ক্রোয়েশিয়ার কিংবদন্তি থেকে জানা যাচ্ছে, ৩০টির মধ্যে ১৬টি মুদ্রা ক্রুসেডারদের হাত দিয়ে ইউরোপে প্রবেশ করেছিল।
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতাশেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০২৩ ০৯:৪১
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৯
বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টের ম্যাথিউ কর্তৃক লিখিত সুসমাচারে যিশুকে ইহুদি পুরোহিতদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য জুডাস ইস্কারিয়টের কথা বলা হয়েছে। জুডাস যিশুর ১২ জন ঘনিষ্ঠতম শিষ্যের অন্যতম। এবং তাঁর এই কাজ খ্রিস্ট ধর্মের ইতিহাসে ‘জঘন্যতম বিশ্বাসঘাতকতা’ বলে চিহ্নিত।
ছবি: সংগৃহীত।
০২১৯
কথিত, শেষ নৈশভোজের আগে জুডাস ইহুদিদের প্রধান পুরোহিতের কাছে যান এবং যিশুকে ধরিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে ৩০টি রৌপ্যমুদ্রা লাভ করেন। এই ৩০টি মুদ্রা নিয়ে পরে পল্লবিত হয়েছে অসংখ্য কিংবদন্তি। এই সব কাহিনির প্রতিপাদ্য হল, এই মুদ্রাগুলি অভিশপ্ত এবং এর নেপথ্যে শয়তানের শক্তি ক্রিয়াশীল। এবং এগুলি কারও হাতে গিয়ে পড়লে তার ভয়ঙ্কর পরিণতি হতে পারে।
ছবি: সংগৃহীত।
০৩১৯
জুডাস নিজেও এই মুদ্রাগুলি ভোগ করতে পারেননি। যিশু ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার পর তিনি গভীর ভাবে অনুতপ্ত হন এবং মুদ্রাগুলি প্রধান পুরোহিতের কাছে ফেরত দিয়ে আসেন। তার পর একটি গাছের ডালে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন।
ছবি: সংগৃহীত।
০৪১৯
জুডাসের এই পরিণতিকেও ‘শয়তানের কাজ’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়। ইহুদিদের প্রধান পুরোহিত সেই ৩০টি মুদ্রাকে সলোমন মন্দিরের কোষাগারে রাখতে চাননি। কারণ, তাঁর মতে এগুলি ছিল ‘ব্লাড মানি’। অর্থাৎ, যে অর্থের সঙ্গে কারও অপঘাত-মৃত্যু জড়িত রয়েছে।
ছবি: সংগৃহীত।
০৫১৯
এই টাকা দিয়ে নাকি জেরুসালেমে ‘আকেলডামা’ নামে একটি জায়গা কেনা হয়। ‘আকেলডামা’ শব্দটির অর্থ ‘রক্তাক্ত জমি’। এই জায়গাটি মৃত বিদেশি ব্যক্তিদের সমাধিক্ষেত্র হিসাবে ব্যবহৃত হতে থাকে। ১৯ শতক পর্যন্ত এখানে ইহুদি নন, এমন ব্যক্তিদের সমাহিত করা হয়েছে।
ছবি: সংগৃহীত।
০৬১৯
কিন্তু ক্রুসেডের পরে জানা যায়, এই ৩০টি মুদ্রা ইউরোপে নিয়ে যাওয়া হয়। এ বিষয়ে যে সব কাহিনি রয়েছে, তার মূল উপজীব্য— ক্রুসেডাররাই এই মুদ্রা ইউরোপে নিয়ে আসেন। অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে, ভ্যাটিকান এই সব ‘অভিশপ্ত’ মুদ্রাকে তাদের গোপন ভল্টে রেখে দেয়।
ছবি: সংগৃহীত।
০৭১৯
কিন্তু, আরও একটি কাহিনি খ্রিস্টীয় সমাজে প্রচলিত হয় যে, ‘জুডাস-মুদ্রা’গুলির সব ক’টি পোপতন্ত্রের হাতে এসে পড়েনি। ২৫-২৬টি মুদ্রা নাকি তারা উদ্ধার করতে সমর্থ হয়। বাকিগুলির সন্ধান পাওয়া যায়নি।
ছবি: সংগৃহীত।
০৮১৯
ইউরোপে যখন খ্রিস্টধর্মের একচ্ছত্র আধিপত্য, তখন যিশু খ্রিস্টের জীবনের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন প্রত্নবস্তুকে বিভিন্ন গির্জায় সংরক্ষণের কাজ শুরু হয়। মধ্যযুগের সংস্কৃতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এবং দার্শনিক উমবের্তো একো তাঁর বেশ কিছু রচনায় এই সব প্রত্নবস্তুকে নেহাতই নকল বলে বর্ণনা করেছেন। তাঁর মতে, এগুলি জনগণের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে সমীহ তৈরির প্রচেষ্টা ছাড়া অন্য কিছুই ছিল না। সুতরাং, ‘জুডাস কয়েনস’ নামে যদি কোনও কিছু ইউরোপে প্রবেশ করেও থাকে, সেগুলি একান্ত ভাবেই নকল।
ছবি: সংগৃহীত।
০৯১৯
কিন্তু সাধারণ মানুষ নিকষ সত্যের চেয়ে কল্পনাকে গুরুত্ব দিতে ভালবাসেন। ‘অভিশপ্ত মুদ্রা’ নিয়ে ক্রমাগত কাহিনি পল্লবিত হতে থাকে মধ্যযুগ থেকে। শোনা যায়, দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের দেশ ক্রোয়েশিয়ার নিন শহরের চার্চ অফ সেন্ট অ্যাসেলায় একটি মুদ্রা সংরক্ষিত রয়েছে।
ছবি: সংগৃহীত।
১০১৯
ক্রোয়েশিয়ার কিংবদন্তি থেকে জানা যাচ্ছে, ৩০টির মধ্যে ১৬টি মুদ্রা ক্রুসেডারদের হাত দিয়ে ইউরোপে প্রবেশ করেছিল। ফরাসি প্রত্নতত্ত্ববিদ ফারনান্দ দে মেলি বিষয়টি নিয়ে ১৯ শতকে জুডাস-মুদ্রা নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। কিন্তু তিনি নাকি নিনের গির্জায় রাখা মুদ্রাটির বিষয়ে কিছুই জানতেন না। ক্রোয়েশিয়ার প্রত্নবিদদের দাবি, রোমে মাত্র একটি মুদ্রাই রয়েছে। এবং তা ভ্যাটিক্যানে নেই, রয়েছে সেন্ট অফ দ্য ক্রস অফ জেরুসালেমে।
ছবি: সংগৃহীত।
১১১৯
নিনের গির্জায় রাখা মুদ্রাটির প্রসঙ্গে এ কথাও বলা হয়ে থাকে যে, জুডাস-মুদ্রা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু তাদের চিনতে পারা খুব সহজ নয়। এখন প্রশ্ন হল, কী উপায়ে বোঝা যাবে যে, কোন মুদ্রা কুখ্যাত ‘জুডাস কয়েন’?
ছবি: সংগৃহীত।
১২১৯
বাইবেল বিশেষজ্ঞ ডোনাল্ড জন ওয়াইজ়ম্যান জুডাস-মুদ্রা সম্পর্কে দু’টি মত ব্যক্ত করেছিলেন। এক, সম্ভবত এগুলি ছিল বর্তমান লেবাননের টায়ার শহরে সেই সময়ে প্রচলিত টেট্রাদ্রাখম, যাতে রোমান সম্রাট অগস্টাস সিজারের প্রতিকৃতি খোদাই করা ছিল। দুই, এই মুদ্রাগুলি মিশরের টলেমি বংশের দ্বারা প্রচলিত রৌপ্যমুদ্রা হতে পারে। কারণ, যিশুর সময় জেরুসালেমে রোমানরা তাদের নিজস্ব রৌপ্যমুদ্রা প্রচলন করেনি।
ছবি: সংগৃহীত।
১৩১৯
মধ্যযুগে কোনও কোনও গির্জায় জুডাস-মুদ্রা হিসাবে কিছু প্রাচীন গ্রিক রৌপ্যমুদ্রা প্রদর্শন করত। সেই মু্দ্রাগুলিতে গ্রিক সূর্যদেবতা হেলিওসের মুখ খোদিত ছিল। সূর্যের কিরণরেখাগুলিকে খ্রিস্টীয় যাজক ও সন্ন্যাসীরা খ্রিস্টের কাঁটার মুকুট হিসেবে দেখাতে শুরু করেন।
ছবি: সংগৃহীত।
১৪১৯
বাইবেল বিশেষজ্ঞরা একটি বিষয়ে জোর দেন যে, কেন মু্দ্রার সংখ্যা ৩০টি ছিল। ওল্ড টেস্টামেন্টের ‘বুক অফ জাকারায়া’-য় সর্বপ্রথম ৩০টি মু্দ্রার কথা উল্লিখিত হয়। সেখানে এক জন ক্রীতদাসের মূল্য ৩০টি রৌপ্যমুদ্রা বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। সে দিক থেকে দেখলে, ইহুদি পুরোহিতরা যিশুকে অপমান করার জন্যই এক জন ক্রীতদাসের দাম তাঁর জন্য যথেষ্ট বলে ইঙ্গিত করেন।
ছবি: সংগৃহীত।
১৫১৯
পরবর্তী কালে জুডাস-মুদ্রা নিয়ে বিভিন্ন রকমের সাহিত্য রচিত হয়েছে। এই সব সাহিত্যে মুদ্রাগুলিকে ‘শয়তানের নিজস্ব সামগ্রী’ বলে প্রায়শই বর্ণনা করা হয়। স্কটল্যান্ডের সাহিত্যিক স্কট ম্যাকবেইন তাঁর ‘দ্য কয়েনস অফ জুডাস’ (২০০১) গ্রন্থে দেখিয়েছেন, এই মু্দ্রাগুলির মধ্যে এমন কিছু রয়েছে, যা মূলত ‘অপশক্তি’। তাঁর উপন্যাসে এই মুদ্রাগুলির মধ্যে ২৫টি ভ্যাটিক্যানে সেন্ট পিটারের সমাধিতে রাখা রয়েছে। কিন্তু বাকি পাঁচটি মুদ্রার কী হল? এখানেই ম্যাকবেইন অবতারণা করেছেন কালোজাদু ও শয়তান উপাসকদের সঙ্গে এই সব ‘অভিশপ্ত মুদ্রা’র সম্পর্ক নিয়ে।
ছবি: সংগৃহীত।
১৬১৯
আমেরিকান সাহিত্যিক জেমস ব্লেলক তাঁর ‘দ্য লাস্ট কয়েন’ উপন্যাসে দেখিয়েছেন, যে ব্যক্তি ৩০টি মুদ্রাকে নিজের অধিকারে আনতে সমর্থ হবেন, তিনি অতিপ্রাকৃত শক্তির অধিকারী হবেন।
ছবি: সংগৃহীত।
১৭১৯
আশ্চর্যের বিষয়, বাংলা ভাষাতেও জুডাস কয়েন নিয়ে লেখা হয়েছে আখ্যান। বাংলাদেশের লেখক মুহম্মদ আলমগীর তৈমুর তাঁর ‘প্রাচীন মুদ্রা’ উপন্যাসে নিয়ে আসেন জুডাস কয়েনের প্রসঙ্গ। এখানেও মু্দ্রাগুলির সঙ্গে যে অশুভ শক্তির সম্পর্ক ওতপ্রোত ভাবে জড়িত, তা সবিস্তার বলা হয়েছে।
ছবি: সংগৃহীত।
১৮১৯
সম্প্রতি স্প্যানিশ ভাষায় ‘থার্টি কয়েনস’ নামে এক ওয়েব সিরিজের দু’টি সিজ়ন রিলিজ করেছে। ‘শয়তানের অপশক্তি’, এগজ়রসিজম এবং এক দীর্ঘ ও জটিল ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জু়ডাস মুদ্রার যোগাযোগই এই সিরিজের প্রধান বিষয়।
ছবি: সংগৃহীত।
১৯১৯
এই সব সাহিত্য এবং সিরিজ় আসলে দীর্ঘ কাল ধরে খ্রিস্টীয় জগতে প্রচলিত কাহিনি ও বিশ্বাস থেকে উঠে এসেছে। জুডাসের ৩০টি মুদ্রার বাস্তব অস্তিত্ব ছিল কি না, তা এখানে বড় কথা নয়। এর মধ্যে নিহিত রয়েছে খ্রিস্টের জীবনের অন্তিম পর্বের অবর্ণনীয় কষ্টের কথা। বিশ্বের সর্বকালে সব থেকে ঘৃণিত বিশ্বাসঘাতকতার কথা। জুডাস কয়েন নিয়ে প্রচলিত কিংবদন্তিগুলি সম্ভবত গণ-অবচেতনে থেকে যাওয়া শুভাশুভ বোধেরই বহিঃপ্রকাশ। আধুনিক সাহিত্য আর চলচ্চিত্র তাকে রূপ দিচ্ছে রোমাঞ্চ-আখ্যানে। কিন্তু এর নেপথ্যে থমকে থাকছে সভ্যতার কিছু আদিম ভয়ের অভিজ্ঞান, যাকে আজও মানুষ হয়তো অতিক্রম করতে পারেনি।