নীললোহিত যে রকম মানুষ, তাতে তার কোনও স্ত্রী থাকা সম্ভব নয়। বোধ হয় উচিতও নয়।
নীললোহিত এক বাউণ্ডুলে, ঘর থেকে ঘর, পথ থেকে পথে ঘুরে বেড়ায়। সেই যে সুনীলের কবিতায় আছে না— ‘‘ঐ ছেলেটা মানুষ দেখলে ধুলো কাদায় ছবি আঁকবে/ ধুলো কাদাই ছিটিয়ে বলবে ভালোবাসতে চেয়েছিলাম।’’
তো, নীললোহিত হল সেই ছেলেটা। তাকে বিয়ে করে ঘর করতে পারবে না কোনও মেয়ে। আর দুঃসাহস করে কেউ যদি সে-কাজ করেও তাকে ঠকতে হবে।
আমি কি ঠকেছি?
উত্তরে ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’ দুই-ই বলতে হয় আমায়। আসলে আমি তো ঠকতেই চেয়েছিলাম (যদি অবশ্য তাকে ঠকা বলে)।
নইলে কী দায় পড়েছিল দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত বাড়ির এক মেয়ের দমদমের কলোনি অবধি গিয়ে ‘কৃত্তিবাস’ সংগ্রহ করার? কী দরকার ছিল বিলেত-ফেরত সব পাণিপ্রার্থীদের বাতিল করে, একদম জিদ ধরে থাকার যে, বিয়ে করলে ওকেই আমি করব।
সুনীল অবশ্য আমায় নিরস্ত করার চেষ্টা করেছিল— ‘‘আমরা উদ্বাস্তু, আমরা খুব সাধারণ, তোমার খুব কষ্ট হবে...।’’
আমি তখন ওর কোনও কথা শুনতে পেতাম না। ওর কথার ভিতরে যে না-বলা কথাগুলো কবিতা হয়ে বেরিয়ে আসত, সেগুলোই তখন আমার অন্ধকারের টর্চ।
‘‘ভ্রূ-পল্লবে ডাক দিলে দেখা হবে চন্দনের বনে/ সুগন্ধের সঙ্গ পাবো দ্বিপ্রহরের বিজন ছায়ায়/আহা কী শীতল স্পর্শ হৃদয় ললাটে, আহা চন্দন, চন্দন/ দৃষ্টিতে কি শান্তি দিলে, চন্দন, চন্দন/... ক্ষণিক ললাট ছুঁয়ে উপহার দাও সেই অলৌকিক ক্ষণ/ তুমি কি অমল-তরু, স্নিগ্ধজ্যোতি, চন্দন, চন্দন...’’— পড়ে আমার তো তখন পাগল-পাগল অবস্থা। মনে হয়েছিল এ আমার জন্যই লেখা, গভীর গভীরতম বনে আমাকেই সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চাইছে লোকটা। সেই লোকটাই আমার কাছে নীললোহিত, যার সঙ্গে আমি চাইলে গাছতলাতেও থাকতে পারতাম।
তবে সুনীলের জায়গায় যদি নীললোহিত থাকত, তা হলে হয়তো আমার বিয়েটাই হত না।
আমি আর ফিরে আসার জায়গায় নেই, এটা বুঝতে পেরে সুনীল একটু এগিয়ে এসেছিল। আমার আর ওর বিয়ে হবে এটা মেনে নিতে পারছিলেন না, আমার যে আত্মীয়রা, তাঁদের কারও কারও সঙ্গে কথা বলেছিল।
নীললোহিত হলে আদৌ সে রকম কিছু করত কি? ‘‘আপনাদের মেয়ে যদি অন্য কাউকে বিয়ে করে তাতে আমার কোনও আপত্তি নেই, কিন্তু সে যদি আমাকেই বিয়ে করতে চায়, তা হলে আমিও তাকে বিয়ে করবই,’’ বলেছিল সুনীল। নীললোহিত এ সবের ধার ধারত না। উল্টে হয়তো ধলভূমগড়ে পাড়ি দিত।
তবু বলব, আমি নীললোহিতকেই ভালবেসেছিলাম। আর বিয়ের পর যখন দেখতাম যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নামের লোকটা ডান হাত দিয়ে, বাঁ হাত দিয়ে (কখনও কখনও পা দিয়েও হয়তো) শুধু লেখে আর লিখে যায়, তখন আমার ভীষণ মন কেমন করত। আমি তো ওর সঙ্গে ভিজে ঘাসের ওপর হেঁটে বেড়াতে চেয়েছিলাম, ওকে আর একটু নিজের করে পেতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু তত দিনে সুনীল বাংলা সাহিত্যের সম্রাট হওয়ার পথে অনেকটা এগিয়ে গেছে। ওর তো চতুর্দিকে তখন ভিড় জমতে শুরু করেছে। আর যেহেতু ও চট করে ‘না’ বলতে পারত না কাউকে, তাই ওর মৌনতাকে সম্মতি ভেবে নিয়ে অনেকেই অনেক কিছু করতে শুরু করেছে।
আমি ক্রমশ বুঝতে পারছিলাম যে এই রাজার ভিতরে আমি যে রাখালকে ভালবেসেছিলাম, তাকে খুঁজে পাওয়া দিনে দিনে কঠিন হয়ে পড়বে।
আর সেই রকম একটা সময়েই ও নীললোহিতের লেখাগুলো লিখতে শুরু করল। ওই একেকটা লেখার মধ্যে দিয়ে আমি আবার প্রথম প্রেমের দিনগুলোকে ফিরে পেতে শুরু করলাম।
‘সুদূর ঝর্ণার জলে’র মারগারিটকে ভালবাসা নীললোহিত বা ‘ভালবাসা নাও হারিয়ে যেও না’র সেই ছেলেটা যে এক বৃদ্ধা ডিম-বিক্রেতা রমণীর সঙ্গে আত্মীয়তা অনুভব করে কাঁচা খেয়ে নেয় উপহার পাওয়া ডিম, আমার খুব কাছের হয়ে উঠেছিল। একটাই কথা বলতে ইচ্ছে করত নীললোহিতের একেকটা উপন্যাস পড়ে, ‘তোমার তুলনা তুমি’।
‘‘আমার কেউ নাম রাখেনি, তিনটে চারটে ছদ্মনামে/ আমার ভ্রমণ মর্ত্যধামে,/...কেউ আমাকে শিরোপা দেয়, কেউ দু’চোখে হাজার ছি ছি/ তবু আমার জন্ম-কবচ, ভালোবাসাকে ভালোবেসেছি,’’— এই পঙক্তিগুলো তো আসলে নীললোহিতেরই, যদিও সে কখনও কবিতা লেখেনি।
আমার একেক সময়, মনে হয় সুনীল, ‘নীললোহিত’ হয়েছিল আমারই জন্য কারণ ও বুঝতে পেরেছিল, যাকে ভালবেসে আমি ওর জীবনে এসেছি, তার সঙ্গে খ্যাতির শিখরে উঠতে থাকা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মিল খুব কম।
একটা ব্যাপারে অবশ্য খুব মিল ছিল দু’জনের মধ্যে। পকেটে দশ টাকা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো নীললোহিত যেমন উদাসীন ছিল টাকার ব্যাপারে, সুনীলও তাই।
অনেক-অনেক রোজগার করলেও সুনীলকে কোনও দিন পয়সার ব্যাপারে মাথা ঘামাতে দেখিনি। বন্ধুবান্ধবদের মদ খাওয়াতে ও যত খরচ করেছে, তাই দিয়ে কলকাতায় একটা বড় বাড়ি হয়ে যায়। এ ছাড়া যে যখন বিপদে পড়ে ধার চেয়েছে, সুনীল তাকে ফেরায়নি। এই যে নীললোহিতের দরকারে অদ্ভুত সব সিচুয়েশনে কেউ না কেউ হাজির হয়ে যায়, আমার মনে হয়, ওরা সবাই বোধ হয়, ছদ্মবেশী সুনীল। সুনীল নিজের জীবনে যে সাহায্যগুলো পায়নি, সেগুলো অন্যদের জন্য করতে ভালবাসত। আর নীললোহিতের জন্য করবে না? সে তো ওরই আয়না।
না কি আমার? মাঝে মাঝে গুলিয়ে যায়।
তবে একটা কথা স্পষ্ট বুঝতে পারি যে ওর প্রেমিকারা সবাই খ্যাতিমান, জনপ্রিয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কেই পেতে চাইত। আর যার আস্তানার নাম দিকশূন্যপুর, তেমন এক ভবঘুরেকে ভালবেসেছিলাম আমিই। একা আমি।
আজও একা থাকলেই নীললোহিতের সঙ্গে অনেক কথা বলি। মান-অভিমানের কথা সুনীলের সঙ্গেই হয়, তবে ভালবাসার কথা বলতে গেলেই নীললোহিত সামনে এসে দাঁড়ায়।
আমি এক-এক সময় ভাবি যে এখন বয়স হয়েছে, এতটা উতলা হওয়া মানায় না, বিশেষ করে নীললোহিতও যখন একটা অদৃশ্য দরজার ও পারে।
তখনই আমাকে চমকে দিয়ে কে যেন বলে ওঠে— ‘‘তোমার রূপালি অসহায় মুখ আমাকে করেছে আরও উৎসুক—/ ধাক্কা মারো না! আপনি হয়তো দরজা খুলবে পলকা ও তালা’’...
সুনীলের সঙ্গে যদি নাও হয়, তো নীললোহিতের সঙ্গে এ জীবনে মুখোমুখি দেখা হবে না আর?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy