মাইলফলক: ‘এইট অ্যান্ড আ হাফ’ (১৯৬৩) ছবির দৃশ্য। ডান দিকে, পরিচালক ফেদেরিকো ফেলিনি
এখন খুব ভোর। সান নিকোলো চার্চে ঘণ্টাধ্বনির সময়। ছোট্ট সে রিমিনি। যত দূর শহর, সে ধ্বনি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে ঘুরে বেড়ায় শহরময়। স্বাগত জানায় নতুন দিনকে। রিমিনিতেই এক ছিমছাম জায়গায় শহরের কবরস্থান। শিল্পী আর্নাল্দো পোমোদোরোর নিজের হাতে গড়া জাহাজের সম্মুখভাগের আকৃতিতে তৈরি স্মৃতিসৌধটিতে হয়তো সেই ভোরে শিশিরভেজা সাদা ফুলের তোড়া রেখে শ্রদ্ধা জানিয়েছিল কেউ। হালকা ধুলোমাখা আবরণ হাতের ছোঁয়ায় হয়তো মুছে দিয়েছিল সে। নিভৃতির আড়ালে পড়ে থাকা ফলকটিতে লেখা আছে— ‘এখানে শান্তিতে শায়িত আছেন ফেদেরিকো দোমেনিকো মার্সেলো ফেলিনি (১৯২০-১৯৯৩)’। ফেলিনির সমাধির দু’পাশ আগলে শান্তিতে শায়িত তাঁর পরিবার। স্ত্রী মাসিনা, আর শৈশবেই মৃত পুত্র পিয়ারফেদেরিকো।
পৃথিবীর সর্বকালীন সেরা পরিচালকদের এক জন তিনি। শতবর্ষ আগে জন্মেছিলেন এই সুন্দর শহর রিমিনিতে। অদূরে এড্রিয়াটিকের শান্ত তরঙ্গ। সে সাগরের রং ভূমধ্যসাগরীয় নীল। সমুদ্রঝরা ভোরের নোনা বাতাস সব ক্লান্তি হরণ করে নেয়। ফেলিনির সমকালীন আরও দু’জন চলচ্চিত্র পরিচালকদেরও সমবয়স উদ্যাপনের পরিকাঠামো তৈরি করে রেখেছিল সিনেমাপ্রেমী পৃথিবী। ইঙ্গমার বার্গম্যান প্রাক-কোভিডে শেষ করে নিয়েছেন তাঁর শতবর্ষ, ছবি ও প্রদর্শনীর মধ্যে দিয়ে। অতিমারির বিষণ্ণ দিনগুলোয় চাপা পড়ে গেলেন সত্যজিৎ রায় আর ফেদেরিকো ফেলিনি। আগামী বুধবার, ২০ জানুয়ারি ফেলিনির ১০১তম জন্মদিন।
কেন ফেলিনি চলচ্চিত্র-জগতের এক বিশ্বজোড়া নাম? শ্রেষ্ঠ বিদেশি ছবির পরিচালক হয়ে রেকর্ড চার বার পুরস্কৃত অস্কারজয়ী হিসেবে, না কি ১৯৬০-এর কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘গোল্ডেন পাম’ পাওয়া চিরকালীন ক্লাসিক ছবি ‘লা দোলচে ভিতা’-র পরিচালক হিসেবে? তাঁর ঝুলিতে তো আরও বেশি ক্লাসিক, ‘লা স্ট্রাদা’, ‘এইট অ্যান্ড আ হাফ’, ‘অ্যামারকর্ড’, ‘রোমা’ এবং আরও অনেক। কিন্তু ফেলিনির সিনেমা-দর্শনে ছিল এক অন্য রকম চিন্তা। তিনি মনে করতেন, চলচ্চিত্রকারদের প্রতিটি ছবিই আত্মজীবনীমূলক। ঝিনুকের মধ্যে বেড়ে ওঠা মুক্তো যেমন ঝিনুকটির জীবনকাহিনি বিধৃত করে, সিনেমাও তা-ই। সে-ও পরিচালকের জীবনস্মৃতি, অন্তর্নিহিত অভিজ্ঞতার স্মৃতি।
রিমিনি শহরের প্রেক্ষাপট তাই বার বার ঘুরে-ফিরে এসেছে ফেলিনির সিনেমায়। এখানকার আকাশ, বাতাস, সমুদ্র, প্রকৃতি, জীবন, ছন্দ এ সবই ফেলিনি পেয়ে এসেছেন নিজের জীবনবৃত্তে। স্বপ্ন আর জীবনরেখা মিলেমিশে এক আইকনিক শিল্পকৃতি সৃষ্টি হয়েছে তাঁর ছবিগুলোয়। জীবনের যাত্রাপথের সমান্তরাল এক নতুন কক্ষপথে হেঁটেছে তাঁর সিনেমার আবহ। ১৯৫৩ সালে তৈরি ‘আই ভিতেলোন্নি’-তে নিভৃতে এসেছে তাঁর বয়ঃসন্ধির সময়কাল অথবা ১৯৭৩-এর অস্কারপ্রাপ্ত ‘অ্যামারকর্ড’ যা ফেলে আসা ধরা-অধরা স্বপ্নে বিধৃত স্ব-জীবনচিত্রের সিনেম্যাটিক বহিঃপ্রকাশ।
আকাশপথে এক হেলিকপ্টার ওড়ে। দড়ি দিয়ে বাঁধা জিশুর সুবিশাল মূর্তি ঝোলে। রোম শহরের আকাশ মুহূর্তে সচকিত হয়ে ওঠে। কত লোক কত রকম ভাবে দেখে। ছাদে দাঁড়ানো সুন্দরী বিকিনি-তনয়ারা বিস্মিত হয়, “দেখো...এটা জিশু...” সবাই তাকায় ঊর্ধ্বমুখে, যেখানে দু’হাত মোড়া পাথুরে জিশু মহাশূন্যে দোলায়মান। কপ্টারের দরজায় আসে সুবেশ পুরুষটি (অভিনয়ে ছিলেন মার্সেলো মাস্ত্রোয়ান্নি)। উপভোগ করে সুন্দরীদের আকর্ষণ। কপ্টার থেকে চেঁচিয়ে ফোন নম্বর চায়। কেউ কিছু শোনে না। শুনতে পায় না। ছবির সাউন্ডট্র্যাকে শুধু কপ্টারের ডানার শব্দ। ‘লা দোলচে ভিতা’-র২এই দৃশ্যটি বিশ্বের সিনেমা-জগতে তার স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে। বার্গম্যানের ‘সেভেন্থ সিল’ ছবির শেষ দৃশ্যে যেমন চরিত্রটি মৃত্যুর সঙ্গে দাবা খেলে অথবা সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’-তে অপু-দুর্গার কাশফুলের বন পেরিয়ে রেলগাড়ি দেখতে যাওয়ার দৃশ্য যেমন ক্লাসিক, ফেলিনির ‘লা দোলচে ভিতা’-র এই শুরুর দৃশ্যটিও আজ ঐতিহাসিক, আইকনিক। সমকালীন, সমবয়সি, একই সময়ে শতবর্ষের অধিকারী তিন দেশের তিন দিকপাল তাঁদের চিত্রপটে এঁকে দিয়ে গেছেন তিন ঘরানার তিন ক্লাসিক দৃশ্য।
১৯৩৬। এক বার ঝড় উঠেছিল সাগরতীরের শহরটিতে। ফেলিনি আর তার সমবয়সি কিশোরদল ছুটে গিয়েছিল এড্রিয়াটিক তটভূমিতে। এক দৈত্যসম বিদঘুটে অতিকায় সামুদ্রিক জীবের মৃতদেহ ভেসে এসেছে। অদেখা, অজানা সেই প্রাণহীন দানবীয় প্রাণীটিও ফেলিনির ‘লা দোলচে ভিতা’-য় জায়গা করে নিয়েছিল। সারা জীবনে রিমিনিতে তিনি একটি দৃশ্যেরও শুটিং করেননি। অথচ তাঁর হৃদয়ের সব কুঠুরিতেই ভরা ছিল ছেলেবেলা থেকে কৈশোরের স্মৃতি-সত্তা-স্বপ্ন। দেখা-না দেখা, পাওয়া-না পাওয়া সব অভিজ্ঞতালব্ধ বিষয়ভাবনা ফেলিনি তাঁর ছবিতে নিয়ে এসেছেন বার বার।
সে বার সেই কিশোর বয়সেই বাবা-মায়ের সঙ্গে প্রথম রোমে যাওয়া। এস এস রেক্স কোম্পানি তখন সবে ট্রান্স-আটলান্টিক শিপ লাইনার চালু করেছে। স্থলপথে রিমিনি থেকে রোম খুব বেশি দূরের নয়। কিন্তু জলপথে সে দূরত্ব দূর যেন বহু দূর। দু’চোখ ভরে দেখেছিলেন প্রথম পাওয়া ইটালিকে। ফেলিনি ‘অ্যামারকর্ড’ ছবিতে নিয়ে এসেছিলেন স্মৃতির সেই জাহাজ-ভ্রমণ।
ফেলিনি বলেছিলেন— ‘রোম শহর দু’ভাবে দেখা যায়। যারা কোনও দিন দেখেনি, আর যারা বহু বার দেখেছে। আলাদা রঙের আস্বাদন। রোমে তখন সিনেমা-শিল্পে ভবিষ্যতের ইতিহাস তৈরি হচ্ছে। রোসেলিনির হাত ধরে তখন তৈরি হয়ে গিয়েছে ‘রোম: ওপেন সিটি’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত বিখ্যাত সিনেসিটা স্টুডিয়ো পুনর্নির্মিত হয়ে গিয়েছে। ইতালি জাতির স্বপ্নে দারিদ্র থেকে উত্তরণের স্বপ্ন সন্ধান চলছে। জাভাত্তিনি, ভিসকোন্তি, আন্তোনিয়নিরা তৈরি করে দিচ্ছেন আধুনিক ইটালীয় চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপট। রাস্তার ফুটপাতের দোকানে ছবি আঁকার স্টুডিয়োয় বসে ফেলিনি তখন তৈরি হচ্ছেন সিনেমার পাঠশালায় অবতীর্ণ হতে। ‘মার্কঅরেলিয়’ পত্রিকায় মজার লেখা লিখতে শুরু করার পর পাঠকমহলে পরিচিতি পেলেন ফেলিনি। সালটা ১৯৪২। জাভাত্তিনি আর জাপ্পোনি— নব্য বাস্তবতাবাদী চলচ্চিত্রের দুই প্রবাদপুরুষের সঙ্গে শুরু বর্ণময় ফেলিনির বর্ণাঢ্য সিনেমা-জীবন। বর্ণাঢ্য, কারণ ফেলিনির জীবনে কাণ্ডকারখানা ঘটার শেষ নেই। ফ্যাসিবাদী ইটালির অধীনে লিবিয়ায় তাঁকে সেই সময় পাঠানো হল একটি ছবির চিত্রনাট্য রচনার কাজে। ব্রিটিশরা যখন ত্রিপোলি দখল করল, ফেলিনি প্রায় বন্দিই হয়ে যাচ্ছিলেন। জার্মানির এক সেনা প্লেন সিসিলি যাচ্ছিল। তাতে চড়ে পালিয়ে কোনও রকমে প্রাণে বাঁচলেন তিনি। আরও প্রায় ন’মাস মুসোলিনির পতন পর্যন্ত এক ডেরায় আত্মগোপনও করে থাকতে হল ফেলিনিকে।
১৯৪৬ সালে রোসেলিনির ‘পাইসা’ ছবিতে চিত্রনাট্য রচনার সুযোগ পেলেন ফেলিনি। সহ-পরিচালকের দায়িত্বও। সেই সময়েই কিংবদন্তি অভিনেতা মার্সেলো মাস্ত্রোয়ান্নির সঙ্গে ফেলিনির পরিচয়। মাস্ত্রোয়ান্নি তখন থিয়েটারের এক তরুণ অভিনেতা। সিনেমা করার স্বপ্ন দেখার সেই শুরু ফেলিনির। একই সঙ্গে শুরু জীবনের বাস্তব, অবাস্তব, স্মৃতি থেকে কল্পনার প্যালেটে রং মেশানো। তাই বলা হয় আজকের সময়ে থাকলে হতাশ হতেন ফেলিনি। আধুনিক কালের অতি দ্রুতগামী বেগবান সমাজে মানুষের স্বপ্ন দেখা থেমে গিয়েছে। কল্পনার গতিপ্রকৃতি বৃত্তাকার আবর্তনে আবদ্ধ। তাই এখনকার দর্শকও বর্তমান প্রজন্মের স্বপ্ন-সিনেমাকে দূরে সরিয়ে রেখেছে।
গত শতকের তিরিশের দশকে রোম-রিমিনির পথে প্রান্তরে লোক-সার্কাস জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ওরেস্তে রাসতেল্লির প্রবাদপ্রতিম প্রভাবে। কিশোর ফেলিনির মজা লাগত ম্যাজিক, অ্যাক্রোব্যাটিক্স আর নানা রঙের ক্লাউনের বিচিত্র কাজকর্মে। ফেলিনির কাছে এটাও ছিল কিশোর মননে সঞ্চারিত কল্পনার অভিঘাত। মানুষের মাঝে, মানুষের সঙ্গে, মানুষকে নিয়ে লোক-সার্কাসের পারস্পরিক অংশগ্রহণের যে আঙ্গিকগত বৈশিষ্ট্য ছিল, ‘লা দোলচে
ভিতা’-র পরবর্তী কালে, বিশেষ করে ‘লা স্ট্রাদা’ বা ‘এইট অ্যান্ড আ হাফ’ ছবিগুলোয় তাঁর স্মৃতিকল্পনা সঞ্চারিত হয়েছিল। দর্শকদের সঙ্গে তাঁর স্মৃতি আর চিত্রভাষার সমন্বয়ে পারস্পরিক বোঝাপড়া গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। মানুষের স্মৃতি চিরকালই সাবলীল। মানুষের স্মৃতি যার-যার অন্তর্নিহিত রূপলোক। ফেলিনির কাছে সৃষ্টি মানে নতুন আবিষ্কার নয়, সত্যও নয়। তাঁর কাছে যা সৃষ্টি, তা আগেও ছিল, থাকবেও চিরকাল।
ফেলিনির ক্যামেরা লেন্সে তাঁর জন্মশহর রিমিনি এ রকমই এক ফ্যান্টাসি, এ রকমই এক শিল্পাঙ্গন। রিমিনির প্রাচীন সিনেমা-থিয়েটার ‘সিনেমা ফুলগর’। প্রতি বছরই এখানে ভিড় লেগে থাকে দর্শকদের, কারণ সবাই জানে এই থিয়েটারে বহু বছর আগে শিশু ফেলিনি তাঁর বাবার হাত ধরে জীবনের প্রথম সিনেমা দেখেছিল। এর উল্লেখ তিনি করেছেন ‘রোমা’ ছবিটিতে। এই থিয়েটারেই কিশোর ফেলিনি, গ্রাদিস্কা বলে কোন কিশোরীর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। এই ঘটনার উল্লেখও তিনি করে গিয়েছেন ‘অ্যামারকর্ড’ ছবিতে। রোমের ‘সিনেসিটা স্টুডিয়ো’-র প্রিয় পাঁচ নম্বর ফ্লোরে বার বার কৃত্রিম ভাবে তৈরি করেছেন রিমিনি শহরের স্মৃতিঘেরা চিত্রপট— ক্যাস্তেল সিসমোন্দো থেকে ক্যাভুর স্কোয়ার।
আমৃত্যু তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাসে ছিল রিমিনির ঘ্রাণ। এড্রিয়াটিকের নাতিশীতোষ্ণ বাতাস চিরকাল ভালবেসেছে ফেলিনিকে। বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকারদের অন্যতম ফেদেরিকো ফেলিনি তাই হয়তো বলতে পেরেছিলেন, “শেষ বলে কিছু নেই। কোনও কিছুর শুরুও নেই। জীবনের অন্তহীন অনুরাগের উষ্ণ ভাবাবেগই থেকে যায় শুধু...”।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy