Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪

রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

পিনাকী ভট্টাচার্য

শক্তিগড়ের ল্যাংচার পেছনে একটা দারুণ গল্প লুকিয়ে আছে। অধিকাংশ দারুণ গল্পের মতোই, এটা মিথ্যে হওয়ার সম্ভাবনা খুব, কিন্তু তাতে রসের কোনও হানি হয় না। গল্পটা হল, বর্ধমানের রাজপুত্রের সঙ্গে কৃষ্ণনগরের রাজকন্যার বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের পর রাজকন্যে যখন অন্তঃসত্ত্বা হলেন, কোনও খাবারই তিনি আর সহ্য করতে পারেন না, যা খান তা-ই বমি হয়ে যায়। মহা মুশকিল। বর্ধমানের রাজা উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ও বউমা, কী খেতে ইচ্ছে করছে? বউমা বললেন, ‘ল্যাংচা’। রাজা এমন কোনও মিষ্টির কথা জীবনে শোনেননি। তিনি তক্ষুনি বেয়াইবাড়ি খবর পাঠালেন। সেখানে সবাই মিলে প্রাণপণ খোঁজ করতে থাকে। কিন্তু কোনও ময়রাই ‘ল্যাংচা’ নামে কোনও মিষ্টির কথা জানে না। তখন রাজকুমারীকেই জিজ্ঞেস করা হল, মিষ্টিটা তিনি খেয়েছেন কোথায়? রাজকন্যে বললেন, এক জন খোঁড়া ময়রা একটা পান্তুয়ার মতো দেখতে মিষ্টি বানান, মিষ্টিটার কী নাম কে জানে, কিন্তু খেতে দারুণ, সেই মিষ্টিটার কথা বলতে গিয়ে তিনি ‘খোঁড়া’র বদলে ‘ল্যাংচা’ বলেছেন। শেষে কালনা-য় সেই খোঁড়া ময়রাকে খুঁজে পাওয়া গেল, তাঁকে লোকে ‘ল্যাংচা দত্ত’ বলেই ডাকত। তাঁকে জায়গা-জমি দিয়ে বর্ধমান শহরের কাছে, শক্তিগড়ে বসানো হল, যাতে তিনি রাজবাড়িতে নিত্য এই মিষ্টি পৌঁছে দিতে পারেন। এখন যে ল্যাংচা বললেই শক্তিগড়, আর গাড়ি করে শান্তিনিকেতন যাওয়ার পথে আপনি যে ‘আরে, শক্তিগড় কখন আসবে, টিপিন করব!’ বলে জিভে জল নিয়ে চেঁচাতে থাকেন, তার ইতিহাস এখানেই শুরু।

বর্ধমানের সীতাভোগ আর মিহিদানার সঙ্গেও বর্ধমানের মহারাজের নাম জড়িয়ে। বিজয় চাঁদ মহাতাব যখন রাজাধিরাজ উপাধি পেলেন, বর্ধমান রাজপ্রাসাদে একটা বিরাট অনুষ্ঠান হল। তাতে বাংলার লেফটেনেন্ট গভর্নর, হাইকোর্টের বিচারপতি, তাবড় তাবড় অতিথি! এই অনুষ্ঠানকে আরও স্পেশাল করতে, দুটো একদম নতুন মিষ্টি তৈরি হল— সীতাভোগ আর মিহিদানা।

সাহেবদের নেকনজরে পড়ার জন্য বেশ কিছু মিষ্টি তৈরি হয়েছে এই বাংলায়। লেডিকেনির নাম যে এ দেশের প্রথম ভাইসরয় লর্ড ক্যানিং-এর লেডিকে সম্মান জানিয়ে, তা অনেকেই জানেন। মেদিনীপুরের ঘাটাল অঞ্চলের বিখ্যাত মিষ্টি বাবরশা’র সঙ্গে যতই আমরা মুঘল বাদশা বাবরের সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টা করি, এই মিষ্টিটা আদপে তৈরি হয়েছিল এডওয়ার্ড বাবর নামে এক ইংরেজ রেসিডেন্টকে খুশি করতে। আর ১৯৬০ সালে রাশিয়ান নেতা বুলগানিনের কলকাতা সফরের সময়, এগারো জন মিষ্টি-কারিগর মিলে তৈরি করেছিলেন নতুন মিষ্টি, ‘বুলগানিনের বিস্ময়’!

ইদানীং জোর দাবি উঠেছে, রসগোল্লার আদিভূমি নাকি ওড়িশা। রথযাত্রার পর জগন্নাথদেব মন্দিরে প্রবেশ করার সময় লক্ষ্মীদেবীকে সন্তুষ্ট করার জন্য রসগোল্লার ভোগ দেন, আর তা চলছে গত ৩০০ বছর ধরে। ভুবনেশ্বরের কাছেই পাহাল গ্রাম নাকি রসগোল্লার জন্মভূমি। রসগোল্লা নিয়ে টানাটানি বাঙালি মেনে নেবে কেন? তাদের পালটা যুক্তি: পাহালের রসগোল্লা আসলে রসগোল্লাই নয়, তা ক্ষীরমোহনের বংশধর। রঙও তার সাদা নয়, আর খেতেও তা রসগোল্লার মতন মোলায়েম নয়। তাই ‘পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ’ নিয়ে প্রেমেন্দ্র মিত্রের অমর উক্তি ‘ঠাকুর তোমায় কে চিনত, না চেনালে অচিন্ত্য!’ একটু বদলে হয়তো বলাই যায়, ‘রসগোল্লা তোমায় কে চেনাত, বাঙালি যদি না বানাত!’

pinakee.bhattacharya@gmail.com

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

আমার পিতামহ ছিলেন কট্টর তালিবান। ওঁর কোট, ছাতা, এমনকী পায়ের পাম্পশু’ও তালিভূষিত ছিল। শতরঞ্চিতেও তালি লাগাতে দেখেছি। স্বাধীনতা তথা দেশভাগ পরবর্তী তিনটে দশকে মধ্যবিত্তরা ‘ইউজ অ্যান্ড থ্রো’ সংস্কৃতি কল্পনা করতে পারেনি। প্রতিটি ভোগ্যবস্তুকে দীর্ঘ পরমায়ু দেওয়ার নানা রকম কায়দা ছিল। পেন মেকানিকরা নিব ঘষত, কী একটা সলিউশন দিয়ে লিক আটকাত, ঘড়ি মেকানিকরা ছিল, হাঁড়ি কড়াইয়ের ফুটো বন্ধ করার ঝালাই-ঘর ছিল, হাওয়াই চটির ফিতে ছিঁড়ে গেলেও আগুনে গালিয়ে জোড়া দেওয়ার টেকনোলজি ছিল। শীতকালে পরতাম পিসতুতো দাদার ছোট হয়ে যাওয়া সোয়েটার। আসলে ওটা পিসতুতো দাদা অর্জন করেছিল ওর জেঠতুতো দাদার কাছ থেকে। এটাই ছিল আমাদের স্কুলিং। জীবনপ্রণালী। স্কুলে ভর্তি হলাম। বালকরা আমোদে মারামারি করে। বোতাম ছিঁড়ে গেলে কুড়িয়ে নিতাম খুঁজে। আমাকে ঘটি’রা কিপটে বলত। প্রফুল্ল দাস নামে এক সহপাঠী ছিল আমাদের। ওকে সবাই ‘পেট ফুললো’ বলত। ও ছোলা ভিজিয়ে দু’দিন রেখে, তার পর খেত। ওর মা ওকে এমনই শিখিয়েছেন। কারণ, ভেজা ছোলা দু-তিন দিন রেখে দিলে বিনে পয়সায় ‘কল’ বের করে দেয়। ও প্রায়ই নেড়া থাকত, কারণ, চুল ছাঁটতে যা খরচ, নেড়া হতেও তাই। ওর রাফ খাতা পেনসিলে লেখা হত প্রথমে, খাতা শেষ হলে ওই খাতাই প্রথম পাতা থেকে কালিতে। পেনসিল কাটতে কাটতে খুব ছোট হয়ে গেলে আঙুলে ধরা যায় না। এই সমস্যা সমাধান করেছিল পেনিসিলিন বানিয়ে। পেন+পেনসিল= পেনিসিলিন। ছোট হয়ে যাওয়া পেনসিলের টুকরোটা কোনও বাতিল হয়ে যাওয়া ফাউন্টেন পেনের খোলের ভিতরে ঠেসে নিলে ফের গ্রিপে চলে আসে। চলে আরও কিছু দিন। এই পেনিসিলিনের আবিষ্কর্তা আলেকজান্ডার ফ্লেমিং নন, প্রফুল্ল। প্রফুল্লর প্রতিভায় আমি আকৃষ্ট হই, এবং আমাদের বন্ধুত্ব হয়। আমরা হেঁটে, ট্রামে টিকিট না কেটে, ঠান্ডা আলুর চপের পর জল খেয়ে অম্বল বানিয়ে— নানা প্রক্রিয়ায় কিপটেমি করেছি, আমি চাকরি পেয়েছি, প্রফুল্ল সিভিলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে ব্যবসা ফেঁদেছে, বাড়ির প্ল্যান তৈরি করে, ড্রাফ্টসম্যানগিরি করে, তবুও বাল্যকালের উত্তরাধিকার-অর্জিত কিপটেমি যায়নি। দুজনে একসঙ্গে নিজেদের প্রিয় বউদের জন্য জোড়া শাড়ি কিনতে গিয়েছি। জোড়া শাড়ি মানে খুব ভাল আঠা দিয়ে জোড়া লাগানো শাড়ি। পুরী বেড়াতে গিয়ে ধর্মশালাতেই থাকার প্ল্যান ছিল, বউদের পতিদ্রোহিতায় হোটেলেই, কিন্তু বাইরে সস্তায় খাওয়া।

চারপাশের চাপে পরবর্তীকালে আমার কিপটেমি কিছুটা কমলেও প্রফুল্লর কমল না। ওর রোজগার বাড়ল, কিপটেমিও বাড়ল। এক দিন ফোন পেলাম পুলিশ ধরেছে, জঙ্গি-নাশকতা-দেশদ্রোহিতা এ সব কেস।

ব্যাপারটা হয়েছিল কী, ওর অফিসের উলটো দিকেই একটা ব্যাংকের এটিএম হয়েছিল। সেই এটিএম-এ মেশিনের পিছনে একটা বোমা পাওয়া গেছে, ওখানকার ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ছবিতে প্রফুল্লকে দেখা গেছে ব্যাগ থেকে সুতো প্যাঁচানো একটা লাল বোমা বার করে মেশিনের পিছনে রাখতে। মেশিনের পিছনে ওই দ্রব্যটা দেখে সিকিয়োরিটি গার্ড, পুলিশকে জানান। পুলিশ এটিএম সিল করে ব্যাংক-কে খবর দেয়, ব্যাংক সি.সি ক্যামেরার ছবি দেখায় পুলিশকে, এবং প্রফুল্ল গ্রেফতার হয়।

আমি তো অবাক। এ কী করে সম্ভব! প্রফুল্ল তো এটিএম কার্ড-ই ব্যবহার করত না, কারণ কার্ড থাকলেই টাকা তুলতে ইচ্ছে করবে, এবং টাকা তুললেই খরচ।

তড়িঘড়ি থানায় ছুটলাম। থানা থেকে আমাকে বলা হল বম্ব স্কোয়াড-কে খবর দেওয়া হয়েছে। ওঁরা এসে বোম নিষ্ক্রিয় করবেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন কবে থেকে প্রফুল্লকে চিনি, মাওবাদীদের সঙ্গে যোগ আছে কি না ইত্যাদি। প্রফুল্লকে অন্য ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল।

বোম-বিশারদরা এসে দেখলেন, ওই বোমটা আসলে একটা গোল টিফিন-কৌটো, লাল শালুতে মোড়া, এবং দড়ি দিয়ে বাঁধা যেন ঝোল না পড়ে যায়। কৌটোর ভিতরে হাতে গড়া আটার রুটি এবং আলুর ঝোল-চচ্চড়ি। প্রফুল্ল যত বার বলেছিল আলু আছে, ওঁরা বলেছিলেন জানি তো, তাই তো ধরা হয়েছে। বোমার একটা প্রতিশব্দ যে আলু— প্রফুল্লর জানার কথা নয়।

অনেক কষ্ট করে প্রফুল্ল বোঝাতে পেরেছিল যে নিতান্ত আত্মরক্ষার জন্য ও এটা করেছিল। বড্ড গরম পড়েছিল ক’দিন। বাড়ি থেকে খাওয়াদাওয়া করে বেলা দশটার মধ্যেই অফিসে এসে যায়, চারটে নাগাদ খিদে পায়। তখন বাড়ির তৈরি টিফিনটায় খারাপ গন্ধ হয়ে যায়। পচে যায়। একটা এসি যখন উলটো দিকেই আছে, মিছিমিছি কারেন্ট পুড়ছে, ওখানে যদি কৌটোটা বেঁধেছেঁদে রেখে আসা যায়, খাবারটা ভাল থাকে, কারও তো ক্ষতি হয় না তাতে।

প্রফুল্লটা হঠাৎই মারা গেল। ও নিঃসন্তান ছিল। জানা গেল এই ‘মক্খিচুস’ প্রফুল্ল একটা ভাল অঙ্কের টাকা— অনাথ শিশুদের জন্য কাজ করে এমন কয়েকটি সংস্থাকে নিয়মিত দান করে গেছে।

swapnoc@rediffmail.com

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy