What is Project December: simulate the dead and how does it work dgtl
Project December
মৃতের সঙ্গে কথা বলার যন্ত্র! কী ভাবে কাজ করে ‘প্রজেক্ট ডিসেম্বর’? কেন কেউ দাবি করেনি স্বত্ব?
পুরো নাম ‘প্রজেক্ট ডিসেম্বর: সিমুলেট দ্য ডেড’। এই পরিষেবার বর্ণনায় বলা হচ্ছে, এটি বিশ্বের সর্বপ্রথম প্রযুক্তি, যার সাহায্যে সুপার কম্পিউটারের সহায়তায় যে কোনও ব্যক্তির সঙ্গে লিখিত ভাবে বাক্যালাপ সম্ভব।
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতাশেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০২৪ ১৩:৩০
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৮
প্ল্যানচেট বা প্রেতসিদ্ধের রোমাঞ্চ কাহিনি নয়, একেবারেই তথ্যপ্রযুক্তি শাসিত বাস্তব জগৎ। সেখানেই দাবি করা হচ্ছে, কৃত্রিম মেধা ব্যবহার করে পরলোকের বাসিন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগের বন্দোবস্ত পাকা। ইচ্ছা হলেই মুঠোফোনে অ্যাপ মারফত যোগাযোগ করা যাবে ‘তেনাদের’ সঙ্গে। আর ‘তেনারা’ও দিব্যি কথাবার্তা চালিয়ে যাবেন ইহজগতের বাসিন্দাদের সঙ্গে। সম্প্রতি এমনই এক খবর ভাইরাল হয়েছে নেটদুনিয়ায়।
০২১৮
মৃত প্রিয়জনের সঙ্গে যোগাযোগ করার উদ্দেশ্যে কীই না করেছে মানুষ! স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ থেকে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত পরলোকগত প্রিয়জনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য প্ল্যানচেটে বসতেন। বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনও চেষ্টা করছিলেন এমন এক যন্ত্র আবিষ্কারের, যার মাধ্যমে প্রেতলোকের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথোপকথন সম্ভব হবে। তার বাইরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ‘অকাল্ট’ বিশ্বাসীরা পরলোকের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপারে বিশ্বাস রাখেন। পশ্চিমি দেশগুলিতে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে প্রেতলোকের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার জন্য পেশাদার ‘মিডিয়াম’রা সক্রিয় রয়েছেন, এমন উদাহরণও বিরল নয়।
০৩১৮
সাহিত্য বা কল্পকাহিনিতে মৃত ব্যক্তির সঙ্গে যোগসাধনের কথা আকছার শোনা গেলেও বাস্তবে ইহ ও পরলোকের সংযোগ স্থাপন সম্ভব নয় বলেই বিশ্বাস করেন যুক্তিবাদে আস্থাশীল মানুষ। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তিই যদি দাবি করে, বিশেষ কোনও যন্ত্রের মাধ্যমে সে সংলাপ সম্ভব, তা হলে দীর্ঘ কাল ধরে লালন করে আসা যুক্তিবাদী মনন খানিকটা টাল খেয়ে যায় বইকি!
০৪১৮
সংবাদমাধ্যম ‘দ্য মেট্রো’র একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে মৃত ব্যক্তিদের সঙ্গে ‘যোগাযোগের’ নতুন নতুন উপায় খুঁজে বার করার চেষ্টা করছেন গবেষক এবং প্রযুক্তিবিদেরা। এ ক্ষেত্রে কোনও অতিপ্রাকৃত উপায় নয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়েই কাজটি সম্পন্ন হবে বলে জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা।
০৫১৮
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণারত মানুষদের অনেকেই জানাচ্ছেন, এমন পরিষেবা পাওয়া সম্ভব, যা ব্যবহার করে মৃত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথোপকথন চালিয়ে যাওয়া যাবে। ‘দ্য মেট্রো’র প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, নিউ ইয়র্কের বাসিন্দা ক্রিস্টি অ্যাঞ্জেল ‘প্রজেক্ট ডিসেম্বর’ নামের এক এআই পরিষেবার মাধ্যমে তাঁর এক প্রয়াত বন্ধুর সঙ্গে কথোপকথন চালাতে সমর্থ হয়েছেন।
০৬১৮
কী এই ‘প্রজেক্ট ডিসেম্বর’? এই এআই পরিষেবাটির পুরো নাম ‘প্রজেক্ট ডিসেম্বর: সিমুলেট দ্য ডেড’। এই পরিষেবার বর্ণনায় বলা হচ্ছে, এটি বিশ্বের সর্বপ্রথম প্রযুক্তি, যার সাহায্যে সুপার কম্পিউটারের সহায়তায় যে কোনও ব্যক্তির সঙ্গে লিখিত ভাবে বাক্যালাপ সম্ভব। উদ্দিষ্ট ব্যক্তি মৃত হলেও কোনও অসুবিধা নেই। কথোপকথন সে ক্ষেত্রেও সম্ভব। উল্লেখ্য, ‘প্রজেক্ট ডিসেম্বর’-এর স্বত্ব এখনও পর্যন্ত গৃহীত হয়নি।
০৭১৮
‘প্রজেক্ট ডিসেম্বর’-এর পরিষেবা পেতে গেলে কিঞ্চিৎ খরচ করতে হবে। ন্যূনতম ১০ আমেরিকান ডলারের বিনিময়ে এই পরিষেবায় প্রবেশ করা যাবে। আমেরিকান কম্পিউটার প্রোগ্রামার জ্যাসন রোহ্রার এই বিশেষ প্রযুক্তিটির আবিষ্কর্তা। এটি আসলে একটি ‘অনলাইন চ্যাটবট’। এটি অন্যান্য চ্যাটবটের মতোই কাজ করে। কিন্তু চ্যাটজিপিটি বা অন্য ‘বট’গুলির সঙ্গে এটির এক ভিত্তিগত পার্থক্য রয়েছে। এখানে চ্যাট করার আগে অ্যালগরিদমকে কিছু তথ্য প্রদান করতে হয়। সেই অনুযায়ীই এই চ্যাটবট কাজ করে।
০৮১৮
যদি এই ‘বট’টিকে ব্যবহারকারী তাঁর পরিচিত প্রয়াত কোনও ব্যক্তি সংক্রান্ত তথ্য প্রদান করে কথোপকথন শুরু করেন, তা হলে ‘প্রজেক্ট ডিসেম্বর’ সেই মৃত ব্যক্তির মতো করেই উত্তর দেবে। ব্যবহারকারীর মনে হবে, তিনি প্রকৃতই মৃত ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলছেন। শুধু মৃত ব্যক্তি নন, এই ‘বট’-এর মাধ্যমে কাল্পনিক ব্যক্তির সঙ্গেও সংলাপ সম্ভব।
০৯১৮
কার্যত ‘প্রজেক্ট ডিসেম্বর’ মৃত ব্যক্তির ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। বা সোজা কথায় তাঁর ‘প্রক্সি’ দিচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই তার পক্ষে সেই মৃত ব্যক্তিটি হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। কিন্তু তার সঙ্গে আলাপরত ব্যক্তিটির তরফে এই বিভ্রম সৃষ্টি হওয়া সম্ভব যে, তিনি প্রকৃতই তাঁর মৃত প্রিয়জনের সঙ্গে কথা বলছেন। এই বিভ্রান্তি একসময়ে ভয়াবহ আকার নিতে পারে বলে মনে করছেন এআই এথিক্স এবং প্রযুক্তির দর্শন নিয়ে চর্চারত গবেষকেরা।
১০১৮
এআই জগৎ কৃত্রিম ভাবে নির্মিত মৃত ব্যক্তিদের সত্তাকে ‘এআই ঘোস্ট’ হলে উল্লেখ করছে। প্রথমেই এই প্রশ্ন উঠেছে যে, প্রয়াত প্রিয়জনের সঙ্গে এই কৃত্রিম কথোপকথনে কি তাঁদের জীবিত স্বজন সান্ত্বনা পাচ্ছেন? না কি বিভ্রমের পর বিভ্রমের পরত তাঁদের আরও বেশি শোকগ্রস্ত এবং উদ্বিগ্ন করে তুলছে? জীবিতাবস্থায় তাঁরা প্রিয়জনকে যে কথাগুলি বলতে পারেননি বা বলা যায়নি, তা এই কৃত্রিম সত্তাটিকে বলা যাচ্ছে আনায়াসেই। সে ক্ষেত্রে সঙ্গত বা অসঙ্গতের সংজ্ঞাও কি বদলে যাচ্ছে না?
১১১৮
উত্তরে চর্চারতsরা জানাচ্ছেন, ‘এআই ঘোস্ট’দের ক্রিয়াকলাপ যতখানি ‘স্বাভাবিক’ বলে মনে করা হচ্ছে, আদৌ তেমন নয়। তারা মৃত ব্যক্তির প্রকৃত সত্তার বিকল্প কিছুতেই হয়ে উঠতে পারে না। পারছেও না। সদ্য প্রিয়জন বিয়োগের যন্ত্রণার উপশমে তারা কিছুটা প্রলেপ দিতে পারে মাত্র।
১২১৮
কিন্তু ‘এআই ঘোস্ট’ কি সত্যিই এতখানি নিরীহ? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে খানিক থমকাচ্ছেন চর্চাকারীরা। প্রাথমিক ভাবে প্রিয়জনহারা অনেক শোকগ্রস্তই ‘ঘোস্ট বট’-এ আসক্ত হয়ে পড়তে পারেন। এই বিভ্রম তাঁদের শোক ভোলানোর নামে কোনও ‘নেশা’য় আসক্ত করে তুলছে কি না, এমন প্রশ্ন তুলছেন সাইবার এথিক্স চর্চাকারীরা।
১৩১৮
বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, ‘ডিজিটাল প্রেতাত্মা’র সঙ্গে তাঁদের প্রিয়জনের মোলাকাত সাময়িক আনন্দের সৃষ্টি করতে পারে। জীবদ্দশায় যে প্রশ্ন সেই ব্যক্তিকে করা সম্ভব হয়নি, তা করা যেতে পারে। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত ‘ঘোস্ট বট’ তাঁদের কোনও স্থায়ী সান্ত্বনা দিতে পারে না। বরং শোকগ্রস্ত মানুষকে আরও বেশি করে শোকের দিকে ঠেলে দিতে পারে ‘ডিজিটাল প্রেত’-এর উপস্থিতি। বাড়িয়ে তুলতে পারে কোনও সম্পর্কের অসম্পূর্ণতা নিয়ে আক্ষেপ। যা থেকে জটিল মনোবিকার দেখা দেওয়াও অসম্ভব নয় বলে মত বিশেষজ্ঞদের একাংশের।
১৪১৮
আয়ারল্যান্ডের মনোবিদ নিগেল মুলিগ্যান ‘ডিজিটাল প্রেতাত্মা’র সঙ্গে ‘ইহ’জগতের ভাব বিনিময় নিয়ে কাজ করছেন। ‘দ্য কনভারশেসন’ ওয়েব জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণা নিবন্ধে মুলিগ্যান ফিরে যাচ্ছেন আধুনিক মনোবিজ্ঞানের জনক সিগমুন্ড ফ্রয়েডের ভাবনার কাছে। প্রিয়জন বিয়োগের পর মনের অবস্থা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ফ্রয়েড দেখিয়েছিলেন, যে সব মৃত্যু অস্বাভাবিক বা আকস্মিক, তা থেকে মৃতের প্রিয়জনেরা অনেক বেশি শোকাহত হন। দুর্ঘটনায় নিহত বা খুন হওয়া মানুষের প্রিয়জনের কাছে তাই ‘ঘোস্ট বট’ অপরাধবোধ পর্যন্ত বয়ে আনতে পারে বলে মুলিগ্যান মনে করছেন।
১৫১৮
প্রেতলোকের কল্পনা এবং তা থেকে জন্মানো ইহলোকের সমস্যা নিয়ে এই সময়ের অনেক চিন্তকই কাজ করে চলেছেন। আমেরিকান সাহিত্যিক তথা দর্শন চর্চাকারী টমাস লিগোটি তাঁর ‘দ্য কন্সপিরেসি আগেন্সট দ্য হিউম্যান রেস’ গ্রন্থে। লিগোটির যুক্তি মেনে চললে তথাকথিত প্রেতের সঙ্গে কথোপকথনরত মানুষের এমন ভ্রম হতেই পারে যে, ‘পরলোক’ ইহজগতের থেকে অধিকতর সুখের। সেই বিন্দু থেকে তিনি অবসাদগ্রস্ত হয়েও পড়তে পারেন।
১৬১৮
নিগেল মুলিগ্যান আরও জানাচ্ছেন, ‘ঘোস্ট বট’ তার সঙ্গে কথোপকথনরত শোকগ্রস্ত মানুষকে ভুল পরামর্শ দিয়ে বিভ্রান্তও করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে তিনি দেখিয়েছেন এ জাতীয় একটি ‘চ্যাট বট’ ২০২৩ সালে এক ব্যক্তিকে বিনা কারণে বিবাহবিচ্ছেদের পরামর্শ দেয়। নিগেলের বক্তব্য, সদ্য সন্তানহারা কোনও বাবা বা মা, তাঁর প্রয়াত সন্তানের জবানিতে ‘ঘোস্ট বট’-এর কারিকুরিতে এমন কথাও শুনতে পারে যে, জীবদ্দশায় সন্তান প্রকৃত ভালবাসা পায়নি বা বাবা-মায়ের তরফ থেকে শুধুই অবহেলা পেয়েছে।
১৭১৮
নিগেল আরও দেখাচ্ছেন, ‘ঘোস্ট বট’ চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে তার সঙ্গে কথোপকথনরত ব্যক্তিকে পরলোকে আসার জন্য আহ্বান করছে বা সোজা কথায়, আত্মহননের প্ররোচনা দিচ্ছে অথবা কারও ক্ষতি করার পরামর্শ দিচ্ছে। ২০২৩ সালে ব্রিটেনের সরকার কৃত্রিম মেধাকে হিংসার প্ররোচনায় ব্যবহার করা রুখতে একটি আইন প্রণয়নও করে।
১৮১৮
শোক আর কৌতূহলকে মানবিক সীমানার মধ্যেই আবদ্ধ রাখতে পরামর্শ দিচ্ছেন নিগেল। সময় যে শোকের উপর প্রলেপ দেয়, সেই পুরনো উপলব্ধিকেই তিনি নতুন করে ব্যক্ত করছেন। প্রয়াত মানুষের জন্মদিন বা প্রয়াণদিবস উদ্যাপনের মধ্যেই শান্তির খোঁজ রয়েছে। ‘ঘোস্ট বট’-এর সহায়তায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে গেলে বিভ্রান্তি ছাড়া অন্য কিছুই যে মিলবে না, সে কথা তিনি গুরুত্বের সঙ্গে জানিয়েছেন।