Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

অন্তরের অন্দরে রয়ে গেল গান

তিনি পরিচিতি পেলেন অভিনেত্রী হিসেবে। মার্জিত স্বভাব, অভিজাত চেহারার জন্য অরুন্ধতী দেবীকে বলা হত ‘উওম্যান অব ক্লাস’। লিখছেন নবনীতা দত্ত নাচ, গান তো ছিলই... ছবিও আঁকতেন খুব সুন্দর। এক সময়ে ছবি আঁকাকেই জীবিকা হিসেবে বেছে নেবেন বলে স্থির করেছিলেন। তখন সঙ্গীতভবন তেমন সরগরম নয়, সবে গড়ে উঠছে।

দু’-তিন বছরেই প্রায় ছ’শো গান শিখে ফেলেছিলেন অরুন্ধতী

দু’-তিন বছরেই প্রায় ছ’শো গান শিখে ফেলেছিলেন অরুন্ধতী

শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০১৯ ০১:০৯
Share: Save:

শেষ বিকেলের রোদ এসে পড়েছে ছাতিম গাছের মাথায়। বাতাসে তার মাতাল করা গন্ধ। গাছের নীচে বসে আছেন রবি ঠাকুর। সামনে দ্বাদশবর্ষীয় বালিকা। সুদূর ঢাকা থেকে সে শান্তিনিকেতনে এসেছে গান শিখতে, রবীন্দ্রগান। সে সময়ে বিশ্বভারতীতে ভর্তি হওয়ার জন্য পরীক্ষা নিতেন স্বয়ং কবিগুরু। গান ধরল সে বালিকা, ‘উজাড় করে লও হে আমার যা কিছু সম্বল’। গান শুরু হতেই কবিগুরু তার সঙ্গে গুনগুন করে গেয়ে উঠলেন। গান শেষ হতেই আর একটি গানের অনুরোধ। সে আবার গান ধরল। গান শেষ হল। কবিগুরু আরও একটি গান শুনতে চাইলে সে চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ পরে তার সরল স্বীকারোক্তি, ‘‘শৈলজাদা আজ দুপুরে আমায় এই দু’টি গানই শিখিয়েছেন। আর তো জানি না।’’ রবীন্দ্রনাথ অবাক। কী বলে মেয়ে? এক দুপুরেই দু’টি গানের সুর তুলে নিয়েছে! হেসে বললেন, ‘‘তোমার গান হবে। কিন্তু আমাদের আশ্রমে থাকবে তো? কত মেয়ে আসে, গান শেখে, কী সুন্দর গায়, তার পর একদিন পাখির মতো ফুরুত করে উড়ে চলে যায়। তুমি যেন সেরকম কোরো না। তুমি যেয়ো না।’’ কিন্তু ভাগ্যের কী পরিহাস! কবিগুরুর সংশয়ই সত্যি হয়েছিল ভবিষ্যতে। সে দিনের সেই বালিকাই অরুন্ধতী দেবী। প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তিনি সংসার পাতলেন কলকাতায় এসে। গান অন্তরের অন্দরেই রয়ে গেল। বরং অভিনয় জগৎই হয়ে উঠল তাঁর পরিচয়ের আধার।

মাথার উপরে ঝাঁ ঝাঁ রোদ, গানের নেশায় দৌড় দিতেন উত্তরায়ণ অভিমুখে‘পুষ্পধনু’ ছবিতে উত্তমকুমারের মুখে সেই সংলাপ মনে পড়ে? যেখানে অরুন্ধতীর নাচের সঙ্গে তাঁকে বাঁশি বাজানোর অনুরোধ করায় তিনি বলছেন, ‘নেশাকে পেশা করার বাসনা আপাতত আমার নেই।’ অরুন্ধতীর জীবনেও ঘটনাটা অনেকটা একই রকম। গান ছিল তাঁর আনন্দের আকাশ। তাকে পেশা করে সেই আনন্দ থেকে নিজেকে কখনও বঞ্চিত করতে চাননি তিনি। অভিনয় তাঁকে পরিচিতি দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু গানেই তিনি খুঁজে পেতেন আশ্রয়। ও পার বাংলা থেকে এ পার বাংলায় পাড়িও সেই গানেরই জন্য। ঢাকার গুহঠাকুরতা পরিবারে জন্ম অরুন্ধতীর। সতেরো জন ভাই বোন ছিলেন। প্রত্যেকেই অসম্ভব গুণী। অরুন্ধতীর বাবা বিভুচরণ গুহঠাকুরতা ছিলেন দার্শনিক প্রকৃতির মানুষ ও উদারমনস্ক। তিনি মন্দিরে দাঁড়িয়ে আরতিও দেখতেন, ব্রাহ্মসমাজে বক্তৃতা শুনতে যেতেন, চার্চে প্রার্থনা করতেন, আবার মসজিদেও যেতেন। ছোট থেকেই উদার পরিবেশে বড় হন অরুন্ধতী ও তাঁর ভাইবোনেরা। তাঁদের যেমন শেখার আগ্রহ ছিল, তেমনই বাবারও উৎসাহ ছিল সন্তানদের সব বিষয়ে পারদর্শী করে তোলায়।

অরুন্ধতীর ছোট পিসি ও পিসেমশাই ছিলেন রবীন্দ্র-অনুরাগী। তাঁরা তখন শান্তিনিকেতনে থাকতে শুরু করেছেন। রবীন্দ্রভাবনায় উদ্বেলিত দু’জনেই। তাঁরাই অরুন্ধতীকে ঢাকা থেকে ডেকে নিয়ে আসেন শান্তিনিকেতনে। শুরু হয় রবীন্দ্রজীবন যাপন। শৈলজারঞ্জনের (মজুমদার) সান্নিধ্যে কণিকার (বন্দ্যোপাধ্যায়) সঙ্গে শুরু হল গান শেখা। বিশ্বভারতীতে সারা বছরই উৎসব লেগে থাকত। সেখানে কত গুণীজনের সমাগম হত। সেই উৎসবেও শেখা হয়ে যেত নতুন গান। দু’-তিন বছরেই প্রায় ছ’শো গান শিখে ফেলেছিলেন অরুন্ধতী!

বাইরের পৃথিবী তখন রণভূমি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর সময়। তার মাঝে বিশ্বভারতী যেন পারিজাত। সেখানে শুধু গান, নাচ, উৎসব, আনন্দ। বিশ্বের হাহাকার চাপা পড়ে যেত গানের সুরে। ১৯৪২ সাল, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরুর সময়। শান্তিনিকেতনে এসে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করলেন ইন্দিরা দেবী চৌধুরানি ও প্রমথ চৌধুরী। ইন্দিরা দেবী পরিচিত ছিলেন ‘বিবিদি’ নামে। শৈলজারঞ্জনের কথায়, ‘বিবিদি ছিলেন গানের খনি।’ এক সাক্ষাৎকারে অরুন্ধতী বলেছিলেন, ‘‘বিবিদির কাছে ‘ভানু সিংহের পদাবলী, ‘মায়ার খেলা’ এবং আরও অনেক নাটকের গান শিখেছিলাম। তখন আমার কলেজ। অফ পিরিয়ড হলেই দৌড়ে চলে যেতাম ‘উত্তরায়ণ’। মাথার উপরে তখন ঝাঁ ঝাঁ রোদ, পথও অনেকটা। কিন্তু গানের নেশা এমন পেয়ে বসেছিল যে ওসব অসুবিধে গ্রাহ্য করতাম না। বিবিদি হয়তো খেতে বসেছেন, কি রান্না করছেন। আমাকে দেখলেই বলতেন, ঐ টি-পয়ের ওপর খাতা পেন্সিল আছে। নোটেশন করে নাও। আমি সুর তোলার সঙ্গে সঙ্গে নোটেশন করে নিতাম... এই আদায় করার ব্যাপারে আমাদের যতখানি উৎসাহ ছিল, বোধহয় তার চেয়েও বেশি তাগিদ ছিল ওঁর নিজের।’’ গান গাওয়ার যেমন আনন্দ ছিল, তেমনই ছিল গান শেখার। ইন্দুলেখা দেবী, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র সকলের সঙ্গেই গান গেয়েছেন অরুন্ধতী দেবী।

তপন সিংহের সঙ্গে অরুন্ধতী দেবী (ছবি: সমর দাস)

শান্তিনিকেতনের দিনগুলি ছিল তাঁর কাছে ব্রহ্মচর্য অধ্যায়ের মতোই। সেখানে এক দিকে চলত গান, অন্য দিকে চলত নাচ। গানের মতোই তাঁর নাচ শেখার সঙ্গী ছিলেন কণিকা। গুরু ব্রজবাসী ও বালকৃষ্ণ মেননের কাছেও নাচ শিখেছিলেন অরুন্ধতী। কলকাতায় ‘গীতবিতান’ প্রতিষ্ঠার সময়ে অরুন্ধতী, কণিকারা একসঙ্গে ‘মায়ার খেলা’ নৃত্যনাট্যও করেছেন। অরুন্ধতী শান্তা আর কণিকা সেজেছিলেন প্রমদা। নাটকের রিহার্সালে কবিগুরু নিজে গান গাইতেন আর বিবিদি বসতেন পিয়ানোয়। অভিভূত হয়ে রবীন্দ্রনাথের গান শুনতেন অরুন্ধতী। যদিও তখন তিনি শান্তার ভূমিকায়, মন পড়ে থাকত গানে। নাটক শেষ হতেই বিবিদির কাছ থেকে সেই সব গান তুলে নিতেন। অনেকেই হয়তো ভেবেছিলেন, সঙ্গীতই হবে তাঁর পরিচয়। কিন্তু জীবনে কোনও কিছুই নিশ্চিত নয়।

এক সাক্ষাৎকারে শৈলজারঞ্জন দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘‘নুকু যদি শুধু গান নিয়ে থাকত, তা হলে আমার দুই ছাত্রীর স্থান হত একই আসনে।’’ বিশ্বভারতীতে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অরুন্ধতী দেবী পরিচিত ছিলেন মোহর ও নুকু নামে। বিশ্বভারতীতে যখন পরীক্ষার রেজ়াল্ট বেরোল, তখন নুকু প্রথম ও মোহর দ্বিতীয় স্থান পেয়েছিলেন।

নাচ, গান তো ছিলই... ছবিও আঁকতেন খুব সুন্দর। এক সময়ে ছবি আঁকাকেই জীবিকা হিসেবে বেছে নেবেন বলে স্থির করেছিলেন। তখন সঙ্গীতভবন তেমন সরগরম নয়, সবে গড়ে উঠছে। এ দিকে কলাভবন তত দিনে জমজমাট। নন্দলাল বসুর ধ্যানপীঠ বলা যায় তাকে। ছবি আঁকার মধ্যে আর এক জগৎ আবিষ্কার করে ফেললেন অরুন্ধতী। যে ভাব গানে প্রকাশ করতে পারতেন না, তা-ই যেন পরিস্ফুট হয়ে উঠত তুলির টানে। বিশ্বভারতী যেন অরুন্ধতীর দু’কাঁধে দু’টি ডানা জুড়ে দিয়েছিল। তাতে ভর করে বিশ্বের কত কী যে সে ওই প্রাঙ্গণে বসেই শিখে ফেলেছিলেন, তার হিসেব নেই। নরম একতাল মাটির ডেলা যে ভাবে হাতের গুণে সুন্দর পুতুলের গড়ন পায়, অরুন্ধতীকে সে ভাবেই তৈরি করছিল রবীন্দ্রচর্চা-ভাবনা।

গাঁধীজির অনশন ভঙ্গ উপলক্ষে অরুন্ধতীর ডাক এল

গানকে ভালবাসলেও তাকে পেশা হিসেবে নির্বাচন করতে চাননি অরুন্ধতী। গান ছিল তাঁর সাধনা, আরাধ্য। তাই কখনও ছবিতেও গাইতে চাইতেন না। আসলে গানকে পণ্য করতে চাননি কখনও। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘সঙ্গীত আমার প্রফেশন নয়, আনন্দের আকাশ। আর এ জন্য আমি সৃষ্টি কর্তার কাছে কৃতজ্ঞ। কারণ আর্ট যখন জীবিকা হয়ে ওঠে তখন স্বাভাবিক সময়েই তার সঙ্গে এমন কতকগুলি বেসুরো ব্যাপার জড়িয়ে পড়ে যে, শিল্পীকেও অশিল্পীজনক আচরণ করতে হয়। রবীন্দ্রসঙ্গীত যদি আমার জীবিকা হয়ে উঠতো, হয়তো নানান ঘটনা ও পরিস্থিতির চাপে এমন কাজ করে বসতাম, যেটা হতো অরাবীন্দ্রিক। আজ যে এমন স্বচ্ছ দৃষ্টিতে সব বিষয়কে দেখতে পাচ্ছি, কারো ওপর কোনো রাগ দ্বেষ না রেখে। তার কারণ রবীন্দ্রসঙ্গীত আমার প্রফেশন নয়। এবং সেই কারণেই কোনো শিল্পী আমার প্রতিদ্বন্দ্বী নন। সবাই আমার বন্ধু।’’

১৯৪০ সাল নাগাদ অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ এল অরুন্ধতীর কাছে। কিন্তু তাঁর মা বাধা দিলেন। তখন রেডিয়োয় গাইলে কিছু সম্মানদক্ষিণা গ্রহণ আবশ্যিক ছিল। অরুন্ধতীর মা সেটাকেই পেশাদার বৃত্তি মনে করে বাধা দিয়েছিলেন। গানকে তো এত সহজে বিকিয়ে দেওয়া যায় না। পরে নুকুর শৈলজাদা তাঁকে বোঝালেন গান গাওয়ার জন্য। সে সময়ে সকলের মধ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীত সে ভাবে পৌঁছয়নি। তা সকলের মধ্যে পৌঁছে দিতে গেলে যে তাকে সাধারণের কাছে নিয়ে যেতে হবে! শৈলজারঞ্জনের কথায় অরুন্ধতীর মা আর আপত্তি করেননি। শুরু হল রেডিয়োয় গান গাওয়া। সকালে পনেরো মিনিট আর সন্ধেবেলা এক ঘণ্টা। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও সঙ্গী হলেন তাঁর।

কিন্তু গাইলেই কি তা পৌঁছবে সকলের কাছে? যারা বাংলা বোঝে না? তাদের কাছেও তো পৌঁছে দিতে হবে রবীন্দ্রগান। অনুবাদ শুরু করলেন অরুন্ধতী। সেই অনূদিত গান জনপ্রিয় হয়ে উঠল বোম্বাই ও দিল্লিতে। ক্রমশ ভাষার গণ্ডি পেরিয়ে সেই সুর গিয়ে পৌঁছল গাঁধীজির কানেও। মহাত্মা গাঁধীর অনশন ভঙ্গ উপলক্ষে অরুন্ধতীর ডাক এল। গাঁধীজির প্রিয় দু’টি গান শোনাতে হবে তাঁকে। ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ এবং ‘আমায় ক্ষম হে ক্ষম’। বিদেশে গিয়েও রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে শুনিয়েছেন। ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছেন। পরে ‘সুরের আগুন’ ও ‘হারমোনিয়াম’ ছবিতেও তাঁকে গাইতে শোনা গিয়েছে।

দাম্পত্যে সন্দেহের বিষ

দু’জনেই ঢাকার মানুষ ছিলেন। রেডিয়োয় অনুষ্ঠানও করতেন। ফলে প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ভাব জমতে খুব বেশি সময় লাগেনি অরুন্ধতীর। কিন্তু সে সম্পর্কে সায় ছিল না গুহঠাকুরতা পরিবারের (অরুন্ধতীর বাপের বাড়ির)। শোনা যায়, তাঁরা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিলেন। পরে সে দাম্পত্যও অবশ্য সুখী হয়নি। একবার এক আলোকচিত্রী তাঁদের বাড়িতে অরুন্ধতী দেবীর ছবি তুলতে এলে প্রভাত বলেন, ‘‘তোকে বিশ্বাস করি। তুই বেডরুমে গিয়ে আমার সুন্দরী স্ত্রীর ছবি তুলতে পারিস।’’ কথায় যদিও সেই আলোকচিত্রীর প্রতি বিশ্বাস প্রদর্শন ছিল। কিন্তু মনের গভীরের অবিশ্বাস বা সন্দেহও কি প্রচ্ছন্ন ছিল না সে উক্তিতে?

মেয়ে অনুরাধা ঘোষের এক সাক্ষাৎকারেও প্রভাতের নিরাপত্তাহীনতার প্রসঙ্গ এসেছে, ‘‘তখন বিদেশের অনেক অনুষ্ঠানেই মায়ের আমন্ত্রণ আসত। সুজ়ান হেওয়র্থ, গ্রেটা গার্বো, অ্যালফ্রেড হিচকক, রোনাল্ড রেগ্যান... কত গুণীজনের সঙ্গে মায়ের দেখা হয়েছে। সে বার বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তপন সিংহ ও অন্যান্যদের সঙ্গে মায়েরও আমন্ত্রণ এল। তখন মা দ্বিতীয় বার অন্তঃসত্ত্বা। বাবা বাধা দিলেন মাকে। কিন্তু মা ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বাবা রাগের মাথায় মাকে বলে বসলেন যে, মায়ের গর্ভের সন্তান তাঁর নয়। যা ছিল সর্বৈব মিথ্যে। মা বার্লিন থেকে ফিরে আসার পরেই আলাদা ভাবে থাকা শুরু হল। আমার তখন খুব কষ্ট হত। কিন্তু বাবা কখনও আমাদের কাস্টডি নিতেও চাননি। বরং তপন সিংহ আমাদের স্নেহ-ভালবাসায় ভরিয়ে দিয়েছিলেন। ভাইকে তাঁর পদবী ও পরিচিতি দিয়েছিলেন। আমাকেও দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি মেয়ে, বিয়ে হয়ে যাবে। তাই সেই ঝামেলায় আর যেতে চাইনি।’’

অরুন্ধতীর অভিনয়ে আসার পিছনেও প্রভাতের প্রচ্ছন্ন ভূমিকা ছিল। অরুন্ধতীকে কখনও আর্থিক সাহায্য করতেন না তিনি। তখন অল ইন্ডিয়া রেডিয়োয় গেয়ে মাত্র পাঁচ টাকা সাম্মানিক পেতেন অরুন্ধতী। তাই দিয়েই নিজের খরচ চালাতেন। পরে ছবির প্রস্তাব এলে অরুন্ধতী আর ‘না’ করেননি।

প্রথম বিয়ে ভেঙে গেলে তিনি পরবর্তী কালে ঘরনি হন তপন সিংহের। তাঁর ও তপন সিংহের বোঝাপড়া ছিল দেখার মতো। পরিচালক তপন ছিলেন অগোছালো মানুষ। সারা দিন তিনি ব্যস্ত থাকতেন নিজের ছবির কাজ ও পড়াশোনা নিয়ে। তাঁর জামাকাপড়, বইপত্র থেকে শুরু করে সংসারও যত্ন করে গুছিয়ে রেখেছিলেন অরুন্ধতী। ছেলে ও স্বামীর খাওয়ার জলও ঢাকা দেওয়া থাকত টেবিলের উপরে। ঘরের কোনও আসবাবে ধুলো পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যেত না। ছেলেমেয়েরা যাতে অমলিন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে বড় হয়, সে দিকেও ছিল তাঁর কড়া নজর।

ছেলে অনিন্দ্য তখন এক নামী কনভেন্টে পড়ছে। স্কুল থেকে ফিরে কী এক কথা প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে সে উল্লেখ করল ‘মিস্টার চ্যাটার্জি’ বলে। সেটুকুও কান এড়ায়নি অরুন্ধতীর। সঙ্গে সঙ্গে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন স্কুল বদলের। সেখান থেকে ছেলেকে নিয়ে এসে ভর্তি করে দিলেন অন্য স্কুলে। সে দিনের সেই কড়া অনুশাসনই কিন্তু তাঁর ছেলের ভবিষ্যতের ইমারতের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে দিয়েছিল।

মেয়ের ব্যাপারেও ছিল একই ধরনের নিয়মানুবর্তিতা। ‘‘বিকেলে মাসতুতো বোনেদের সঙ্গে বাইরে বেড়াতে বেরতাম। আমাদের বাড়ি ফেরার কথা ছিল সন্ধে ছটায়। এর দু’-পাঁচ মিনিট এদিক ওদিক হলেই মা দারুণ বকতেন। মা বলতেন, ছটা মানে ছটাই, সময়ানুবর্তিতা জীবনের সবচেয়ে বড় জিনিস,’’ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন অনুরাধা।

উত্তমকুমারও ফিকে পড়ে যেতেন তাঁর ব্যক্তিত্বে

এতটা নিয়মানুবর্তিতা ছিল বলেই হয়তো একই জীবনে এত কিছু করতে পেরেছিলেন। অভিনয় জগতেও তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র। ১৯৫২ সালে ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ ছবি দিয়ে তাঁর অভিনয় জগতে পদার্পণ। তার পরে ‘চলাচল’, ‘গোধূলি’, ‘বিচারক’, ‘জতুগৃহ’... কত ছবি। পাশাপাশি গানের রেকর্ডিংও তখন শুরু করেছেন। এইচএমভি থেকে বেরোচ্ছে ক্যাসেট। যেমন সুন্দরী ছিলেন, তেমনই ছিল অভিজাত ভাবভঙ্গি। ফলে খ্যাতি পেতে বেশি সময় লাগেনি। তিনি যখন অভিনয় করতে আসেন, সুচিত্রার সৌন্দর্যে তখন আপামর বাঙালি কাবু। তার মাঝেও আলাদা করে লাইমলাইট কেড়ে নেন অরুন্ধতী। এমনকি পুরুষপ্রধান ছবিতেও তিনি আলাদা করে নজরে পড়তে শুরু করলেন। তাঁর আদবকায়দা, সংলাপ বলার ধরন... সবেতেই ছিল অভিজাত ভঙ্গি। সে সময়ের এক কাগজে তাঁকে ‘উওম্যান অব ক্লাস’ বলেও অভিহিত করা হয়।

তখনও উত্তমকুমারের একটি ছবিও সফল হয়নি। অরুন্ধতীর নায়ক হিসেবে তাঁর ডাক এল ‘বকুল’ ছবিতে। সে ছবিতে অবশ্য অরুন্ধতীর অভিনয় ও ক্যারিশমায় চাপা পড়ে যান উত্তম। পরে মহানায়ক স্বীকার করেছিলেন যে, পরের দিকে তিনি যত ছবি করেছেন অরুন্ধতীর সঙ্গে, একসঙ্গে দৃশ্য থাকলে আলাদা করে প্রস্তুতি নিতেন। তাঁর অভিজাত চেহারা, মার্জিত স্বভাব, ব্যক্তিত্ব... সবই যেন দ্যুতি হয়ে ছড়িয়ে পড়ত চারপাশে। তবে এক ধরনের চরিত্রে নিজেকে আটকে রাখেননি। কখনও ‘ঝিন্দের বন্দী’র রাজকন্যা, কখনও ‘জতুগৃহ’র সাধারণ এক ঘরণি, এমনকি ‘ছেলে কার’ ছবিতে হাসির দৃশ্যেও তিনি সমান সাবলীল। ‘কালামাটি’ ছবিতে তাঁর চরিত্রের কথা যদি মনে করা যায়... সেখানে কয়লাখনিতে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের সন্তানদের দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন নায়িকা। তাঁর বাড়িতে রয়েছে আবার এক পঙ্গু মানুষ। কর্মক্ষেত্র ও ব্যক্তিজীবনের টানাপড়েনে ক্ষতবিক্ষত একটি চরিত্রকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন অরুন্ধতী। আবার ‘বিচারক’ ছবিতে একজনের স্বামীর প্রতি তাঁর দুর্বলতা, যা ঠিক প্রকাশও করা যায় না, তা সুন্দর ফুটিয়ে তুলেছিলেন পিয়ানো বাজানোর দৃশ্যে। আর গিরিবালার বাবাকে যখন তিনি বলছেন, ‘‘আমি বিদেশী নই, আপনার মেয়েদের মতো আমিও এ দেশেরই মেয়ে। এ দেশের মাটি আমার মা, এ দেশের ঠাকুর আমার ঠাকুর...’’ তখন কি সত্যিই চোখের সামনে ভগিনী নিবেদিতার মুখখানা ভেসে ওঠে না?

কর্মময় জীবন ঈষৎ থমকে যায় শারীরিক অসুস্থতায়। সেরিব্রাল অ্যাটাক হয় অরুন্ধতীর। শরীরের একটা দিকে প্যারালিসিস হয়ে যায়। কিন্তু বসে থাকা যে তাঁর ধর্ম নয়। সেই ভগ্ন শরীর একটু মেরামত হতেই আবার ফিরে এলেন কর্মজগতে। ঠিক পৌঁছে যেতেন শুটিং ফ্লোরে। স্বামীর কাজে সহায়তা করতেন। শেষের দিকে প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়েও কাজ শুরু করেন।

ছবির টাইটেল কার্ড থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার

অরুন্ধতীর স্মৃতিচারণায় তপন সিংহ বলেছিলেন, ‘‘আমি ওর থেকে অনেক কিছু শিখেছি... এমনই একটা ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে এসেছিলেন বলে বাংলা ছবিতে তাঁর জায়গা ছিল আলাদা। এমন কী তিনি যখন ক্যামেরার সামনে থেকে পিছনে সরে আসেন তখনও।’’ অরুন্ধতী পরিচালনা শুরু করেন অনেক শেষের দিকে। কিন্তু যে গল্পগুলি তখন তিনি ছবির জন্য বেছেছিলেন, তার বিষয়বস্তু ছিল অনেক এগিয়ে। ‘ছুটি’ ছবির কথাই ধরা যাক। যার মাধ্যমে বাঙালি পেয়েছিল এক নতুন জুটি আর নতুন ধরনের গল্প। সে বছরের সেরা ছবির পুরস্কারও পেয়েছিল সেটি। ‘পদি পিসীর বর্মি বাক্স’, ‘মেঘ ও রৌদ্র’র মতো গল্প নিয়েও ছবি করেছিলেন। সেই তালিকায় ছিল ‘দীপার প্রেম’ ছবিটিও। যার জন্য সেই সময়ে সমালোচনাও শুনতে হয়েছিল। তবুও তিনি পিছপা হননি। বরং ছবিটি সেন্সর করানো সত্ত্বেও পুনর্বার প্রযোজক ছবিটি এডিট করানোয় তিনি টাইটেল কার্ড থেকে নিজের নাম সরিয়ে দিতে বলেন। বম্বে ল্যাব থেকে ছবিটি এডিট করিয়ে প্রায় চোদ্দোশো ফুট বাদ দিয়ে ছবিটির পুনর্মুক্তির দিন স্থির হয়। সেই খবর কানে যেতেই অরুন্ধতী দেবী নিজেরই ছবি থেকে নিজের নাম তুলে নিতে আইনের দ্বারস্থ হন। তবে ছবিটির সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা যাতে তাঁদের টাকাপয়সা পেয়ে যান, তাই ছবিটির ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছিলেন। নিজের আত্মমর্যাদা রক্ষায় যেমন অনড় ছিলেন, তেমনই ছিল অসম্ভব দায়িত্ববোধ।

কারও কিছু হলেই ছুটে যেতেন। মানুষের সাহায্যে সব সময়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন। প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়েও কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু নিজের শেষ মুহূর্তে পাশে ছিল না কেউ। চলে যাওয়ার দিনটিও ছিল ভারী অদ্ভুত। সে দিন সন্ধেবেলায় একটি কাজে আটকে যান তপন সিংহ। প্রত্যেক দিন বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ তিনি বাড়ি ফিরতেন। সে দিন ফিরতে মিনিট দশেক দেরি হয়েছিল। সেই দশ মিনিটেই সব শেষ। তিনি বাড়ি ফেরার মিনিট দশেক আগেই মারা যান অরুন্ধতী। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কাউকে একটা খবর পর্যন্ত দিতে পারেননি। হপ্তাদুয়েক ধরে তাঁর বাড়ির ফোন কাজ করছিল না। এই মুঠোফোনের যুগে বসে সে কথা ভাবতে বড় অদ্ভুত লাগে। পরে তপন সিংহ আফসোস করে বলেছিলেন, ‘‘আর দশ মিনিট আগে যদি আসতাম— ওকে শেষ দেখাটা দেখতে পেতাম। হয়তো আমায় কিছু বলার ছিল ওর শোনা হোলো না...’’

ঋণ: আনন্দলোক (১৯৯০),
রবি বসুর সাক্ষাৎকার

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Film Industry Arundhati Devi Tapan Sinha
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy