Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

কাশ্মীর থেকে পাড়ি দিত সম্প্রীতির ক্যারাভান

দু’বছর অন্তর ঘোড়া, ইয়াক, খচ্চরের পিঠে সোনাদানা, দুর্মূল্য পশমিনা, জাফরান, আখরোট, আপেল নিয়ে পাহাড়ি পথে কয়েক মাস পর মালবাহকেরা পৌঁছত তিব্বতের রাজধানী লাসা। দলাই লামার উদ্দেশে অর্ঘ্য। ক্যারাভান-চালকেরা প্রায় সকলে মুসলমান। বিধর্মীর ছোঁয়ায় বৌদ্ধ ভিক্ষুর অর্ঘ্য অপবিত্র হবে, এমনটা তখন ভাবতেই পারত না কেউ।দু’বছর অন্তর ঘোড়া, ইয়াক, খচ্চরের পিঠে সোনাদানা, দুর্মূল্য পশমিনা, জাফরান, আখরোট, আপেল নিয়ে পাহাড়ি পথে কয়েক মাস পর মালবাহকেরা পৌঁছত তিব্বতের রাজধানী লাসা। দলাই লামার উদ্দেশে অর্ঘ্য। ক্যারাভান-চালকেরা প্রায় সকলে মুসলমান। বিধর্মীর ছোঁয়ায় বৌদ্ধ ভিক্ষুর অর্ঘ্য অপবিত্র হবে, এমনটা তখন ভাবতেই পারত না কেউ।

আবাহন দত্ত
শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

লাদাখের রাজধানী লেহ থেকে দক্ষিণে ৬০ কিলোমিটার গেলে ছোট জনবসতি মিরু। সেখান থেকে গিয়ার দূরত্ব বেশি নয়, বারো কিলোমিটার। এখনকার লেহ-মানালি হাইওয়ে ধরে গেলে মিনিট পনেরো। চল্লিশের দশকে ওটুকুই যেতে সময় লাগত গোটা একটা দিন। যাতায়াতে ঘোড়া, খচ্চর ও ইয়াকই ছিল একমাত্র ভরসা। তা-ও না মিললে পয়দল।

‘‘কাল রাতে মিরুতে আমাদের ঘড়িগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বোধহয় উচ্চতার কারণে। মাটিতে ছায়া দেখে আমরা সেগুলোকে মিলিয়ে নিচ্ছি। এখন বিকেল ৫টা। আমরা ১টা নাগাদ গিয়া-তে পৌঁছেছি।’’ শব্দগুলো লেখা ছিল আব্দুল ওয়াহিদ রাধুর ডায়েরিতে। তারিখ ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৪২। শ্রীনগরের ইংরেজি স্কুল আর আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার পর পারিবারিক পেশায় যোগ দেন ওয়াহিদ। ১৯৪২ সালেই প্রথম বার রওনা হন ‘লোপচাক ক্যারাভান’ নিয়ে। একে সরকারি অভিযান বলা যেতে পারে। প্রতি দু’বছর অন্তর লাদাখের রাজধানী লেহ থেকে এই ক্যারাভানেই প্রচুর উপহার যেত তিব্বতের রাজধানী লাসায়— দলাই লামার জন্য।

রাধুরা আসলে হিন্দু ব্রাহ্মণ, ত্রাকৌ পদবির কাশ্মীরি পণ্ডিত। কবে ইসলামে ধর্মান্তরিত হন তাঁরা, মনে নেই তাঁদেরও। বিশ শতকে ব্যবসা করলেও, তিনশো বছর আগে ধর্মপ্রচারের কাজেই লাদাখে পা রেখেছিলেন শেখ আসাদ রাধু। এই ভ্রাম্যমাণ বাণিজ্য শুরু করেন তাঁর ছেলে ফারুখ রাধু। লাদাখের রাজকুমার ‘গিয়ালপো’-র সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল ফারুখের। লাদাখিরা তাঁকে ‘ফোরোকপা’ বলে ডাকতেন। ‘ফোরোকপা’র বাড়ি ছিল তিব্বতি ঢঙের। যদিও হিসেব অনুযায়ী লাদাখে মুসলিমরা সংখ্যালঘু, তা বলে তাঁদের ‘বিদেশি’ ভাবতেন না কেউ। বহু শতক ধরেই বৌদ্ধ আর মুসলিমরা মিলেমিশে থেকেছেন এখানে। মিশে গিয়েছে দুই ধর্মের সংস্কৃতিও। গ্রামাঞ্চলে রাধুদের ডাকা হত ‘আখোন পা’ নামে। বৌদ্ধ ও মুসলমান, উভয়েই ব্যবহার করতেন এই ডাক। ইসলাম ধর্মের শিক্ষক ‘মোল্লা’দের এই নামে ডাকা হয় মধ্য এশিয়ায়। ওয়াহিদের নানা, হাজি মহম্মদ সিদ্দিকেরও চেহারা, পোশাক লাদাখি। গৃহসজ্জা তিব্বতি। মাথার সাদা পাগড়িই কেবল আলাদা করে চিনিয়ে দিত তাঁকে।

সমন্বয়ের এই ছবি বহন করত লোপচাকও। মুসলমান পরিচালিত ক্যারাভানটি ছিল দলাই লামার প্রতি লাদাখি বৌদ্ধদের সরকারি শ্রদ্ধা। ক্যারাভানে দু’-তিন জন যুবক থাকত যারা তিব্বতি গুম্ফায় শিক্ষানবিশ হিসেবে ভর্তি হত।

লোপচাক ক্যারাভানের রাস্তায় গিয়া-ই শেষ গ্রাম যেখানে মানুষের স্থায়ী বসতি আছে। তার পরেই পশ্চিম তিব্বতের বিশাল মরুভূমি। প্রকৃতি সেখানে নিষ্ঠুর। এই নিষ্ঠুরতার সাক্ষী লোপচাকও। ১৯৩২ সালে তিব্বতের চাংথাং মরুভূমিতে যে তুষারপাত হয়েছিল, স্মরণকালের মধ্যে তা সবচেয়ে বেশি। এই অবস্থায় খচ্চরের পিঠে প্রচুর জিনিস চাপিয়ে লাসা থেকে রওনা হন ওয়াহিদের বাবা খাজা আব্দুল করিম। সঙ্গে জনা চারেক আত্মীয়। কৈলাস পবর্তের কাছাকাছি পুরু বরফে আটকে পড়ে খচ্চরগুলি। একে একে তুষারসমাধি হয় সব ক’টিরই। কোনও মতে লাসা ফেরেন আব্দুল করিমরা। জিনিসপত্র সবই পড়ে থাকে মরুভূমিতে, তুষারের গভীরে। এ বার সেই রাস্তাতেই ঠিক উল্টো মুখে, নভেম্বরের কঠিন ঠান্ডায় ক্যারাভান নিয়ে চলেছেন ওয়াহিদের কাকা খাজা আব্দুল আজিজ। গিয়া থেকে রওনা হয়ে রুপসুর পথে তাঁরা পৌঁছন তাকলাং গিরিপথের পায়ের কাছে জারা-য়। এখান থেকেই ঢুকে পড়তে হয় তিব্বতের গারতোক এলাকায়। পাঁচ হাজার মিটার উচ্চতায় অসুস্থ হয়ে পড়েন আব্দুল আজিজ। প্রবল মাইগ্রেন আর ঝিমুনি ভাব। তবে অসুখটা চেনা, তাই ভয় হয় না বিশেষ।

বরং অনেক বেশি ভয় মানুষকে। তারা পরিচিত কাজাখ বা ‘হাসাকাপা’ বলে। সিনকিয়াং থেকে শুরু করে তারা তখন ঢুকে পড়েছে তিব্বতের উচ্চ মালভূমিতেও। তদানীন্তন সোভিয়েট ইউনিয়নে ধর্মের কারণে অত্যাচারিত হওয়ার ভয়ে পালিয়ে এসেছে চিনে। প্রাথমিক ভাবে পশুচারণ করতেই চাংথাং মরুভূমিতে এসেছিল হাসাকাপা-রা। অচিরেই সংঘাত হয় মরুভূমির অবিসংবাদিত প্রভু তিব্বতি আদিবাসীদের সঙ্গে। পাল্লা দিয়ে বাড়ে ক্যারাভান লুঠ করার প্রবণতা, এমনকি খুনের মতো ঘটনাও।

পাশাপাশি: দলাই লামার দাদা গিয়ালো থোন্ডুপের সঙ্গে আব্দুল ওয়াহিদ রাধু

তবে এটাই সার সত্য নয়। ওয়াহিদের ডায়েরিতে উঠে এসেছে অন্য ছবিও। তিব্বত বলতেই সেখানে সাদর আতিথেয়তার চিত্র। বা তিব্বতিদের ঐতিহ্যে জড়িয়ে থাকা নানান আচার ও রীতিনীতি। ক্যারাভান নতুন কোনও গ্রামে পৌঁছলেই তাঁদের আপ্যায়নের ভার নেন গ্রামপ্রধান ‘গোপা’। ওয়াহিদদের থাকা খাওয়া-সহ পুরো দায়িত্ব তখন তাঁর। অতিথিদের জন্য অর্ঘ্যের ডালি সাজিয়ে স্থানীয় মানুষেরা মাতেন ‘কালচোর’ উৎসবে। দেওয়া হয় দুধ, তিব্বতি পানীয় ‘ছাং’ আর শুকনো ফল, চাল বা ময়দা দিয়ে তৈরি নুড্ল— ‘সাম্পা’। আদিবাসীদের এলাকা পেরোলে তাঁবুর বদলে পাকাবাড়ি চোখে পড়তে থাকে। সেখানে অভ্যর্থনা আরও জাঁকজমকে ভরা। গারতোক পৌঁছতেই স্থানীয় লামার দুই প্রতিনিধি এসে ওয়াহিদদের গলায় পরিয়ে দেন উত্তরীয়— ‘খাদা’। এই পথে চলতে চলতে চোখে পড়ে অসংখ্য ‘চোর্তেন’ বা বৌদ্ধ স্তূপ। তাদের সম্মান জানিয়ে প্রত্যেকটি চোর্তেনের বাঁ দিক দিয়ে পেরিয়ে যায় ওয়াহিদদের ক্যারাভান। গারতোক পৌঁছনোর পরেই তিব্বত সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি ‘আতুং’ আসেন ক্যারাভানকে পথ চেনাতে। সেখান থেকেও কুড়ি দিনের পথ লাসা। এই পথেই ২৯ অক্টোবর কৈলাস পর্বতের পাদদেশে মানস সরোবরের কাছে পৌঁছয় লোপচাক। লাদাখি বৌদ্ধদের এই তীর্থস্থান তাঁদের কাছেও শ্রদ্ধার, জানান ওয়াহিদ। ডায়েরিতে লিখছেন, ‘খুব কষ্ট করে হলেও আমরা এগোচ্ছি। আমাদের চারপাশে যে পাহাড়গুলো ঘিরে আছে, সেগুলো পৃথিবীর বলে মনে হয় না। আমরা এখন চলেছি এশিয়ার সবচেয়ে পবিত্র স্থানগুলির দিকে।’

জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি শিগাৎসে পৌঁছয় লোপচাক ক্যারাভান। বড় শহর। জীবন তাই এখানে খানিক কম কষ্টের। একটু আরাম পান ওয়াহিদরাও। শহরে পৌঁছনোর অনেক আগে থেকেই ক্যারাভানকে অভ্যর্থনা জানাতে রাস্তার আশপাশের গুম্ফা থেকে বেরিয়ে আসেন লামারা। রাস্তার দু’ধারে জিভ বার করে দাঁড়িয়ে থাকেন চাষিরা। অতিথিদের অভ্যর্থনা জানানোর তিব্বতি রীতি যে ওটাই! পাঞ্চেন লামার তাশিলুংপো গুম্ফার কাছে সরকারি অতিথিশালায় ওঠেন ওয়াহিদরা। লাসা সরকার নিয়োজিত স্থানীয় গভর্নর জেনারেল ‘শি-জং’য়ের সঙ্গে দেখা হয় আব্দুল আজিজ আর ওয়াহিদের। ফের এগোয় ক্যারাভান। আর দু’দিনের পথ লাসা। পথে এক সময় পৌঁছন দ্রেপুং গুম্ফায়। ৭৭৭৭ জন লামার বাস সেখানে। তাঁদের মধ্যে থেকে এগিয়ে আসেন লাদাখিরা। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা যুগ যুগ ধরে এ ভাবেই অভ্যর্থনা জানান হাজি মহম্মদ সিদ্দিকদের। তার পর আসেন লাসার মুসলমানরা। শোভাযাত্রা চলতে থাকে রাজধানীর রাস্তায়।

তিব্বতি নববর্ষ ‘মোনলাম’ উৎসবে সাততলা পোতালা প্রাসাদের বিশাল দরবারে দলাই লামাকে সম্মান জানাতেন সরকারি আধিকারিকেরা। এমনকি, মোনলাম উপলক্ষে এক মাসের জন্য প্রশাসনিক ক্ষমতাও তুলে দেওয়া হত ভিক্ষুদের হাতে। দ্রেপুং, গান্ডেন ও সেরা— তিন বৌদ্ধ মঠের লামারাই তখন সরকার চালাতেন। বৌদ্ধদের সঙ্গে নতুন বছরের উৎসবে শামিল হতেন মুসলিমরাও। হাজির থাকতেন ব্রিটিশ, নেপালি, ভুটানি,

চিনা প্রতিনিধিরা। আর থাকতেন লোপচাক ক্যারাভানের প্রতিনিধিরা।

এই উৎসবেই লাদাখি বৌদ্ধদের তরফে দলাই লামাকে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করত লোপচাক। উপহারের ডালিতে থাকত সোনাদানা, জাফরান, কাশ্মীরি শাল, সিনকিয়াংয়ের হরেক পোশাক আর তিব্বতের শুকনো আখরোট। দরবারে যোগ দিতে গেলে সাজপোশাকেরও নিয়মকানুন আছে। লাদাখি মুসলমান হিসেবে ওয়াহিদরা পরতেন সাদা পাগড়ি। লোপচাকের প্রধান হিসেবে আব্দুল আজিজ পরনের ‘গস’ বা ‘শুবা’-র (কোট) উপর চাপাতেন কারুকাজ করা শাল। তাঁর ঘোড়ার জিনে দু’টো লাল পমপম লাগানো হত, যাতে বোঝা যায় তিনি উচ্চপদে অধিষ্ঠিত। নিয়ম অনুযায়ী, লোপচাক ছিল চতুর্থ স্তরে। লোপচাক প্রধানের সহকারী হিসেবে ওয়াহিদের সঙ্গে থাকতেন এক জন বৌদ্ধ দেহরক্ষী। তাঁর মাথায় লাদাখের চিরাচরিত উঁচু মখমলের টুপি। পোতালা প্রাসাদের দরজায় থাকতেন দলাই লামার দেহরক্ষীরা। তাঁদের হাতে লোহার মুগুর আর চাবুক। অভ্যাগতদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হলে সামলানোর দায়িত্ব তাঁদেরই। দর্শকদের প্রতিটি আসনই পূর্বনির্ধারিত। ওয়াহিদের ডায়েরিতে লেখা, ‘নিজের চোখে দেখলাম, কেউ এক পা এগোতেই রক্ষীরা ঢুকে পড়ল, অল্পবিস্তর মারধরও করল। সে ক্ষেত্রে তার সামাজিক স্তরও মান্যতা পেল না।’

দরবারে সবাই চুপ, সিংহাসনে পা ভাঁজ করে বসে চতুর্দশ দলাই লামা। সে সময়ে তাঁর বয়স মাত্র আট। দরবারের উচ্চপদস্থ সরকারি আধিকারিকদের দৃষ্টি ওই বালকের উপরেই। সিংহাসনের দু’দিকে দাঁড়িয়ে সুসজ্জিত দুই রাজপ্রতিনিধি। একে একে আসতেন মন্ত্রী, করণিক ও সাধারণ মানুষ। সকলের গায়ে আনুষ্ঠানিক পোশাক, মাথায় সোনার মুকুট। পূর্ববর্তী দলাই লামার পরিজনেরা আসতেন তাঁদের শ্রেণি অনুযায়ী। আসতেন অভিজাতবর্গ। সিংহাসনের বাঁ দিকে বসতেন ব্রিটিশ, নেপালি ও চিনা প্রতিনিধিরা। এর পর ধূপের ঘন ধোঁয়ার মধ্যে শুরু হত অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের আদবকায়দা ঠিকমতো বজায় রাখতে না পারলে রক্ষীদের প্রহার জুটত নিয়মভঙ্গকারীর কপালে। তবে সব ছাপিয়ে থাকত বৌদ্ধ, মুসলমান, ব্রিটিশ, চিনা— নানান ধর্ম ও জাতির মানুষের অনন্য সম্মিলন। তিব্বত এমনই উদার। সকলকে কাছে টেনে নেয়। তাই ওয়াহিদের প্রিয় শহর লাসা।

১৯৫১। চিনা কমিউনিস্ট জেনারেল, চাং চিং-ইয়ু আসবেন বলে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ছিলেন স্থানীয়েরা। আপ্যায়নের চেয়ে কৌতূহলটাই মুখ্য। কিন্তু হতাশ হলেন তাঁরা। কোনও সাজগোজ, জাঁকজমক নেই, সাধারণ কালো ইউনিফর্ম, মাথায় মাও ক্যাপ। সঙ্গীদেরও একই পোশাক। কমিউনিস্ট অনাড়ম্বরে মন ভরল না তিব্বতিদের।

ওই উৎসবমুখরতা, আড়ম্বরের জায়গাটাতেই ধাক্কা দিয়েছিল চিনা কমিউনিস্টরা। আভিজাত্যপ্রেমী ধর্মতন্ত্রের বদলে ধর্মহীন সমানাধিকার প্রতিষ্ঠাই তাদের লক্ষ্য। বলা হয়েছিল, তিব্বতকে শোষণের হাত থেকে মুক্ত করে তাকে মাতৃভূমি চিনের সঙ্গে অচ্ছেদ্য ভাবে জুড়ে দিতে চায় লাল চিন। বৃহৎ প্রতিবেশীর চাপে ভেঙে পড়ে তিব্বতি সরকার। যে শাসক শ্রেণি, অভিজাতবর্গ, কাশাগ (মন্ত্রিসভা) এত দিন রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্য প্রতিনিয়ত লড়াই করত, তারা পিছিয়ে এসে সব ক্ষমতা সমর্পণ করে দলাই লামার হাতে। ফলস্বরূপ ১৯৫১ সালে ২৩ মে তিব্বতের ‘শান্তিপূর্ণ মুক্তি’ ঘটে। স্বাক্ষর হয় সতেরো-দফা চুক্তি। এর ভিত্তিতেই নির্ধারিত হয় ভবিষ্যতের চিন-তিব্বত সম্পর্ক। ক্রমে মুছে যেতে থাকে তিব্বত, প্রভাবশালী হয়ে ওঠে চিন।

চল্লিশের দশকের গোড়ায় গোটা বিশ্ব যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ধুঁকছে, সে খবর তখন তিব্বতে পৌঁছয়নি। কোথায় হিটলার, কোথাই বা যুদ্ধ—লোপচাক ক্যারাভানের মাথাব্যথা বলতে তখন প্রবল ঠান্ডা আর হাসাকাপা-রা। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়া আর ক’দিনই বা এড়িয়ে থাকা যায়? অচিরেই তিব্বতে ঢুকে পড়ল বহির্বিশ্বের হাওয়া। কমিউনিস্টরা বলেছিল, তিব্বতকে ‘সংস্কার’ করতে হবে। তাই লাসায় তৈরি হতে থাকল বড় বড় ব্যারাক। বানানো হল হাসপাতাল, স্কুল। তিব্বতে ঢুকল আধুনিক পোশাক, ভোজ্য তেল, নানা রকমের খাবার, ঘড়ি, ওষুধ, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষার যন্ত্র। আর আঘাত নেমে এল চিরাচরিত প্রথার উপর। যে ধর্মবিশ্বাসে অনন্ত কাল ধরে বেঁচেছে তিব্বতিরা, তাকে বলা হল কুসংস্কার। একটু একটু করে ভেঙে দেওয়া হল গোটা তিব্বতি সমাজব্যবস্থাটাই।

ওয়াহিদ তা বুঝতেন। ঐতিহ্য আর প্রথাকে বাঁচিয়ে রাখার পাঠটা তিনি শিখেছিলেন নানা হাজি মহম্মদ সিদ্দিকের কাছে। ‘আধুনিক’ ও ‘পশ্চিমি’ শিক্ষার কড়া বিরোধী ছিলেন নানা। অন্দরসজ্জা, পোশাকআশাক, লেখাপড়া, সব কিছুতেই ঐতিহ্যের পথে হাঁটার পরামর্শ দিতেন ওয়াহিদকে। এমনকি তাঁর নিজের শহর লেহ ছেড়ে শ্রীনগরে ‘আধুনিক’ লেখাপড়া করতে যাওয়ার ব্যাপারটা ভাল মনে নেননি তিনি। তখন ওয়াহিদ ভাবতেন, জীবনে এগোতে গেলে পুরনো রীতিনীতি ঝেড়ে ফেলতে হবে। ব্রিটিশ আধিকারিকদের সাজপোশাক দেখে মুগ্ধ হতেন তিনি। কিন্তু বড় হতে হতে বুঝতে থাকেন, কোন জিনিসগুলো মুছে যাচ্ছে জীবন থেকে। ছেলেবেলায় মক্তবে ধর্মের পাঠের পরে ভর্তি হয়েছিলেন লেহ শহরের সেকেন্ডারি স্কুলে। সেখানে শিক্ষকতা করতেন ব্রাহ্মণ কাশ্মীরি পণ্ডিতেরা। আর ছাত্রদের অনেকেই মুসলমান। সবাই মিলেমিশে ছিলেন একসঙ্গে। ধর্মের শিক্ষাটাও নানার কাছেই পেয়েছিলেন ওয়াহিদ। তাই বৌদ্ধদের নিজের মনে করতে অসুবিধে হয়নি তাঁর। কিন্তু তিব্বত তো তখন কঠোর। ‘বৈজ্ঞানিক’ মার্ক্সবাদ ছাড়া কিছু গ্রহণ করে না। প্রিয় শহর লাসা ছেড়ে তাই পালালেন ওয়াহিদ।

ওয়াহিদের তিব্বতে ধর্মের অনুশাসনটাই মানানসই ছিল। তা নিয়ে মানুষের ক্ষোভ ছিল না, কারণ সে নিয়মের মধ্যেও তাঁরা ছিলেন নিজেদের মতো করে। কষ্ট ছিল, কিন্তু তা লাঘব করার জন্য নাস্তিক অনুপ্রবেশের প্রয়োজন ছিল না। সকলে তো ভালবেসে পাশাপাশিই ছিলেন। দ্বেষ, হিংসা, অনাচার বরং সেখানে ঢুকল পাশ্চাত্য থেকে আমদানি করা তত্ত্বের হাত ধরে। আধুনিক ‘বৈজ্ঞানিক’ মনোভাব তাঁদের শেখাল লাভ, মুনাফা। বদলে গেল চিরাচরিত রীতি, পোশাক, সংস্কৃতি। নিজস্ব খারাপগুলো হয়তো গেল, সঙ্গে ধুয়ে গেল নিজস্ব সমস্ত ভালও।

এক দলের সম্বল দলাই লামার ছবি। তাঁরা বৌদ্ধ। ছিলেন ওয়াহিদের মতো মুসলমানরাও। সেই আঠারো শতক থেকেই তো লাসায় মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে বিখ্যাত লাসা মসজিদ। বৌদ্ধ প্রতিবেশীদের গায়ে গায়ে, বেঁধে বেঁধেই ছিলেন মুসলমানরা। আর এক দলের সম্বল জেনারেল মাও বা চৌ এন-লাই’এর ছবি। সমাজতন্ত্র তাঁদের জীবনের ভিত্তি। তাঁরা গুঁড়িয়ে দিলেন সব ধর্মকেই। শ্রেণিহীন, ধর্মহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হল তিব্বতে। তা বড্ড বেমানান, বিদেশি ঠেকল! মাঝখান থেকে ধর্মতন্ত্রকে ভাঙতে গিয়ে সম্প্রীতিটাও ভেঙে খানখান হয়ে গেল। চিনের জনবসতিতে পরিষ্কার, বৌদ্ধরা থাকেন লাসা ও পাশ্ববর্তী অঞ্চলে। আর বেশির ভাগ মুসলমান থাকেন আরও দূরে, মধ্য এশিয়ার অন্দরে ঝিনজিয়াং প্রদেশে।

তবু ভারত ব্যতিক্রম। ওয়াহিদের কাশ্মীরে আজও জুলাই, অগস্ট মাসে অমরনাথ যাত্রায় উপচে পড়েন লাখো লাখো হিন্দু তীর্থযাত্রী। কিন্তু ঘোড়াওয়ালারা অধিকাংশই মুসলমান। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। বিবিধ ধর্মের মাঝে ওই সংহতিটাই ছিল তিব্বত অবধি বিস্তীর্ণ পার্বত্য পথে লোপচাক ক্যারাভানের মূলমন্ত্র!

ঋণ: টিবেটান ক্যারাভানস: জার্নিস ফ্রম লেহ টু লাসা, আব্দুল ওয়াহিদ রাধু/ স্পিকিং টাইগার

অন্য বিষয়গুলি:

Communal Harmony Kashmir Dalai Lama
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy