Take a look at the life and legacy of former President Pranab Mukherjee dgtl
Pranab Mukherjee
সংগ্রহ করতেন নিজের কার্টুন, রাষ্ট্রপতি ভবনে সে সবের প্রদর্শনীও করেন প্রণব
প্রণব মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণে দেশীয় রাজনীতিতে এক অপূরণীয় শূন্যতা নেমে এল।
নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০২০ ১৮:৫৩
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১৩৯
জীবনের সুদীর্ঘ ও বর্ণময় রাজনৈতিক অধ্যায়কে সরিয়ে রেখে শপথ নিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি পদে। কিন্তু সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে বসেও ঘনিষ্ঠ মহলে আক্ষেপ করতে শোনা গিয়েছিল তাঁকে। প্রাত্যহিক রাজনৈতিক উদ্দীপনা যে কতটা ‘মিস’ করেন, অকপটে তা জানিয়েছিলেন। সেই প্রণব মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণে দেশীয় রাজনীতিতে এক অপূরণীয় শূন্যতা নেমে এল।
০২৩৯
সম্পূর্ণ নিজের দক্ষতায় একসময় জাতীয় রাজনীতিতে অপরিহার্য হয়ে উঠেছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তাই কংগ্রেস তাঁকে ‘প্রাপ্য সম্মান’ না দিলেও, দলের বিরুদ্ধে কখনও মন্তব্য করতে শোনা যায়নি তাঁকে। আবার বিরোধীদের সঙ্গেও সদ্ভাব বজায় রেখে চলতেন তিনি। যে কারণে সকলেই সমীহ করতেন তাঁকে। তাঁর মৃত্যুতে তাই শোকের ছায়া নেমে এসেছে রাজনৈতিক মহলে।
০৩৩৯
১৯৩৫ সালের ১১ ডিসেম্বর বীরভূমের মিরাটি গ্রামে জন্ম প্রণব মুখোপাধ্যায়ের। বাবা কামদাকিঙ্কর ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। ১৯৫২ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় কংগ্রেসের পরিষদীয় দলের সদস্য ছিলেন তিনি। তিনি এআইসিসি-র সদস্যও ছিলেন।
০৪৩৯
১৯৪৬ সালের অগস্ট মাসে দাদার বিয়ে উপলক্ষে প্রথম কলকাতায় আসা প্রণব মুখোপাধ্যায়ের। ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে পরিবার ও আত্মীয়দের সঙ্গে বেশ কিছু দিন কলকাতায় আটকে থাকতে হয়েছিল তাঁকে।
০৫৩৯
তবে রাজনৈতিক পরিবেশে বড় হলেও, রাজনীতিতে প্রণবের হাতেখড়ি হয় ঢের দেরিতেই। সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে পাশ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাস এবং এলএলবি-তে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন তিনি।
০৬৩৯
এর পর কেন্দ্রীয় সরকারের পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফ বিভাগে সাধারণ কেরানি হিসেবে কাজে যোগ দেন তিনি। ‘দেশের ডাক’ নামের একটি পত্রিকায় সাংবাদিকতাও করেন প্রণব। ১৯৬৩ সালে বিদ্যানগর কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন।
০৭৩৯
১৯৬৯ সালে রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয় প্রণব মুখোপাধ্যায়ের। সে বছর মেদিনীপুর উপনির্বাচনে নির্দল প্রার্থী ভিকে কৃষ্ণ মেননের নির্বাচনী প্রচারকে সফল করে তোলেন তিনি। সেই সূত্রেই ইন্দিরা গাঁধীর নজর পড়ে তাঁর উপর। প্রণব মুখোপাধ্যায়কে কংগ্রেসের সদস্য করে নেন তিনি।
০৮৩৯
সে বছরই জুলাই মাসে রাজ্যসভার সাংসদ নির্বাচিত হন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তার পর মোট চার বার, ১৯৭৫, ’৮১, ’৯৩ এবং ’৯৯ সালে রাজ্যসভায় নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৮০-র জানুয়ারি থেকে ১৯৮৪-র ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি রাজ্যসভায় কংগ্রেসের দলনেতাও ছিলেন।
০৯৩৯
বাংলা কংগ্রেসে তাঁর রাজনৈতিক গুরু ছিলেন অজয় মুখোপাধ্যায় ও সুশীল ধাড়া। ১৯৬৯ সালে রাজ্যসভার সাংসদ হওয়ার পরে ‘শিক্ষক’ হিসেবে পেয়েছিলেন প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী এম সি চাগলা এবং স্বাধীন ভারতের প্রথম অ্যাটর্নি জেনারেল এম সি শেতলওয়াড়কে (সমাজকর্মী তিস্তা শেতলওয়াড় ঠাকুরদা)।
১০৩৯
বাংলা কংগ্রেসের টিকিটে রাজ্যসভা সাংসদ হওয়ার পরে প্রথম বক্তৃতা পশ্চিমবঙ্গ বিধান পরিষদ অবলুপ্তির প্রস্তাবের সমর্থনে। ঘটনাচক্রে, প্রণবের বাবা কামদাকিঙ্কর সেইসময় কংগ্রেসের বিধান পরিষদীয় সদস্য ছিলেম। রাজ্যসভায় প্রণবের দ্বিতীয় বক্তৃতা ছিল, ইন্দিরা গাঁধী সরকারের ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের সিদ্ধান্তের সমর্থনে।
১১৩৯
রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার ঢের আগেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তাঁর স্ত্রী শুভ্রার জন্ম অধুনা বাংলাদেশের যশোরে। ১০ বছর বয়সে সপরিবারে কলকাতা চলে আসেন তিনি। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বাবা কামদাকিঙ্করের সঙ্গে তাঁদের পূর্ব পরিচিতি ছিল। সেই সুবাদেই হুগলির উত্তরপাড়ায় তাঁদের থাকার ব্যবস্থা হয়। সেখান থেকে ইতিহাস এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পাশ করেন শুভ্রা এবং পরবর্তী কালে শিক্ষকতায় যোগ দেন।
১২৩৯
শোনা যায়, শুভ্রা যে সময় হাওড়ার একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন, সেইসময় কদমতলায় বড়দিদির বাড়িতে থাকতেন প্রণব। সেখানে যাতায়াত ছিল শুভ্রার। সেই সূত্রেই দু’জনের মধ্যে আলাপ বাড়ে। ১৯৫৭ সালের ১৩ জুলাই প্রণব ও শুভ্রা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
১৩৩৯
১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে ইন্টার পার্লামেন্টরি ইউনিয়নের অধিবেশনে প্রণব মুখোপাধ্যায়কে ভারতীয় প্রতিনিধি দলের সদস্য মনোনীত করেন ইন্দিরা। সেখানে পাক সেনার ভয়াবহ অত্যাচারের বিবরণ তুলে ধরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সমর্থনে সওয়াল করেন প্রণব।
১৪৩৯
১৯৭৭ সালে জনতা পার্টির সরকার নিয়োজিত শাহ কমিশনে সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করায় ১৭৮-১৭৯ ধারায় ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত করা হয় প্রণবকে। যদিও শেষমেশ পর্যন্ত দিল্লি হাইকোর্টের রায় তাঁর পক্ষেই যায়।
১৫৩৯
১৯৭৭-এর ৩ অক্টোবর ইন্দিরা গাঁধী-সহ কয়েক জন কংগ্রেস নেতাকে গ্রেফতার করে সিবিআই। প্রণব খবর পেয়েছিলেন, তাঁকেও কিছু ক্ষণের মধ্যেই গ্রেফতার করা হবে। দ্রুত কয়েকটি বই, জামাকাপড়, পাইপ আর তামাক গুছিয়ে নিয়ে বাংলোর লনে সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করেন তিনি। কিন্তু গভীর রাত পর্যন্ত কেউ তাঁকে গ্রেফতার করতে যাননি।
১৬৩৯
১৯৭৮ সালে কংগ্রেসের ভাঙনের পরে দিল্লির বিট্টলভাই পটেল স্টেডিয়ামে নবগঠিত কংগ্রেস(ই)-র সভানেত্রী হিসেবে ইন্দিরার নাম প্রস্তাব করেছিলেন প্রণব। সেই বছর কর্নাটকের চিকমাগালুর লোকসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচনে জয়ের পরে পুত্রবধূ সনিয়াকে নিয়ে ব্রিটেনে গিয়েছিলেন ইন্দিরা। সেই সফরে তাঁদের সঙ্গী হয়েছিলেন সস্ত্রীক প্রণব।
১৭৩৯
অর্থমন্ত্রী হওয়ার পরে ১৯৮২ সালে প্রথম ‘পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট স্কিম’-এর মাধ্যমে অনাবাসী ভারতীয়দের ভারতে বিনিয়োগ করার পথ খুলে দেন প্রণব। সেইসময় দেশের শিল্পমহল ও বিরোধী শিবির এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল। ওই প্রকল্প নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন অমেঠীর তৎকালীন সাংসদ রাজীব গাঁধীও।
১৮৩৯
‘পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট স্কিম’-এ ফাঁক থাকার সুযোগে পরবর্তী কালে অনাবাসী শিল্পপতি স্বরাজ পল ‘এসকর্টস’ এবং ‘ডিসিএম’-এর বিপুল পরিমাণ শেয়ার নিয়ম বহির্ভূত ভাবে কেনেন বলে অভিযোগ ওঠে। এ বিষয়ে প্রণবের বিরুদ্ধে মামলা হলেও আদালতে তিনি জয়ী হন। প্রণব মুখোপাধ্যায় অর্থমন্ত্রী থাকাকালীনই বিশ্ব অর্থভাণ্ডারের দেনা শোধ করে ভারত। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর পদে মনমোহন সিংহের নিয়োগপত্রেও স্বাক্ষর করেন তিনি।
১৯৩৯
১৯৮৪-র ৩১ অক্টোবর মেদিনীপুরের কাঁথির জনসভা মঞ্চে এআইসিসি সাধারণ সম্পাদক রাজীবের পাশে ছিলেন প্রণব। সে সময়ই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর আসে।
২০৩৯
১৯৮৬-র এপ্রিলে একটি ইংরেজি পত্রিকায় একান্ত সাক্ষাৎকারে পূর্বতন ইন্দিরা সরকারের সঙ্গে তুলনা টেনে রাজীব জমানার সমালোচনা করেছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। এর পরেই দলবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে কংগ্রেস থেকে ছ’বছরের জন্য বহিষ্কৃত হন তিনি।
২১৩৯
কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হয়ে সে বছরই পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস (আরএসসি) দল গঠন করেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। কিন্তু ১৯৮৭ সালে রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে ভাল ফল করতে পারেনি তাঁর দল। বলা হয়, কংগ্রেসে থাকাকালীন তুখোড় রাজনীতিবিদ হিসেবে তাঁর যে ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছিল, একটি আঞ্চলিক দলের নেতা হিসেবে জনমানসে সেই জনপ্রিয়তা গড়ে তুলতে পারেননি।
২২৩৯
এর পর ১৯৮৮ সালে ত্রিপুরা বিধানসভা নির্বাচনের আগে ‘বহিষ্কৃত’ প্রণবকে প্রচারে শামিল করতে চেয়ে রাজীবের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন সে রাজ্যের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কংগ্রেস নেতা সন্তোষমোহন দেব। রাজীব সেই আবেদন মেনে নিলে প্রণব ফের দলে ফেরেন। কংগ্রেসের সঙ্গে মিশে যায় একাহাতে তাঁর প্রতিষ্ঠা করা আরএসসি।
২৩৩৯
১৯৯১ সালে রাজীব গাঁধীর মৃত্যুর পর প্রণব মুখোপাধ্যায়কে যোজনা কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেন পিভি নরসিংহ রাও। নরসিংহ রাওয়ের সরকারেই প্রথম বার বিদেশমন্ত্রী হন প্রণববাবু। ১৯৯৫ থেকে ’৯৬ পর্যন্ত নরসিংহ রাও সরকারের বিদেশমন্ত্রী ছিলেন তিনি।
২৪৩৯
১৯৯৪ সালের ১৫ এপ্রিল মরক্কোর রাজধানী মারাকাশে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ‘জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফস অ্যান্ড ট্রেড’ (গ্যাট)-এ সই করেছিলেন নরসিংহ সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী প্রণব। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মূল স্রোতে ভারতকে শামিল করার এই প্রয়াসে বামেদের তীব্র বাধার মুখে পড়তে হয়েছিল তাঁকে।
২৫৩৯
১৯৯৮ সালের ১৪ মার্চ কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে নির্বাচিত সভাপতি সীতারাম কেশরীর অপসারণ এবং নয়া সভাপতি হিসেবে সনিয়া গাঁধীকে মনোনীত করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। কংগ্রেসের ইতিহাসে এমন ঘটনা নজিরবিহীন। সেইসময় খসড়া লেখার পাশাপাশি বৈঠকে প্রস্তাব উত্থাপনও করেছিলেন প্রণব। বলা হয়, তিনি নিজে হাতে সনিয়ার রাজনীতিতে পদার্পণের রূপরেখা তৈরি করেন।
২৬৩৯
সনিয়া গাঁধী কংগ্রেসের সভাপতি নিযুক্ত হওয়ার পর এআইসিসি-র সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন প্রণব মুখোপাধ্যায়। ১৯৮৫-র পর ২০০০ সালে ফের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। ২০১০ সালে সেই পদ থেকে ইস্তফা দেন প্রণব।
২৭৩৯
২০০৪ থেকে ’১২ পর্যন্ত পর পর দু’বার মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর থেকে লোকসভার সাংসদ নির্বাচিত হন প্রণব মুখোপাধ্যায়। ওই সময়ে লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতাও ছিলেন তিনি। শোনা যায়, ২০০৪ সালে সনিয়া গাঁধী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে রাজি না হলে সেইসময় প্রণব মুখোপাধ্যায়কে ওই পদে বসানো হতে পারে বলে জল্পনা শুরু হয়। কিন্তু শেষমেশ প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসেন মনমোহন সিংহ।
২৮৩৯
২০০৭ সালেই প্রথম প্রণব মুখোপাধ্যায়কে রাষ্ট্রপতি করার দাবি ওঠে কংগ্রেসে। কিন্তু সেইসময় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় প্রণবের সমকক্ষ কেউ না থাকায়, সেই প্রস্তাব খারিজ হয়ে যায়। মনমোহন সিংহের আমলে প্রতিরক্ষা, অর্থ এবং বিদেশ— এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের দায়িত্ব হাতে পান প্রণব মুখোপাধ্যায়। এর পাশাপাশি কংগ্রেস সংসদীয় দল এবং কংগ্রেস পরিষদীয় দলের নেতৃত্বেও ছিলেন তিনি।
২৯৩৯
২০১১ সালের ৮ এপ্রিল লোকপাল বিলের খসড়া তৈরির জন্য গঠিত যৌথ কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনই ‘রাজনীতিক’ হিসেবে প্রণবের শেষ বড় কাজ। ১০ সদস্যের এই কমিটিতে পাঁচ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর পাশাপাশি ছিলেন অন্না হজারে-সহ নাগরিক সমাজের পাঁচ প্রতিনিধি। সংসদীয় পরিধির বাইরে এসে নাগরিক সমাজকে নিয়ে আইন প্রণয়নের এই উদ্যোগ ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে নজিরবিহীন।
৩০৩৯
২০১২ সালে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন জমা দেওয়ার আগে ইউপিএ সরকার থেকে ইস্তফা দেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। সাংবিধানিক পদে বসার আগে কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। সক্রিয় রাজনীতি থেকে পুরোপুরি নিজেকে সরিয়ে নেন। প্রণব মুখোপাধ্যায়ই দেশের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি। তিনি সরে যাওয়ার দু’বছরের মাথাতেই কেন্দ্রে ক্ষমতাচ্যুত হয় কংগ্রেস।
৩১৩৯
প্রণব মুখোপাধ্যায়কে রাষ্ট্রপতি করা নিয়ে সেইসময় আপত্তি তোলে বিজেপি। এনডিএ শিবির থেকে প্রণবের সমর্থনে ভোট পড়ায় অসন্তোষও প্রকাশ করে তারা। কিন্তু ২০১৪ সালে কংগ্রেসকে হারিয়ে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় এলে, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সুসম্পর্কই ছিল তাদের। ২০১৯ সালে, প্রজাতন্ত্র দিবসের এক দিন আগে তাঁকে সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ভারতরত্নও প্রদান করে মোদী সরকার।
৩২৩৯
রাষ্ট্রপতি হয়ে দেশের প্রথম নাগরিককে ‘হিজ এক্সেলেন্সি’ এবং ‘মহামহিম’ সম্বোধন করার প্রথায় ইতি টানেন প্রণব। বরং মার্কিন মুলুকের মতো ইংরেজিতে ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট’ এবং হিন্দিতে ‘মাননীয়’ সম্বোধনের প্রয়োগ করায় জোর দেন। তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত কার্টুনগুলির প্রতিও অমোঘ আকর্ষণ ছিল প্রণবের। যে সব কার্টুন পছন্দ হতো, সেগুলি সংগ্রহ করে রাখতেন তিনি। ওই সব কার্টুন নিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবনে একটি প্রদর্শনীও হয়।
৩৩৩৯
রাষ্ট্রপতি হিসেবে পাঁচ বছরের কার্যকালে ৩৪টি প্রাণভিক্ষার আর্জি খারিজ করেন প্রণব মুখোপাধ্যায়, যার মধ্যে ১৯৯৩ মুম্বই হামলার অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী ইয়াকুব মেমনের প্রাণভিক্ষার আর্জি দু’-দু’বার খারিজ করেন তিনি। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আর ভেঙ্কটরমণ নিজের কার্যকালে ৪৫টি প্রাণভিক্ষার আর্জি খারিজ করেছিলেন। তাঁর পরেই রয়েছেন প্রণব।
৩৪৩৯
প্রণববাবু রাষ্ট্রপতি থাকাকালীনই ২০১৫ সালে শ্বাসযন্ত্রজনিত সমস্যার জেরে মৃত্যু হয় তাঁর স্ত্রী শুভ্রার। ২০১৭ সালে দ্বিতীয় বার রাষ্ট্রপতি পদে তাঁর মনোনয়ন জমা দেওয়া নিয়ে জল্পনা ওঠে। কিন্তু বার্ধক্য ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে রাজি হননি তিনি।
৩৫৩৯
আজীবন ‘কংগ্রেস ম্যান’ হিসেবে পরিচিত প্রণব মুখোপাধ্যায় ২০১৮ সালে নাগপুরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের (আরএসএস)অনুষ্ঠানে যোগ দিলে, তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। সেইসময় তাঁর এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন প্রণবকন্যা তথা কংগ্রেস নেত্রী শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায়ও।
৩৬৩৯
সঙ্ঘের টুপি পরে, বুকের কাছে হাত রেখে অভিবাদন করছেন প্রণব এমন একটি ভুয়ো ছবি সেইসময় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। তা দেখে শর্মিষ্ঠা বলেন, ‘‘এ রকম ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করেছিলাম। তা নিয়ে আগে থেকেই সতর্ক করেছিলাম বাবাকে।’’ পরবর্তী কালে এমন অভিযোগও ওঠে যে, নাগপুরে হেগড়েওয়ারকে ভূমিপুত্র বলার জন্যই প্রণব মুখোপাধ্যায়কে ভারতরত্ন দেওয়া হল।
৩৭৩৯
তবে এ সব নিয়ে কোনও মন্তব্য করেননি প্রণব মুখোপাধ্যায়। বরং নাগপুরে সঙ্ঘের মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভারতের বহুত্ববাদী সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় সহাবস্থানের কথা তুলে ধরেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘সহিষ্ণুতাই আমাদের শক্তি। আমাদের বহুত্বকে আমরা স্বীকার করি এবং সম্মান করি। …গোঁড়ামি, ধর্ম, আঞ্চলিকতা, ঘৃণা বা অসহিষ্ণুতার দ্বারা আমাদের জাতীয়তাকে ব্যাখ্যা করার যে কোনও চেষ্টা জাতি হিসেবে আমাদের পরিচিতিকে গুলিয়ে দেবে।’’
৩৮৩৯
প্রণবের নাগপুরে সঙ্ঘের অনুষ্ঠানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে সেইসময় প্রশ্ন তোলেন একাধিক কংগ্রেস নেতাও। তবে তার পাল্টা কোনও মন্তব্য করেননি তিনি। বরং মোদী ঝড়ের সামনে কংগ্রেস যখন অস্তিত্ব রক্ষায় হিমশিম খাচ্ছে তখনও তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘‘ফের ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা রাখে কংগ্রেস।’’
৩৯৩৯
যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ইউপিএ জমানায় কখনও তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়নি। তা নিয়ে কোনও আক্ষেপ রয়েছে কিনা জানতে চাইলে প্রণব বলেন, ‘‘৭ নম্বর রেসকোর্সে পৌঁছনো কখনওই আমার গন্তব্য ছিল না।’’