রামময়: গায়ে জড়ানো চাদরে, সারা মুখে লেখা রামনাম। দেওয়ালে জুড়েও সেই একই ছবি
ধু ধু করছে মহানদীর চর। বালি থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রির উত্তাপ। নদীর পশ্চিম পাড়ে গ্রাম, মহাবৃক্ষের সারি তেতে ওঠা বাতাসে ঝালরের মতো দুলছে। বালির ওপর দিয়ে বয়ে চলা নদীর জল সীমিত ত্রিভুজে আবদ্ধ হয়ে আছে নদীর পুব পাড় ঘেঁষে। জলের ওপর ভেসে আছে খানকয় মোষের চওড়া পিঠ। একটা কাক সেই পিঠগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে উড়ছে অনিশ্চিত ভাবে। সবই যেন তপ্ত এই সমসময়ের একান্ত প্রতীক।
মোষগুলোর কাছাকাছি জলজ ত্রিভুজের বাহুটাকে ভূমি ধরলে, ত্রিভুজের শীর্ষবিন্দুতে স্নান সেরে উঠে এসেছেন পাঁচ ফুট উচ্চতার ন্যাড়ামাথা এক বৃদ্ধ। তাঁর ভেজা শরীর জুড়ে ঝকমক করছে দুই অক্ষরের একটা শব্দ— ‘রাম’। একটা ‘রাম’ শব্দের ‘র’ উল্কি আঁকতে তিনটে ছুঁচ শরীরে কুড়ি বার ফোটানো হয়। এই মানুষটির ব্রহ্মতালু থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত বিছিয়ে থাকা কয়েকশো রামনাম কত বার এবং কত ভাবে ওঁকে বিদ্ধ করেছে, তা নির্ণয় করা খুব কঠিন।
তিন দিন ধরে মহানদী সংলগ্ন পূর্ব ছত্তীসগঢ়ের বহু গ্রাম তোলপাড় করে অবশেষে খুঁজে পাওয়া গেল মানুষটিকে। নাম মেহতর রাম। কয়েকশো রামনাম শরীরে ধারণ করা এই মানুষটি আদ্যন্ত নাস্তিক। ছত্তীসগঢ় ও মহারাষ্ট্রে ছড়িয়ে থাকা প্রায় কুড়ি হাজার মানুষের যে রামনামি সম্প্রদায়— মেহতর রাম যে সম্প্রদায়ের এক জন অধ্যক্ষ— তার সকল সদস্যই নাস্তিক। শুধু তাই নয়, যে মুহূর্তে প্রথম ‘রাম’ শব্দের ‘র’ লেখার জন্য ভেষজ কালিমাখা তিনটে ছুঁচ প্রথম তাঁর শরীরে বিঁধেছিল, সেই মুহূর্তেই হিন্দু মেহতর রুইদাস মরে গিয়ে নাস্তিক মেহতর রাম জন্ম নেন বলে ওঁর বিশ্বাস। নাস্তিকতায় জীবন বদল এই রামনামি সম্প্রদায়ের দর্শন। শরীরে ধারণ করা রামনাম হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে, অশিক্ষা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে, ভ্রষ্ট মেরুকরণের বিরুদ্ধে রামনামিদের প্রত্যক্ষ অস্ত্র। অজস্র মানুষের সতেজ বেঁচে থাকার মন্ত্র এটাই।
বালির ওপর শুকোতে দেওয়া একটা চাদর, তাতেও সারি সারি রামনাম লেখা। সেই চাদর, আর ময়ূরের পালক গাঁথা একটা মুকুট হাতে তুলে নিয়ে মেহতর রাম ওঁর সঙ্গে আসতে বললেন। কিছুটা এগোতেই একটা গ্রাম— উড়কাকান। গ্রামের একেবারে শেষে একটা বাড়ির উঠোনে বিশাল হাঁড়িতে ধান সেদ্ধ হচ্ছে। সেটা পেরোতেই ধবধবে সাদা একটা স্তম্ভ ঘিরে শ’দুয়েক মানুষের সমাবেশ। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় এঁদের শ্রেণি-অবস্থান এক। পুরুষ-নারী নির্বিশেষে প্রত্যেকের গায়ে চড়ানো উড়নিতে সারিবদ্ধ রামনাম। মেহতর রাম-এর মতো সর্বাঙ্গে না হলেও প্রত্যেকের সারা মুখে বা কপালের মধ্যিখানে উল্কি করা রামনাম। সাদা স্তম্ভটার চূড়া থেকে গোড়া পর্যন্ত প্রতিটি রাম শব্দের ব্যাপ্তি ও বিস্তারও এক। চতুর্দিকে আশ্চর্য এক রামময় সমাজ—লম্বা রাম, বেঁটে রাম, স্মিতমুখ রাম, ঈষৎ সন্দিহান রাম, কুণ্ঠিত রাম, ফোকলা হাসির রাম। একটা শামিয়ানার ছায়ায় রামচরিতমানস খুলে গোল হয়ে বসেছেন অনেকে। অনুচ্চ সুর ছড়িয়ে পড়ছে দুপুরের রোদ্দুরে। গায়কদের বৃত্তের বাইরে উড়নি হাওয়ায় উড়িয়ে ছন্দে ছন্দে দুলে যাচ্ছেন এক সা-জোয়ান। তাঁর পায়ে বাঁধা ঘুঙুর, আকাশের দিকে তোলা মুখে রামনামের আঁকিবুকি। দু’চোখ বোজা। এই ভিড়, দৃশ্য ও শব্দকল্প একযোগে কী চাইছে?
রামনামিদের মন্দির নেই, বিগ্রহ নেই, ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই। ‘রাম’ তাদের কাছে এমন এক সমাজের প্রতীক যেখানে শ্রেণি ও লিঙ্গবৈষম্য নেই, কুশাসন নেই, অশিক্ষা নেই, ধর্মের গোষ্ঠীবদ্ধতা নেই। গানের দল গাইছে ‘নাহি দারিদ্র সম দুখ জগমোহি’, দারিদ্রের চেয়ে বড় দুঃখ জগতে নেই। ঠিক এই পদটাই ‘ঢোঁড়াইচরিত মানস’-এ তাৎমাটুলির মন্দিরে গাওয়া হত না? পৃথিবীর সমস্ত শোষিত মানুষেরই বুঝি রয়ে গেছে ঈশ্বরহীন, অ-ভাববাদী এক সমাজে বিশ্বাস, যেখানে মানুষ বড় কাঁদলে বা একাকী হলে মানুষই তার পাশে এসে দাঁড়ায়।
বুদ্ধের যুগেও বর্ণাশ্রম প্রথা মেনে চলা ব্রাহ্মণ্যবাদীদের বিরুদ্ধে মাথা তুলেছিলেন রাজনৈতিক ভাবে অবহেলিত সাধারণ মানুষ, সমাজে যাঁরা ছিলেন ‘ওয়ার্কিং ক্লাস’। বুদ্ধের সঙ্ঘ প্রকারান্তরে এই শ্রেণিশোষণের চেহারাটা প্রকাশ্যে আনে। বুদ্ধ থেকে চৈতন্যদেব পর্যন্ত দু’হাজার বছর এই মানুষদের নেতৃত্ব দিয়েছেন এমন কেউ যিনি নিজে উচ্চবর্ণের লোক। তাঁর পক্ষে তথাকথিত নিম্নতর শ্রেণির মানুষকে এককাট্টা করা কিছুটা সহজ ছিল। কিন্তু চৈতন্যদেবের চেয়ে বয়সে অল্প বড় কবীরের পক্ষে এই কাজ ততটা সহজ ছিল না। কারণ তিনি উচ্চবর্ণের কেউ নন, নিতান্তই অন্ত্যজ। শ্রেণি অবস্থানের খাতিরে বাকিরা যত সহজে তাঁদের কথা সবাইকে শোনাতে পারতেন, সেটাই করতে গিয়ে কবীরকে একটা আস্ত সমাজ-আন্দোলন শুরু করতে হল। পনেরোশো শতকের শেষ দিকে শুরু হল তাঁর ভক্তি আন্দোলন।
কবীর সরাসরি বললেন, ব্রাহ্মণ তার চার বেদের মধ্যে ডুবে মরে গেছে। তাই ব্রাহ্মণ্য সমাজব্যবস্থা অচল। তাঁর সাহসী দর্শন সহজবোধ্য করার জন্য কবীর ব্যবহার করলেন এক ধ্বনিময় প্রতীক। এই প্রতীক হল নামগান। ঈশ্বরের নাম করতে করতে ও তাঁর কথা ভাবতে ভাবতে ঈশ্বরকে নিজের মধ্যে ধারণ করার স্বাধীনতা। কবীর একে বললেন নির্গুণ ভক্তি, কারণ তাঁর ঈশ্বরের কোনও রূপ নেই, মানুষের বোধ-এর মধ্যেই ধরা পড়ে তাঁর স্বরূপ। আর এই ঈশ্বরকে নিজের মধ্যে দেখতে পান যিনি, তিনিই পরম ব্রাহ্মণ। তা তিনি জোলা-কুমোর-চাষা যা-ই হোন না কেন। কবীর জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে ব্রাহ্মণত্বের এই পরম অবস্থার নাম দিলেন ‘রাম’। প্রাচীন মহাকাব্যের চরিত্র এ ভাবেই একটা আধ্যাত্মিক রূপ পেল। কবীরপন্থীদের প্রথম শাখা স্থাপন করলেন তাঁর সাক্ষাৎ শিষ্য ধর্মদাস, আজকের ছত্তীসগঢ়ে। কারণটা সহজ। কবীরের আবেদন যাঁদের কাছে সর্বাধিক, সেই অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষের ভিড় সেখানে বেশি। এই কবীরপন্থীরাই প্রথম দাবি তুললেন, তাঁরা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ধর্মসম্প্রদায়, হিন্দুধর্মের সঙ্গে তাঁদের কোনও সম্পর্ক নেই। এ দিকে অন্ত্যজদের মধ্যে ‘রাম’-এর মারকাটারি প্রভাব দেখে বর্ণহিন্দুরাও রামকে আত্মসাৎ করতে নড়েচড়ে বসলেন। কবীরের প্রায় একশো বছর পরে সহজবোধ্য অওয়ধি বুলিতে তুলসীদাস লিখলেন রামচরিতমানস। ১০৭৩ পঙ্ক্তি এবং ১২,৮০০ লাইনের এই কবিতায় তুলসীদাস তুলে ধরলেন তার নিজের ভাষায় এক রামকে,যিনি একই সঙ্গে সগুণ ও নির্গুণ। অযোধ্যার নিছক কোনও রাজপুত্র নন। তুলসীদাসের ‘রামচরিতমানস’ ভারতের এখন যা হিন্দি বলয় তাকে কাঁপিয়ে দিল, আধ্যাত্মিকতা সরিয়ে এক আটপৌরে জীবনবোধ রামচরিতের দিকে মানুষকে টেনে নিল। বিশেষত অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষ, যাঁদের অধিকাংশই পড়তে জানেন না, তাঁরাও শ্রুতিতে গেঁথে নিলেন রামচরিত। বঞ্চিত মানুষের কাছে রাম হয়ে উঠলেন ন্যায়বিচারের প্রতীক।
এটাই ভারতবর্ষ। বাল্মীকির সংস্কৃত রামায়ণে শম্বুকবধ, সীতাবিসর্জন থাকলেও অওয়ধি ভাষার তুলসীদাস বা তামিল ভাষায় কম্বন রামায়ণে তা নেই। এ বার ১৮২০ সাল নাগাদ এক কবীরপন্থী— নাম ঘাসিদাস, জাতে চামার, জন্ম রায়পুরের কাছে গিরোধ গ্রামে— রামকে তাঁর আধ্যাত্মিকতার খোলস ছাড়িয়ে একেবারে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতির মধ্যে নামিয়ে আনলেন। তুলসীদাস রামের যে অবয়ব নির্মাণ করেছেন, ঘাসিরামের মনে হল তা এক জন সৎ মানুষের প্রোফাইল, এবং সামাজিক ভাবে সেই সৎ মানুষকে যোগ্য সঙ্গত করার জন্য ঘাসিরাম তাঁর লোকজনকে বললেন মদ-মাছ-মাংস ছেড়ে দিতে। অন্ত্যজদের প্রতি বর্ণহিন্দুদের বিতৃষ্ণার কারণগুলো বিশ্লেষণ করে ঘাসিদাস ঘোষণা করলেন, তাঁর লোকজন আর মরা পশুর চামড়া ছাড়ানোর মতো কাজ করবে না, চাষের কাজে গরু-বলদ খাটাবে না, এবং সকলেই কণ্ঠিমালা নেবে। এ ভাবে রাম ও হরি একত্র মিশিয়ে কবীরপন্থীদের মধ্যে ঘাসিরাম তৈরি করলেন এমন এক সম্প্রদায় যারা সমাজে শুচিতার প্রশ্নে বর্ণহিন্দুদের চেয়ে কোনও অংশে কম শুদ্ধ নয়, যাদের কাছে রাম এক জন সৎ মানুষের নাম। ঘাসিরামের এই সম্প্রদায়কে দেগে দেওয়া হল ‘সৎনামি’ নামে। বর্ণাশ্রম প্রথায় এঁদের জন্য যে কাজ নির্দিষ্ট করা হয়েছে তা করতে অস্বীকার করে এই সৎনামিরা রীতিমতো সমাজবিদ্রোহ শুরু করলেন। শুচিতার প্রশ্নে উচ্চবর্ণকে চ্যালেঞ্জ করে হয়ে উঠলেন হিন্দি বলয়ের এক প্রধান রাজনৈতিক শক্তি।
কবীরের মতোই গাঁধীরও প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল সহজবোধ্য কিছু প্রতীকের। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দেশে ফিরে নিরক্ষর মানুষের মধ্যে ‘স্বরাজ’ বস্তুটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বেশ ফাঁপরে পড়লেন। যাদের ইতিহাসচেতনা নেই তাদের শ্রুতিতে গাঁথা কাব্যচেতনায় তিনি বাধ্য হয়েই ঘা দিলেন। বোঝালেন, স্বরাজ আসলে তুলসীদাস বর্ণিত রামরাজ্য। স্বাধীনতা পেলেই ভারতে প্রতিষ্ঠা হবে এমন এক রাজ্য যেখানে রামরাজ্যের মতোই শ্রেণিবৈষম্য ও লিঙ্গবৈষম্য থাকবে না, ধনী-দরিদ্র ভেদ বিলুপ্ত হয়ে এক সুষম সমাজ তৈরি হবে। রামরাজ্যের স্বপ্নে অন্ত্যজ শ্রেণির বিরাট একটা অংশ গাঁধীজির সঙ্গে চলল, সৎনামিরা তো বটেই। গাঁধীর রাম আর আজকের হিন্দুত্ববাদীদের রাম আদপেই এক নন। বাঙালি লেখক সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘ঢোঁড়াইচরিত মানস’-এও আমরা পড়েছি কী ভাবে অলৌকিক উপায়ে বিলিতি কুমড়োর খোসায় ‘গানহী বাওয়া’-র ‘মূরত’ নিজে থেকেই আঁকা হয়ে গিয়েছে, আর তাৎমাটুলির তাৎমা বা তাঁতিরা জেনে গিয়েছে গানহী বাওয়া ‘সাদি বিয়া করে নি, নাঙ্গা থাকে বিলকুল’। রামের আদলেই তাৎমাটুলির ঢোঁড়াইয়ের মানসযাত্রা লিখেছিলেন সতীনাথ।
পূর্ব ছত্তীসগঢ়ের চরপাড়া গ্রামে ১৮৭০ সাল নাগাদ জন্মান পরশুরাম। সৎনামি, জাতিতে চামার। নিজের চেষ্টায় তিনি পড়ালেখা শেখেন, বন্ধুদের মধ্যে রামচরিতমানস পাঠ ও ব্যাখ্যা তাঁর একটা নেশা হয়ে দাঁড়ায়। ১৯০৭ সালে এক দিন চণ্ডালের বই পড়ার স্পর্ধা দেখে রাগে উন্মত্ত হয়ে দশরথ সিংহ নামের এক জমিদার দলবল নিয়ে পরশুরাম ও তাঁর নিরীহ শ্রোতাদের উত্তমমধ্যম দেন। সবাইকে স্তম্ভিত করে পরশুরাম এই অপমানের বিচার চেয়ে রায়পুর আদালতে নালিশ ঠুকলেন।
১৯১২ সালের ১২ অক্টোবর আদালতের রায়ে দশরথ সিংহ সদলবলে জেলে গেলেন। আর ব্রিটিশ সম্রাজ্ঞীর হয়ে ‘সেশন্স জজ’ ঘোষণা করলেন, এই দিন থেকে ভারতের যে কোনও মানুষকে যে কোনও উপায়ে উপাসনা করার আইনি অধিকার দেওয়া হল।
ভারতের রাজনৈতিক আকাশে গাঁধীর উদয় হওয়ার তিন বছর আগে উচ্চবর্ণকে আদালতে টেনে নিয়ে গিয়ে অন্ত্যজের এই আইনি লড়াইয়ে যুগান্তের ইঙ্গিত ছিল। সরকারি রক্ষাকবচকে অস্ত্র করে পরশুরাম অন্ত্যজদের বাঁচার মতো বাঁচতে পারার একটা উপায় ভাবতে বসলেন। পরশুরামকে ঘিরে তাঁর স্বজাতি অর্থাৎ চামাররা সৎনামিদের মধ্যেই একটা উপসম্প্রদায় তৈরি করলেন। পরশুরামের প্রথম কাজই হল দলের সবাইকে লিখতে ও পড়তে শেখানো। সবাই এর পর মেতে উঠলেন ‘রামচরিতমানস’ সংস্কারের কাজে। যে-যে পঙ্ক্তিতে তাঁদের মনে হল যে তুলসীদাস ধনীকে বেশি অধিকার দিয়েছেন বা নারীকে পুরুষের চেয়ে দুর্বল করে দেখিয়েছেন, সেগুলো কেটে দিয়ে এঁরা নতুন করে লিখলেন। এই সাহস ভারতবর্ষের মুখ্য, গৌণ কোনও সম্প্রদায় বা উপসম্প্রদায় দেখিয়েছে বলে আমার অন্তত জানা নেই। উড়কাকান গ্রামে ঝাঁ-ঝাঁ রোদ্দুরে এক চিলতে শামিয়ানার নীচে যে ‘রামচরিতমানস’ পড়া হচ্ছিল, তা এই সংশোধিত সংস্করণ। একে বলা যেতেই পারে সামাজিক সাম্যপ্রার্থী মানুষের রাজনৈতিক ইস্তাহার। এই ইস্তাহার অনুযায়ী রাম হয়ে দাঁড়ালেন সাম্যের প্রতীক। আর রাম বা সাম্য তাঁদের একমাত্র কাম্য, ঘোষণা করে পরশুরাম ও তাঁর দলবল হয়ে গেলেন ‘রামনামি’।
পরশুরাম বুঝেছিলেন, লিঙ্গবৈষম্য থেকে গেলে কোনও জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখতে পারে না। তাই ছত্তীসগঢ়ে প্রচারিত গুহ নামের এক অন্ত্যজ গোষ্ঠিপতি এবং শবরী নামের এক অচ্ছুত বেদেনির প্রেমকথায় ভর করে তিনি রূপ দিলেন আদর্শ রামনামি পরিবারের। যে কোনও রামনামি পরিবারে স্ত্রী ও স্বামী নিজেদের পরিচয় দেন নারী-পুরুষ হিসেবে। অর্থাৎ সামাজিক সম্পর্কের বাইরেও স্বামী এবং স্ত্রীর পুরুষ এবং নারী হিসেবে পৃথক ও নিজস্ব অস্তিত্ব থেকেই যাচ্ছে। বাড়িতে অতিথি এলে স্বামী এবং স্ত্রী উভয়েই নিঃসঙ্কোচে দু’হাতে অতিথির দু’হাত চেপে ধরে ঘরে নিয়ে যান। পরশুরাম নিশ্চিত ভাবে জানতেন, আদালত যা-ই বলুন না কেন, তাঁরা যা করে চলেছেন তা সমাজবিদ্রোহ, তাঁদের নাস্তিকতা ও সাম্যবাদ এ দেশের মানুষের খুব সহজে হজম হওয়ার কথা নয়। তাঁরা বুঝলেন, এই বিদ্রোহকে চারিয়ে দিতে হলে বিদ্রোহীকে একটা ব্যতিক্রমী, চাক্ষুষ রূপ দিতে হবে, যাতে এক হাট লোকের মধ্যে দিয়ে তিনি হেঁটে গেলেও সহজেই সকলের চোখে পড়েন, লোকে তাঁকে দেখিয়ে বলতে পারে— দেখো, ওই মানুষটি এক জন নাস্তিক, সাম্যবাদী, রামনামি।
চাক্ষুষ রূপদানের প্রথম উপকরণটি হল ‘অঙ্কিত’ বা উল্কি। ছত্তীসগঢ়ের অধিকাংশ আদিবাসী সমাজেই মেয়েদের বিয়ের আগে উল্কি আঁকানো আবশ্যিক। সম্ভবত তাঁদের দেখেই পরশুরাম তাঁর কপালের মাঝখানে ‘রাম’নাম উল্কি করান। ফলে মননে তো বটেই, শরীরেও এক জন রামনামি হয়ে ওঠেন রাম বা সাম্যের প্রতীক। ১৯৩৯ সালে রামপ্রিয়াবাই নামের এক ভদ্রমহিলা প্রথম সারা শরীর জুড়ে উল্কি আঁকান। তখন থেকেই রামনাম উল্কি করে নাস্তিকতায় দীক্ষা নেওয়া রামনামিদের আনুষ্ঠানিক রেওয়াজ হয়ে দাঁড়ায়। সমস্ত শরীরে রামনাম উল্কি করান যিনি, তাঁকে তাঁরা বলেন ‘পূর্ণনাক্ষিক’। পাঁচ বছর আগে প্রথম যখন যাই, তখন মেহতর রাম-সহ মোট সাত জন পূর্ণনাক্ষিক বেঁচে ছিলেন। এখন সংখ্যাটা তিন। জরুরি অবস্থা ঘোষণার ঠিক আগে ছত্তীসগঢ়ের এই অঞ্চলে (তখন কিছুটা মধ্যপ্রদেশ, কিছুটা ওড়িশা) গ্রামীণ অর্থনীতি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল (১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল যথাক্রমে ২২% ও ৩০%)। রামনামি পরিবারের বহু ছেলেমেয়েকে কাজের খোঁজে শহরে যেতে হয়। উল্কিময় শরীরের জন্য সেখানে কী ধরনের অত্যাচার তাদের সহ্য করতে হয় তা সহজেই অনুমেয়। সেই থেকে রামনামি পরিবারের ছেলেমেয়েরা বাহুর ভিতর দিকে একটি মাত্র রামনাম লেখানো নিরাপদ মনে করছেন। তাদের বাস্তববোধসম্পন্ন সমাজও এতে আপত্তির কিছু দেখছে না।
ব্যতিক্রমী দেহসাজের দ্বিতীয় উপকরণটি ‘উড়নি’ বা চাদর। সুতির সাদা থানের ওপর কাঠকয়লা ও বটের আঠা দিয়ে সার সার রামনাম লেখার কাজটা এঁরা নিজেরাই করে থাকেন। তৃতীয় উপকরণ— ‘মুকুট’— কঞ্চির কাঠামোয় সুতো জড়িয়ে তার উপর ময়ূরের পালক গুঁজে নিজেরাই তৈরি করেন। চতুর্থ উপকরণটি ‘ঘুঙরু’ বা ঘুঙুর। রামনামিদের প্রাণ বাঁধা গানে। যেহেতু এঁদের বাহ্যিক কোনও রকম ধর্মযাপন নেই, তাই সবাই মিলে সুর করে ‘রামচরিতমানস’ গাওয়া এঁদের জমায়েতের আবশ্যিক শর্ত, প্রায় সংস্কারের মতো। গানের সঙ্গতের জন্য এক থোকা ঘুঙুর অধিকাংশ রামনামিই সব সময় কাঁধের উপর বিছিয়ে রাখেন। গান কখন কোথায় ডাকে, বলা তো যায় না!
এ হেন চেহারা ও ভূষণ নিয়ে পথে নির্বিকার হেঁটে যেতে হলে ঠিক কতটা সাহসী হতে হয় তা ভাবতেই হৃৎকম্প হতে পারে। অথচ ভাটগাঁও-এর হাট থেকে সারংগড়গামী বাসের ভিড়ে দেড়ফুটি মুকুট মাথায় নিয়ে পঁচাশি বছরের বৃদ্ধা পুনিয়াবাই রাম অবলীলায় মিশে যান। এই স্মার্টনেস রামনামিদের বিশ্বাসের সঙ্গে যায় ভাল। প্রথম থেকেই এঁদের অন্তরাত্মা সঙ্কোচহীন, সংশয়রহিত। গাঁধীর রামরাজ্যের স্বপ্ন এঁদের চেয়ে বেশি আর কেউ বোঝেননি। আবার গাঁধীরই ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে যোগ না দিয়ে এবং ব্রিটিশ বিচারব্যবস্থার উপর আস্থা রেখে সৎনামি সম্প্রদায় থেকে বেরিয়ে আসতে এঁদের এতটুকু বাধেনি। সমাজের সমস্ত কুপ্রথার বিরুদ্ধে তাঁদের লড়াইয়ের অস্ত্রগুলো অতি সরল কিন্তু শাণিত। যেমন ধরা যাক জাতপাতের বিরুদ্ধে লড়াই। যে কোনও রামনামি নামের শেষে ‘রাম’ পদবি ব্যবহার করেন। আবার সাবালক বা সাবালিকা হওয়ার পর কাছারিতে গিয়ে পয়সা খরচ করে যার যেমন পছন্দ একটা পদবি নামের সঙ্গে জুড়ে নেন। যেমন মেহতর রাম ট্যান্ডন, পিয়ারাম বাই সাক্সেনা, পীতাম্বর রাম ব্যানার্জি, দশরথ রাম পটেল। এর তাৎপর্য: ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, বণিক, সবাইকে অন্তত আলঙ্কারিক ভাবে জাতপাতহীন সাম্য-সমাজের চৌহদ্দিতে নিয়ে আসা। অতি সারল্যমাখা অথচ মোক্ষম প্রতিঘাত!
এই সময়েও পূর্ব ছত্তীসগঢ়ের লাল ধুলো ওড়া রাস্তায় রামনামিরা শিরদাঁড়া টানটান রেখে হেঁটে বেড়াতে পারেন। তাঁদের দর্শন ধুলোর মতোই প্রত্যক্ষ, সেখানে অনুমানের কোনও জায়গা নেই। সারসিমা, কারতোঁয়া, ভাটগাঁও, গিধৌরির মতো অজস্র গ্রামে সাদামাটা স্তম্ভ ঘিরে বসে এঁরা এখনও গেয়ে চলেন সাম্যের গান। যৌথ সমাজ ও সচেতন মন এঁদের মোক্ষ। কদাচিৎ কোনও রামনামি পরিবারে দুটির বেশি সন্তান দেখেছি। জীবনযাপনের মান ন্যূনতমতেই বেঁধে রেখে একটি রামনামি পরিবার সন্তানদের কলেজে পাঠাবেই। কোনও মতে সাক্ষর রামনামি পিতার মেয়ে কলেজে কম্পিউটার সায়েন্স পড়াচ্ছে— এমন দৃষ্টান্ত এই ছোট্ট সমাজে খোঁজ করলেই পাওয়া যায়। সত্তরের দশকে অভাবের তাড়নায় ত্রিবেণীর ইটভাটায় মজুরের কাজ করেছেন লীলাবতী ও তাঁর স্বামী মনোজ রাম। এই দম্পতির মেয়ে কামদা ক’বছর আগে ছিলেন ছত্তীসগঢ় বিধানসভার কনিষ্ঠ সদস্য, আর নাতনি জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী। গোটা ছত্তীসগঢ় জুড়ে খোঁজ করলে দেখা যাবে স্কুলগুলোয় জনসংখ্যার অনুপাতে রামনামি পরিবার থেকে আসা শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা বহুগুণ বেশি। এক প্রজন্মে এরা পেরিয়েছেন তীব্র অভাব, দ্বিতীয় প্রজন্মে উঠে এসেছেন পাকা দালানকোঠায়। সরল জীবনযাপন ও প্রখর বাস্তববোধ তাঁদের সমস্ত নৈরাশ্য থেকে আড়াল করে রেখেছে। বহু রাত রামনামি পরিবারের উঠোনে খাটিয়ায় শুয়ে শুনেছি, গানের বিরতিতে কথা চলছে— এ বার কার কত বিঘে জমিতে আমনের চাষ হল, সেচের জল পাওয়া না গেলে কী কর্তব্য।
এক শীতের ভোরে পীতাম্বর রামের সঙ্গে হেঁটে পেরোচ্ছিলাম মহানদী। অনেকটা বালি পেরিয়ে বরফঠান্ডা জলের একটা সরু স্রোত। অঙ্কিত, উড়নি, মুকুট, ঘুঙরু নিয়ে পীতাম্বর জলে নামলেন, জল ডিঙিয়ে ও পারের বালির উপর উঠে দাঁড়ালেন। তার পর পিছন দিকে ফিরে দু’হাত ছড়িয়ে দিলেন দু’দিকে। বললেন, ‘‘আমার শরীরের এই উল্কিগুলো আমার এই সত্তর বছরের জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত। এই যে রামনামগুলো, এদের কোনওটা আঘাত, কোনওটা আদর। এই যে আমাকে দেখছ, বলতে পারো— এটাই রামায়ণ।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy