বিদায় গোদার! এ এক অদ্ভুত সমাপতন। ১৩ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার ফরাসি-সুইস চলচ্চিত্র পরিচালক জঁ লুক গোদার প্রয়াত হলেন। আর কয়েক দিনের মধ্যেই কলকাতায় মুক্তি পেতে চলেছে অমর্ত্য ভট্টাচার্য পরিচালিত ওড়িয়া ছবি ‘আদিউ গোদার’।
নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতাশেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১০:২২
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২০
বিদায় গোদার! এ এক অদ্ভুত সমাপতন। ১৩ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার ফরাসি-সুইস চলচ্চিত্র পরিচালক জঁ লুক গোদার প্রয়াত হলেন। আর কয়েক দিনের মধ্যেই কলকাতায় মুক্তি পেতে চলেছে অমর্ত্য ভট্টাচার্য পরিচালিত ওড়িয়া ছবি ‘আদিউ গোদার’।
০২২০
ছবির কেন্দ্রে রয়েছে এক পর্ন-প্রেমী প্রৌঢ়ের আচমকা গোদার-দর্শনের কাহিনি। পর্ন ছবির ডিভিডির ভিতরে গোদারের ছবি ঢুকে পড়া এবং সোখান থেকে ছবির মূল চরিত্রের গোদার-আসক্ত হয়ে পড়া— এই নিয়েই ‘আদিউ গোদার’।
০৩২০
কিন্তু পর্ন ছবির বান্ডিলে কী ভাবে ঢুকে পড়েন গোদার? এই প্রশ্নের একটি সহজ উত্তর রয়েছে। ‘আধুনিক’ চলচ্চিত্রের অন্যতম দিশারি পুরুষ গোদারের প্রতি অনেক বারই যৌন-কেন্দ্রিক ছবি তৈরির অভিযোগ উঠেছে।
০৪২০
এমনকি গোদার স্বয়ং এক সময়ে বলেছিলেন চলচ্চিত্রে যৌনতার অনুপুঙ্খ উপস্থাপন বাস্তবতার পিছনে লুকিয়ে থাকা বিষয়গুলিকে তুলে আনতে পারে।
০৫২০
গোদারের এই মত সমালোচিত হলেও আধুনিক চলচ্চিত্রে যৌনতার উপস্থিতিকে অস্বীকার করা যায় না।
০৬২০
সিনেমায় ‘নিউ ওয়েভ’ বা নবতরঙ্গের অন্যতম রূপকার গোদার যখন ছবি তুলতে এলেন, তখন পশ্চিম গোলার্ধে এক ভাঙনের যুগ। পূর্বতন যাবতীয় ধারণা বা সংস্কারকে ভেঙে ফেলতে উদ্যত হয়েছে বিট প্রজন্ম, যৌনতা সম্পর্কিত ছুঁতমার্গকে চুরমার করতে চাইছে সাহিত্য-চিত্রকলা-দর্শন। চলচ্চিত্র তত দিনে তার মিঠে মিঠে ভাব কাটিয়ে প্রকাশ করতে চাইছে ‘বাস্তবতা’-র অন্য রূপকে। গোদার সেই দর্শনের অন্যতম পথিকৃৎ।
০৭২০
১৯৬৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি ‘অ্যান্থলজি’ ছবি ‘সিক্স ইন প্যারিসে গোদার পরিচালিত অংশটি ছিল ‘মঁপারনাসে এত লেভালোই’। এই ছবিতে কড়া পুরুষতান্ত্রিক যৌন ‘নজর’-এর কারণে আজও মানবীচেতনাবাদীরা গোদারের সমালোচনায় মাতেন। এই ছবিতে দুই পুরুষে আসক্ত এক নারীর যৌন অবস্থানকে দেখানো হয়েছিল একান্ত ভাবে পুরুষ-আধিপত্যবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে।
০৮২০
পরে অবশ্য এ কথাই উঠে আসে যে, গোদার পুরুষ-প্রাধান্যের বিষয়টিকেই তীব্র ভাবে আক্রমণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সমস্যা দাঁড়ায় এখানেই যে, ‘সঠিক’ যৌন অবস্থানকে ব্যক্ত করতে পরিচালকের প্রয়োজন পড়েছিল সেই ভাষার, যা হয়তো এক অর্থে যৌন উদ্দীপক।
০৯২০
১৯৬৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত গোদারের ছবি ‘কনটেমপ্ট’-এ নায়িকা ছিলেন ব্রিজিত বার্দো। ছবির কাহিনি আলবার্তো মোরাভিয়ার। ছবির বিষয় ছিল অস্তিত্ববাদী দর্শনের উপর আধারিত। বার্দো তখন যৌনতার মূর্তরূপ হিসেবে বিবেচিত। ‘কনটেমপ্ট’-এর শয্যাদৃশ্য ও আনুষঙ্গিক নগ্নতাকে ঘিরে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়। বার্দোর শরীরী আবেদন ছবির মূল বক্তব্যকে ছাপিয়ে গিয়েছে বলেও কথা ওঠে।
১০২০
১৯৬৪-এর ছবি ‘দ্য ম্যারিড উওম্যান’ নিয়ে আবার বিতর্ক বাধে। ফরাসি সেন্সর বোর্ড ছবির নামকরণকেই ‘আপত্তিকর’ বলে দাবি করে। তার উপরে ছিল বিস্তর যৌনদৃশ্য প্রদর্শনের অভিযোগ।
১১২০
গোদার তাঁর তরফে জানান, এক বিশেষ জীবনযাপনকে এই ছবি আঘাত করছে। তাই এত আপত্তি। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তথ্যমন্ত্রীর মধ্যস্থতায় গোদার ছবিটির কিছু দৃশ্য পুনর্নির্মাণ করেন।
১২২০
১৯৬৬-র ছবি ‘ম্যাসকুলিন ফেমিনিন’-কে গোদারের জীবনের অন্যতম সেরা কাজ বলে আলোচকরা জানান। ১৯৬০-এর দশকের ফ্রান্স তথা প্যারিসের যুবসমাজ এবং যৌনতাই ছিল এ ছবির কেন্দ্রীয় বিষয়। আর তার সঙ্গে মিশে যায় রাজনীতি। জনপ্রিয় সংস্কৃতি, মার্ক্সবাদ এবং পুঁজি-নিয়ন্ত্রিত জীবনের টানাপড়েনকে একত্রে তুলে আনে এই ছবি। অবধারিত ভাবে আসে যৌনতা। কিন্তু তার তরঙ্গ অবশ্যই ছিল ভিন্ন সুরে বাঁধা।
১৩২০
গোদারের পরিচালনায় অন্যতম বিতর্কিত ছবি ১৯৮৫ সালের ‘হেইল, মেরি’। এই ছবিতে গোদার খ্রিস্টধর্মের কেন্দ্রীয় ভাবনা কুমারী মেরির তত্ত্বকে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে চান। অবধারিত ভাবে ছবিটিকে নিয়ে তুলকালাম আরম্ভ হয়। এই ছবি ধর্মবিশ্বাসে আঘাত হানতে পারে বলে মতপ্রকাশ করেন স্বয়ং পোপ দ্বিতীয় জন পল।
১৪২০
তুমুল সমালোচনার মুখে পড়ে গোদার ইটালি থেকে ছবিটিকে তুলে নিতে পর্যন্ত উদ্যোগী হন। কিন্তু আজ এই ছবি তার অসামান্য নির্মাণের কারণে প্রশংসিত, বিষয়ভাবনার কারণে আদৃত।
১৫২০
বার বার গোদার সমালোচিত হয়েছেন পর্দায় শরীর প্রদর্শনের কারণে। কিন্তু এ কথা বলা দরকার যে, গোদার মনে করতেন, ছবিতে ‘আধুনিক’ মানুষের অস্তিত্বের সঙ্কটকে তুলে ধরা একান্ত প্রয়োজন। সেই সঙ্কটের একটি বড় অংশ নিহিত রয়েছে যৌনতার মধ্যেই। ১৯৬০-এর দশকের বিশ্বব্যাপী যুব আন্দোলনের একটি বিশেষ অভিমুখ ছিল যৌনমুক্তি।
১৬২০
গোদার এই ‘মুক্তি’-কেই কখনও প্রশ্ন করেছেন, কখনও নৈর্ব্যক্তিক ভাবে বর্ণনা করেছেন। কারণ, তিনি বিশ্বাস করতেন ‘বাস্তব’-এর উপস্থাপনায়। আর যৌনতাকে বাদ দিয়ে বাস্তব কি সম্ভব?
১৭২০
গোদারের ছবি এক সময়ে সত্যিই ঢুকে পড়েছিল তৃতীয় বিশ্বে আমদানি হওয়া পর্ন ছবির বান্ডিলে। তবে সেই বান্ডিল থেকে আলাদা মহিমায় গোদার যে আবার উঠে দাঁড়াবেন, সে কথাই বলতে চেয়েছে ‘আডিউ গোদার’।ওড়িশার প্রত্যন্ত গ্রামের এক পর্ন-আসক্ত প্রৌঢ়ের ক্রমশ গোদার আবিষ্কারও ‘বাস্তব’-এর বাইরে নয়।
১৮২০
এক সময়ে কি ‘নুন শো’-তেও কলকাতা দেখেছিল ‘কনটেমপ্ট’-এ মতো ছবি? ব্রিজিত বার্দোর শরীরী বিভঙ্গ ছাপিয়ে কি সিনেমার ‘নতুন’ ভাষা গ্রাস করেছিল ১৯৯০-এর দশকে ‘বড়’ হয়ে উঠতে থাকা প্রজন্মকে?
১৯২০
৯১ বছর বয়সে চলে গেলেন গোদার। দেখে গেলেন চলচ্চিত্র নামক শিল্পমাধ্যমটির বিপুল সব বাঁকবদল। শেষ জীবনেও ভাঙনের জয়গান গেয়েছেন এই চিরতরুণ। মুঠোফোনে তোলা সিনেমাও যে নতুন চিত্রভাষা তৈরি করতে পারে, এ নিয়ে আশা ব্যক্ত করতে একটুও কুণ্ঠিত হননি তিনি।
২০২০
গোদার জানতেন, ‘ভাঙারই আরেক নাম ‘গড়া’। তাঁর ছবি, যৌনতা নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি— সবই ছিল ‘সৃজন’-এরই আর এক নাম।