Frances Johnson known as Begum Johnson has her grave at St. John's Church Kolkata dgtl
The oldest British resident in Bengal
নাতি ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী, নিশুত রাতে নাকি ঘুরে বেড়ায় কলকাতার ইংরেজ ‘কিস্সাওয়ালি’র আত্মা
বেগম জনসন বাংলার ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এক হিসাবে দেখলে, বেগম জনসন ছিলেন কলকাতার প্রথম ও শেষ ইংরেজ ‘কিস্সাওয়ালি’।
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতাশেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১২:০৯
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৫
নবারুণ ভট্টাচার্যের জনপ্রিয় উপন্যাস ‘কাঙাল মালসাট’-এ এক বিশেষ চরিত্রের নাম বেগম জনসন। সেই কাহিনিতে সে এক প্রেত। কলকাতার প্রাচীন প্রেতিনী। উপন্যাসের ঘটনাক্রমে সে বিবিধ অন্তর্ঘাতমূলক কাজকর্মের সঙ্গে জড়িত। আপাত-কৌতুকের মোড়কে পরিবেশিত এই চরিত্রটি কিন্তু নিছক কল্পনাপ্রসূত নয়। বেগম জনসন নাম্নী এক মহিলা শহর কলকাতার আদিপর্বের ইতিহাসে এক রক্তমাংসের চরিত্রই ছিলেন। কে তিনি? এই শহরের সঙ্গে তাঁর যোগসূত্রটিই বা কী?
০২১৫
বেগম জনসনকে প্রথম প্রজন্মের ভারতপ্রেমী ইংরেজদের অন্যতম বললে বোধ হয় ভুল হবে না। তাঁর আসল নাম ফ্রান্সেস জনসন। জন্ম ১৭২৫ সালের ১০ এপ্রিল। জীবনের বেশির ভাগ সময়টাই তিনি কাটিয়েছেন কলকাতায়। এমনকি, তাঁর সমাধিও রয়েছে এই শহরের অন্যতম প্রাচীন এক গির্জার প্রাঙ্গণে।
০৩১৫
কলকাতার সেন্ট জন’স গির্জা সংলগ্ন গোরস্থানে রয়েছে বেগম জনসনের কবর। স্মৃতিফলকে ইংরেজি ভাষায় যা লেখা রয়েছে তার মর্মার্থ এই— “বাংলার প্রাচীনতম ব্রিটিশ বাসিন্দা, সর্বজনের ভালবাসা প্রাপ্ত, সম্মানিতা ও শ্রদ্ধেয়া।” এই ‘প্রাচীনতম ব্রিটিশ বাসিন্দা’ অভিধাটি থেকে তাঁর ভারত তথা বঙ্গপ্রেমের বিষয়টি অনুমান করা যায়। কিন্তু রহস্য জাগে এই নিয়ে যে, তাঁর নামের আগে ‘বেগম’ শব্দটি কী করে বসল।
০৪১৫
বেগম জনসনের পিতৃসূত্রে প্রাপ্ত নাম ফ্রান্সেস ক্রুক। তাঁর বাবা এডওয়ার্ড ক্রুক তদানীন্তন মাদ্রাজের ফোর্ট সেন্ট ডেভিডের গভর্নর ছিলেন। তাঁর মা ইসাবেলা বেইজ়োর ছিলেন পর্তুগিজ-ভারতীয় বংশোদ্ভূত। সে দিক থেকে দেখলে, এ দেশের সঙ্গে তাঁর রক্তের যোগ ছিলই।
০৫১৫
ফ্রান্সেস জনসনের প্রথম বিবাহ মাত্র ১৩ বছর বয়সে (যদিও এ নিয়ে মতান্তর রয়েছে) প্যারি পার্পলার টেম্পলার নামে এক ইংরেজ যুবকের সঙ্গে। প্যারি ছিলেন কলকাতার গভর্নর টমাস ব্রডিলের আত্মীয়। প্যারি ও ফ্রান্সেসের দুই সন্তান হয়। কিন্তু তাঁদের বিয়ে বেশি দিন টেকেনি। ফ্রান্সেস এর পর বিয়ে করেন জেমস অল্টহ্যাম নামে এক ব্যক্তিকে। কিন্তু বিয়ের দিন পনেরোর মাথায় জেমস মারা যান।
০৬১৫
দ্বিতীয় স্বামীর মৃত্যুর দু’বছর পর উইলিয়াম ওয়াট্সকে বিয়ে করেন ফ্রান্সেস। ওয়াট্স সে সময় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উচ্চপদস্থ আধিকারিক। এই সময় বাংলার রাজনৈতিক পটভূমিতে অস্থিরতা দেখা দেয়। নবাব আলিবর্দি খানের মৃত্যুর পর তাঁর দৌহিত্র সিরাজ-উদ-দৌলার মসনদে আরোহণ নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। ওয়াট্স সেই সমস্যায় জড়িয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় ফ্রান্সেসকে তাঁর সন্তান সমেত সিরাজ আটক করেন। অবশ্য এ কথা জানা যায় যে, আলিবর্দি খানের বিধবা পত্নী তাঁদের যথেষ্ট যত্নআত্তি করতেন এবং তাঁদের ফরাসি অধিকৃত চন্দননগরে রাখা হয়।
০৭১৫
১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে সিরাজ পরাজিত হলে পরের বছর ওয়াট্সকে কোম্পানির তরফে তাঁর কাজের জন্য পুরস্কৃত করা হয়। তাঁকে ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্নরের পদ দেওয়া হলেও ওয়াট্স দেশে ফিরে যেতে চান। ফ্রান্সেস তাঁর সন্তানদের নিয়ে স্বামীর সঙ্গে ইংল্যান্ড ফিরে যান। সেখানে কয়েক বছর ভালই ছিলেন তাঁরা। কিন্তু, ১৭৬৪ সালে ওয়াট্স মারা যান। পরবর্তী পাঁচ বছর ফ্রান্সেস ইংল্যান্ডেই কাটান। তত দিনে তাঁর সন্তানেরা সাবালক হয়েছেন। ১৭৬৯ সালে তিনি আবার ভারতে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন।
০৮১৫
ফ্রান্সেসের বয়স তখন ৪০-এর কোঠার মধ্য ভাগে। এই বয়সে তিনি কেন নিজের সন্তান এবং স্বভূমি ছেড়ে ভারতে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলেন, জানা যায় না। ইতিহাসবিদদের অনুমান, দীর্ঘকাল ভারতবাসের ফলে ফ্রান্সেস নিজেকে সমকালীন ব্রিটিশ সমাজে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। অনেকে বলেন, তিনি ভারত, বিশেষত কলকাতাকে মনেপ্রাণে এতখানি ভালবেসে ফেলেছিলেন যে, স্বভূমির টানও তার কাছে তুচ্ছ বলে মনে হয়।
০৯১৫
১৭৮৯ সালে ফ্রান্সেস কলকাতায় চলে আসেন। তখন তিনি বিপুল ধনসম্পত্তির মালকিনও বটে। কলকাতায় এক সুবিশাল বাড়ি কিনে প্রচুর পরিচারক-পরিচারিকা সহ তিনি থাকতে আরম্ভ করেন। জানা যায়, সেই প্রাসাদোপম আবাসটি ছিল বর্তমান বিবাদি বাগ বা ডালহৌসি স্কোয়্যারের ফেয়ারলি প্লেস-এ। সেই অট্টালিকাকে তিনি প্রাচ্য কায়দাতেই সাজিয়েছিলেন। নিজেও অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন আলবোলা-ফুর্সিতে তামাক সেবন বা পান খাওয়ায়। তাঁর এ হেন জীবনযাপনের জন্য তিনি পরিচিতি পান ‘বেগম’ হিসাবে। তিনি ছাড়া আর কোনও ইউরোপীয় নারী ‘বেগম’ হিসাবে পরিচিতি পেয়েছিলেন বলে জানা যায় না।
১০১৫
১৭৭২ সালে ইংল্যান্ড থেকে ভারতে আসেন রেভারেন্ড উইলিয়াম জনসন নামে এক অক্সফোর্ড-শিক্ষিত তরুণ ধর্মযাজক। তিনি ফোর্ট উইলিয়ামের পাদ্রি হিসাবে যোগ দিতেই কলকাতায় আসেন। ফ্রান্সেসের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে এবং অচিরেই তা প্রণয় সম্পর্কে গড়ায়। ১৭৭৪ সালে ফ্রান্সেস বিয়ে করেন উইলিয়ামকে। তার পর থেকেই তাঁর পরিচিতি ঘটে ‘বেগম জনসন’ হিসাবে। ফ্রান্সেসের সেই বিয়ে নিয়ে যে ব্রিটিশ সমাজে বেশ আলোড়ন পড়েছিল, তা সমসাময়িক পত্রপত্রিকা থেকে জানা যায়।
১১১৫
১৭৮৮ সালে উইলিয়াম তাঁর কাজে ইস্তফা দিয়ে ইংল্যান্ড ফিরে যান। কিন্তু বেগম থেকে যান কলকাতাতেই। এর পর তাঁর জীবন বইতে থাকে ভিন্ন খাতে। ভারতীয় কেতায় সাজানো তাঁর আবাসে নিয়মিত বসতে থাকে আড্ডার আসর। যে আসরের মধ্যমণি ছিলেন বেগম নিজেই।
১২১৫
বেগম জনসন বাংলার ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। বর্গি আক্রমণ, বাংলার নবাবির পালাবদল, পলাশির যুদ্ধ থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্রমে ক্ষমতা বাড়িয়ে চলার মতো বিভিন্ন বিষয় তিনি চোখের সামনে দেখেছেন। এমনকি, নবাবি অন্দরমহলের সঙ্গে তাঁর যোগও ছিল ভাল। সেই সূত্রে বিবিধ কাহিনি তাঁর স্মৃতিধৃত ছিল। সেই সব গল্প তিনি বলতেন আড্ডায়। সঙ্গে চলত খানাপিনা আর তামাক-তাম্বুলের মজলিশ।
১৩১৫
বেগম জনসন জীবদ্দশাতেই পরিণত হয়েছিলেন এক কিংবদন্তিতে। তাঁর মুখ থেকে গল্প শোনার আগ্রহে কলকাতার ইংরেজ সমাজের নামজাদা ব্যক্তিরাও ভিড় জমাতেন। এক হিসাবে দেখলে, বেগম জনসন ছিলেন কলকাতার প্রথম ও শেষ ইংরেজ ‘কিস্সাওয়ালি’। কলকাতার শ্বেতাঙ্গ সমাজের বিবিধ কেচ্ছা, বিশেষ করে গোপন প্রেমের কাহিনি রসিয়ে বলার জন্য তাঁর খ্যাতি কোম্পানির বড়লাটকেও টেনে আনত ফেয়ারলি প্লেসের সেই বাড়ির আড্ডায়।
১৪১৫
১৮১২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি বেগম জনসন মারা যান। আর সে বছরই তাঁর নাতি রবার্ট জেনকিনসন ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হন। বেগমকে ডালহৌসি অঞ্চলের সেন্ট জনস চার্চ সংলগ্ন গোরস্থানে কবর দেওয়া হয়। থামওয়ালা গোলাকার সেই কবর আজও কলকাতার একটি দ্রষ্টব্য বস্তু।
১৫১৫
গল্প এখানেই শেষ হলে ভাল হত। কিন্তু কলকাতা শহরের স্বভাবই এই যে, এখানে গল্প শেষ হইয়াও শেষ হয় না। গত কয়েক বছর ধরে শহর কলকাতায় কিছু সংস্থা গভীর রাতে ‘ঘোস্ট ওয়াক’-এর বন্দোবস্ত করেছেন। অর্থাৎ কিনা রাত জেগে নিশুতি শহরে ভূতের সন্ধান। সেই ‘ওয়াক’-এর অন্যতম আকর্ষণ হল ফেয়ারলি প্লেস থেকে সেন্ট জনস চার্চ যাওয়ার পথে বেগমের কাহিনি শোনা। তা হলে কি বেগমের আত্মা আজও ঘোরাফেরা করছে সেখানে? কলকাতা এ নিয়ে কোনও ‘আরবান লিজেন্ড’-এর জন্ম না দিলেও নবারুণ ভট্টাচার্যের উপন্যাসে প্রেত হিসাবেই হাজির বেগম। সুতরাং কল্পনার আঁকশি বাড়িয়ে কেউ যদি বেগমের নাগাল পেতে চান, তাঁকে নিশুত রাতে এক বার অন্তত সেন্ট জন’স গির্জার আশপাশে হানা দিতে হতে পারে।