বিশ্ব থেকে ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে চলেছে বালি, কেন? কী হতে পারে এর ফলে?
পরিবেশবিদেরা বলেন, জলের পর সব থেকে বেশি হেলাফেলা করা হয় এই প্রাকৃতিক সম্পদকে নিয়ে। নষ্টও হয় সব থেকে বেশি। অথচ এই বালি না থাকলে কিন্তু দুর্গতির শেষ থাকবে না।
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
নয়াদিল্লিশেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০২৩ ১৪:১৩
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২০
যত্রতত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকে। পরিবেশবিদেরা বলেন, জলের পর সব থেকে বেশি হেলাফেলা করা হয় এই প্রাকৃতিক সম্পদকে নিয়ে। নষ্টও হয় সব থেকে বেশি। অথচ এই বালি না থাকলে কিন্তু দুর্গতির শেষ থাকবে না। এর জন্য প্রাণ নিয়েও হয়েছে টানাটানি।
০২২০
বড় বড় ইমারত, আবাসন, সেতু, উড়ালপুল। এই সবের অন্যতম উপাদান হল বালি। বালি ছাড়া কংক্রিটের ইমারত তৈরি সম্ভব নয়।
০৩২০
আধুনিক প্রযুক্তি তৈরির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রয়েছে সিলিকনের। সিলিকনের সঙ্গে অ্যালুমিনিয়াম বা লোহা মিশিয়ে তৈরি করা হয় ডায়নামো, ট্রান্সফরমার প্লেটস, ইঞ্জিন ব্লকস, সিলিন্ডার, যন্ত্রের টুল, ডিঅক্সাইড ইস্পাত। এই সিলিকনেরও কিন্তু অন্যতম উপাদান হল বালি।
০৪২০
বালির সঙ্গে চুনাপাথর-সহ আরও বেশ কিছু উপকরণ গলিয়ে, রাসায়নিক পরিবর্তনের মাধ্যমে তৈরি হয় কাচ। সুতরাং, কাচ তৈরির অন্যতম উপকরণও হল বালি।
০৫২০
এ সব কারণে দৈনন্দিন জীবনে বালির গুরুত্ব খুব বেশি। আমরা এই বিষয়ে ততটা সচেতন না হলেও এই প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করতে পারব না। আর সেই প্রয়োজনের কারণে নদীখাত, সমুদ্রসৈকত থেকে নিয়মিত তোলা হচ্ছে বালি। রোজ যত পরিমাণ বালি উত্তোলন করা হয়, তত পরিমাণ কিন্তু তৈরি হয় না। সেখানেই বাড়ছে সমস্যা।
০৬২০
রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিবেশ প্রকল্প (ইউএনইপি) বলছে, গত দু’দশকে বালির চাহিদা আগের থেকে বেড়েছে তিন গুণ। ২০১৯ সালে পৃথিবীতে বালির চাহিদা ছিল পাঁচ হাজার কোটি টন। নির্মাণের ক্ষেত্রে এক টন সিমেন্টের সঙ্গে তার সাত থেকে আট গুণ বালি মেশাতে হয়। তবেই মজবুত হয় নির্মাণ।
০৭২০
ইউএনইপি জানিয়েছে, ২০১২ সালে বালি দিয়ে যত নির্মাণ হয়েছে, তা যোগ করলে গোটা পৃথিবীর চারপাশে বিষুবরেখা বরাবর ৮৮ ফুট উঁচু প্রাচীর দেওয়া যায়।
০৮২০
আর এই নির্মাণের জন্য পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে যথেচ্ছ বালি উত্তোলন করা হয়। যতটা প্রয়োজন, তার থেকে অনেক বেশি বালি উত্তোলন করা হয়। তার পর তার বেশির ভাগ নষ্ট হয়।
০৯২০
এই যথেচ্ছ ভাবে বালি উত্তোলনের ফলেই ভুগছে পৃথিবী। বেড়েছে বন্যার প্রকোপ। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড (ডব্লুডব্লুএফ) বলছে, যথেচ্ছ বালি তোলার কারণে মাটি আলগা হয়ে যাচ্ছে। সে কারণে বন্যার প্রবণতা বাড়ছে।
১০২০
নদীগর্ভ থেকে ক্রমাগত বালি উত্তোলনও বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে পরিবেশকে। ডব্লুডব্লুএফ ভূতত্ত্ববিদ মার্ক গোয়চট জানিয়েছেন, নদীগর্ভে বালি থাকলে তা জলবায়ুর পরিবর্তনের মোকাবিলা করতে পারে। নদীর ব-দ্বীপে যথেষ্ট পলি, বালি থাকলে তবেই তা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উঁচুতে থাকে। এর ফলে সমুদ্রের নোনাজল ঢুকতে পারে না নদীতে।
১১২০
নদীগর্ভ থেকে বালি তোলার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সেখানকার বাস্তুতন্ত্র। নদীতে বসবাসকারী মাছ, প্রাণী, উদ্ভিদ মারা পড়ছে। নষ্ট হচ্ছে বহু বিরল প্রাণী। এমনকি মাছের সংখ্যাতেও টান পড়তে পারে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা।
১২২০
বালিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে মাফিয়াচক্রও। এই প্রাকৃতিক সম্পদ কেনাবেচা করে কোটিপতি হয়েছেন বহু মানুষ। এই টানাপড়েনে খুন হয়েছেন বহু।
১৩২০
সাংবাদিক ভিনস বেইসার বালির ইতিহাস নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন। সেই বইয়ে তিনি জানিয়েছেন, কী ভাবে বালি পাচারের জন্য পুলিশকে ঘুষ দেয় মাফিয়ারা। তাদের পথে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ালে তাঁকে খুন করতে দ্বিতীয় বার ভাবে না।
১৪২০
বেইসার নিজের বইতে জানিয়েছেন, বালি পাচারের ঘটনা দেখা যায় চিন, কেনিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনামে। তবে সম্ভবত সব থেকে বেশি বালি পাচার হয় ভারতে।
১৫২০
প্রাকৃতিক সম্পদ সংক্রান্ত বিষয়ে কাজ করা একটি অসরকারি সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ভারতে বালি পাচারের বলি ৩৯ জন।
১৬২০
মৃতদের মধ্যে রয়েছেন ২৩ জন নাগরিক, পাঁচ জন সাংবাদিক এবং সমাজকর্মী, ১১ জন সরকারি কর্মী। বালি পাচারে বাধা দিতে গিয়ে খুন হয়েছেন তাঁরা। প্রাক্তন খনি মন্ত্রী পীযুষ গয়াল জানিয়েছিলেন, ২০১৫-’১৬ সালে ১৯ হাজার বেআইনি খননের ঘটনা হয়েছিল। যেগুলির মধ্যে বালি উত্তোলনের ঘটনাও রয়েছে।
১৭২০
এই পাচার রুখতে সরকারের কাছে একাংশের দাবি ছিল, বালি উত্তোলনকে বৈধতা দেওয়া হোক। তা হলে দুর্নীতি, খুন কমবে। যদিও পরিবেশবিদরা মনে করছেন, এ ভাবে সমস্যার সমাধান হবে না। উল্টে বাড়বে। আর এ ভাবে চললে খুব শীঘ্রই পৃথিবীর বুক থেকে বালি শেষ হয়ে যাবে।
১৮২০
২০১৪ সালে ইউএনইপি একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে জানিয়েছিল, বালি হল বিরল এক প্রাকৃতিক সম্পদ। তাই এর ব্যবহার কমানো উচিত। যথেচ্ছ নির্মাণেও লাগাম টানার পরামর্শ দিয়েছিল তারা।
১৯২০
গবেষকেরা মনে করেন, পৃথিবীতে বালির সঞ্চয় ধরে রাখতে তার পুনর্ব্যবহার প্রয়োজন। কিন্তু গ্লাস, প্লেটের মতো বাড়িঘর, ইমারতের ব্যবহার স্বল্পমেয়াদি নয়। দীর্ঘকাল ব্যবহারের জন্যই সে সব তৈরি করা হয়। ফলে বালি পুনর্ব্যবহারের সুযোগ কম।
২০২০
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বলছে, নির্মাণের উপর কর বৃদ্ধি করলে এই প্রবণতা কমবে। ফলে বালির ব্যবহারও কমবে। পাশাপাশি বাড়িঘর নির্মাণের ক্ষেত্রে বালির বিকল্পের কথাও ভাবতে হবে। সম্ভব হলে কাঠ, খড় বা মাটি দিয়ে বাড়ি তৈরি করতে হবে।