পিনাকী ভট্টাচার্য
কালীপুজো অবধি বিজয়ার রেশ টেনে সবেমাত্র ভাইফোঁটা পর্ব শেষ হল— আপামর বাঙালির ওয়েস্ট-লাইন ইঞ্চি দুই-এক বাড়িয়ে। আজকে বাঙালি মিষ্টির সুলুকসন্ধান দেওয়া যাক— সেই মিষ্টি, যা গত তিন সপ্তাহ ধরে বঙ্গসমাজের মুখ্য খাদ্য হয়ে উঠেছিল।
বৈদিক যুগ থেকেই এ দেশের মানুষের হেঁশেলে দুধ আর দুগ্ধজাত বিভিন্ন খাবার ঢুকে পড়েছিল। দুধের সঙ্গে সখ্য এতটাই, হিন্দুশাস্ত্রের অন্যতম প্রধান এক দেবতাকে অবধি গোয়ালাদের মাঝে শৈশব কাটাতে হয়েছে আর তাঁর ছোটবেলার দুধ, মাখন আর ননী চুরির গল্পে যত মিটার কাগজ আর গান রেকর্ডের স্পুল ভরেছে, মাপলে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা অবধি লজ্জায় মাথা নামাবে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে, ছানার উল্লেখ আমাদের শাস্ত্রে এক্কেবারেই পাওয়া যায় না। তার এক প্রধান কারণ হল: আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের বিধান ছিল, দুধ কেটে গেলে তা পরিত্যাজ্য। আর তা মেনে ছানাকে রাখা হয়েছিল হিন্দু শাস্ত্রের অনুমোদিত খাদ্যতালিকার বাইরে।
তা হলে কি প্রাচীন কালে মিষ্টি ছিল না? অবশ্যই ছিল, আর তা তৈরি হত দুধের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে, তা থেকে ক্ষীর বানিয়ে। যেমন আজও উত্তর ভারতে বা পশ্চিম ভারতে করা হয়ে থাকে। চিনির জোগান কোনও দিনই কম ছিল না এই দেশে। এখানে চিনির উৎপাদন আর ব্যবহার এতটাই বেশি ছিল, চিনের ইতিহাস বলে: হিউ-য়েন-সাং এ দেশে আসার আগেই, চিনের সম্রাট তাই-হুং অনেক লোক পাঠিয়েছিলেন ‘ল্যু’ (ভারতবর্ষে) আর বিশেষ করে ‘মো-কি-তো’ (বাংলায়), চিনি তৈরির কৌশল জানার জন্য।
দ্বাদশ শতাব্দী থেকে ষোড়শ শতাব্দী অবধি আমরা সাহিত্যে সন্দেশের উল্লেখ অনেক বার পাই, কিন্তু তা তৈরি হত ক্ষীর আর খোয়াক্ষীর থেকে। আমাদের বাংলার নিজস্ব ছানার সন্দেশ সেই সময় আসেনি। এই ছানার সন্দেশ তৈরির ব্যাপারে পর্তুগিজদের অবদান অপরিসীম।
সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে বাংলায় ব্যবসা করতে এসে গঙ্গার আশেপাশে থেকে যাওয়া পর্তুগিজ বণিক আর তাঁদের বংশধরদের সংখ্যা প্রায় বিশ হাজার ছুঁয়ে যায়। এঁদের অনেকেই রন্ধনশিল্পে মধ্যম পাণ্ডব ছিলেন। নিজের দেশের রান্নার কৌশল এ দেশের খাবারের ওপর প্রয়োগ করে অসাধারণ কিছু পদ বানিয়ে গিয়েছেন তাঁরা।
এ ভাবেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে ক্রমে তৈরি হয় ছানার সন্দেশ। ফরাসি পরিব্রাজক ফ্রাসোয়া বার্নিয়ের এ দেশে সপ্তদশ শতাব্দীতে ছিলেন। তিনি ফেরত গিয়ে ভ্রমণপঞ্জিতে লেখেন, বাংলাদেশে যে সব জায়গায় পর্তুগিজরা বাস করে, সেগুলো মিষ্টির জন্য বিখ্যাত হয়ে পড়েছে; পর্তুগিজদের মিষ্টি তৈরির স্বভাবনৈপুণ্যের ফলে এই সব জায়গায় মিষ্টির ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠেছে।
কলকাতায় ছানার তৈরি মিষ্টি ঢুকে পড়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর এক্কেবারে প্রথম দিকে। ইংরেজ শাসকদের কাছে তখন কলকাতার স্থান লন্ডনের পরেই— ব্যবসায় আর দালালিতে বাঙালিরা বেজায় ফুলছে। শিক্ষিত বাঙালিরা বিভিন্ন রাজকার্যে যোগ দিচ্ছেন আর শহরে সচ্ছল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বলে এক শ্রেণি জন্ম নিচ্ছে। সেই শ্রেণি এই নতুন পাওয়া ছানার সন্দেশে মজল, এবং বাঙালির চিরকালের স্বভাব আতিথেয়তার সঙ্গে এই খাদ্যটিকে মেশাল। বাঙালি সংস্কৃতির এক অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে সন্দেশ যোগ দিল তখন থেকেই।
pinakee.bhattacharya@gmail.com
স্বপ্নময় চক্রবর্তী
একটা সময় ছিল, আশির দশকে, যখন নানা রকম অনিবার্য কারণে বেতার সম্প্রচার বন্ধ থাকত, একটা কারণ ছিল কেব্ল ফল্ট। ইডেন গার্ডেন্সের আকাশবাণীর স্টুডিয়ো থেকে টেলিফোন কেব্ল-এর মাধ্যমে আমতলার ট্রান্সমিটারে অনুষ্ঠানগুলো চালান করা হত। যদি কেব্ল-এ কিছু গন্ডগোল হত, মেরামত না হওয়া পর্যন্ত সম্প্রচার বন্ধ রাখতে হত, বা তড়িঘড়ি টেপ-পত্র নিয়ে ট্রান্সমিটারে চলে গিয়ে, ওখান থেকেই বাজাতে হত।
এক দিন সকালে জানা গেল যুগোস্লাভ প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো প্রয়াত হয়েছেন এবং ভারত সরকার জাতীয় শোক ঘোষণা করেছেন। এই সময় বেতারে তবলা ছাড়া সেতার, ঢোল ছাড়া ভজন, গীতা-কোরান-গ্রন্থসাহেব-ত্রিপিটক-রামায়ণ ইত্যাদি বাজিয়ে রাষ্ট্রীয় মন-খারাপ বোঝানো হয়। এই টেপগুলোর নাম ‘ডিমাইজ টেপ’। ঠিক এই দিন সকালেই কেব্ল ফল্ট। স্টেশন ডিরেক্টর বললেন, ডিমাইজ টেপগুলো নিয়ে ট্রান্সমিটারে চলে যাও। প্রচুর বিজ্ঞাপন এসেছে, রামায়ণ-মহাভারতের ফাঁকে টাইম মতন বিজ্ঞাপনগুলো বাজিয়ে দিও।
নির্দেশনামায় বলা থাকে, কোন সময়ে কোন বিজ্ঞাপন বাজাতে হবে। রামায়ণ বাজাচ্ছি, ভরত রামের জুতো মাথায় নিয়েছেন, তক্ষুনি ‘বাটা’র বিজ্ঞাপনের টাইম। বেজে উঠল, বাটার জুতো জুড়ায় আঁখি পায়ে পরি না মাথায় রাখি। তার পর হনুমানের লম্ফ দেবার সময় ‘হরলিক্স আরও শক্তি বেশি দেয়’ বাজল। ফোনে উপরওয়ালা জানালেন, ‘ইউ আর ডুয়িং ওয়েল’, তক্ষুনি ঘড়ঘড়ঘড়। মানে ট্রান্সমিটারও বিগড়েছে।
ইঞ্জিনিয়ারদের কাছে গিয়ে বললাম, কী হবে? এখনও কতগুলো ‘স্পট’ বাকি। এক জন ইঞ্জিনিয়ার বললেন ডোন্ট ওরি, ডোন্ট ওরি। সার দেওয়া কয়েকটা বিরাট আলমারি। ওগুলোই নাকি ট্রান্সমিটার। একটা পাল্লা খুলে দু’হাতে দুটো কাঠের লাঠি নিয়ে ভিতরে কোনও যন্ত্রের অংশে চাপ দিলেন। ঘড়ঘড় থেমে গেল। উনি ইংরেজিতে বললেন, এই মুহূর্তে লুজ কানেকশন টাইট করা যেত না। এ বার তুমি তোমার কাজ করো। উনি দু’হাতের দুটো কাষ্ঠদণ্ডের অলৌকিক ক্রিয়ায় দু’ঘণ্টা ধরে কষ্ট করে ট্রান্সমিটার চালু রাখলেন। প্রথম অধিবেশন শেষ হল। দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হওয়ার আগে কিছুটা সময় থাকে হাতে। উনি ট্রান্সমিটারের পেট থেকে নাড়িভুঁড়ি বার করে ফেললেন, তার পর দুটো তারের মাঝখানে একটা ছোট পাউডারের কৌটো ঝালিয়ে দিলেন, বললেন, এটার ‘ওম্স’ ফিট করে গেছে, এ বার বাকি স্পটগুলো বাজাও। ‘ওম্স’ হল রেজিস্ট্যান্সের মাপ। ওঁর নাম বেঙ্কটরাঘবন। সবাই বেঙ্কট বলেই ডাকত। কাজপাগল লোকটিকে এ ভাবেই প্রথম দেখি।
বেঙ্কটরাঘবন কোনও বি.ই বা বি.টেক ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন না, কিন্তু মেশিনগুলোর হার্ট-লাংস-লিভার ওঁর মতো কেউ বুঝত না। উনি হয়তো মেশিনের মনও বুঝতেন, কত দিন আমি দেখেছি উনি মেশিনের গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।
সব স্পেয়ার পার্টস সব সময় মজুত থাকে না। বেঙ্কট সব সময় বিকল্প আবিষ্কার করতেন। পাউডার কৌটোর রেজিস্ট্যান্স, গ্লাসউলের পরিবর্তে শুকনো কচুরিপানার ইনসুলেটর, প্যারাফিনের বদলে নারকোল তেল আর ঢ্যাঁড়সের রসের লুব্রিক্যান্ট...
উনি মেশিনের গোঁগোঁ আওয়াজগুলিকে আলাদা করতে পারতেন। সব গোঁগোঁ এক নয়। বেঙ্কটকে দেখেছি মেশিনের গায়ে কান চেপে গোঁগোঁ শুনছেন। কখনও আগেভাগেই এটা-ওটা পালটে দিচ্ছেন। কিংবা কিছু সোল্ডারিং করে দিচ্ছেন। আবার এমনও দেখেছি— চড়চাপড় মেরে মেশিন ঠিক করে দিচ্ছেন। এই থাপ্পড়-থেরাপি সবার দ্বারা সম্ভব হত না। বেঙ্কটই জানতেন, কোন মেশিন কী ধরনের অবাধ্য হলে কোন অংশে কী ধরনের থাপ্পড় মারতে হবে। মেশিন বেশি অবাধ্যতা করলে দু-চারটে লাথিও মারতে দেখেছি, সঙ্গে কিছু উত্তেজিত শব্দ। হয়তো গালাগাল, তামিলে।
প্রথম দিনের স্মৃতিতে ফিরি। হনুমানবাহিনী লঙ্কা জয় করে উল্লাস করছে, তার মধ্যেই দাদের মলমের বিজ্ঞাপন বাজাচ্ছি, তখন বিকেল, বেঙ্কটরাঘবন লাঞ্চবক্স নিয়ে এলেন ট্রান্সমিটারের পিছন থেকে। একটা কৌটোয় মিল্ক পাউডার আর জল দিয়ে রেখে দিয়েছিলেন, সঙ্গে সামান্য দইয়ের সাঁজা। ওটা দই হয়ে গেছে। বেঙ্কট বোঝালেন, আইডিয়াল টেম্পারেচার ফর মেকিং কার্ড ইজ থার্টি থ্রি ডিগ্রি। আই গেট দ্যাট টেম্পারেচার দেয়ার। খুব সহজে দই বানিয়ে, ভাতের সঙ্গে খেয়ে নেন। আর সামান্য একটু আচার।
উনি ওভারটাইম বিল করতে ভুলে যেতেন বলে সহকর্মীদের কাছে প্যাঁক খেয়েছেন কত। এর পর উনি রাঁচিতে বদলি হলেন। অনেকে বলল, ও পাগল বলেই রাঁচিতে ট্রান্সফার করা হয়েছে।
আমাকেও রাঁচি যেতে হয়েছিল কয়েক বছর পর। বেঙ্কটের খোঁজ করেছিলাম। জানলাম উনি এখন চেন্নাই চলে গেছেন। শুনলাম বাড়িতে ওয়াশিং মেশিনের মোটরের সঙ্গে কী সব কারিকুরি করে একটা নাগরদোলা বানিয়েছিলেন, কোয়ার্টারের বাচ্চারা ওঁর বাড়ি গিয়ে বিনেপয়সায় নাগরদোলা চড়ে আসত।
‘উও পুরা পাগল থে।’
এ রকম দু-চারজন পাগল আছে বলেই আমরা আছি।
swapnoc@rediffmail.com
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy