মহাকাশযানের ‘শ্মশান’! জনমানবহীন ‘শিব ঠাকুরের আপন দেশ’ বহু বছর ধরে কৌতূহলের কেন্দ্রে
পয়েন্ট নিমোর সবচেয়ে নিকটবর্তী যে স্থলভাগগুলি রয়েছে, তার কোথাও জনবসতি নেই। গভীর সমুদ্রতলে নেই কোনও প্রাণের অস্তিত্ব।
নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতাশেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৯:০৩
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৭
মহাকাশে নয়, বরং মহাকাশযানের ‘শ্মশান’ রয়েছে পৃথিবীর বুকেই। স্থলভাগ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এই জায়গায় রয়েছে গভীর সমুদ্র। ঠিকানাহীন এই জায়গাটির নাম ‘পয়েন্ট নিমো’। কোনও দেশের অংশ না হওয়ায় এখানে কোনও আইনের প্রচলনও নেই। যেন ঠিক ‘শিব ঠাকুরের আপন দেশ’!
০২১৭
পার্শ্ববর্তী জনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলির সঙ্গে এই অঞ্চলের কোনও রকম যোগাযোগ নেই। এর সবচেয়ে নিকটবর্তী স্থলভাগগুলির মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের অন্তর্গত ডুকি দ্বীপপুঞ্জ। পয়েন্ট নিমো থেকে এই দ্বীপপুঞ্জের দূরত্ব ২,৭০৪ কিলোমিটার।
০৩১৭
এ ছাড়াও কাছাকাছি স্থলভাগের মধ্যে রয়েছে ইস্টার দ্বীপপুঞ্জ, মাহের দ্বীপপুঞ্জ, মেরি বায়ার্ড ল্যান্ড। কিন্তু এই দ্বীপপুঞ্জগুলির মধ্যে কোথাও জনবসতি নেই। পয়েন্ট নিমোও রয়েছে এই তালিকায়। এমনকি, যাতায়াতের সুবিধাও নেই এখানে।
০৪১৭
শুধু মাত্র নৌকোর মাধ্যমে এখানে যাতায়াত করা যায়। পয়েন্ট নিমোয় পৌঁছতে নিকটবর্তী জনবসতি থেকে দু’সপ্তাহেরও বেশি সময় লাগে। বিমানে যাওয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই এখানে।
০৫১৭
১৯৭১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই এলাকায় মোট ২৬৩টি মহাকাশযানের ধ্বংসাবশেষ ফেলা হয়েছে। এর মধ্যে রাশিয়ার একটি স্পেস স্টেশন মির, সালয়ুত স্পেস স্টেশন প্রোগ্রামের অন্তর্গত ছ’টি স্টেশন এবং নাসার স্কাইল্যাব স্পেস স্টেশনের অবশিষ্টাংশও এখানে ফেলা হয়েছে।
০৬১৭
ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইএসএ), জাপান এয়্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি (জাক্সা), ১৪০টি রাশিয়ার পরিবহণকারী মহাকাশযান, স্পেসএক্স-এর একটি রকেটের ধ্বংসাবশেষ। এমনকি, ২০২৮-৩০ সালে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন (আইএসএস)-এর আয়ু শেষ হলে পয়েন্ট নিমোয় ফেলা হবে।
০৭১৭
সমুদ্রের ১,৬০১ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে শুধু মাত্র মহাকাশযানের অবশিষ্টাংশ খুঁজে পাওয়া যায়, যার বেশির ভাগ স্টিল, অ্যালুমিনিয়াম, টাইটানিয়াম দিয়ে তৈরি। এ ছাড়াও কিছু তেজস্ক্রিয় উপাদান এবং হাইড্রাজিনের মতো ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ থাকে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, জলের মধ্যে এই পদার্থগুলির উপস্থিতির কারণে এখানে কোনও সামুদ্রিক প্রাণী লক্ষ করা যায় না।
০৮১৭
আমেরিকার বিখ্যাত লেখক এইচপি লভক্রাফ্ট তাঁর লেখা ‘দ্য কল অব থুলু’ গল্পে এমন এক জায়গার কথা উল্লেখ করেছেন, যেখানে কোনও জনবসতি নেই, এমনকি কোনও সামুদ্রিক প্রাণীও নেই। তবে, এই গল্পটি ১৯২৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। তখন পয়েন্ট নিমোর কোনও হদিসই পায়নি বিশ্ববাসী।
০৯১৭
১৯৯৭ সালে আমেরিকার ন্যাশনাল ওশ্যানিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এনওএএ)-এর গবেষকরা পয়েন্ট নিমোর কাছে একটি নিম্ন কম্পাঙ্কের উপস্থিতি টের পান।
১০১৭
সেই কম্পাঙ্কের ফলে এক ধরনের শব্দও শোনা যেত। প্রথম দিকে এর কোনও উৎস খুঁজে পাননি গবেষকরা।
১১১৭
লভক্রাফ্টের অনুরাগীরা দাবি করতেন, গল্পের চরিত্র এবং পটভূমি এখানে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এই আওয়াজ থুলুর কণ্ঠস্বর। প্রসঙ্গত, ‘থুলু’ লভক্রাফ্টের গল্পে বার বার ফিরে আসা এক মহা-অস্তিত্ব যা অতিজাগতিক আতঙ্কের জন্ম দেয়।
১২১৭
এমনকি, এখানে কোনও সামুদ্রিক প্রাণীও নেই ঠিক যেমন গল্পেও উল্লেখ করেছেন লভক্রাফ্ট। এত সাদৃশ্য থাকায় তাঁরা মেনে নিয়েছিলেন যে, বাস্তবেও অস্তিত্ব রয়েছে থুলুর।
১৩১৭
কিন্তু পরবর্তীকালে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে জানান, হিমবাহের চলনের ফলে এই শব্দের সৃষ্টি হয়। মহাকাশযানের অবশিষ্টাংশ থেকে যে ক্ষতিকর রাসায়নিক নিঃসৃত হয়, তার জন্যও এখানে কোনও প্রাণী থাকতে পারে না।
১৪১৭
কেউ কেউ মনে করেন, সমুদ্রের জলে তীব্র বিপরীতমুখী স্রোত তৈরি হওয়ার ফলে সেখানে কোনও পুষ্টিকর উপাদান পৌঁছতে পারে না। ওই এলাকার সমুদ্রের জলে খাবার পাওয়া যায় না বলেই কোনও প্রাণীও নেই।
১৫১৭
ক্রোয়েশিয়া-কানাডার এক সার্ভে ইঞ্জিনিয়ার লুকাতেলা ১৯৯২ সালে ম্যাপিং পদ্ধতির মাধ্যমে এই এলাকার অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশের গণনা করেছিলেন।
১৬১৭
এই অঞ্চলের নামকরণের পিছনেও অন্য গল্প রয়েছে। জুলে ভার্নের বিখ্যাত চরিত্র ক্যাপ্টেন নিমো। তার নামের উপর ভিত্তি করেই এখানকার নাম দেওয়া হয়। লাটিন ভাষায় ‘নিমো’ শব্দের অর্থ ‘কেউ নয়’।
১৭১৭
পয়েন্ট নিমো জায়গাটিতে প্রাণের কোনও অস্তিত্ব নেই বলেই হয়তো সাদৃশ্য রেখে এমন নামকরণ করা হয়েছে। সামুদ্রিক প্রাণীর কোনও অস্তিত্ব না থাকলেও পয়েন্ট নিমোর সমুদ্রপাতে আগ্নেয়গিরির ফলে যে ফাটল তৈরি হয়, সেখানে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতির প্রমাণ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।