খুনের ঘটনার পর বাড়িটি ফাঁকা পড়ে থাকায় রিয়্যাল এস্টেট কর্মীরা তা বিক্রির চেষ্টা করতে থাকেন। সেই সময় লুৎজ় পরিবারের পছন্দ হয় সেই বাড়িটি। খুনের ঘটনা সম্পর্কে প্রথমে অবগত ছিলেন না লুৎজ় দম্পতি। বাড়ি কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর রিয়্যাল এস্টেট কর্মীদের কাছে ঘটনার কথা জানতে পারেন তাঁরা। তবুও সিদ্ধান্তে বদল হয় না তাঁদের।
ক্যাথি কর্নস নামে এক তরুণীর সঙ্গে আলাপ হয় জর্জের। বিবাহবিচ্ছিন্না ছিলেন ক্যাথি। ন’বছরের ড্যানিয়েল, সাত বছরের ক্রিস্টোফার এবং পাঁচ বছরের মিসি— তিন সন্তান ছিল ক্যাথির। রেস্তরাঁয় খাবার পরিবেশন করে উপার্জন করতেন তিনি। জর্জের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার পর বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। চাকরি ছেড়ে তিন সন্তানকে নিয়ে জর্জের সঙ্গে লং আইল্যান্ড চলে যান ক্যাথি।
অ্যামিটিভিলের বাড়িটির সঙ্গে নানা কাহিনি জড়িয়ে রয়েছে শুনে জর্জকে ‘হাউস ব্লেসিং’ করানোর জন্য নির্দেশ দেন জর্জের এক বন্ধু। বন্ধুর কথামতো ফাদার রে পেকোরারোর সঙ্গে যোগাযোগ করেন জর্জ। ১৯৭৫ সালের ১৮ ডিসেম্বর নতুন বাড়িতে প্রবেশ করেন লুৎজ় দম্পতি। তার আগে ‘হাউস ব্লেসিং’ সারতে পৌঁছন রে। কিন্তু বাড়ির শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া করার সময় চমকে ওঠেন তিনি।
রোনাল্ড তাঁর দুই ভাই মার্ক এবং জনকে যে ঘরে খুন করেছিলেন, সেই ঘরটিকে সেলাইঘর হিসাবে সাজিয়ে তুলেছিলেন ক্যাথি। বাড়ির অন্য ঘরগুলি ‘ব্লেস’ করে যখন সেই ঘরে রে ঢোকেন, তখন আঁতকে ওঠেন তিনি। ঘরটি স্বাভাবিকের তুলনায় অত্যাধিক ঠান্ডা এবং ঘরভর্তি মাছি। ঘরে ‘হোলি ওয়াটার’ ছেটাতেই নাকি এক দানবিক কণ্ঠস্বর শুনতে পান রে। অনবরত সেই কণ্ঠ রে-কে বলে যাচ্ছিল, ‘‘এই ঘর থেকে বেরিয়ে যাও।’’
গৃহপ্রবেশের পর তিন দিন কেটে যায়। তিন দিনই অস্বাভাবিক ভাবে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যেত জর্জের। রোজই ঘুম থেকে উঠে ঘড়িতে দেখতেন সওয়া ৩টে বাজছে। নতুন বাড়িতে যাওয়ার পর দুঃস্বপ্নও দেখতে শুরু করেন ক্যাথি। যেন রোনাল্ডের খুন করার ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খ দেখতে পাচ্ছেন তিনি। জর্জ এবং ক্যাথির সম্পর্কও খারাপ হতে শুরু করে। তিন সন্তানের প্রতিও অধিকাংশ সময় রেগে থাকতেন তাঁরা। নিজেদের মধ্যে অকারণে অশান্তি তো হতই। এমনকি, সন্তানদের ভয় দেখানোর জন্য মাঝেমধ্যে মারধরও করতেন তাঁরা।
২২ ডিসেম্বরের ঘটনা। বাচ্চাদের জন্য দুপুরের খাবার রান্না করছিলেন ক্যাথি। হঠাৎ ড্যানিয়েল এবং ক্রিস্টোফার চিৎকার করে ওঠে। তাদের চিৎকার শুনে ঘরে ছুটে যান ক্যাথি। গিয়ে দেখেন, তাঁদের বাড়ির সমস্ত শৌচালয় থেকেই কালো রঙের আঠালো তরল গড়িয়ে পড়ছে। সেলাইঘরে গিয়ে দেখেন, প্রচুর মাছি উড়ে বেড়াচ্ছে। এই ঘটনার পর ভয়ে ভয়ে দিন কাটাতে থাকে লুৎজ় পরিবার।
এমন 'অপ্রাকৃত' ঘটনা ঘটলেও তার মধ্যে নতুন বাড়িতে বড়দিন উদ্যাপন করেছিলেন লুৎজ় দম্পতি। কিন্তু সে রাতেও সোয়া ৩টের সময় ঘুম ভেঙে যায় জর্জের। ঘুম থেকে উঠে তিনি দেখেন, বাড়ির বাইরের বোটহাউসের দরজা খোলা। বাড়িতে কেউ ঢুকে পড়েছে কি না, তা দেখতে বাইরে যান তিনি। বাইরে দাঁড়িয়ে অন্দরমহলের দিকে তাকাতেই পিলে চমকে ওঠে জর্জের। তিনি দেখেন, মিসির ঘরের জানলার সামনে এক ছায়ামূর্তি। কিন্তু তা মানুষের ছায়া নয়।
ছায়ামূর্তি দেখে সঙ্গে সঙ্গে মিসির ঘরে ছুটে যান জর্জ। কিন্তু ঘর খুলে দেখেন, সব স্বাভাবিক রয়েছে। মিসিও নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। পর দিন সকালে মিসি যখন খেলায় ব্যস্ত, তখন তার ঘর থেকে দু’জনের কথোপকথন শুনতে পান ক্যাথি। সঙ্গে সঙ্গে মিসির ঘরে যান তিনি। মিসির ঘরে গিয়ে তিনি দেখেন, ঘরে রাখা আরামকেদারা দুলছে এবং তার দিকে তাকিয়ে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে মিসি।
২৭ ডিসেম্বর রাত সওয়া ৩টের সময় বিকট শব্দ শুনে ঘুম ভাঙে জর্জের। কিন্তু ক্যাথি তখন ঘুমিয়ে রয়েছেন। তাঁদের পোষ্য হ্যারিও তখন ঘুমন্ত। মনের ভুল ভেবে আবার ঘুমিয়ে পড়েন জর্জ। পরের দিন বাড়ির বেসমেন্টে একটি গোপন ঘরের সন্ধান পান ক্যাথি। বইয়ের তাক সরাতেই দেওয়ালে লাল রং করা ঘরটি খুঁজে পান তিনি। ঘর থেকে বার হচ্ছে দুর্গন্ধ। শুধু তাই নয়, গোপন ঘরের সন্ধান পেয়ে উপরে উঠে আসতেই ক্যাথি দেখেন হলঘরটি সবুজ রঙের আঠালো পদার্থে ভরে গিয়েছে। সমস্ত দরজা থেকেও গড়িয়ে পড়তে থাকে সেই তরল।
১৯৭৬ সালের ১৪ জানুয়ারি। জর্জ এবং ক্যাথি বার বার ফাদার রে-র সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। তাই নিজেরাই ‘হাউস ব্লেসিং’-এর সিদ্ধান্ত নেন। বন্ধুর নির্দেশানুযায়ী হাতে বাইবেল, হোলি ওয়াটার এবং ক্রস নিয়ে বাড়ি শুদ্ধিকরণ করতে শুরু করেন তাঁরা। ‘ব্লেস’ করার সময় হঠাৎ এক দানবিক কণ্ঠ শুনে কেঁপে ওঠেন জর্জ এবং ক্যাথি। কে যেন ভারী গলায় বলে ওঠে, ‘‘তোমরা কি থামবে?’’
ভয়ে ভয়ে সে দিন কাটান জর্জ এবং ক্যাথি। ১৫ জানুয়ারি। ঘড়িতে তখন সওয়া ৩টে। মাঝরাতে আবার ঘুম ভেঙে যায় জর্জের। ঘুম ভাঙার পর তিনি লক্ষ করেন, হাত-পা কিছুই নাড়াতে পারছেন না তিনি। সব যেন অবশ হয়ে গিয়েছে। পাশ ফিরে দেখেন, বিছানায় ক্যাথিও শুয়ে নেই। বিছানা থেকে শূন্যে উড়ে হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছেন ক্যাথি। এমনকি, ঘরের বাইরেও কাউকে হাঁটাচলা করতে দেখেন জর্জ।
পাশের ঘর থেকে চিৎকার করে ওঠে ক্যাথির দুই পুত্র। তাদের বিছানা শূন্যে ভাসছে। পোষ্য হ্যারিও চিৎকার করে ঘরময় দৌড়ে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ করেই যেন সব কিছু নিমেষের মধ্যে থেমে যায়। শান্ত হয়ে যায় সব। ভয় পেয়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যান সকলে। কোনও রকমে ব্যাগপত্তর গুছিয়ে ক্যাথির মায়ের বাড়ি চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা।
লুৎজ় দম্পতির সাক্ষাৎকার দেখার পর তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এক সাংবাদিক। এড এবং লরেন ওয়ারেন নামে দুই জনপ্রিয় ডেমোনোলজিস্ট (দানবতত্ত্ববিদ তথা অতিপ্রাকৃত বিষয়ে অনুসন্ধানকারী)-এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন তিনি। ১৯৭৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ওয়ারেন দম্পতি জর্জের সঙ্গে দেখা করেন। অ্যামিটিভিলের সেই বাড়িতে ঢুকেই অসুস্থ বোধ করতে শুরু করেন লরেন।
ওয়ারেন দম্পতি এক রেডিয়ো শোয়ে জানিয়েছিলেন, অ্যামিটিভিলের বাড়িতে অপশক্তির উপস্থিতি টের পেয়েছিলেন তাঁরা। শত চেষ্টা করেও সেই অপশক্তির সঙ্গে লড়তে পারেননি। তাই জর্জ এবং ক্যাথিকে সেই বাড়ি ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন তাঁরা। লরেনের মতে, অ্যামিটিভিলের সেই বাড়িটি নাকি আমেরিকার ‘ভূতুড়ে’ বাড়ির তালিকায় শীর্ষস্থান দখল করে।
অ্যামিটিভিলের ঘটনার উপর তার পর একাধিক বই লেখা হয়েছে। বড় পর্দায় তৈরি হয়েছে বহু ছবিও। সেই বাড়িটিও পরিণত হয়ে যায় পর্যটনস্থলে। দূরদূরান্ত থেকে সেই ‘ভূতুড়ে’ বাড়িটি দেখতে লোকে আসতেন। কেউ ভূতের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন। কেউ আবার গুজব বলে উড়িয়ে দিতেন। রোনাল্ডের অ্যাটর্নি উইলিয়াম ওয়েবার এই ঘটনার তীব্র সমালোচনা করেন।
কাহিনির সত্যতা যাচাই করার জন্য জর্জ এবং ক্যাথির পলিগ্রাফ টেস্টও করা হয়। পরীক্ষা করে দেখা যায়, তাঁরা সব সত্যি কথাই বলছেন। ১৯৮০ সালে লন্ডনে চলে যান তাঁরা। তবে তাঁদের সংসার দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায় জর্জ এবং ক্যাথির। তবে তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব বজায় ছিল। ২০২১ সালের মার্চ মাসে জেলবন্দি থাকা অবস্থায় মৃত্যু হয় রোনাল্ডের।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর, ১৯৭৭ সালে অ্যামিটিভিলের বাড়িটি কেনেন জেমস ক্রোমার্টি। স্ত্রী বারবারাকে নিয়ে সেই বাড়িতে দশ বছর ছিলেন তিনি। কিন্তু কোনও দিনও কোনও অদ্ভুত কাণ্ড ঘটতে দেখেননি তিনি। তার পর বহু বার সেই বাড়ির মালিকানা বদল হয়েছে। কেউই কোনও অলৌকিক ঘটনার উল্লেখ করেননি। বরং এই ঘটনায় প্রতিবেশীরা বিরক্ত হন। ‘ভূতুড়ে’ বাড়ি হিসাবে রটনা ছড়িয়ে যাওয়ার ফলে তাঁদের এলাকার শান্তি নষ্ট হচ্ছে দাবি করেন তাঁরা। পর্যটকদের অকারণ ভিড়ে বিব্রত বোধ করেন তাঁরা। তবে আজও অ্যামিটিভিলের রহস্য সেখানে টেনে নিয়ে যায় কৌতূহলীদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy