Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪

রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০১৪ ০১:০০
Share: Save:

কিংবদন্তি বলে, সামোসা ভারতবর্ষে প্রথম আসে ত্রয়োদশ কি চতুর্দশ শতাব্দীতে, ইরানি ব্যবসাদারদের হাত ধরে। তারা দেশের চার দিকে ব্যবসার জন্য ঘুরে বেড়াত। সারা দিন পথ চলে সন্ধেবেলায় কোনও সরাইখানায় থামত, রাত কাটানোর জন্য। আর সেই রাতের বেলাতেই, মাংসের পুর দেওয়া, কড়া করে ভাজা শিঙাড়া সাবধানে মুড়ে নিয়ে, ঘোড়ার পিঠে ঝুলিয়ে রাখত। পরের দিন পথের দ্বিপ্রাহরিক ভোজনটা হয়ে যেত এই খাবারে।

দিল্লির সুলতানদের রাজকবি আমির খুসরু ১৩০০ সালের আশেপাশে লিখেছেন, মাংস, ঘি আর পেঁয়াজ দিয়ে তৈরি সামোসা রাজকুমাররা ও তাঁদের পার্ষদরা কী ভীষণ উপভোগ করে খেতেন। চতুর্দশ শতাব্দীর পর্যটক ইবন বতুতা তাঁর লেখায় মহম্মদ বিন তুঘলকের দরবারের এক ভোজের বর্ণনা করেছেন, যেখানে ‘সামুশাক’ বা ‘সাম্বুসাক’-এর কথা আছে। মাংসের কিমা, পেস্তা, কাঠবাদাম, আর মশলা দিয়ে তৈরি পুর, পাতলা ময়দার মোড়কের মধ্যে পুরে ঘি দিয়ে ভেজে এই খাবার বানানো হত। পরিবেশন করা হত ঠিক পোলাও পরিবেশনের আগে।

ষোড়শ শতাব্দীর মুঘল আমলে লেখা ‘আইন-ই-আকবরি’তে ‘কুতাব’ বলে এক পদ রান্নার ফন্দি-ফিকির লেখা আছে। সেখানে বলা হয়েছে, হিন্দুস্তানের লোক এই খাবারটিকে ‘সাম্বুসা’ বলে।

শিঙাড়া বললেই যে বন্ধুটির কথা আমাদের অবধারিত ভাবে মনে পড়ে যাবে, সে হল জিলিপি। সে-ও এসেছে মধ্য এশিয়া থেকে। ইরানের ‘জুলাবিয়া’ আর আমাদের জিলিপি একই জিনিস। ও দেশে জুলাবিয়া বিশেষ পালা-পার্বণে তৈরি হয় আর রমজানের সময় গরিবদের বিলোনো হয়। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে লেখা আল-বাগদাদির রান্নার বইয়ে জিলিপি বানানোর কায়দা-কৌশল বর্ণনা করা আছে। শুধু মধ্য এশিয়া নয়, গোটা এশিয়া মহাদেশই জিলিপির রসে সিক্ত। আফগানিস্থানে জিলিপি এতটাই প্রিয় যে শীতের দিনে আফগানিরা ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে মাছ আর জিলিপি খেয়ে ঋতু বদলের জন্যে প্রহর গোনে।

কিন্তু ভারতে ঠিক কবে জিলিপি এসেছে, সেটা বের করাটা জিলিপির প্যাঁচের মতোই জটিল। ‘গুণ্যগুণবোধিনী’ (১৬০০ খ্রিস্টাব্দ) নামের রান্না সংক্রান্ত এক পুঁথিতে জিলিপির উল্লেখ রয়েছে। সংস্কৃত ভাষায় পয়ার ছন্দে লেখা এই পুঁথিতে জিলিপি বানানোর জন্য কী লাগে আর কী ভাবে বানাতে হয়, দুয়েরই বর্ণনা পাওয়া যায়। আর একটা কথা বলা দরকার, ‘গুণ্যগুণবোধিনী’তে বর্ণনা করা কলাকৌশল এখনকার দিনের জিলিপি বানানোর কলাকৌশলের সঙ্গে প্রায় এক্কেবারেই মিলে যায়।

এমনকী তারও আগে, ১৪৫০ সালে জৈন সাধু জিনসূর-এর লেখা ‘প্রিয়ংকর-রূপকথা’তে জিলিপির উল্লেখ রয়েছে। এই পুঁথির কথা আবার সপ্তদশ শতাব্দীতে রঘুনাথের লেখা প্রামাণ্য ‘ভোজন-কুতূহল’-এও পাওয়া যায়। কাজেই জিলিপির সঙ্গে ভারতবর্ষের সম্পর্ক প্রায় ছ-সাতশো বছর পুরনো।

ছবি: সায়ন চক্রবর্তী।

pinakee.bhattacharya@gmail.com

আমাদের এক সম্পর্কিত বোন ছিল, ওর ডাকনাম ছিল বুলু। ও হামাগুড়ি দিত, কারণ ও দাঁড়াতে পারত না। খুব ছোটবেলায় ওর টাইফয়েড হয়েছিল, তার পর ওর নিম্নশরীর অকেজো হয়ে যায়। ওর পা ছিল সরু সরু। কিন্তু উপরের দিকটা স্বাভাবিক ছিল। খুব ভাল গানের গলা ছিল।

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

আমার পিসেমশাইয়ের বাড়িতে নানা ছুতোয় আমরা যেতাম, পিসেমশাই এটা পছন্দ করতেন, উপভোগও করতেন। সরস্বতী পুজো, ঝুলন ইত্যাদি উপলক্ষে ও-বাড়িতে সমবেত হতাম আমরা, চ্যাঙারি করে খাস্তা কচুরি, জিলিপি এ সব নিয়ে আসতেন। কুলপিওয়ালাকে বাড়িতে ডেকে কুলপি খাওয়াতেন এই সব বালক-বালিকাদের। বুলুদির উদ্যোগে ফাংশন হত। যে বুলুদি কক্ষনও উঠে দাঁড়াতে পারবে না, গাইত: ‘চল কোদাল চালাই ভুলে মানের বালাই।’ কিংবা ‘ছুটব খেলব হাসব সবারে ভালবাসব।’ বুলুদির বাবা কোলে করে বুলুদিকে পিসেমশাইয়ের বাড়িতে পৌঁছে দিত। দুর্গাপুজোর সময় পিসেমশাই ছোটদের গাড়ি করে ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যেতেন। বুলুদি ধারের সিটে বসত, আমরা নেমে প্যান্ডেলের দিকে যেতাম, বুলুদি গাড়িতেই বসে থাকত। আমরা অসুরের গোঁফ কিংবা সিংহের লেজ নিয়ে বিশেষজ্ঞের মতামত দিচ্ছিলাম, তখন হঠাৎ বুলুদির কান্নার শব্দ শুনেছিলাম। ফোঁপাচ্ছিল। একটা ঠাকুর রাস্তা থেকেই দেখা যাচ্ছিল, গাড়িটা থামিয়েছিল ড্রাইভার। বুলুদি চোখ বুজেছিল। না, দেখব না, যাও।

আমার পিসতুতো বোনের নাম রাণু। আমার থেকে তিন বছরের ছোট। দেখতে ফুটফুটে। বুলুদি রাণুকে একটা বাটি দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, বল তো, এটা কী? রাণু বলেছিল, বাটি। বুলুদি তখন ‘তোর বরকে নিয়ে সাঁতার কাটি।’ রাণুর এতে খুব রাগ হয়েছিল। বলেছিল, ইস, কত সাঁতার দিতে পারবি, নিজের পায়েই দাঁড়াতে পারিস না...

বুলুদির সঙ্গে রাণুুর আড়ি হয়ে গেল। রাণু কয়েক বার ‘ডাব ডাব’ বলে ভাব করার চেষ্টা করেছিল, বুলুদি ‘সেদো’ বলেই চুপ করে থেকেছে। সেদো মানে যে যেচে সেধে ভাব প্রার্থনা করে। ‘ডাব’ হল ভাব করার সাংকেতিক শব্দ। এর উত্তরেও ‘ডাব’ বলতে হয়।

সময় বয়ে গেল। রাণু সিক্সে ‘খায় কিশমিশ’ অধ্যায়ে পৌঁছে গেছে। বুলুদি তো স্কুলে যেতে পারেনি, বাড়িতেই যেটুকু। বুলুদি একটু বড় হয়ে গেছে কিনা, ওকে কোলে করে আনা যায় না। রাণু সিক্স, আমি নাইন। আমাকে দিয়ে রাণুু একটা ভাব করার চিঠি পাঠিয়েছিল বুলুদিকে। আমি দৌত্যকর্মটি করেছিলাম, কিন্তু কূটনীতিতে সফল হতে পারিনি। বুলুদির কাছ থেকে অনুরূপ ‘ভাবের চিঠি’ নিয়ে আসতে পারিনি।

রাণু পড়াশুনোয় ভাল ছিল। ডাক্তারি পাশ করল, বিলেতে ডাক্তার বর পেল।

বুলুদির বাড়িতে গিয়েছিলাম আমার বিয়ের নিমন্ত্রণ করতে। ওদের বাড়িটার সামনে বোর্ড: ‘সুরমূর্চ্ছনা সঙ্গীত বিদ্যালয়’। ভিতরে ‘রুমঝুম রুমঝুম...খেজুরপাতার নুপূর বাজায়।’ সামনে ছাত্রীরা। বুলুদি বলল, কত দিন পরে এলি। তার পর এ কথা-সে কথা। এক বার বলল, রাণুকে বলে দিস আমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি। আমার ৪০ জন ছাত্রছাত্রী এখন। তিন জন রেডিয়ো আর্টিস্ট।

আমি বলি, এখনও সে কথা মনে রেখেছিস? ও বলে, কী করব, কাঁটা গেঁথে আছে যে। আমি বলি, কাঁটা তুলে ফেল।

এর পর আমাদের চুল পেকেছে। দাঁত নড়েছে, ছানিও কাটিয়েছি কেউ। রাণু কলকাতায় এলে আমাদের ডাকে, ওর একটা বাড়ি আছে কলকাতায়। এ বছর একটা বড় হোটেলে ডাকল সবাইকে। গেট টুগেদার। শৈশবের সব বন্ধু-বান্ধবীদের বাড়ি খুঁজে খুঁজে গিয়ে নিমন্ত্রণ করল। বুলুদির বাড়িতেও গেল। হুইলচেয়ার ঢুকে যায় এমন গাড়ির ব্যবস্থা করল রাণু। সেই গাড়িতে হোটেলে এল বুলুদি। সাদা চুল। সামনের দাঁতও নেই।

খুব হাসছে।

রাণু বলল, আমরা সবাই সুইমিং পুলে যাব। জলে নামব। কুমির জলকে নেমেছি খেলব। তোকেও নামতে হবে বুলুদি। বুলুদি বলে, এ সব তো দেখিনি কোনও দিন, যা বলবি, আজ তাই হবে। সুইমিং পুলে ভেসে থাকার ব্যবস্থাও ছিল। ওয়াটারপ্রুফ পরিয়ে ভাসানো হল বুলুদিকে। রাণুু, রাণুর বর জলে। রাণু বলল, তোর কথাটা দেখ সত্যি করিয়ে দিলাম। সেই কবে বলেছিলি ‘তোর বরকে নিয়ে সাঁতার কাটি’ হল তো?

বুলুদি রাণুর হাত ধরে বলল, বল তো, আলুকাবলি আলুকাবলি।

তুই একটা পুরো পাগলি।

swapnoc@rediffmail.com

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy