তাঁর সঙ্গে প্রথম আলাপে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত বলে উঠেছিলেন, ‘‘তুমিই তা হলে সেই চিনের প্রাচীর গোষ্ঠ পাল!’’ খালি পায়ে যিনি লড়ে গিয়েছিলেন সে যুগের বুটপরা ইউরোপীয় ফুটবলারদের বিরুদ্ধে, স্বজাতির হয়ে। গোষ্ঠ পালকে নিয়ে লিখছেন কৌশিক দাশ
পুকুর না বলে ছোটখাটো দিঘি বলাই ভাল। হবে নাই বা কেন, ভাগ্যকুলের জমিদারবাড়ির পুকুর বলে কথা। নৌকা নিয়ে এ পার-ও পার করতে হয়! সেই পুকুরে আট-ন’ বছরের ছেলেটা হাবুডুবু খাচ্ছে। কোনও মতে এক বার মাথা তুলছে, পরক্ষণেই তলিয়ে যাচ্ছে।
বাঁচার আশা যখন প্রায় শেষ, একটা হাত এসে টেনে তুলল বাচ্চাটাকে। জটু মালির সেই হাতটা সে দিন ছিল বলে পরবর্তী কালে ভারতীয় ফুটবল পেয়েছিল সোনায় বাঁধানো দুটো পা। গোষ্ঠ পালের পা!
একশো বছরেরও বেশি আগের সেই ঘটনার কথা বলতে গিয়ে এখনও উত্তেজিত হয়ে পড়েন গোষ্ঠ পালের ছেলে নীরাংশু পাল। ‘‘আমরাও এই ঘটনার কথা জানতাম না। এক বার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ফুটবলার হয়ে ওঠার জন্য তুমি কার কাছে সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ? বাবা তখন জটু মালির কথা বলেন। বলেছিলেন, জটু না থাকলে আমার আর বড় হয়ে ওঠা হত না।’’
গোষ্ঠবাবুর মামার বাড়ি ছিল বর্তমান বাংলাদেশের ভাগ্যকুলে। এক বার গরমের ছুটিতে মামা বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। তখনই ঘটনাটা ঘটে। সে দিন শনিবার ছিল, হাটবার। বাড়ি ফাঁকা হয়ে যাওয়ার পরে জটু মালি এসে তাঁর বন্ধুকে বলেন, ‘‘চল তোকে একটু সাঁতার শেখাব।’’ দু’জনে চলে আসেন বিশাল পুকুরের পাড়ে। এর পরে নৌকা করে একটু এগিয়ে শুরু হয় সাঁতার শেখানোর পালা। তখনই তলিয়ে যাচ্ছিল ছোট্ট গোষ্ঠ।
লড়াইটা বোধ হয় জন্ম থেকেই মজ্জাগত ছিল গোষ্ঠ পালের। ১৮৯৬ সালের ২০ অগস্ট। ফরিদপুরের ভোজেশ্বরে যখন গোষ্ঠ পালের জন্ম হয়, তখন বাবা থাকতেন কলকাতায়। ছেলে হওয়ার খবর শুনে সোনার হার, হাতের বালা বানানো শুরু করে দেন। যে দিন যাবেন, সব নিয়ে যাবেন। কিন্তু বাবা আর ছেলের কোনও দিন দেখা হয়নি। ওই সময়ে টাইফয়েড এক মারাত্মক অসুখ ছিল। তাতেই মৃত্যু হয় গোষ্ঠবাবুর বাবার।
ছেলে জন্মানোর পরেই বাবার মৃত্যু! ব্যাপারটা ভাল ভাবে নিতে পারেননি অনেক আত্মীয়স্বজন। মা নবীন কিশোরী দেবী এর পরে ছেলেকে নিয়ে নিজের বাপের বাড়ি ভাগ্যকুলে চলে যান। সেখান থেকে মাঝে মাঝে ফরিদপুরের বাড়িতে যাতায়াত চলত। এর পরে গোষ্ঠ পালের এক কাকা নবীন কিশোরীকে বলেন, ‘‘আমাদের আর একটা বাড়ি আছে শোভাবাজারের কুমোরটুলিতে। তোমরা সেখানে চলে যাও।’’ এর পরে এক দিন ছ’-সাত বছরের ছেলের হাত ধরে মা চলে আসেন কুমোরটুলিতে। সেখান থেকেই শুরু হয় গোষ্ঠ পালের নতুন এক জীবন।
(২)
‘‘কোথায় যাচ্ছিস?’’— এই প্রশ্নটা দিনে কত বার যে শুনতে হত বছর দশেকের ছেলেটাকে, তার ইয়ত্তা নেই। তখন স্বাধীনতা সংগ্রামের জোয়ারে দেশ উত্তাল। মা ভয় পেতেন, ছেলেও না ভেসে যায় রাজনীতির স্রোতে। কলকাতায় এসে সারদাচরণ স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন গোষ্ঠ পাল। পিতৃহীন ছেলেকে সব সময়ে চোখে চোখে রাখতেন মা নবীন কিশোরী। আর ফুটবল খেলা? কখনওই নয়। মা কিছুতেই চাইতেন না ছেলে ‘বল লাথায়’। বলতেন, স্বামীজির বই পড়। মহারাজদের সঙ্গে কথা বল। অনেক ভাল থাকবি।
মায়ের কথা অমান্য করেননি গোষ্ঠবাবু। শুনেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের বাণী। আর তাতেই উদ্বুদ্ধ হয়ে বেছে নেন ফুটবলকে! শোভাবাজার অঞ্চলে অনেক ঠাকুরবাড়ি ছিল, যেখানে ছেলেকে নিয়ে যেতেন মা। সেখানেই এক মহারাজের মুখে শোনেন স্বামীজির বাণী। শোনেন, ফুটবল মানুষকে স্বর্গের কাছাকাছি নিয়ে যায়। ফুটবল চরিত্র গঠন করে। যা শুনে গোষ্ঠ পালের সে দিন মনে হয়েছিল, মা তো ঠিক বলছেন না তা হলে। স্বামীজি তো ফুটবল খেলারই কথা বলছেন। সেই থেকে কুমোরটুলি পার্কে চুটিয়ে ফুটবল খেলা শুরু। মাকে লুকিয়ে হাফপ্যান্ট সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়া। সেটা সম্ভব না হলে ধুতি পরেই ফুটবল পায়ে নেমে পড়া। ফুটবল যাঁর রক্তে, স্বামীজির কথা শোনার পরে তাঁকে মাতৃত্বের শৃঙ্খলেও আটকে রাখা সম্ভব
ছিল না।
(৩)
আবারও সেই ভাগ্যকুল। ১৯১২ সাল। আগের বছরই ইস্ট ইয়র্কশায়ারকে হারিয়ে আইএফএ শিল্ড জিতে ফুটবল আর জাতীয়তাবোধকে এক স্রোতে মিলিয়ে দিয়েছে মোহনবাগান। সেই ক্লাব একটা প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গোষ্ঠ পালের মামাবাড়ির অঞ্চলে গিয়েছে। আসল লক্ষ্য ছিল, কোনও ভাল ফুটবলার পাওয়া যায় কি না, দেখা। বিশেষ করে রক্ষণে।
স্থানীয় একটা দলের সঙ্গে খেলা। মোহনবাগান এক গোলে জিতছে। প্রায় পুরো মোহনবাগান দলই বিপক্ষের অর্ধে গিয়ে আক্রমণ চালাচ্ছে। বিরতিতে দেখা গেল, একটি ছেলে বাকিদের ডেকে কী সব বলছে। দ্বিতীয়ার্ধের খেলা শুরু। হঠাৎ প্রতিপক্ষের দু’জন ফুটবলার মোহনবাগানের অর্ধে ঘোরাফেরা করতে শুরু করে। এর পরে সেই ছেলেটি ডিফেন্স থেকে লম্বা শটে বল ফেলে দিল মোহনবাগান অর্ধে। এক বার নয়, বেশ কয়েক বার। সেই পাস থেকে দুটো গোল এবং মোহনবাগানের পরাজয়!
সে দিন মাঠে ছিলেন মোহনবাগানের শিল্ডজয়ী দলের অন্যতম নায়ক রাজেন সেনগুপ্ত। রাজেনবাবু এসে স্থানীয় ক্লাবের কয়েক জনের কাছে জানতে চান, ওই ছেলেটা তোমাদের কী বলেছিল বিরতিতে? জবাব পান, ‘‘ও বলেছিল, মোহনবাগানের সবাই উপরে উঠে আসছে। তোদের দু’জন ওদের অর্ধে থাক। আমি বল বাড়াব, তোরা গোল করবি।’’ রাজেনবাবুর পরের প্রশ্ন, ছেলেটার নাম কী? উত্তর— গোষ্ঠ পাল!
মুগ্ধ রাজেনবাবু এর পরে ডেকে নেন গোষ্ঠ পালকে। বলেন, ‘‘তুমি মোহনবাগানে খেলবে? তুমি তো কুমোরটুলিতে খেলো, সামনের বছর চুক্তি করব তোমার সঙ্গে।’’ গোষ্ঠবাবু অবশ্য ভুলেই গিয়েছিলেন ঘটনাটা। কলকাতায় ফিরে কুমোরটুলি ক্লাবের হয়ে যে রকম খেলছিলেন, খেলতে থাকেন। গোষ্ঠ পাল ভুলে গেলেও মোহনবাগান ভোলেনি। এক দিন কুমোরটুলি পার্কের সামনে আবার হাজির রাজেনবাবু। গোষ্ঠ পালের এক কাকাকে বলেন, ‘‘ওর মায়ের সঙ্গে কথা বলব। ওকে মোহনবাগানে খেলাব।’’ গোষ্ঠবাবু তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন, ‘‘মাকে বললে আর খেলতে দেবে না।’’
শেষ পর্যন্ত অবশ্য খেলেছিলেন গোষ্ঠ পাল। ১৯১৩ সালে। প্রথমে একটা প্রীতি ম্যাচে ডালহৌসি ক্লাবের বিরুদ্ধে। কিন্তু ভেজা মাঠ, ওই রকম একটা ক্লাবের হয়ে প্রথম ম্যাচ। একটু নার্ভাস তো ছিলেনই গোষ্ঠবাবু। যার ফলে সে দিন ভাল খেলতে পারেনি বছর ষোলোর ছেলেটি। তাঁর রক্ষণ ভেঙে দুটো গোলও করে যায় প্রতিপক্ষ। মাথা নিচু করে যখন সে দিন মাঠ ছাড়ছিলেন গোষ্ঠ পাল, একটা কথা ধরেই নিয়েছিলেন। আর কোনও দিন বোধ হয় মোহনবাগানের জার্সি গায়ে মাঠে নামা হবে না।
(৪)
বড় ক্লাবে খেলার আশা ওই ম্যাচের পরে ছেড়েই দেন গোষ্ঠ পাল। কিন্তু ক্লাবকর্তা শৈলেন বসু, রাজেনবাবুরা কয়েক দিনের মধ্যেই আবার মাঠে ডাকলেন তাঁকে। লিগ চ্যাম্পিয়ন ব্ল্যাক ওয়াচ ক্লাবের সঙ্গে খেলা। গোষ্ঠবাবু ধরেই নিয়েছিলেন তাঁকে ডাকা হলেও খেলার সুযোগ দেওয়া হবে না। কিন্তু রাজেনবাবু নিজে সে দিন না খেলার সিদ্ধান্ত নেন। শিল্ডজয়ী বিখ্যাত ডিফেন্ডার ভূতি সুকুল নিজের জায়গা ছেড়ে সরে গিয়েছিলেন লেফট ব্যাকে, যাতে নিজের পছন্দের রাইট ব্যাকে খেলতে পারেন গোষ্ঠ পাল। ওই একটা সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলেন গোষ্ঠ। ব্ল্যাক ওয়াচের একটার পর একটা আক্রমণ আটকে দিয়েছিলেন সে দিন। মোহনবাগান জেতে ২-০। পুত্র নীরাংশুর কথায়, ‘‘ওই শুরু। তার পর আর বাবাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।’’ এর পরে তেইশ বছর এক ক্লাবের জার্সিতে দাপিয়ে বেড়ান গোষ্ঠ পাল।
মা তখন দেশের বাড়িতেই অনেকটা সময় কাটান। ছেলে কলকাতায় কী করছে, সেই নিয়ে চিন্তায় থাকেন দিনরাত্রি। তাই দেরি না করে, প্রায় ধরেবেঁধেই, মোহনবাগানের হয়ে অভিষেকের বছর দেড়েকের মধ্যেই ছেলের বিয়ে দিয়ে দেন তিনি। সেই বিয়েতে মোহনবাগানের কেউ আমন্ত্রিত ছিলেন না। এর পরে গোষ্ঠবাবু অস্বস্তিতে ক্লাবে যাওয়াও বন্ধ করে দেন। তখন তাঁকে ডেকে পাঠান তৎকালীন ক্লাবকর্তা শৈলেনবাবু। সব শুনে হালকা ধমক দিয়ে কাছে ডেকে নেন গোষ্ঠ পালকে। বলেন, ‘‘নিমন্ত্রণ করনি ঠিকই, কিন্তু আমাদের একটা কর্তব্য আছে তোমাকে আশীর্বাদ করার। এই নাও।’’ এর পরে বাঘের ছবিওয়ালা একটা বিশেষ ব্যাজ তুলে দেন গোষ্ঠ পালের হাতে। বলেন, ‘‘১৯১১ সালের শিল্ডজয়ী দলের সদস্যদের জন্য এই বিশেষ ব্যাজ তৈরি করেছিলাম। ১১ জন ফুটবলারকে দেওয়ার পরে একটা আমার কাছে রয়ে গিয়েছে। মোহনবাগানের ঐতিহ্য যাদের হাতে সুরক্ষিত থাকবে, তাদের জন্যই এই ব্যাজ। তুমি এটা নাও।’’ পাশাপাশি গোষ্ঠ পালকে দিয়ে একটা শপথও করিয়ে নিয়েছিলেন শৈলেনবাবু— ‘‘কোনও দিন মোহনবাগান ছাড়বে না। অন্য কোনও ক্লাবের হয়ে খেলবে না।’’ গোষ্ঠবাবু কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই কথা কি তিনি শেষ পর্যন্ত রাখতে পেরেছিলেন?
(৫)
১৯১৩ থেকে শুরু। মোহনবাগান জার্সিতে তখন রক্ষণে রাজত্ব করছেন গোষ্ঠ পাল। ব্রিটিশ ফুটবলারদের মধ্যে সাড়া ফেলে দিয়েছেন। এক জন ডিফেন্ডারের টানে ময়দানে জনসমাগম ঘটছে। মোহনবাগানও তখন কলকাতা ফুটবল লিগের দ্বিতীয় ডিভিশন থেকে প্রথম ডিভিশনে উঠে দাপট দেখাচ্ছে। গোষ্ঠবাবুর নেতৃত্বে রোভার্স, ডুরান্ড কাপ খেলছে। ওই সময়ে উঠে আসছে আরও একটা ক্লাব। ইস্টবেঙ্গল। আরও বড় ব্যাপার হল, গোষ্ঠবাবুর মামাবাড়ি ওই ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের উত্থানের নেপথ্যে। তখন একই মাঠে অনুশীলন করতেন দুই ক্লাবের ফুটবলাররা। ইস্টবেঙ্গলের বড় কর্তা ছিলেন বনোয়ারি লাল রায়, সম্পর্কে গোষ্ঠবাবুর মামা। এক দিন প্র্যাক্টিসের শেষে মামা এসে ভাগ্নেকে বলেন, চল গাড়ি করে তোকে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি। গোষ্ঠবাবুও গাড়িতে উঠে পড়েন। গাড়ি চলে আসে পার্ক স্ট্রিটে। যেতে যেতে ভাগ্নেকে কয়েকটা উঁচু, উঁচু বাড়ি দেখিয়ে বনোয়ারিবাবু বলেন, ‘‘পছন্দ করে ফেল, এই বাড়িগুলোর মধ্যে কোনটা নিবি। তোকে আমরা একটা বাড়ি দেব। সঙ্গে এক লক্ষ টাকা। তুই শুধু ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেল।’’ গোষ্ঠবাবু জবাব দেন, ‘‘তা হলে গাড়ি থামাও। আমি বাড়িগুলো দেখি।’’ গাড়ি থামল, গোষ্ঠবাবু বাইরে বেরোলেন। এবং গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিয়ে বললেন, ‘‘মামা, আমি যদি জানতাম তুমি এই প্রস্তাব দেবে, তা হলে কখনও তোমার গাড়িতে উঠতাম না। মোহনবাগান আমি ছাড়ব না।’’
তা হলে কি ইস্টবেঙ্গলের জার্সিতে কখনও খেলেননি গোষ্ঠ পাল? উপরের কাহিনিটা শোনার পরে প্রশ্নটা করা গেল গোষ্ঠ-পুত্র নীরাংশুবাবুকে। তাঁর মুখে পরবর্তী ঘটনাটাও জানা গেল। গোষ্ঠ পাল ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেলেছিলেন, আবার খেলেনওনি!
ইস্টবেঙ্গল ক্লাব তখন কুমোরটুলি, শ্যামপার্কে ছোট ছোট প্রতিযোগিতা খেলত। ওই সময়ে গোষ্ঠ পাল ইস্টবেঙ্গল জার্সিতে মাঠে নেমেছিলেন। কিন্তু... এখানে একটা বড় ‘কিন্তু’ আছে! ইস্টবেঙ্গল ক্লাব তখনও ভারতীয় ফুটবল সংস্থায় (আইএফএ) নাম নথিভুক্ত করায়নি। যে কারণে হয়তো পরবর্তী কালে গোষ্ঠ পাল ঘনিষ্ঠ মহলে বলতেন, তিনি ইস্টবেঙ্গলের হয়ে কোনও দিন খেলেননি। ‘‘তবে ইস্টবেঙ্গল ওদের প্রথম অধিনায়ক হিসেবে বাবার নামই বলে,’’ বলছিলেন নীরাংশুবাবু, ‘‘আমি রাজস্থানের হয়ে খেলার সময়ে এক বার ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে ঢুকে বাবার ছবি টাঙানো দেখেছিলাম। যেখানে লেখা ছিল, ইস্টবেঙ্গলের প্রথম অধিনায়ক।’’
(৬)
মোহনবাগান ও গোষ্ঠ পাল নামটা প্রায় সমার্থক হয়ে যাওয়ার পিছনে নানা কারণ ছিল। হয়তো গোষ্ঠবাবু মোহনবাগানের হয়ে কোনও বড় ট্রোফি জিততে পারেননি, কিন্তু ক্লাবকে তিনি ঐতিহ্যের চুড়োয় নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। ব্রিটিশরা তখন রীতিমতো সমীহ করত ভারতের এই দলটিকে। ১৯১৩ সালে মোহনবাগান ক্লাবে যোগ দেওয়ার দু’বছরের মধ্যে ‘বি’ ডিভিশনে চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রথম ডিভিশনে খেলার ছাড়পত্র পেয়ে যায় মোহনবাগান। ১৯১৫ সালে চতুর্থ এবং পরের বছরই রানার-আপ হয়। ওই সময় থেকে ধীরে ধীরে ১৯১১ সালের শিল্ডজয়ী তারকারা সরে যেতে থাকেন ময়দান থেকে। যার ফলে ১৯২১ সালে মোহনবাগানকে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব এসে পড়ে গোষ্ঠবাবুর উপরে। সেই দায়িত্ব সামলেছিলেন পরের পাঁচ বছর। গোষ্ঠবাবুর নেতৃত্বে আরও এক বার কলকাতা লিগ জেতার খুব কাছে এসেও রানার আপ হয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয় মোহনবাগানকে। ১৯২৩ সালে আবার আইএফএ শিল্ড জেতার সামনে এসে পড়েছিল মোহনবাগান। কিন্তু ফাইনালে ক্যালকাটা এফসি-র কাছে হেরে যায়। সে দিন বৃষ্টিতে মাঠ খেলার প্রায় অনুপযোগী হয়ে পড়েছিল। কিন্তু কাদা মাঠেই গোষ্ঠ পালদের বাধ্য করা হয় খেলতে। খালি পায়ে সে দিন বুটপরা শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে টক্কর দিতে পারেনি মোহনবাগান।
১৯২৩ সালে রোভার্স কাপে খেলার সুযোগ হয় মোহনবাগানের। এবং গোষ্ঠ পালের নেতৃত্বে চোখধাঁধানো ফুটবল খেলে ফাইনালে পৌঁছে যায়। কিন্তু হেরে যায় ডারহাম লাইট ইনফ্যান্ট্রির কাছে। দু’বছরের মধ্যে প্রথম ভারতীয় ক্লাব হিসেবে ডুরান্ড কাপে খেলার আমন্ত্রণ পায় মোহনবাগান। ১৯২৪ সালে প্রথম ভারতীয় অধিনায়ক হিসেবে ঘোষণা করা হয় গোষ্ঠ পালের নাম, যাঁর নেতৃত্বে পরে কলম্বো সফরে যায় ফুটবল দল।
এই সময়ই গোষ্ঠ পাল থেকে জন্ম নেয় দুর্ভেদ্য ‘চিনের প্রাচীর’। যে নামে এখনও পরিচিত ভারতীয় ফুটবলের এই কিংবদন্তি। কিন্তু কী ভাবে নামকরণ হয়েছিল ‘চিনের প্রাচীর’? কলকাতা ফুটবলের আনাচকানাচে খোঁজ নিলে দুটো তত্ত্ব উঠে আসছে। এক, তাঁর খেলা দেখে ভক্তরাই একটা সময় ডাকতে শুরু করেন ওই নামে। আর অন্য তত্ত্বটা হল, রোভার্স কাপে গোষ্ঠ পালের খেলায় মুগ্ধ এক ইংরেজ সাংবাদিক বলে ফেলেছিলেন, ‘‘হি ইজ় অ্যাজ় সলিড অ্যাজ় দ্য গ্রেট ওয়াল অব চায়না।’’ এর পরে ‘দ্য ইংলিশম্যান’ সংবাদপত্রে গোষ্ঠ পালকে তিনি ‘দ্য গ্রেট ওয়াল অব চায়না’ বলে উল্লেখ করেন। এই ফুটবলারের সঙ্গে প্রথম আলাপে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত বলে উঠেছিলেন, ‘‘তুমিই তা হলে সেই চিনের প্রাচীর গোষ্ঠ পাল!’’
একশো বছর পার হয়ে গেলেও যে নাম একটুও ফিকে হয়ে যায়নি।
গোষ্ঠ পালের ফুটবল জীবনে দুটো অপূর্ণতা সম্ভবত থেকে গিয়েছিল। মোহনবাগানের হয়ে বড় ট্রোফি না জিততে পারা এবং তাঁর আমলে ক্লাবের লোগো বদল না হওয়া। লোগো বদলটা কী রকম? নীরাংশুবাবু শোনাচ্ছিলেন সেই কাহিনি। মোহনবাগানের প্রথম লোগো ছিল গাছের তলায় বাঘ বসা। কিন্তু ১৯১৮ সাল নাগাদ রাজস্থান ক্লাব তাদের প্রতিষ্ঠার সময়ে সেই একই লোগো ব্যবহার করে। মোহনবাগান ক্লাবের আবেদনেও সেই লোগো বদলানো হয়নি। মোহনবাগান কর্তারা তখন পালতোলা নৌকার নতুন লোগো তৈরি করেন। ঠিক হয়, একটা বড় ট্রোফি জেতার পরে লোগো বদল হবে। ‘‘বাবার আমলে সেই বড় ট্রোফি আসেনি, তাই তখন লোগোও বদল হয়নি,’’ আক্ষেপ নীরাংশুবাবুর।
(৭)
রাজনীতিবিদ অতুল্য ঘোষ এক বার বলেছিলেন, ‘‘গোষ্ঠ পাল হল, জেল না খাটা এক স্বাধীনতা সংগ্রামী।’’ কথাটা নির্ভেজাল সত্যি। গোষ্ঠ পাল ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন মাঠের সবুজ ঘাসে। খালি পায়ে ফুটবল খেলে তিনি ব্রিটিশদের কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছিলেন। শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে গোষ্ঠবাবুর লড়াই দেখতে তখন মাঠে হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমাচ্ছেন। গুলি না চালিয়েও তিনি ইংরেজদের ‘রক্তক্ষরণ’ ঘটাচ্ছেন, যেটা ব্রিটিশ রাজের কাছে একটা অশনি-সঙ্কেত হিসেবে দেখা দিয়েছিল। এর পরে শুরু হয় ছলে-বলে-কৌশলে মোহনবাগানকে নানা ভাবে আটকে দেওয়ার খেলা। যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও জানিয়ে এসেছেন গোষ্ঠ পাল। তাঁর ফুটবল জীবনের শেষটাও হয় এক ‘অসহযোগ আন্দোলন’-এর মধ্য দিয়ে।
১৯৩৫ সাল। ক্যালকাটা ফুটবল ক্লাবের বিরুদ্ধে খেলছে মোহনবাগান। যখনই বিপক্ষ বক্সে বল নিয়ে উঠছেন মোহনবাগানের ফুটবলাররা, রেফারি বাঁশি বাজিয়ে থামিয়ে দিচ্ছেন। একটা সময় আর সহ্য হয়নি গোষ্ঠবাবুর। তিনি দলের সবাইকে নিয়ে মাঠেই শুয়ে পড়েন এবং খেলতে অস্বীকার করেন। তৎকালীন আইএফএ কর্তারা ব্যাপারটা ভাল ভাবে নেননি। তদন্ত হয় গোষ্ঠ পালের বিরুদ্ধে। এর পরে সেই বছরেই যবনিকা নেমে আসে এই কিংবদন্তির ফুটবল জীবনে। এরও আগে ১৯৩৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে দলকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল গোষ্ঠবাবুর। সেখানেও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনে শামিল
হন তিনি। দক্ষিণ আফ্রিকা সফর থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। সরকারি কারণ ছিল, চোট পেয়েছিলেন তিনি।
গোষ্ঠবাবুর জনপ্রিয়তা কতটা সুদূরপ্রসারিত ছিল, তা একটা ঘটনাতেই বোঝা যায়। তখন দেশ স্বাধীন হয়ে গিয়েছে। ১৯৪৮ সাল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে কলকাতায় আসছেন গোষ্ঠ বাবুর মা নবীন কিশোরী। গোয়ালন্দয় তাঁকে আটকায় পূর্ব পাকিস্তানের পুলিশ। বৃদ্ধার প্রতি কোনও সহানুভূতি না দেখিয়ে তারা সুটকেসের তালা ভেঙে ভিতরের জিনিস ঘাঁটতে শুরু করে। তখন হঠাৎ এক অফিসারের চোখ পড়ে একটি ছবির উপরে। সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধাকে জিজ্ঞেস করেন, ছবির ওই লোকটি আপনার কে হয়? বৃদ্ধা উত্তর দিয়েছিলেন, ‘‘আমার পোলা। ওর কাছেই তো যাচ্ছি।’’ শোনার পরে ওই অফিসার নতুন তালা কিনে সুটকেসে লাগান। নিজে এসে নবীন কিশোরী দেবীকে ট্রেনের জানালার পাশে বসিয়ে দিয়ে যান। পরে ছেলেকে মা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘হ্যাঁ রে, তুই করস কী?’’ গোষ্ঠবাবু উত্তর দেন, ‘‘কিসুই না। শুধু বল লাথাই।’’ এই বল লাথিয়েই কিন্তু ইংরেজদের হৃৎকম্প ধরিয়েছিলেন গোষ্ঠ পাল।
(৮)
গোষ্ঠবাবু শুধু ফুটবলেই নয়, ক্রিকেট, হকি, টেনিসেও সমান দাপট দেখিয়েছিলেন। মোহনবাগানের হকি, ক্রিকেট দলের অধিনায়কও হয়েছিলেন। এক বার ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের বিরুদ্ধে খেলতে নেমেছেন। পরেছিলেন ধুতি-পাঞ্জাবি। প্রথমে বিপক্ষ দল কোনও আপত্তি জানায়নি। কিন্তু গোষ্ঠবাবু এক ওভারে দু’উইকেট নেওয়ার পরে ঝামেলা শুরু হয়। ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের খেলোয়াড়রা জানিয়ে দেন, ধুতি-পাঞ্জাবি পরে গোষ্ঠ পালকে ক্রিকেট খেলতে দেওয়া যাবে না। মোহনবাগানও মাঠ ছেড়ে উঠে যায়। শুধু সেই ম্যাচেই নয়, তার পরে বছর ছয়েক খেলা বন্ধ ছিল দু’দলের মধ্যে।
১৯৬২ সালে প্রথম ফুটবলার হিসেবে পদ্মশ্রী পুরস্কার পান গোষ্ঠ পাল। সেই পুরস্কার নেওয়ার সময়ে গলাবন্ধ কোট পরতে হত। সেটা জানার পরে গোষ্ঠ পাল রাষ্ট্রপতির আপ্তসহায়ককে চিঠি লিখে জানান, তাঁর পক্ষে গলাবন্ধ কোট পরে পুরস্কার নিতে আসা সম্ভব নয়। যে চিঠির জবাবে আপ্তসহায়ক লেখেন, ‘‘আপনি যে পোশাক পরেই আসবেন, মাননীয় রাষ্ট্রপতি তাতেই খুশি হবেন।’’
খেলাধুলোর গণ্ডিতেই শুধু আবদ্ধ থাকেননি গোষ্ঠ পাল। একটি সিনেমায় অভিনয়ও করেছিলেন। সিনেমার নাম ছিল ‘গৌরীশঙ্কর’। হঠাৎ কেন সিনেমা করার সিদ্ধান্ত? নীরাংশুবাবু বলছিলেন, ‘‘বাবার জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। ওই সিনেমার পরিচালক বাবার বন্ধু ছিলেন। উনি অনুরোধ করায়, বাবা রাজি হয়ে যান।’’
(৯)
১৯৭৬ সালের ৮ এপ্রিল। ‘ফুটবল দেবতা’ সে দিন তলিয়ে গিয়েছিলেন চিরঘুমের গভীরে। মোহনবাগানের জার্সি ও পতাকায় মোড়া তাঁর শবদেহ যখন শ্মশানে নিয়ে আসা হয়, নিমতলা ঘাটে মানুষের ঢল নেমেছিল। চিতায় শায়িত দেহ ধীরে ধীরে আগুনের গ্রাসে চলে যায়। কিন্তু কী আশ্চর্য! পা দুটো তো পুড়ছে না। আর এক কিংবদন্তি ফুটবলার শৈলেন মান্না সে দিন শ্মশানে দাঁড়িয়ে গোষ্ঠবাবুর ছেলেকে বলেছিলেন, ‘‘এ হল গোষ্ঠদার পা। এ কি সহজে পুড়বে!’’
তাঁর নামে ডাকটিকিট বেরিয়েছে, রাস্তার নামকরণ হয়েছে। কিন্তু পরিবারের একটা আক্ষেপ এখনও যায়নি। নীরাংশুবাবুর আবেদন, ‘‘বাবার অনেক পুরস্কার-স্মারক আমি মোহনবাগান ক্লাবের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। তার মধ্যে অনেক কিছুই আর পাওয়া যাচ্ছে না। ওগুলো যদি ফিরে পেতাম!’’
ইডেন গার্ডেন্সের উল্টো দিকে চোখ পড়লে দেখা যাবে তাঁর মূর্তিটা। সুবিশাল চেহারা, ৪৮ ইঞ্চি বুকের ছাতি। পায়ের পেশি দেখে চমকে উঠতেন প্রতিপক্ষ দলের ফুটবলারেরা। দৃপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন বল নিয়ে। খালি পায়ে যিনি লড়ে গিয়েছিলেন সে যুগের বুটপরা ইউরোপীয় ফুটবলারদের বিরুদ্ধে। লড়েছিলেন স্বজাতির হয়ে। জাতীয়তাবোধের মশাল জ্বালিয়েছিলেন সবুজ ঘাসে।
তিনি সত্যিই মাঠের দেবতা। দুর্ভেদ্য ‘চিনের প্রাচীর’। গোষ্ঠ পাল।
তথ্য সহায়তা: পরিসংখ্যানবিদ হরিপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy