ঘাটশিলায় প্রথম স্ত্রী রমাদেবীর সঙ্গে
অনায়াসে উদাসীন
নিজেকে ভাবতেন তলস্তয়ের ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’-এর নায়ক বেজুকভ। নিজের ব্যক্তিত্ব নিয়ে এতটাই মুগ্ধ ছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
বাইরে নরম-কোমল মানুষটি কিন্তু ভেতরে ভেতরে বেশ শক্তই ছিলেন। প্রয়োজনে খুব কাছের মানুষদের ব্যাপারেও অনায়াসে উদাসীন হয়ে যেতেন।
অনেক দিনের বন্ধু বিভূতিভূষণ সম্পর্কে এমনই ধারণা ছিল নীরদ চন্দ্র চৌধুরী-র।
স্বাধীনতার বছর তিনেক আগের কথা। কলকাতায় মাঝেমধ্যেই হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা চলছে।
একবার রাস্তায় দাঙ্গার মধ্যে পড়ে বিভূতিভূষণ একটি বালির বস্তার আড়ালে লুকিয়ে পড়লেন। ভয়ে শুকিয়ে কাঠ হয়ে বস্তার পিছন থেকে কেবলই বন্ধু নীরদচন্দ্রকে বলছিলেন, ‘‘আমাকে ছেড়ে যেয়ো না, ট্রামে তুলে দিয়ো।’’ কিন্তু যে মুহূর্তে ট্রাম এল, নীরদচন্দ্র দেখলেন, তাঁকে রাস্তায় প্রায় ঠেলে ফেলে দিয়ে বিভূতিভূষণ ট্রামে উঠে চলে গেলেন। একবার পেছন ফিরেও তাকালেন না।
‘মা’-র খোঁজে নিষিদ্ধ পল্লিতে
বয়স তখন চার কী পাঁচ। বাবার হাত ধরে প্রথম কলকাতায় এলেন। বাবা দরিদ্র ব্রাহ্মণ।
এ শহরে ভাল পাড়ায় বাড়ি ভাড়া করে থাকার মতো রেস্ত নেই। তাই বাধ্য হলেন শিশুপুত্রকে নিয়ে এক ‘নিষিদ্ধ’ পাড়ায় বস্তিতে ঘর ভাড়া নিতে।
সে ঘরের পাশেই এক মহিলা প্রায়ই ছোট্ট বিভূতিকে ডেকে গল্প করতেন। কখনও টফি দিয়ে আদর করে গালও টিপে দিতেন।
মা-ছাড়া বাড়িতে খুব তাড়াতাড়ি শিশু বিভূতি মহিলার স্নেহের কাঙাল হয়ে উঠল। একদিন সন্ধেবেলা জেদ ধরল, ঘরে যাবে না, তার কাছেই রাতটা থাকবে।
মহিলা যত বোঝান, বিভূতি নাছোড়।
মধ্যবয়সে মেসে থাকার সময় একদিন বিভূতির মনে পড়ল ওই মহিলার কথা। ঠিক করলেন সেই পুরনো পাড়ায় মহিলাকে খুঁজতে যাবেন তিনি। যেমন ভাবা তেমন কাজ।
সেখানে গিয়ে তিনি যত বলেন খুঁজতে এসেছেন সেই মহিলাকে, এ ছাড়া আর অন্য কোনও উদ্দেশ্য নেই, অল্পবয়সি যুবতী মেয়েরা শুনতে নারাজ। একসঙ্গে চার-পাঁচ জন মেয়ে নাকি তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সকলেরই আবদার তাঁকে ঘরে নিয়ে যাওয়ার।
শেষে ছুটে, দৌড়ে, পালিয়ে কোনও ক্রমে সে যাত্রা রক্ষা পান বিভূতিভূষণ। এ কথা মেসে এসে প্রাণের সখা নীরদচন্দ্রকে বলতে তিনি নাকি প্রথমে একচোট হাসেন। তারপর বিভূতিভূষণের কোনও আক্কেল নেই বলে তাঁকে খুব ভর্ৎসনা করেন।
তাতেও তাঁর ‘আক্কেল’ হয়নি।
একবার এক বন্ধু বলেছিলেন সন্ধ্যাবেলা ওয়েলিংটন স্ক্যোয়ারে গেলে নাকি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বেশ্যাদের দেখা যায়।— ‘‘তুমি যাবে, আমিও থাকব।’’
বিভূতিভূষণের বয়স তখন চল্লিশের বেশি। কথা মতো নির্দিষ্ট সময়ে তিনি সেখানে গিয়ে হাজির। নভেম্বর মাস। শীতকাল। বাতাসে ঠান্ডা বেশ। বহু ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর দেখলেন, সব ভোঁ ভাঁ। বন্ধুও নেই, ‘তারা’ও নেই।
রাগে গজগজ করতে করতে মেসে ফিরলেন। নীরদচন্দ্রর মতে, আসলে লেখার রসদ খুঁজতে তিনি জীবনটাকে এমন করেই চেখে দেখতে চাইতেন। তাই-ই এ সব করে কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলতেন মাঝেমধ্যে।
প্রথম লেখা গল্প
বিএ পাশ করার পর প্রথম চাকরি পেলেন হরিণাভির একটি স্কুলে।
ক্লাসের ফাঁকে একদিন স্টাফরুমে বসে আছেন। একটি অল্পবয়সি ছেলে এসে বলল, ‘‘চলুন,আমরা দু’জনে মিলে একটা বই লিখি।’’
বিভূতিভূষণ কমবয়সি ছোকরার চাপল্য ভেবে কথাটার কোনও গুরুত্বই দিলেন না।
মনে মনে ভাবলেন, ‘‘বই তো দূর অস্ত, কোনও দিন কোনও গল্প, প্রবন্ধ লেখার কথাও আমার মনে আসেনি।”
পরের দিন স্কুলে পৌঁছে দেখেন, যেখানে-সেখানে সাঁটা বিজ্ঞাপন।
‘‘শীঘ্র প্রকাশিত হইতেছে....শীঘ্র প্রকাশিত হইতেছে উপন্যাস।’’
ভাবলেন নিশ্চয় ওই ডেঁপো ছোকরার কাজ, উপন্যাসের নামকরণও করে ফেলেছে সে।—চঞ্চলা!
এ দিকে সহকর্মীরা বিভূতিভূষণের পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘‘বাঃ, মশাই! আপনি তো বেশ গোপন রসিক দেখছি। তা কবে বেরোচ্ছে উপন্যাস?’’
পরে বিভূতিভূষণ তাঁর বন্ধু এবং ভ্রমণসঙ্গী যোগেন্দ্রনাথ সিংহকে বলেছিলেন, উপন্যাস তো দূর অস্ত, এমনকী তিনি যে আদৌ লেখক নন, বিজ্ঞাপনটা পুরো মিথ্যে, এ কথাও কাউকে বলতে পারছেন না।
ছেলেটাকে কার্যত কলার চেপে বলেছিলেন, তাঁর সঙ্গে এইসব রসিকতার মানে কী? কোন প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছেয় সে এ সব করল!
তাতে ছেলেটি একটুও উত্তেজিত না হয়ে বলেছিল, ভেবেছিল দু’জনে মিলে লিখে ফেলবে, আর ‘চঞ্চলা’ নামটাও তো মন্দ নয়।
তার এই ভাবলেশহীন উত্তরে বিভূতিভূষণ আর কিছু বলতে পারেননি। এদিকে রাস্তায়, বাজারে, স্কুলে, সকলের একই প্রশ্ন— কবে বেরোচ্ছে উপন্যাস?
রাগের চোটে কাগজ-কলম নিয়ে বসে একটি ছোট গল্প লিখলেন। পাঠিয়ে দিলেন কলকাতার একটি মাসিক পত্রিকায়। পত্রিকার নিয়ম অনুযায়ী সঙ্গে একটি ঠিকানা লেখা খাম স্ট্যাম্প সেঁটে পাঠালেন।
তিন দিন পর থেকেই অপেক্ষা। দুরু দুরু বুকে স্কুলে বসে ভাবছেন এই বুঝি খাম ভর্তি অমনোনীত গল্প ফেরত এল!
সপ্তাহ তিনেক বাদে এল সেই খাম। দেখামাত্র বিভূতিভূষণ খামটা পকেটে চালান করে দিলেন।
বিভূতিভূষণ ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘‘দুঃখ তো হল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এই আনন্দও হল যে রোজকার দুশ্চিন্তা তো কাটল। আমার মনের অবস্থা এমন হল যে কোনও প্রিয়জন অসাধ্য রোগে মারা গিয়ে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেল।’’
বাড়ি ফিরে খাম খুলে দেখেন, লেখা তো নেই! বদলে একটি চিঠি। সম্পাদক মশাই লিখেছেন, “আপনার রচনা মনোনীত হয়েছে, শীঘ্রই প্রকাশিত হবে।”
পরবর্তী কালে বিভূতিভূষণ তাঁর বন্ধুকে বলেছিলেন, ছেলেটি বোধহয় ঈশ্বরের দূত হয়ে সে দিন তাঁর কাছে এসেছিল। ওই বিজ্ঞাপন কাণ্ডটি না ঘটলে তিনি কোনও দিন লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন না।
সেই ছোকরার আসল নাম ছিল যতীন্দ্রমোহন রায়। ১৩২৮, মাঘ মাসের ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় বিভূতিভূষণের প্রথম গল্প ‘উপেক্ষিতা’। এই গল্পটি সেই বছর শ্রেষ্ঠ গল্পের পুরস্কারও ছিনিয়ে নেয়।
প্রেমে পড়েও পালালেন
প্রায়শই বিভূতিভূষণ তাঁর মুগ্ধ পাঠিকাদের থেকে প্রেমপত্র গোছের চিঠি পেতেন এবং বন্ধু নীরদচন্দ্র চৌধুরীর মতে, তিনি এ সব বেশ ভালই উপভোগ করতেন। সেই সব গল্প বেশ রসিয়ে রসিয়ে প্রাণের সখা নীরদচন্দ্রকে বলতেন।
মির্জাপুর স্ট্রিটের মেসে আসার আগে হরিণাভির স্কুলের চাকরিটা ছেড়ে দেন বিভূতিভূষণ।
চাকরিটি ছাড়ার পেছনে একটা রোম্যান্টিক ঘটনা জড়িয়ে। ওই সময় তিনি স্কুলের কাছে একটি দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতেন। তাঁদের একটি বিবাহযোগ্যা তরুণী কন্যা ছিল। সে আড়ালে-আভাসে বিভূতিভূষণকে খেয়াল রাখত।
বিভূতি স্কুলে চলে গেলে প্রায়শই মেয়েটি এসে তাঁর এলোমেলো ঘরদোর গুছিয়ে দিত। বিভূতিভূষণ সে সব বুঝতে পারতেন। কিন্তু কিছু বলতেন না।
কারণ, মেয়েটিকে তাঁরও বেশ লাগত। প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর কখনওই তাঁর মন-মেজাজ ভাল থাকত না। ঠিক তখনই না চাইতেই অমন যত্ন –আত্তি!
মেয়েটি নিজেকে ‘আমি আপনার দাসী’ সম্বোধন করে বেশ কয়েকটি চিঠিও লিখেছিল তাঁকে। সে-চিঠি নীরদচন্দ্র দেখে বলেছিলেন, ‘‘এমন পবিত্র পত্র তিনি দেখেননি আগে।’’
কিন্তু হঠাৎই বিভূতিভূষণ ওই চাকরি ছেড়ে কলকাতায় চলে এলেন। কারণ ওই মেয়েটির উপর তিনি যতই মানসিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে উঠছিলেন ততই বুঝতে পারছিলেন, তাঁরা কুলীন ব্রাহ্মণ, মেয়েটি তাঁদের সমগোত্রীয় নয়। কাজেই কোনও সম্পর্ক হলে তাঁর পরিবার খুশি হবে না। আশেপাশেও অনেক কথা হবে।
এই সব ভেবে তিনি কাউকে না জানিয়ে প্রায় লুকিয়েই কলকাতায় চলে আসেন। ফিরে এসে স্কুলে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন।
এই ঘটনা পেরিয়ে প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার তেইশ বছর পর বিভূতিভূষণ দ্বিতীয় বিবাহ করেন।
কল্যাণীর সঙ্গে দেখা
ইছামতী নদীতে স্নান করতে গিয়ে জলে ডুবে বোন জাহ্নবীর মৃত্যু হল। আকস্মিক এই ঘটনায় বিভূতি যেন দুমড়েমুচড়ে গেলেন।
তার দু’দিন পর। একটি অল্পবয়সি মেয়ে এল বিভূতির কাছে অটোগ্রাফ চাইতে।
মেয়েটিকে খুব ভাল লেগে গেল তাঁর। ধীরে, ধীরে দুই অসমবয়সির বন্ধুত্বও বেশ গাঢ় হল। এক বছরের মাথায় দু’জনে বিয়ে করলেন।
পরবর্তী কালে বিভূতিভূষণ কল্যাণী দেবীকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘‘এখন মনে হচ্চে হয়তো অনেক জন্মের বন্ধন ছিল তোমার সঙ্গে— নয় তো এমন হবে কেন? কল্যাণী, তুমি আমার অনেক দিনের পরিচিতা, এ বার এত দেরীতে দেখা হল কেন জানি নে, আরও কিছুকাল আগে দেখা হলে ভাল হতো।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy