরাল’-এ (১৯৫৩) মানুষের মনস্তত্ত্ব ও চরিত্র সম্পর্কে বলতে গিয়ে পোয়ারো জানান, তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, কোনও ব্যক্তিকে যে কোনও বিষয় নিয়ে দীর্ঘ ক্ষণ ধরে কথা বলাতে পারলে একটা সময়ে সংশ্লিষ্ট মানুষের আসল চরিত্রটা বেরিয়ে আসবে।

তবে এ সবের সঙ্গে শরণার্থী ও বহিরাগত হওয়াটাও রহস্য সমাধানে পোয়ারোকে একটা বাড়তি সুবিধা দিয়েছে বলে মনে করেন কিরেন টেলর। ইংল্যান্ডের স্টার্লিং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক কিরেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন বেলজিয়ান উদ্বাস্তুদের সম্পর্কে গবেষণা করছেন। পোয়ারো ও বেলজিয়ান উদ্বাস্তুদের যোগসূত্র সম্পর্কে কিরেনের মত, ‘‘ক্রিস্টি সচেতন ভাবেই পোয়ারোকে এক জন বেলজিয়ান উদ্বাস্তু হিসেবে তুলে ধরেছিলেন। যাতে তাঁর প্রতি পাঠক সমব্যথী হন। তা ছাড়া উদ্বাস্তু হওয়ার সুবাদে, এক জন বহিরাগত হিসেবে পোয়ারো কোনও ঘটনাকে একেবারে নির্মোহ ভাবে বিশ্লেষণ করতে পারতেন। ওটাই ওঁর ইউএসপি!’’

এ বার বর্তমানে...

সাম্প্রতিক করোনা-পরিস্থিতিতে শতবর্ষের পোয়ারো যেন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। রাষ্ট্রপুঞ্জের হাই কমিশনার ফর রিফিউজি-র তথ্য, কোভিড-১৯’এর জন্য বিশ্ব জুড়ে প্রায় সাত কোটি মানুষ ‘ডিসপ্লেসড’, তার মধ্যে ২ কোটি ৬০ লক্ষই উদ্বাস্তু। যেমনটা ছিলেন পোয়ারোও। কিন্তু নিজে শিকড়ছিন্ন হলেও পোয়ারো তাঁর ক্ষুরধার বুদ্ধির মাধ্যমে নিজস্ব ছাপ রেখে যেতে ভোলেননি।

আসলে যুদ্ধ হোক, দেশভাগ বা কোভিড-১৯-এর মতো অতিমারি, সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন তো প্রান্তিক মানুষেরাই— উদ্বাস্তু, শরণার্থীরাই। রাষ্ট্রের কাছে হয়তো তাঁরা নিছকই সংখ্যা, কিন্তু আসলে তাঁরা জীবনের লড়াইয়ে পিছু না হটা মানুষ! ইতিহাস কখনও সেই লড়াইকে মনে রাখে, কখনও ভুলেও যায়। কিন্তু ‘পোয়েটিক জাস্টিস’-এর হাত ধরে সেই মানুষেরাই প্রাণ পান সাহিত্যে। আগাথা ক্রিস্টির মতো লেখক পোয়ারোকে দিয়ে নিজের অজান্তেই যেন ইতিহাসের ফাঁক ভরাট করে দেন। ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায়ের কথায়, ‘‘১৯১৪ সালের বেলজিয়ান উদ্বাস্তুদের সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। বেলজিয়ান উদ্বাস্তু বলতে প্রথমেই যে নামটা মাথায় আসে, তা এরকুল পোয়ারোর।’’

পোয়ারো কোনও এক জন নির্দিষ্ট শরণার্থী নন। তিনি বিশ্বব্যাপী উদ্বাস্তু-বহিরাগতদের প্রতিনিধি, যাঁকে চাইলেও উপেক্ষা করা যাবে না। আত্মপ্রকাশের শতবর্ষ পরেও উদ্বাস্তু ও শরণার্থীদের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠের উপেক্ষা অগ্রাহ্য করে তিনি বলবেন, ‘আমার নাম এরকুল পোয়ারো, আমিই বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা।’

অন্য বিষয়গুলি:

Poirot Detective
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy