Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪

রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

পিনাকী ভট্টাচার্য

পান ঠিক কবে থেকে আমরা চিবোচ্ছি, বলা দুষ্কর। কারণ, পান অনেকটা সেই গেছোদাদার মতো, কোথায় আছে জানার চেয়ে কোথায় নেই বলা বোধহয় বেশি সোজা। জাতকের গল্পে অবধি পানের উল্লেখ আছে! চরক-সুশ্রুত-কাশ্যপের আয়ুর্বেদ শাস্ত্র থেকে বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্র’ অবধি তার অবাধ গতি। যদিও কামসূত্রের কোটেশনটা এই লেখায় দেব না, আপনার যতই দীর্ঘশ্বাস পড়ুক!

‘পান’ শব্দটা এসেছে সংস্কৃত ‘পর্ণ’ থেকে। যার আভিধানিক অর্থ ‘পাতা’। আর এর ইংরেজি ‘বিট্ল’ শব্দটা পানের মালয়লি প্রতিশব্দ ‘বেতেল’ থেকে। কেরল উপকূল থেকে পর্তুগিজরা যখন গা-জোয়ারি করে এ দেশের মশলা ইউরোপে নিয়ে যাচ্ছিল, জাহাজে করে বেতেল-ও সেখানে পৌঁছে যায়।

পান নিয়ে অনেক গল্প আছে। একটা আবার মহাভারতের। পুরনো দিনে রীতি ছিল, অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে পান দিয়ে ব্রাহ্মণ ও অতিথি বিদায় করার। পাণ্ডবদের অশ্বমেধ যজ্ঞের পর হল কী, এই জন্য যে পান দরকার তা কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। খুঁজতে খুঁজতে এক দল পাতালে উপস্থিত হল। সেই সময় সর্পরাজ তক্ষক অর্জুনের ওপর রাগে ফুঁসছেন, কয়েক দিন আগেই খাণ্ডবদহনে তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে। এ দিকে নাগেদের সঙ্গে পাণ্ডবদের পুরনো আত্মীয়তা— কুন্তীর ঠাকুরদার বাবা ছিলেন নাগবংশীয়। পুতিদের সম্মান রাখতে তখন এক নাগ-রানি তাঁর আঙুল কেটে, পান খুঁজতে আসা লোকেদের হাতে দিলেন, আর বললেন, এটা পুঁতে দিয়ো। সেখান থেকে নতুন করে পানগাছ সৃষ্টি হল। সেই জন্যই পানের কোনও ফুল বা ফল হয় না। সংস্কৃতে পানের আর এক নাম ‘নাগবল্লরী’ এই কারণেই।

ভারতে এসেছেন, এ দিকে পান নিয়ে মন্তব্য করেননি, এমন পর্যটক পাওয়া মুশকিল। ১২৯৫ সালে গুজরাতের মানুষজনকে দেখে মার্কো পোলোর দৃঢ় ধারণা হয়েছিল সেখানকার মানুষের মজবুত দাঁত আর খোলতাই চেহারার পেছনে রয়েছে পান খাওয়া। পনেরো শতকে আব্দুর রাজ্জাক বিজয়নগর যান আর রাজা নিজে পান তুলে দেন তাঁর হাতে। রাজ্জাকের পান খেয়ে খুব ফুর্তি হয়েছিল। তাঁর ধারণা হয়: পান খুবই বলবর্ধক, আর ৭০০ মহিলাকে অন্তঃপুরে রেখেও রাজা যে এ রকম ক্লান্তিহীন, তা এই পানের মহিমা। প্রায় উলটো-গল্পও আছে! ১৫৪৮ সালে পর্তুগিজ পর্যটক বারবোসা পানের অনেক গুণগান করেন, কিন্তু শেষে সাবধান করে দেন, কর্পূরের সঙ্গে পান খেলে পুরুষত্বের হানি হয়! সপ্তদশ শতাব্দীর ইতালীয় পর্যটক মানুচ্চির অভিজ্ঞতা আবার একদম অন্য ঘরানার। পান খেয়ে মুখ রাঙানো লোকদের দেখে ওঁর দৃঢ় ধারণা হয় এদের ভয়ানক কোনও অসুখ করেছে। এর পর আবার এক মেমসাহেবের অনুরোধে প্রথম বার পান খেয়ে দাঁত ছিরকুট দিয়ে ভিরমি খেয়েছিলেন! পানে জর্দা ছিল যে!

যাঁরা এখনও মহাভারতের গল্পটা থেকে বেরোতে পারেননি আর ভারতীয় পরম্পরার কথা ভেবে মথিত হয়ে আছেন, তাঁদের জানাই, ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে লেখা ভিয়েতনামি বই ‘লাইফ স্টোরি অব ট্যান অ্যান্ড ল্যাং’-এও পানের কথা লেখা আছে।

লিপস্টিকহীন যুগে পান খেয়ে মেয়েদের ঠোঁট রাঙানো প্রথম শুরু করেন সম্রাজ্ঞী নুরজাহান। তিনি আমাদের বধর‌্মানের মঙ্গলকোটের কাছে আজকের বাদশাহি সড়কের আশেপাশে কিছু দিন ছিলেন যে!

pinakee.bhattacharya@gmail.com

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

তিনি সাংবাদিক, ভাষাবিদ, কবি এবং ইতিহাসবিদ। তাজমহল যে একদা শিবমন্দির ছিল, সেটা প্রমাণ করে দেবেন বলেছিলেন। ভারতীয় সভ্যতা মগধ থেকে রোম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বিশ্বাস করতেন। এ নিয়ে বইও লিখবেন বলেছিলেন। এর সপক্ষে দু-একটি প্রমাণও চা খেতে খেতে বলেছিলেন, যেমন ইস্তানবুল (উনি বলছিলেন ‘ইস্তাম্বুল’) নামটা এসেছে তাম্বূল থেকে। ভারত থেকে সমুদ্রপথে ওখানে প্রচুর পান যেত। পান’কে সংস্কৃতে বলা হয় তাম্বূল। আর, ভারতীয় প্রভাবে এই পানের খিলি দিয়েই তুর্কিস্তানেও ভালবাসা প্রকাশ করা হত। বাড়িতে অতিথি এলে প্রথমেই এক খিলি পান ধরিয়ে দেওয়া হয়। এই পানপাত্রই হল ‘লাভ সাইন’। এটা হার্ট থেকে আসেনি। লাভ সাইন বলে যেটা দুনিয়া মানে, হার্টের সঙ্গে তার কোনও মিল নেই, পানের সঙ্গেই আছে। ‘ইস্তাম্বুল সে হি লাভ সাইন পুরা ইয়োরোপ মে চর্চিত হুয়া।’

ওঁর নাম গিরিরাজ মোরাদাবাদি। পদবি ব্যবহার করতেন না, বরং স্থান-নামটাই ব্যবহার করতেন। উত্তর ভারতের অনেক কবিদের এটাই দস্তুর। গিরিরাজবাবু মোরাদাবাদকে বহন করে চললেও, ওঁর সঙ্গে আলাপ রাঁচিতে, একটি পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লেখেন এবং বেতারের সংবাদদাতা। ওঁর সঙ্গে মাঝেমধ্যে গল্প হত।

এক বার বেশ কিছু ক্ষণ তাঁর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ ঘটে। সুবর্ণরেখা নদীর বালি থেকে দেশীয় প্রথায় সোনার কুচি খুঁজে বের করার কাজ করেন কিছু জনজাতি। এটা নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি করার কাজে ওঁর সাহায্য চেয়েছিলাম এবং গাড়িতে আমি তাঁর কাছ থেকে প্রাচীন ভারতের স্বর্ণযুগ সম্পর্কিত প্রভূত জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছিলাম।

সুবর্ণরেখা নামটা থেকেই স্বর্ণের দিকে যাওয়া শুরু। বললেন, হূন-রা সোনার ব্যবসা করত, সোনার লোভেই ভারতে আসত। হিন্দুকুশ পাহাড়ের ও-পার থেকেই ‘স’-এর উচ্চারণ ‘হ’ হয়ে যায়। সিন্ধু যেমন হিন্দু। স্বর্ণকে বলত হন্ন। হন্ন থেকেই হূন। জার্মানির শহর বন, সেই শব্দের রুট হল সুবর্ণ। জার্মানির এয়ারওয়েজ লুফ্থানসা শব্দের উৎপত্তি ‘লুপ্ত হংস’। ভারত থেকে এক দল সভ্য সৈন্য তৎকালীন অসভ্য জার্মানির বারোটি দরজা ধ্বংস, মানে লীন করে সেই এলাকায় সভ্যতা দান করে। বারোটি দরজা লীন করা হয় বলেই শহরটির নাম বার্লিন। ক্রমশ জ্ঞান বাড়তে লাগল আমার। জানলাম, যিশু খ্রিস্ট ভারত থেকেই ও-দেশে গিয়েছিলেন। ওঁর জন্ম বিহারের বেতলাইসাম-এ। ‘স’-ধ্বনি ‘হ’ হয়ে গিয়ে বেতলাইহাম হয়ে গেছে। ‘অপভ্রংস্ মে উও হো গিয়া বেথলেহেম।’ বেতলাইসাম গ্রামের এক কুঁড়েঘরে ঈশান কোণে জন্ম হয় বলে ওঁর নাম রাখা হয় ঈশা। আর ঈশার মায়ের নাম ছিল মেরি নয়, মীরা। মীরা ছিলেন ঊষা-কন্যা, কৃষ্ণপন্থী, ইয়োরোপে ‘ক’-এর উচ্চারণ খ। গরুকে আমরা বলি কাউ, ওরা বলে খাও। কৃষ্ণকে ওরা বলত খৃষ্ণ, সেই থেকেই খ্রিস্টান। ওঁর কাছেই জানলাম প্রাচীন প্যালেস্তাইনের মানুষ ছিল শৈব। ওই অঞ্চলের ভাষা ছিল শিবের ভাষা শিবরু। ‘শ’ ধ্বনি ‘হ’ হয়ে যায় বলে শিবরু হয়ে গেল হিব্রু। মিশরের প্রাচীন সভ্যতাও ছিল শিবসভ্যতা! ওদের নদীর নাম নীল। শিবের অপর নামও নীল। আরও জানলাম পুরো সেমেটিক সভ্যতাটাই ভারতের দান। নেবুকার্দনেজারের আসল নাম ছিল নব কান্তেশ্বর, আর আলেকজান্ডার আসলে আলোচন্দ্রহার। আব্রাহাম ছিলেন উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের মানুষ। অভ্রশ্যাম। শ=হ, সুতরাং অভ্রহ্যাম। আবার ভ=ব, সুতরাং আব্রাহাম।

চার-পাঁচ ঘণ্টা তো কম নয়। এর মধ্যে ইতিহাস ও ভাষাবিজ্ঞানের তত্ত্ব ছাড়াও, নিজের কথাও বলেছিলেন। সম্পূর্ণ ভাবে আয়ুর্বেদে বিশ্বাসী। যেহেতু কবি, তাই একটু সুরা পান করেন— আয়ুর্বেদিক সুরা। নিরামিষ আহার করেন, রোজ সাতটি থানকুনি পাতা সেবন করেন। তুলসীপত্র খুবই ভাল, কিন্তু চিবিয়ে খেতে নৈতিকতায় বাধে, তাই ঘ্রাণ নেন, আর রোজই খালি পেটে চার চামচ গোমৃত পান করেন। গোমৃত ব্যাপারটা জানতাম না, বললেন গো+অমৃত=গোমৃত। আসলে গোমূত্র।

বলছিলেন, অনেক দোকানেই সিল করা বোতলে গোমৃত, গোসুধা, বৈতরণী ইত্যাদি লেবেলে পাওয়া যায়। কিন্তু খাঁটি কি না সন্দেহ হয়। রাঁচিতে এখন খাটাল পাওয়া মুশকিল। আর খাটালের গরুগুলিকে বেশি দুধের জন্য নানা রকম ‘বদ দাওয়াই’ খাওয়ানো হয়, সুঁই দেয়া হয়, ফলে গোমৃতে তার প্রভাব পড়ে... বলতে বলতেই দেখা গেল বাইরে এক পাল গরু। ড্রাইভারকে থামাতে বললেন, জল খাওয়ার প্লাস্টিকের জারটা নিয়ে গাড়ি থেকে নামলেন, মিনিট দশেক অপেক্ষা, সোর্স থেকে সংগ্রহ করা টাটকা ফেনায়িত গোমৃত নিয়ে ফিরলেন। বললেন, বাড়ি নিয়ে যাবেন। ‘সির্ফ ঘাস খায়া হুয়া আসলি চিজ।’

জানালেন, গোমৃতের কারসাজিতেই ভাল হজম হয়, ঘুম হয়, যৌবনও তাজা রয়েছে, পরিশ্রম করতে পারেন। সম্প্রতি ছেলের বিয়ে দিলেন। বিয়েতে দশ জন লওন্ডা আনিয়েছিলেন। লওন্ডাদের সঙ্গে নিজেও নেচেছিলেন। লওন্ডা! আমি একটু কপাল কুঁচকে ওঁর দিকে তাকালে বলেছিলেন— প্রাচীন যুগেও ভারত থেকে পাশ্চাত্য দেশে লওন্ডা যেত। ওরা কদর বুঝত। আরে, লন্ডন সিটি কা নাম ক্যায়সে বনা? লওন্ডা সে না?

swapnoc@rediffmail.com

অন্য বিষয়গুলি:

pinaki bhattacharya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy