উত্তমকুমার তখনও উত্তমকুমার হননি।
ইন্ডাস্ট্রির কাছে তিনি তখন ‘ফ্লপ মাস্টার জেনারেল’! সে সময়, ’৪৯-এ পূর্ণশ্রী, প্রাচী, আলেয়াতে মুক্তি পেল উত্তমকুমারের তৃতীয় ছবি ‘কামনা’। নায়িকা ছবি রায়। সে ছবি ফ্লপ! পুলকের সঙ্গে উত্তমের সম্পর্ক ছিল মামা-ভাগ্নের। তাই চিন্তায় পড়লেন তিনি। কোথাও নতুন ছবির ডাক পাচ্ছেন না শুনে, চিন্তায় পড়লেন পুলক।
কলেজের থার্ড-ইয়ারের ক্লাস কেটে একদিন জামাইবাবু সরোজ মুখোপাধ্যায়ের কাছে হাজির। তার আগে, সরোজবাবু উত্তমকে নিয়ে দিয়ে ‘কামনা’ করেছেন। তবু খানিকটা জোর করেই জামাইবাবুকে রাজি করালেন। স্মৃতিরেখা বিশ্বাসের বিপরীতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করলেন উত্তম। ছবির নাম ‘মর্যাদা’।
যেহেতু উত্তম অভিনীত তাঁর আগের ছবিগুলি ফ্লপ করেছিল, তাই প্রযোজকের শর্ত মতো নাম বদলে অভিনয় করলেন নায়ক। ‘অপয়া’ নাম বদলে মহানায়কের নতুন নামকরণ হল ‘অরূপকুমার।’ ছবিতে পুলকের লেখা গান, নায়কের লিপে প্রথম প্লে-ব্যাক করলেন কেউ। তিনি তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
উত্তমকুমারের সঙ্গে জীবনের নানা মুহূর্ত কাটিয়েছিলেন পুলক। সে সব স্মৃতি লিখেওছিলেন।
এক বারের কথা। তখন ‘ছোটি সি মুলাকাত’ ছবির কাজ চলছে। তারই ফাঁকে এক দিন কলকাতায় ময়রা স্ট্রিটে উত্তমকুমারের ফ্ল্যাটে সান্ধ্য মজলিশ। ঘরে রয়েছেন প্রযোজক দেবেশ ঘোষও। তিনি তখন তাঁর নতুন ছবি ‘কাল তুমি আলেয়া’-র স্ক্রিপ্ট নিয়ে শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলছেন। রাত গড়াতেই কোলের কাছে হারমোনিয়ম টেনে একের পর এক গানে মৌতাত জমালেন মহানায়ক। জোয়ারি সুরে ভেসে যাচ্ছে ঘর। একসময় উত্তম উঠে টয়লেটে গেলেন।
পুলক দেবেশকে বললেন, ‘‘তোমার নতুন ছবির গান আমাকে দিয়ে লেখাবে বললে, কিন্তু ছবির মিউজিক ডিরেক্টর কে?’’
দেবেশ বললেন, ‘‘মিউজিক ডিরেক্টর? তাই তো!’’
পুলক লিখছেন, ‘‘দেবেশ দৌড়ে চলে গেল উত্তমের বন্ধ টয়লেটের দরজার সামনে। দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে চ্যাঁচাতে লাগল এই উত্তম, তুই আমার ‘কাল তুমি আলেয়া’র মিউজিক ডিরেক্টর, তুই আমার...! যতক্ষণ না ‘হ্যাঁ’ বলবি, ততক্ষণ ... ভিতর থেকে কী উত্তর এল আমি শুনতে পেলাম না। কিন্তু দেখলাম, একসময় আশ্বস্ত হয়েই দেবেশ সোফাটায় ধপ করে বসে পড়ল।’’
ছবিতে ছিল তিনটি গান। তার মধ্যে দুটি চরিত্রের লিপে, তৃতীয়টি ব্যাকগ্রাউন্ডে। রাজি হলেও, খুব সহজ ছিল না উত্তমের কাছ থেকে সুর আদায় করা। পর পর বেশ কয়েকদিন ঘুরে দেবেশের মধ্যস্থতায় একদিন সুর করতে বসলেন উত্তম। প্রথম গানটি, ‘একটু বেশি রাতে/ মনের মানুষ ফিরল ঘরে’। পরের দিন সুর হল ‘পাতা কেটে চুল বেঁধে কে টায়রা পরেছে/ কে খোঁপার পাশে পাশ চিরুনি বাহার করেছে।’
ব্যাকগ্রাউন্ডের গানটিও উত্তম সুর করলেন। সলিল চৌধুরীর ‘আজারে আজা নিদিয়া তু আজা’-র কেতায়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলায় সে গানও জনপ্রিয় হয়, ‘যাই চলে যাই/ আমায় খুঁজো না তুমি।’
কখনও উত্তমের কোনও অনুরোধ ফেলতেন না পুলক।
একবার উত্তম পুলককে বললেন, ‘‘আমাদের মরশুমি ক্লাবের সঙ্গে টেকনিসিয়ান্স স্টুডিয়ো একটা ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলবে। মামা, তোমাকেও খেলতে হবে।’’
কথাটা যেখানে হচ্ছে সেখানে তখন ছিলেন শ্যামল মিত্র, রতু মুখোপাধ্যায়, ভূপেন হাজরিকারা।
সকলে হইহই করে উঠলেন। ফুটবল খেলার প্রস্তাবে মুখ শুকিয়ে গেল পুলকের! বললেন, ‘‘আমি!’’
নাছোড় উত্তম! শেষে সাহস দিলেন শ্যামল। সেই ম্যাচ হয়েছিল এক রবিবার সকালে মহমেডান স্পোটিং মাঠে। উত্তম ক্যাপ্টেন।
পুলক লিখছেন, ‘‘খেলা আরম্ভ হল। শ্যামল, উত্তম, রতু সুনীল বেশ ভালই খেলা জানত। ... আমিও ওদের সঙ্গে অহেতুক দৌড়োদৌড়ি করতে লাগলাম। একবার আমার কাছে বল এল। মেরে দিলাম একটা শট। বল কোথায় দেখতে পাচ্ছি না। উত্তম পাশেই ছিল। বুঝতে পেরে হো হো করে হেসে আমায় বললে, ‘মামা ওই যে বল। স্কাইং হয়ে গেছে!’’
সে দিন ‘মরশুমি’ ক্লাব জিতেছিল। উত্তমকুমারের একটি থ্রু শিল্পী শ্যামল মিত্র আলতো করে এগিয়ে দিয়েছিলেন সুরকার রতু মুখোপাধ্যায়ের দিকে। রতু বলটা সোজা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন জালে। সেলিব্রেট করতে সকলে হাজির ময়দান থেকে গঙ্গার ধারে। সেখানে ইলিশ কিনে ভবানীপুর, মরশুমি ক্লাব। মনে মনে সেই তখনই বুঝি পুলক লিখে ফেলেছিলেন উত্তম অভিনীত ‘ধন্যি মেয়ে’ ছবির সেই বিখ্যাত গান, ‘সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল!’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy