Durga Puja at Sovabazar Rajbari hides so many unknown secrets dgtl
Shovabazar Rajbari Durga Puja
খড়্গ দেখে রাজার কোলে লুকিয়ে পড়ে বলির ছাগল! শোভাবাজারের পুজোয় সেই থেকে বন্ধ পশুহত্যা
কলকাতার থিমের পুজোর ভিড়ে আজও স্বাতন্ত্র্য ধরে রেখেছে শোভাবাজার রাজবাড়ি। শোভাবাজারের ঠাকুরদালানে তিল ধারণের জায়গা মেলে না পুজোর পাঁচ দিন। এত বছর পরেও জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি এতটুকু।
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতাশেষ আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০২৩ ০৮:০২
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৯
রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিট, কলকাতা- ৭০০০০৫। শোভাবাজার রাজবাড়ির চেনা ঠিকানা। কলকাতার মধ্যে সাবেকি পুজো হিসাবে এখনও এই পুজোর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি।
০২১৯
দুর্গাপুজোয় থিমের ভিড়ে আজও স্বাতন্ত্র্য ধরে রেখেছে শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো। শহরের অলিগলিতে থিমের পুজো দেখতে যেমন মানুষ ভিড় করেন, তেমনই শোভাবাজারের ঠাকুরদালানেও তিল ধারণের জায়গা মেলে না পুজোর পাঁচ দিন।
০৩১৯
সাবেকিআনাই এই পুজোর মূল আকর্ষণ। থিম নেই। চেনা প্রতিমা প্রতি বছর একই ভাবে একই নিয়মে পুজো করা হয়। এই পুজোর গায়ে আসলে লেগে আছে ২৬৬ বছরের পুরনো ইতিহাসের গন্ধ।
০৪১৯
শোভাবাজার রাজবাড়িতে একটি নয়, দু’টি আলাদা আলাদা পুজো হয়। নবকৃষ্ণ স্ট্রিটের দু’দিকে দু’টি আলাদা বাড়ি। দু’টিই রাজার বাড়ি। তবে কেন একই রাজবাড়ির দু’টি আলাদা পুজো, তার ইতিহাস জানতে হলে ফিরতে হবে পলাশির যুদ্ধের সময়ে।
০৫১৯
১৭৫৭ সালে পলাশির প্রান্তরে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে ক্ষমতা দখল করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। বলা হয়, সে দিনই ভারতের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়ে গিয়েছিল। যা পরবর্তী দু’শো বছর ধরে আর মাথা তোলেনি।
০৬১৯
পলাশিতে ইংরেজদের জয়ের বছরেই শোভাবাজারে রাজা নবকৃষ্ণ দেব ধুমধাম করে দুর্গাপুজোর সূচনা করেন। সেই ঐতিহ্য এখনও বহমান। শুধু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুজোর রীতি, নিয়মকানুন, বিনোদনে লেগেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া।
০৭১৯
পুত্রসন্তান না হওয়ায় ১৭৬৭-’৬৮ সাল নাগাদ রাজা নবকৃষ্ণ তাঁর নিজের ভাইয়ের পুত্রকে দত্তক নিয়েছিলেন। সেই গোপীমোহন দেবের পুত্র রাধাকান্তের নামেই পরিচিত শোভাবাজার রাজপরিবারের ‘বড় বাড়ি’।
০৮১৯
কয়েক বছর পরে রাজা নবকৃষ্ণের পুত্রসন্তান হয়। তখন তাঁর বয়স ৪৩ বছর। রাজার পুত্র রাজকৃষ্ণ বড় হলে শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গোৎসব আলাদা হয়ে যায়। দুই বাড়িতে আলাদা করে পুজোর রেওয়াজ তৈরি হয়। রাজকৃষ্ণের নামে পরিচিতি পায় রাজপরিবারের ‘ছোট বাড়ি’।
০৯১৯
বর্তমানে ‘বড় বাড়ি’ ভগ্নপ্রায়। পুজো এখনও হয় বটে, তবে ‘ছোট বাড়ি’র পুজোর জৌলুস তুলনামূলক বেশি। অথচ, একসময় কলকাতা শহরে ‘বড় বাড়ি’র পুজোর জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া।
১০১৯
শোভাবাজারের এই ‘বড় বাড়ি’তেই দুর্গাপুজোয় প্রতি বছর চাঁদের হাট বসত। লর্ড ক্লাইভ থেকে শুরু করে ইংরেজ বড়লাটেরা সকলেই আসতেন। বসত বাঈজি নাচের আসর। তৎকালীন কলকাতার বাবু সমাজের মাথারাও এই পুজোয় আসর জমিয়ে তুলতেন।
১১১৯
শোভাবাজারের পুজোয় বাঈজি নাচের রীতি দীর্ঘ দিন প্রচলিত ছিল। পরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুজোর বিনোদনে বদল আসে। বাঈজি নাচ বন্ধ হয়ে পুজো উপলক্ষে রাজবাড়িতে যাত্রা, পালাগান কিংবা নাটকের আয়োজন করা হত। ক্রমে তা-ও উঠে গিয়েছে।
১২১৯
রাজপরিবারের সদস্য কৃষ্ণ শর্বরী দাশগুপ্ত জানান, এক সময় রাজবাড়ির দু’টি পুজোতেই পশুবলির প্রথা ছিল। তবে বড় বাড়িতে রাধাকান্তের আমলেই বলি বন্ধ হয়। ছোট বাড়িতে অবশ্য কয়েক বছর আগে পর্যন্তও দুর্গাপুজোয় পাঁঠাবলি দেওয়া হত।
১৩১৯
শোনা যায়, এক বার পুজোয় বলির দিন স্বয়ং রাধাকান্তের ধুতির আড়ালে লুকিয়ে পড়েছিল বলির ছাগল। খড়্গ দেখে কিছু কি আন্দাজ করতে পেরেছিল সে? রাজা কিছুতেই আর পুজোয় বলি দিতে দেননি। কারণ, আশ্রিতকে হত্যা করার পক্ষপাতী ছিলেন না তিনি। পুরোহিতদের অনেক আপত্তি, অনুযোগ সত্ত্বেও জেদ বজায় রেখেছিলেন রাধাকান্ত।
১৪১৯
রাজবাড়ির ছোট বাড়ির পুজোতে বলি বন্ধ হয়েছে সম্প্রতি। কোভিড অতিমারির সময়ে রাজপরিবারের চেনা যে ব্যক্তি বলি দিয়ে থাকেন, তিনি আসতে পারেননি। অন্য এক জনকে বলির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি নাকি এক কোপে পাঁঠা কাটতে পারেননি। তাতে বলি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সেই থেকে ছোট বাড়ির পুজোতেও আর পশুহত্যা হয় না।
১৫১৯
দশমীর দিন বিসর্জনের আগে নীলকণ্ঠ পাখি উড়িয়ে দেওয়ার চল ছিল রাজবাড়িতে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই রীতিও উঠে গিয়েছে। এখন অবশ্য মাটির নীলকণ্ঠ পাখিতে পুরনো রেওয়াজের রেশ বজায় রাখা হয়।
১৬১৯
শোভাবাজার রাজবাড়িতে সারা বছর রাধাগোবিন্দের পুজো হয়। দুর্গাপুজোর সময় সেই রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ অন্যত্র সরিয়ে রাখেন রাজপরিবারের সদস্যেরা। রাধাগোবিন্দের সামনে শাক্ত পুজো সম্ভব নয়।
১৭১৯
শোভাবাজারের পুজোয় রান্না করা কোনও ভোগ দেবীর উদ্দেশে অর্পণ করা হয় না। ভোগের মূল উপাদান এখানে ফল এবং মিষ্টি। তবে আলাদা করে কিছু ভাজা পদও দেবীর ভোগে দেওয়া হয়।
১৮১৯
শোভাবাজার রাজবাড়ির ছেলেমেয়েরা স্বাধীনতার পর থেকে (১৯৪৭) নিজেদের উদ্যোগে মহিষাসুরমর্দিনীর আদলে দেবীবন্দনার আয়োজন করতেন। পরিবারের সদস্যেরাই সেই অনুষ্ঠানের ভাষ্য লিখে, গান লিখে, তাতে সুর দিয়ে উপস্থাপন করতেন। বেতার মাধ্যমে তা ছড়িয়ে যেত গোটা পাড়ায়।
১৯১৯
২৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কলকাতার প্রাচীনতম পুজোর ঐতিহ্য বয়ে চলেছে শোভাবাজারের ঠাকুরদালান। ইতিহাসই সেখানকার চাকচিক্য মলিন হতে দেয়নি। রাজবাড়ির আনাচেকানাচে আজও ছড়িয়ে আছে প্রাচীন কলকাতার অজানা গল্পকথা।