১৯৩৯ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবে শুরু। পৃথিবী জুড়ে চলছে হিটলারের ইহুদি নিধন যজ্ঞ। সেই যজ্ঞের বলি হতে যাওয়া প্রায় ৬৬০ জন শিশুকে নিরাপদে নাজ়ি অধিকৃত চেকোস্লোভাকিয়া (অধুনা চেক প্রজাতন্ত্র) থেকে ব্রিটেন পৌঁছে দেন ব্রিটিশ যুবক নিকোলাস উইন্টন। দীর্ঘ ৫০ বছর আগের অতীত সম্পর্কে কাউকেই জানতে দেননি নিকোলাস। এমনকি তাঁর অর্ধাঙ্গিনী গ্রেটেকেও নয়।
সব ঠিকই ছিল। ১৯৩৮ সালে ছুটি কাটানোর জন্য এবং স্কি করার উদ্দেশ্যে সুইৎজ়ারল্যান্ড যাওয়ার পরিকল্পনা করেন তিনি। কিন্তু সেই পরিকল্পনায় ইতি টানতে বাধ্য হন নিকোলাস। বন্ধু মার্টিন ব্লেকের একটি অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারেননি তিনি। ব্লেক সে সময় ব্রিটিশ কমিটির সহযোগী হিসাবে নাজ়ি অধিকৃত চেক প্রজাতন্ত্রের শরণার্থী শিবিরে কাজ করছিলেন।
১৯৩৮-এর অক্টোবরে জার্মানি ও অন্য ইউরোপীয় পরাশক্তিদের মধ্যে ‘মিউনিখ চুক্তি’ হওয়ার পর নাজ়িরা চেকোস্লোভাকিয়ার পশ্চিম দিকের একটা অংশ নিজেদের দখলে নেওয়ার জন্য হামলা চালায়। প্রাগ থেকে চেকের সুডেটেনল্যান্ডের শিবিরে এসে পৌঁছে নিকোলাস দেখেন সেখানকার ইহুদিরা ভয়াবহ পরিস্থিতিতে দিন কাটাচ্ছেন। বিশেষ করে শিশুরা।
জার্মানির আগ্রাসী মনোভাব দেখে গোটা বিশ্ব আন্দাজ করে নিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সময়ের অপেক্ষা। প্রতিটি আশ্রয় শিবিরে দেখা দিয়েছিল খাদ্যের হাহাকার। কারও কাছে খাবার কেনার সামর্থ্য ছিল না। শিবিরে থাকা বাচ্চাদের নিয়ে কষ্টে দিনাতিপাত করছিলেন মায়েরা। তাঁরা মনে প্রাণ চাইছিলেন যে কোনও ভাবে সন্তানদের অন্য দেশে নিরাপদে পৌঁছে দিতে।
এই অবস্থায় নিকোলাসের দেশ ব্রিটেন ইহুদি শরণার্থী ও শিশুদের সুরক্ষা দিতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। ১৯৩৯ সালের শেষের দিকে শুরু হয় ‘কিন্ডারট্রান্সপোর্ট’। এখানে ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত অভিভাবকহীন ইহুদি শিশুদের আশ্রয় দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। শর্ত ছিল ব্রিটেনে আশ্রয়দাতা পরিবার থাকতে হবে ও ৫০ ডলার করে জমা রাখতে হবে সরকারের কাছে।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ১০ হাজার ইহুদি শিশুকে উদ্ধার করা সম্ভব হলেও চেকোস্লোভাকিয়ার ক্ষেত্রে এই উদ্ধারকাজ তেমন এগোচ্ছিল না। অগণিত পরিবার আশ্রয়হীন ভাবে ঘুরে বেড়াতে থাকে রাস্তায়। উইন্টন চুপ করে থাকতে পারলেন না এমন বিপর্যয় দেখে। সুডেটেনল্যান্ডের শিবিরে হাত গুটিয়ে বসে না থেকে নিজের উদ্যোগে এখানকার শিশুদের ব্রিটেনে পাঠানোর জন্য উঠেপড়ে লাগেন।
এই শিশুদের ব্রিটেনে নিয়ে আসার জন্য প্রয়োজন ছিল বিপুল অর্থের। সেই তহবিল সংগ্রহের জন্য লন্ডনে ফিরে আসেন উইন্টন। বিভিন্ন দেশ থেকে সহায়তা চেয়ে যোগাযোগ শুরু করেন তিনি। পাহাড়প্রমাণ দায়িত্ব চাপে উইন্টনের কাঁধে। সকালে স্টক মার্কেটে সময় দিতে হত রুজিরুটির জন্য। এর পরের অবসর সময়টুকু তিনি শিশুদের উদ্ধারের কাজে ব্যয় করতে লাগলেন।
অক্লান্ত পরিশ্রমের পরও ভাগ্য খুব একটা সহায় হল না নিকোলাসের। ছোটাছুটিই সার হল। ব্রিটিশ সরকারের মধ্যে তেমন একটা সাহায্যের মনোভাব দেখা গেল না। ফলে নিজেই কোমর বেঁধে নামলেন তিনি। তাঁর শিবিরে আশ্রয়ে থাকা বাচ্চাদের ছবি তুলে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আটকে দিতে শুরু করলেন। নিকোলাসের আশা ছিল, ছবি দেখে যদি কোনও সহৃদয় পরিবারের মন গলে ও সেই বাচ্চাকে আশ্রয় দিতে তাঁরা রাজি হয়ে যান।
অবশেষে ভাগ্যদেবতা সুপ্রসন্ন হলেন নিকোলাসের প্রতি। ১৯৩৯ সালের মার্চ মাসে উইন্টনের উদ্যোগে বাচ্চাদের নিয়ে প্রথম বিমানটি প্রাগ থেকে লন্ডনের উদ্দেশে রওনা দেয়। ঠিক তার পর দিনই হিটলার তাঁর বাহিনী নিয়ে প্রাগের দিকে যাত্রা শুরু করেন। এই ঘটনার পর অবশ্য আরও সাত বার শিশুদের নিয়ে রেলপথে ও পরে জাহাজে ব্রিটেনে নিয়ে আসেন তিনি।
হলরুম কানায় কানায় ভর্তি দর্শকে। সেই অনুষ্ঠানেই একটি চমক অপেক্ষা করছিল নিকোলাসের জন্য, যা তাঁর কাছে ছিল সম্পূর্ণ অজানা। বৃদ্ধ মানুষটি জানতেনই না, তাঁর চারপাশে যাঁরা বসে আছেন, এক সময় তাঁদেরই বাঁচিয়েছিলেন তিনি। হঠাৎ অনুষ্ঠানের সঞ্চালিকা এক জনের নাম ঘোষণা করেন। সেই মহিলা বসেছিলেন বৃদ্ধ নিকোলাসের পাশেই। তিনি হঠাৎই বৃদ্ধকে জড়িয়ে ধরেন।
২০১০ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘হলোকাস্টের ব্রিটিশ নায়ক’ উপাধি প্রদান করে। ২০১৪-এর ২৮ অক্টোবর চেক প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট নিকোলাসকে সে দেশের সর্বোচ্চ সম্মান ‘অর্ডার অফ দ্য হোয়াইট লায়ন’ প্রদান করেন। প্রাগের যে স্টেশন থেকে শেষ বারের মতো তিনি শিশুদের নিয়ে যাত্রা করেন সেখানে তাঁর একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy