মাছ ধরার নৌকার আদলে ছোট জলযান তৈরি করে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় গুন্ডাগিরি করে চলেছে কুখ্যাত চিনা ভাড়াটে জলযোদ্ধাদের দল। কতটা ভয়ঙ্কর এই ‘চাইনিজ় মেরিটাইম মিলিশিয়া’?
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০২৫ ০৯:৫৫
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২৫
আকারে অবিকল মাছ ধরার ছোট নৌকা। তাই নিয়েই দক্ষিণ চিন সাগর এবং ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ড্রাগনের ভাড়াটে জলযোদ্ধার দল! তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একাধিক দেশ। অন্য দিকে ওই ভাড়াটে নৌবাহিনীর অস্তিত্বই স্বীকার করতে নিমরাজি চিনা চেয়ারম্যান তথা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।
০২২৫
বেজিঙের এই ভাড়াটে জলযোদ্ধাদের পোশাকি নাম ‘চাইনিজ় মেরিটাইম মিলিশিয়া’ বা সিএমএম। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে এর একাধিক নাম রয়েছে। কেউ কেউ একে ‘পিপল্স আর্মড ফোর্স মেরিটাইম মিলিশিয়া’ (পিএএফএমএম) বলে থাকেন। কারও কাছে আবার এটি ‘ফিশারি মিলিশিয়া’ হিসাবে বেশি পরিচিত।
০৩২৫
গত কয়েক বছরে তাইওয়ান থেকে শুরু করে ফিলিপিন্সের সঙ্গে বিবাদে বার বার খবরের শিরোনামে এসেছে চিনের এই ভাড়াটে জলযোদ্ধাদের নাম। অন্য দেশের জলসীমায় ঢুকে সেখানকার মৎস্যজীবীদের ভয় দেখানো এবং তাঁদের নৌকা নষ্ট করার মতো গুন্ডাগিরির অভিযোগ রয়েছে এদের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট দেশের উপকূলরক্ষী বাহিনীকে প্ররোচনা দেওয়ার কাজেও সিএমএমকে পরিকল্পিত ভাবে ব্যবহার করে ড্রাগন ফৌজ।
০৪২৫
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের দাবি, চিনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ নৌবাহিনীর মোট তিনটি শাখা রয়েছে। সেগুলি হল পিএলএ নেভি, উপকূলরক্ষী বাহিনী (চায়না কোস্ট গার্ড বা সিসিজি) এবং ভাড়াটে জলসৈনিকদের দল। এর মধ্যে আকারের দিক থেকে সিএমএম সবচেয়ে ছোট বলে জানা গিয়েছে।
০৫২৫
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে চিনে গৃহযুদ্ধ চলাকালীন এই ভাড়াটে নৌবাহিনী তৈরি করে চিনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিসিপি)। ওই সময়ে স্থানীয় জেলে এবং শ্রমিকদের নিয়ে এটি গড়ে তোলা হয়েছিল। পরবর্তী কালে সিএমএমের যাবতীয় দায়িত্ব চলে যায় পিএলএ-র নৌ-কম্যান্ডারদের হাতে।
০৬২৫
১৯৫০-এর দশকে আনুষ্ঠানিক ভাবে জন্ম হয় ‘চাইনিজ় মেরিটাইম মিলিশিয়া’র। মূলত মৎস্যজীবীদের নিরাপত্তা দেওয়া এবং উপকূলের নিরাপত্তার কাজ করত এই বাহিনী। তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার নৌসেনার দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত ছিলেন ড্রাগনের ভাড়াটে জলযোদ্ধারা। দৈনন্দিন কাজ বা সিএমএমের প্রশিক্ষণেও সেই ছোঁয়া দেখা গিয়েছিল।
০৭২৫
১৯৭০-এর দশক থেকে এই ভাড়াটে বাহিনীকে প্রতিবেশী দেশের দ্বীপ বা জমি কব্জা করার কাজে ব্যবহার করতে শুরু করে চিন। ফলে দক্ষিণ চিন সাগর এবং ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় বাড়তে শুরু করে সিএমএমের প্রভাব। বদলাতে শুরু করে বেজিঙের ভাড়াটে ফৌজের ‘অপারেশন’-এর ধরন।
০৮২৫
১৯৭৪ সালে প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জের অধিকারকে কেন্দ্র করে ভিয়েতনামের সঙ্গে আঞ্চলিক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে চিন। ওই যুদ্ধে পিএলএ নৌসেনার উভচর যানগুলিকে ভিয়েতনামের উপকূলে পৌঁছে দিতে সাহায্য করেছিল এই ভাড়াটে জলযোদ্ধাদের বাহিনী।
০৯২৫
ওই বছরই দিয়াওয়ু দ্বীপপুঞ্জকে কেন্দ্র করে জাপান ও তাইওয়ানের সঙ্গে চিনের বিরোধ চরমে উঠেছিল। ফলে দ্বীপটিকে ঘিরে ফেলতে সিএমএমের জাহাজগুলিকে ব্যবহার করেছিল বেজিং। যদিও তার পরেও দিয়াওয়ু দখল করতে সক্ষম হয়নি ড্রাগন।
১০২৫
জাপান, তাইওয়ান বা ফিলিপিন্স— চিন লাগোয়া দেশগুলি ড্রাগনের এই ভাড়াটে জলযোদ্ধাদের বাহিনীকে স্পেনীয় ‘আর্মাডা’র সঙ্গে তুলনা করেছে। ষোড়শ শতাব্দীতে ওই নৌবহর নিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে রীতিমতো দাপিয়ে বেড়িয়েছিল দক্ষিণ ইউরোপের দেশটি। পরে অবশ্য ব্রিটেনের সঙ্গে যুদ্ধে হার মানে ‘আর্মাডা’। পরবর্তী দশকগুলিতে সমুদ্রের রাজত্ব চলে গিয়েছিল ইংরেজদের হাতে।
১১২৫
২০১২ সালে এক রকম জোর করেই স্কারবোরো শোল প্রবাল দ্বীপটি দখল করে চিন। বেজিঙের এই সাম্রাজ্য বিস্তারে বড় ভূমিকা নিয়েছিল ‘চাইনিজ় মেরিটাইম মিলিশিয়া’। বর্তমানে দ্বীপটি ড্রাগনভূমির হাইনান প্রদেশের অন্তর্গত। এর অধিকার নিয়ে ফিলিপিন্স এবং তাইওয়ানের সঙ্গে বিরোধ রয়েছে প্রেসিডেন্ট শি-র।
১২২৫
চিনা সিএমএমের শক্তি ও ক্ষমতার বিষয়টি ইতিমধ্যেই ব্যাখ্যা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের নৌসেনা কম্যান্ডার অ্যান্ড্রু এস এরিকসন। নেভাল ওয়ার কলেজে দেওয়া বক্তৃতায় এই ধরনের নৌবহরকে ‘ছোট্ট সবুজ মানুষ’ বা ‘লিটল গ্রিন মেন’ বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। ২০১৪ সালে ইউক্রেনের থেকে ক্রিমিয়াকে ছিনিয়ে নিতে ভাড়াটে জলযোদ্ধাদের ব্যবহার করে রুশ নৌবাহিনী। বেজিঙের সিএমএম সেই আদলে তৈরি বলে জানিয়েছেন তিনি।
১৩২৫
এরিকসন জানিয়েছেন, মাছ ধরার জাহাজের মতো দেখতে জলযান নিয়ে সমুদ্রে গুন্ডাগিরি করার বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে। এটা টানা কয়েক দিন চালিয়ে গেলেই সংশ্লিষ্ট দেশটির মৎস্যজীবীরা সাগরের ওই এলাকায় আর যাবেন না। তখন ধীরে ধীরে সেখানে প্রবেশ ঘটবে চিনা রণতরীর। আর সঙ্গে সঙ্গে গোটা এলাকাটি নিজেদের বলে কূটনৈতিক স্তরে দাবি জানাতে শুরু করবে জিনপিং প্রশাসন।
১৪২৫
আমেরিকার গোয়েন্দাদের দাবি, বর্তমানে পীত সাগর, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম এবং মালয়েশিয়ার বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকায় একচেটিয়া ভাবে দাদাগিরি চালিয়ে যাচ্ছে ‘চাইনিজ় মেরিটাইম মিলিশিয়া’। এই ভাড়াটে জলযোদ্ধাদের নৌকাগুলিতে রয়েছে স্যাটেলাইট ফোন। এর সাহায্যে নৌকম্যান্ডারদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন তাঁরা, নিয়ে থাকেন নির্দেশও।
১৫২৫
গোয়েন্দা রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, ২০১৮ সাল পর্যন্ত ভাড়াটে জলযোদ্ধাদের নৌবহরকে হাতিয়ার দিয়ে সাজায়নি পিএলএ নৌবাহিনী। কিন্তু বর্তমানে ওয়াটার মাইন এবং সামরিক হেলিকপ্টারে হামলা চালানোর মতো ছোট আকারের ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে সুনির্দিষ্ট এলাকায় পাঠানো হচ্ছে তাঁদের। এ ছাড়া ‘চাইনিজ় মেরিটাইম মিলিশিয়া’কে আগ্নেয়াস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে বলেও জানা গিয়েছে।
১৬২৫
সূত্রের খবর, প্রতি তিন থেকে চার মাস অন্তর ভাড়াটে জলযোদ্ধাদের কাজের খতিয়ান নিয়ে থাকেন প্রেসিডেন্ট শি। তাঁদের আক্রমণাত্মক মনোভাবে তিনি যথেষ্টই খুশি বলে জানা গিয়েছে। আর তাই সিএমএমের উন্নতিসাধনে বাজেট বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেজিং।
১৭২৫
সম্প্রতি তাইওয়ানকে কব্জা করতে ফের আগ্রাসী মনোভাব দেখিয়েছে চিন। সমুদ্রের গভীরে থাকা ফাইবার-অপটিক্যাল কেব্ল কেটে টেলি যোগাযোগ ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ধ্বংস করার চেষ্টা করে বেজিং। ড্রাগনের এ হেন ‘ধূসর-এলাকা হয়রানি’তে (গ্রে এরিয়া হ্যারাসমেন্ট) অতিষ্ঠ প্রশান্ত মহাসাগরের ওই দ্বীপরাষ্ট্র। যে কোনও মুহূর্তে পরিস্থিতি বড় সংঘাতের দিকে মোড় নিতে পারে বলে মত প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের।
১৮২৫
তাইওয়ানের অভিযোগ, চলতি বছরের (পড়ুন ২০২৫) ৫ জানুয়ারি তাঁদের জলসীমায় ঢোকে ‘শুনসিন-৩৯’ নামের একটি চিনা জাহাজ। কিলুং বন্দরের কাছে নোঙর ফেলে সমুদ্রের তলদেশে থাকা ফাইবার-অপটিক্যাল তার কেটে দেয় ওই জলযান। এর পর চুপচাপ সেখান থেকে জাহাজটিকে অন্যত্র সরিয়ে নেয় বেজিং।
১৯২৫
সমুদ্রের গভীরে থাকা ফাইবার-অপটিক্যাল কেব্ল কাটার বিষয়টি প্রথম নজরে আসে তাইওয়ানের চুংহওয়া টেলি যোগাযোগ দফতরের আধিকারিকদের। এর জেরে বিঘ্নিত হয় পরিষেবা। বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নামে দ্বীপরাষ্ট্রের উপকূলরক্ষী বাহিনী। তাদের দাবি, অভিযুক্ত চিনা জাহাজটিতে মোট সাত জন সদস্য ছিলেন। হংকংবাসী এক ব্যক্তি ওই জনযানটির মালিক। জাহাজটি কিলুং বন্দরের কাছে আসার আগে আফ্রিকার দেশ ক্যামেরুন এবং তানজ়ানিয়ায় নোঙর করেছিল।
২০২৫
কিন্তু তাইপের এই অভিযোগ হেলায় উড়িয়ে দেয় ‘শুনসিন-৩৯’-এর পরিচালন সংস্থা। গত ১০ জানুয়ারি এই ইস্যুতে বিবৃতি জারি করে তারা। সেখানে বলা হয়েছে, বন্দরের কাছে এলে নোঙর ফেলা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এর সঙ্গে সমুদ্রের গভীরে থাকা ফাইবার অপটিক্যাল কেব্ল নষ্ট হওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই।
২১২৫
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, প্রতিবেশী দেশগুলিতে এই ধরনের সমস্যা তৈরি করতে ‘চাইনিজ় মেরিটাইম মিলিশিয়া’কে কাজে লাগাচ্ছে বেজিং। যদিও তাইওয়ানের ঘটনায় চিনা ভাড়াটে জলযোদ্ধারা জড়িত ছিলেন না। মূলত একসঙ্গে একাধিক মাছ ধরার জাহাজ নিয়ে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে ঢুকে পড়ে হাঙ্গামা শুরু করার বদনাম রয়েছে তাঁদের।
২২২৫
তাইওয়ানের জলসীমায় ঢুকে এই ধরনের দাদাগিরি চিন প্রথম বার করল, এমনটা নয়। ২০২৩ সালে বেজিঙের বিরুদ্ধে একই রকমের অভিযোগ তুলেছিল তাইপে। সে বার মূল তাইওয়ানের সঙ্গে মাৎসু দ্বীপপুঞ্জের সংযোগকারী দু’টি কেব্লকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় ড্রাগনের নৌবাহিনী। ফলে প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রে ব্যাহত হয়েছিল ইন্টারনেট পরিষেবা।
২৩২৫
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা একে চিনের ‘বৃহত্তর হাইব্রিড যুদ্ধ কৌশল’ বলে উল্লেখ করেছেন। লম্বা সময় ধরে তাইপেকে নিজেদের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দাবি করে আসছে বেজিং। প্রশান্ত মহাসাগরের এই দ্বীপরাষ্ট্র ড্রাগনের কাছে একটি ‘বিদ্রোহী প্রদেশ’, কোনও স্বতন্ত্র দেশ নয়।
২৪২৫
বিশ্লেষকদের কেউ কেউ আবার একে ‘ধূসর-এলাকা হয়রানি’ বলে থাকেন। তাঁদের ব্যাখ্যা, চিনের পিপল্স লিবারেশন আর্মি বা পিএলএ তাইওয়ানকে ‘ধূসর এলাকা’ বলে মনে করে। প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রটি দখল করতে সরাসরি যুদ্ধের রাস্তায় যেতে চাইছেন না ড্রাগনের ফৌজি কম্যান্ডারেরা। এই ধরনের পদক্ষেপের মাধ্যমে তাইপের উপর মানসিক চাপ তৈরি করতে চাইছেন তাঁরা।
২৫২৫
পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, চিনা লালফৌজের ‘হাইব্রিড যুদ্ধ কৌশল’-এর বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হল, তাইওয়ানকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে পিএলএ নৌসেনার বড় আকারের যুদ্ধাভ্যাস। গত দু’বছরে এ ভাবে বহু বার তাইপের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে বেজিং।