পাখির জাত, খাওয়ার ধরন দেখে ভাগ্যগণনা! ‘অরনিথোম্যান্সি’র চর্চা চলত প্রাচীন ভারতেও
প্রাচীনকালে ইহুদিদের মধ্যেও যে অরনিথোলজির চর্চা প্রচলিত ছিল, তার প্রমাণ রয়েছে বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে।
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতাশেষ আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১০:০৭
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৯
বাংলায় ছাপাখানা তৈরির পর থেকেই প্রায় একটি বই ফুটপাথে শোভা পেতে শুরু করে। সেটির নাম ‘কাক চরিত্র’। সেই বইতে কাকের গতিবিধি ও আচরণ বিশ্লেষণ করে মানুষের ভাগ্যনির্ণয়ের পদ্ধতি বর্ণিত রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে কাককে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন অভীষ্ট সিদ্ধির উপায়।
০২১৯
‘কাক চরিত্র’ বইটি এতটাই আজগুবি যে, তার অধিকাংশ ক্রেতাই নিছক মজা পাওয়ার জন্য বইটি সংগ্রহ করেন। কিন্তু, আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে ব্যাপারটা মোটেই ‘মজার’ ছিল না। কাক বা আরও বেশ কিছু পাখির আচরণ, ডাকাডাকি ও গতিবিধি বিশ্লেষণ করে মানুষের ভাগ্য নির্ধারণের বিদ্যা বিভিন্ন সভ্যতাতেই প্রচলিত ছিল। সেই বিদ্যা কোথাও ‘অরনিথোম্যান্সি’, আবার কোথাও বা ‘অগারি’ নামে পরিচিত ছিল।
০৩১৯
প্রাচীন গ্রিসে মহাকবি হোমার বা হেসিয়ডের রচনায় অরনিথোম্যান্সির উল্লেখ রয়েছে। হোমার রচিত মহাকাব্য ‘ওডেসি’-তে একটি ঈগলকে আকাশের ডান দিকে তিন বার এক মৃত ঘুঘু-সহ উড়ন্ত অবস্থায় দেখা গেলে, তার ব্যাখ্যা ওডেসিয়াসকে জানাতে এক জন অগার (যাঁরা অগারি চর্চা করতেন)-কে নিয়ে আসা হয়। সেই ব্যক্তি জানান, ঈগলের এ হেন উড়ান থেকে জানা যাচ্ছে, ওডেসিয়াসের স্ত্রীর পাণিপ্রার্থীদের মৃত্যু ঘটেছে। প্রসঙ্গত, ট্রয়ের যুদ্ধে যোগদান করতে ওডেসিয়াস রাজ্য ছেড়েছিলেন। যুদ্ধশেষে বাকি সব রাজারা ফিরে এলেও ওডেসিয়াসের ফিরতে ১০ বছর সময় লেগে গিয়েছিল। এই সময়ে তাঁর স্ত্রী পেনেলোপিকে বহু যুবক বিয়ে করার জন্য উঠেপড়ে লাগেন।
০৪১৯
গ্রিক ট্র্যাজেডির জনক ইস্কাইলাস তাঁর ‘প্রমিথিউস’ নাটকে জানিয়েছিলেন যে, কিংবদন্তির বীর প্রমিথিউস (যিনি মানুষের জন্য দেবতাদের কাছ থেকে আগুন চুরি করে এনেছিলেন) নাকি অরনিথোম্যান্সির প্রবর্তক। প্রমিথিউসই নাকি নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন, কোন পাখিগুলি ‘শুভ’ আর কোনগুলি ‘অশুভ’ সঙ্কেত বহন করে।
০৫১৯
অরনিথোম্যান্সি দু’রকম হতে পারে। এক, কোনও অগার স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে পাখিদের আচরণ দেখে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন। দুই, কেউ পেশাদার অগারের কাছে গিয়ে তাঁর দেখা বা তাঁর স্বপ্নে দেখা কোনও পাখির আচরণের ব্যাখ্যা জেনে নিতে পারেন।
০৬১৯
গ্রিক অরনিথোম্যান্সির সঙ্গে রোমান অগারির কিছু পার্থক্য ছিল। রোমান অগাররা সাধারণত পাখির উড়ান দেখে ভবিষ্যদ্বাণী করতেন। প্রাচীন রোমে অগাররা পুরোহিতের মর্যাদাপ্রাপ্ত ছিলেন। রোমান অগারদের দাবি ছিল, তাঁরা পাখিদের আচরণ দেখে ঈশ্বরের অভিপ্রায় বুঝতে পারেন।
০৭১৯
রোমান অগাররা পাখির উড়ানের দিক, তাদের জাত, সংখ্যা, এমনকি তাদের খাওয়ার ধরন ও খাবারের পরিমাণ দেখেও নাকি ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারতেন। ব্যক্তিমানুষের ভাগ্যগণনার পাশাপাশি, তাঁরা ব্যবসা-বাণিজ্য, যুদ্ধ এবং ধর্ম বিষয়েও ভবিষ্যদ্বাণী করতেন।
০৮১৯
প্রাচীনকালে ইহুদিদের মধ্যেও যে অরনিথোলজির চর্চা প্রচলিত ছিল, তার প্রমাণ রয়েছে বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে। ইহুদি কিংবদন্তি অনুযায়ী, রাজা সলোমন ছিলেন বহুবিদ্যা বিশারদ। সর্বোপরি বিভিন্ন রকমের জাদুবিদ্যায় তাঁর বিপুল দক্ষতা ছিল। এই জাদুগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল পাখিদের আচরণ বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যৎ নির্ধারণের ক্ষমতা। হিব্রু বাইবেলের বিবরণ ও বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়, সলোমন প্রাচ্য ও প্রাচীন মিশরের যাবতীয় জ্ঞান আয়ত্ত করেছিলেন। তার মধ্যে পাখিদের ভাষা অন্যতম।
০৯১৯
ইহুদি ধর্মগ্রন্থ ‘তালমুদ’-এ বর্ণিত একটি কাহিনি অনুসারে, সলোমন তাঁর বিখ্যাত মন্দিরটি নির্মাণের সময় শামির নামে এক পোকাকে পাথর কাটার কাজে লাগিয়েছিলেন। শামিরের মালিক ছিল ‘হুপো’ নামের এক পাখি। সলোমন দানবরাজ অ্যাশমোডাইকে প্রভাবিত করে হুপোর অবস্থান জানতে চান। দানবেরা নাকি পাখিদের সঙ্গে কথোপকথনের বিদ্যা জানত। সলোমনকে তারা এই বিষয়ে সাহায্য করে।
১০১৯
সলোমনের এই কাহিনিটি থেকে অনুমান করা যায়, ‘দানব’রাই অরনিথোম্যান্সির প্রাচীনতম চর্চাকারী। সলোমনের নামে চলিত দু’খানি গ্রন্থ— ‘গ্রেটার কি অফ সলোমন’ এবং ‘লেসার কি অফ সলোমন’ দানব-সহ বিভিন্ন অতিপ্রাকৃত প্রাণীর বর্ণনা দেয়। সেই সঙ্গে এদের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করে অতিলৌকিক শক্তির অধিকারী হওয়ার পদ্ধতিও বর্ণনা করে। এই সব শক্তির মধ্যে পশু-পাখির ভাষা বোঝার ক্ষমতা অন্যতম। ভারতের জনপ্রিয় কিংবদন্তি ‘বত্রিশ পুত্তলিকা’ এবং ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’তে রাজা বিক্রমাদিত্যেরও এই ক্ষমতা ছিল বলা হয়েছে।
১১১৯
রাজা সলোমন ও রানি শেবার কিংবদন্তি থেকে জানা যায়, তাঁদের মধ্যে দৌত্য করেছিল ‘হুদহুদ’ নামের একটি পাখি। প্রসঙ্গত, হুদহুদ আসলে হুপোরই আর এক নাম।
১২১৯
প্রাচীন এই সব কাহিনি-কিংবদন্তি ছাড়াও আনাতোলিয়ার হিটাইটরা ত্রয়োদশ বা চতুর্দশ শতকে অরনিথোম্যান্সির চর্চা করত বলে জানা যায়।
১৩১৯
মধ্যযুগে ইউরোপে অ্যালকেমিস্ট ও ডার্ক ম্যাজিক চর্চাকারীদের অনেকেই পাখির আচরণ নিয়ে বিবিধ গবেষণা করেছিলেন বলে জানা যায়। তাঁদের কেউ কেউ অরনিথোম্যান্সিতে পারঙ্গম ছিলেন বলেও কথিত আছে।
এশিয়ার বিভিন্ন সংস্কৃতিতে অরনিথোম্যান্সির অস্তিত্বের কথা জানা যায়। ভারতীয় সংস্কৃতিতে এর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ অবশ্যই ‘কাক চরিত্র’। তবে, এর বাইরেও জনজাতিদের মধ্যে এই বিদ্যার চল রয়েছে, যা মৌখিক পরম্পরায় টিকে রয়েছে।
১৬১৯
অরনিথোম্যান্সিতে সব থেকে বেশি আলোচিত হয় কাক আর পেঁচারা। ইউরোপে ম্যাগপাই নিয়েও বিস্তর সংস্কার রয়েছে। তবে রাত্রিচর পাখিদের ঘিরে অশুভ সঙ্কেতের কথা বার বার ইউরোপীয় সাহিত্যে বা লোকবিশ্বাসে ঘুরেফিরে আসে।
১৭১৯
কেন মানুষ পাখিদের আচরণে ভবিষ্যৎ দেখতে চেয়েছিল— এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, পাখি যে হেতু আকাশচারী জীব, মানুষ তাকে স্বর্গের নিকটবর্তী প্রাণী বলে মনে করে। বহু সংস্কৃতিতে পাখি ‘ঈশ্বরের দূত’ও। খ্রিস্ট ধর্মে ঘুঘুপাখিকে ‘পবিত্র আত্মা’র প্রতীক বলে বর্ণনা করা হয়। এই সব কারণেই পাখিদের আচরণে ভবিতব্যকে দেখতে চেয়েছিল মানুষ। আর তা থেকেই জন্ম হয় অরনিথোম্যান্সির মতো বিদ্যাচর্চার।
১৮১৯
কাক বা পেঁচার মধ্যে মানুষ যুগে যুগে রহস্যময়তার সন্ধান পেয়েছে। কাকের আচরণ যে অনেক সময়েই বিদঘুটে, তা অনস্বীকার্য। এডগার অ্যালান পো-র কবিতা থেকে গ্রিম ভাইদের রূপকথায়, এমনকি শেক্সপিয়রের ‘ম্যাকবেথ’ ও ‘হ্যামলেট’ নাটকে কাক বা দাঁড়কাক রীতিমতো ইঙ্গিতময় ভূমিকায় উপস্থিত।
১৯১৯
ভারতে প্রচলিত ‘কাক চরিত্র’ যত আজগুবি বই-ই হোক না কেন, এর মধ্যে নিহিত রয়েছে আদিম জাদুবিশ্বাস। এই বইতে বর্ণিত ক্রিয়াকলাপকে উদ্ভট বলে মনে হলেও এগুলি যে ‘কালো জাদু’ হিসাবে এক সময়ে চর্চিত হত, তা বোঝা যায়। শেষমেশ একটা প্রশ্ন থেকেই যায় যে, মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সংযুক্তি যে সময় নিবিড় ছিল, তখনই এ ধরনের বিদ্যার জন্ম হয়েছিল। আজকের প্রকৃতি-বিচ্ছিন্ন মানুষের কাছে সেই বিদ্যা নেহাতই আজগুবি।