Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪

শক্তি দায়িত্ব নিলে অন্য রকম কৃত্তিবাস হতো

নিছক কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় নন, আড্ডার মধ্যমণি এক ছেলেমানুষের কথা বললেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়। শুনলেন ঋজু বসু। নিছক কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় নন, আড্ডার মধ্যমণি এক ছেলেমানুষের কথা বললেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়। শুনলেন ঋজু বসু।

শেষ আপডেট: ২২ জুলাই ২০১৭ ১১:২০
Share: Save:

ড্রিঙ্ক করার পরে বন্ধুর বউয়ের সঙ্গে একটু ফ্লার্ট তো অনেকেই করেন! তাতে আমি দোষের কিছু দেখি না, কিন্তু শক্তিকে অনেকটা খেয়েও তেমন কিছু করতে দেখিনি।

মদ্যপানের পরে সুনীলের বন্ধুদের মধ্যে নানা মজার ঘটনা ঘটত। এএইআই ক্লাবের আড্ডায় একবার কেউ একজন সুনীলকে বললেনও, শোনো, তুমি যদি স্বাতীকে ডিভোর্স করো, আমায় খবর দিও কিন্তু। সুনীল, বুদ্ধদেব গুহ, মতি নন্দী অনেককেই মেয়েদের সঙ্গে একটু-আধটু ফ্লার্ট করতে দেখেছি। আর শ্যামল (গঙ্গোপাধ্যায়) তো ইচ্ছে করে দুষ্টুমি করতেন, ‘স্বাতী তুমি কি আমায় একবারটি চুমু খেতে দেবে?’ বন্ধুদের মধ্যে এ সবই নির্দোষ মজা। শক্তির কিন্তু মেয়েদের নিয়ে এই ব্যাপারটা কখনও দেখিনি!

আমার বরং ওঁকে দেখে কেমন মায়া হতো! মায়েদের যেমন সবচেয়ে দুষ্টু ছেলেটার ওপরে বাড়তি স্নেহ থাকে। আমার মনে হয়, মদ খেলে সুনীল খানিকটা বেশি ‘হোল্ড’ করতে পারত। চট করে অতটা বেসামাল হতো না। হলেও চুপচাপ থাকত। শক্তি তুলনায় বেশি হইচই করতেন। হয়তো একটু বেশি তাড়াতাড়ি অনেকটা খেয়ে ফেললেন! তার পর কয়েক বার বললেন, ‘আমি শক্তি চট্টোপাধ্যায়!’ কিংবা হয়তো নিজেদের মধ্যে একটু গালাগাল করলেন। সুনীলকে দু’-একবার দেখেছি, এই সময়ে ওঁকে সামলাচ্ছে, ‘শক্তি, উঁ-হু এখানে কিন্তু এ সব কথাবার্তা হয় না।’ প্রথম প্রথম লোকটাকে নিয়ে আমার একটু জড়তা ছিল। শক্তিকে একটু ভয়-ভয়ও করত। কিন্তু ক্রমশ সে-সব কেটে গিয়েছিল। তখন মনে হতো, যাই একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিই, কয়েক বার দিয়েওছি! বলেছি, ‘সত্যি আপনারা পারেনও! কেন এত খান? কী যে করেন! ’

শক্তি চট্টোপাধ্যায় বলতে তো কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় বা সুনীলের বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়— যা-ই হোক, আমার কাছে শুধুই কিছু সুখস্মৃতি। শক্তি আর শঙ্খ ঘোষের কবিতা পড়া আমার বিশেষ প্রিয়। শক্তির খোলা গলায় কবিতা পড়ার মধ্যে একটা নিজস্বতা ছিল। ‘ফুটপাথ বদল হয় মধ্যরাতে’ বা ‘অবনী বাড়ি আছো’ তো শক্তির সিগনেচার কবিতা। আমার কিন্তু ‘ওই বাঘটা’ও বড্ড প্রিয়...সেই যে ‘ভালবাসার বাঘ বেরোল বনে’! তবে কবিতার বাইরের মানুষটাও একটা আলাদা ছাপ ফেলেছিল।

সুনীলের পুরনো বন্ধুদের মধ্যে অনেকের সঙ্গেই পরে খানিক সুর কেটে গিয়েছে, বা কিছু অভিমান জন্মেছে! কিন্তু শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক বিশেষ বদলায়নি। হ্যাঁ, কত লোকে তো কত কথা রটায়। এর-ওর নাম করে এটা-সেটা বলে। শক্তির নাম করেও হয়তো কেউ সুনীলকে কখনও কিছু বলেছে। কিন্তু তার ফলে শক্তি-সুনীল সম্পর্কে শেষ দিন অবধি আমি তেমন কোনও বদল দেখিনি।

নীরদ মজুমদারের বাড়িতে আড্ডায় শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

এখনও শক্তির কথা ভাবলেই আমার ওঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার শেষ দিনটার কথা মনে পড়ে! উনি তখন আনন্দবাজার থেকে রিটায়ার করেছেন। শান্তিনিকেতনে পড়াচ্ছেন। সে-দিনটায় বেশ সকাল-সকাল আমাদের শান্তিনিকেতনের বাড়িতে এসে হাজির। তা আমার মনে আছে, দু’বন্ধু তো যথারীতি রামের বোতল খুলে বসলেন। আমি বেশ রাগ করেছিলুম! আর শক্তি অমনি ‘অমন করিস না মা, আজ একটু খেতে দে না’ করে উঠলেন। মদ খেলে আমাকে ‘তুই’ বলতেন, ‘মা-মা’ করে ডাকতেন। কিন্তু সে-দিন মদ্যপানের আগেই শক্তি-সুনীলের কিছু কথাবার্তা হয়েছিল, যা আমার মনে থেকে গিয়েছে।

আমি তখন রান্নাবান্না দেখছি, ঘরের কাজ সামলাচ্ছি, আর মাঝেমধ্যে ওঁদের মাঝে এসে বসছি। তখন সুনীল সাহিত্য অ্যাকাডেমি নিয়ে ব্যস্ত, আনন্দবাজারের চাকরিও করছে। লেখালেখির চাপ খুবই! ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে তখন সুনীলের মধ্যে একটা দুশ্চিন্তা ছিল। তখন বোধহয় ‘কৃত্তিবাস’ বন্ধই ছিল, বা বিক্ষিপ্ত ভাবে বেরোচ্ছিল। পরে আমাদের বিলেতের বন্ধু ভাস্কর দত্ত ‘কৃত্তিবাস’-এর পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। সেই সময়ে কে ‘কৃত্তিবাস’টা দেখবেন, কে সময় দেবেন— কিছুই ঠিক করা যাচ্ছিল না। দুই বন্ধুর মধ্যে এ সব নিয়েই কথা হয়েছিল।

স্ত্রী মীনাক্ষী ও সন্তানদের সঙ্গে কবি

শক্তি ‘কৃত্তিবাস’-এর দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলেন। ‘আমি তো রিটায়ার করেছি। তুমি আমায় কৃত্তিবাসটা দিয়ে দাও।’ সুনীল এটা শুনে খুবই উৎসাহিত হয়েছিল। শক্তি বলছিলেন, ‘লেখা যে যার মতো দেবে, আমি নিজে বিজ্ঞাপন জোগাড় করে আনব!’ শক্তিই মালিক-সম্পাদক হবেন। সুনীল শুনে বলেছিল, ‘এ তো খুব ভাল কথা! সত্যিই আমি আর পারছি না। তুমি দেখলে নিশ্চিন্ত হতে পারি! কলকাতায় ফিরে বাকি কথা হবে।’

এ সবই আমার নিজের কানে শোনা! খুবই সিরিয়াসলি কথা বলছিলেন দু’জনেই। তখনও কেউ গ্লাস হাতে নেননি। তার আগেই কৃত্তিবাসের ব্যাপারটা ওঁরা ঠিক করে ফেলেন। দু’জনেই একমত হয়েছিলেন। কিন্তু কথা আর হয়নি। শক্তির আর কলকাতায় ফেরাও হয়নি। সে-রাতে আমরা কলকাতায় ফিরে যাই! আর তার পরের দিনই শক্তির চলে যাওয়ার খবরটা ছড়িয়ে পড়ে।

ওই দিনটাতেও শক্তিকে মৃদু বকুনি দিতে হয়েছিল। শক্তি এদেশি। কিন্তু মিষ্টি দু’চক্ষে দেখতে পারতেন না। বোয়াল-চিতল সব মাছ ভালবাসতেন। সে-দিনও বোয়াল মাছ রান্না হয়েছে শুনে খুব ভালবেসে খেতে চাইলেন। কিন্তু ভাত খেতে পারলেন না! কিছুতেই খেলেন না। এত করে বললাম! তবু ভাত ছাড়া ভরদুপুরে শুধু মাছ খেয়েই বেরিয়ে গেলেন। সেই শেষবারের মতো।

এই শক্তির ক-ত গল্পই যে আমি শুনে আসছি, সুনীলের সঙ্গে আলাপ হওয়া ইস্তক। ওঁর কবিতা আমি আগেই পড়েছি, যেমন সুনীলেরটাও পড়তাম। কিন্তু আমি কবিতার তত ভক্ত ছিলাম না গোড়ায়। তখন সুনীলের ‘নীললোহিত’ বেশি ভাল লাগত। এর মধ্যে সুনীলের সঙ্গে আলাপ হল। তখন কিন্তু সুনীলের সঙ্গে শরৎবাবু (শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়), তারাপদ (রায়)— এঁদেরই বেশি দেখতাম। আমি-সুনীল, শরৎবাবু-বিজয়া এখানে-ওখানে বেরোতামও, শক্তি সেখানে থাকতেন না। পরের দিকে সাগরদা (সাগরময় ঘোষ) কোথাও ডেকেছেন। কিংবা এএইআই ক্লাবের আড্ডায় বসেছি! এই সব জায়গায় সব সময়ে শক্তিকে পাওয়া যেত না। উনি এলে সকলেই কিন্তু খুব খুশি হতেন। শক্তির সঙ্গে বোধহয় হিমানীশ গোস্বামীদের বেশি ভাব ছিল। বন্ধুর সংখ্যা শক্তিরই বেশি। সুনীলের তুলনায় প্রায় ১০-১২ গুণ। সুনীল তো একটু লাজুক প্রকৃতিরও ছিল। লোকে ভাবত দাম্ভিক! কিন্তু শক্তি বরাবরই যেখানে যায় মধ্যমণি! নানা রকম মজা, ছেলেমানুষিতে জমিয়ে রাখে। শক্তিকে দেখার আগেই ওঁদের বিষয়ে অনেক মজার গল্প আমি শুনে ফেলি। তার মধ্যে একটা ওই এলএসডি খাওয়া। শক্তি-সুনীল দু’জনেই খেয়েছিলেন। তারাপদ খাননি। একজনকে তো সামলাতেও হবে! বোধহয় তাই!

শুনেছি, আমেরিকার বিখ্যাত কবি অ্যালেন গিন্‌সবার্গ ওঁদের বলেছিলেন, বেশি নয়, তোমাদের বড় জোর দু’টো করে বড়ি দেব। তা ওরা দু’জনেই বোধহয় একটা করে খেয়েছিল। তাতেই যা হওয়ার হয়! আমার এখন ঠিক ভাল মনে নেই, কার কী হয়েছিল। তবে সুনীল সম্ভবত ছোটবেলায় চলে গিয়েছিল, খানিকটা নিজের থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে দেখছিল। অনেকগুলো লাল রঙের ফুটকি দেখছিল! আর আলপথের ওপর একটা ছোট ছেলে। কী-সব আশ্চর্য দৃশ্য! হ্যালুসিনেশন! শক্তিও তেমন কী যেন দেখেছিলেন, কিছু একটা দেখে ওঁর বোধহয় খুব কষ্ট হয়েছিল।

এই লোকটাকেই বোধহয় প্রথম দেখলাম ডায়মন্ড হারবারে। তখনও আমার আর সুনীলের বিয়ে হয়নি। আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারটা কেউ জানে না। শুধু দু’জনের মধ্যেই গোপন রয়েছে। সুনীলের অনেক বন্ধুর মধ্যে সে-দিন শক্তিও ছিলেন। সেটা অবশ্য খুব আলাদা করে মনে নেই। এই সময়ের কাছেপিঠেই সুনীলের বন্ধুদের দুদ্দাড় করে বিয়ে হতে লাগল। ১৯৬৭ সালটায় তো বিয়ের লাইন লেগেছিল। তারাপদ, সমরেন্দ্র (সেনগুপ্ত)-র বোধহয় আমাদের আগেই বিয়ে হয়েছিল। আমাদের পরে বোধহয় শক্তি, শরৎবাবু, শ্যামলের।

এর পরে শক্তির কাছেও ওঁদের সবার অল্প বয়সের দৌরাত্ম্যের নানা গল্প শুনেছি। আমায় একবার বলেছিলেন, ‘জানো, তোমার বর আমায় মেরেওছে! ওর মার খেয়েই আমি এখনও কানে একটু কম শুনি!’ সুনীলের হাতের পাঞ্জাটা খুব বড় ছিল তো! সুনীলও পরে বলেছিল, শক্তিকে সামলাতে কখনওসখনও একটু-আধটু অমন করতে হতো। এ সবই ওরা যখন দল বেঁধে রাতের কলকাতা শাসন করত, তখনকার ঘটনা। মাঝেমধ্যে টলমলে অবস্থায় মাথা গরম করত ওরা সবাই। ট্যাক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে ঝামেলাটামেলা হয়েছে, শুনেছি। আবার নিজেদের মধ্যেও টুকটাক কিছু! কিন্তু তখনকার এ সব ঘটনা ওঁদের বন্ধুত্বে কোনও দিন ছায়া ফেলেনি।

কবি সম্মেলন: শিশির মঞ্চের সামনে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

পরের দিকে, মানে আমাদের বিয়ের পরে অবশ্য ওঁদের মধ্যে কোনও মারকুটেপনা আমি দেখিনি। তবে একটা ঘটনা আলাদা করে মনে আছে। আমাদের বাড়িতেই ঘটেছিল! তখন সম্ভবত আমরা বিজন সেতুর দিকটায় একটা অন্য বাড়িতে থাকতাম। আমার শাশুড়ি-মা অন্য কোথাও গিয়েছিলেন। এই সুযোগে বাড়িতে একটা আসর বসেছিল। শক্তি, সুনীল, মতি... তার পর খেলোয়াড়রা—চুনী গোস্বামী, পিকে ব্যানার্জি এঁরা ছিলেন। শক্তি তো নিজেই খুব উৎসাহ নিয়ে বললেন, আমি ‘বার’ সামলাচ্ছি। আর ‘বার’ সামলানো মানে তো যত না সামলাচ্ছেন, নিজে ঢকঢক করে খাচ্ছেনও তত বেশি। এর মধ্যেই ঘটল ঘটনাটা। পিকে তো খুব সুন্দর কথা বলতেন। আর অনর্গল কথা বলতেন। শক্তি বোধহয় কিছুতেই ‘এন্ট্রি’ পাচ্ছিলেন না। আচমকা ‘অ্যাই চুপ!’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। আমরা সবাই একটু অপ্রস্তুত।
পিকে নিজেও বেশ খানিকটা হকচকিয়ে গিয়েছেন।

এর কিছুক্ষণ বাদে পিকে, চুনীরা চলে যাওয়ার পরই বোধহয় শক্তি আর মতির মধ্যে গোলমাল শুরু হল। ঠিক কী নিয়ে, এত দিন বাদে তা আর মনে নেই। কিন্তু একটার পর একটা গ্লাস ভাঙছে তখন! কাউকে থামানো যাচ্ছে না। সে যা-হোক, কোনওমতে সামলানো গেল। তবে আমাদের বাড়িতে শক্তির আসাটা খুব ঘন-ঘন ঘটত না। এর একটা কারণ বোধহয় আমার শাশুড়ি-মা আমাদের বাড়িতে থাকতেন। সুনীলের মা খুব ব্যক্তিত্বময়ী ছিলেন। তখনকার দিনে তো মা-বাবারা থাকলে ছেলেমেয়েদের এত মদ খাওয়ার চল ছিল না। আমার শাশুড়ি-মা সুনীলকে দিয়ে মদ খাওয়ার ব্যাপারে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। তা, সুনীলের পক্ষে তো ‘মদ খাব না’ কথা দেওয়া সম্ভব হয়নি। ও চেষ্টা করত, মা থাকলে বাড়িতে না-খাওয়ার বা বাইরে থেকে খেয়ে এসে চুপ করে শুয়ে পড়ার। এ ছাড়া জানতাম, একটু বেশি খেলে শক্তি মাঝেমধ্যেই বাড়ি না-ফিরে কোনও বন্ধুর বাড়িতে থেকে যাওয়াটা প্রেফার করেন। তারাপদদের বাড়িতে ওঁরা স্বামী-স্ত্রী শুধু দু’জনে থাকতেন। শুনেছি, শক্তি সেখানে খুব যেতেন। কিন্তু আমাদের বাড়িতে তো মা থাকতেন। হয়তো সে-জন্যই শক্তি সচরাচর অত রাতে তেমন একটা আসতেন না।

কিন্তু সেই নিয়মেরও হেরফের ঘটেছে। একবার অন্তত স্পষ্ট মনে আছে, শক্তি আমাদের বাড়িতেই থেকে গিয়েছিলেন। সে রাতে খাওয়ার পরে একটা সিঙ্গল খাট বা ডিভানে ওঁর শোওয়ার বন্দোবস্ত হল। মনে আছে, শুয়ে মাঝেমধ্যেই কী রকম আওয়াজ করছেন! কখনও বা আচমকা ‘অ্যাই সুনীল’ করে ডেকে উঠছেন! উনি এমন করায় আমি দু’-একবার বলেছি, ‘যান, এ বার ঘুমিয়ে পড়ুন’, কিন্তু ফল হচ্ছে না। তখন মাকে গিয়ে বলেছি। মা অমনি উঠে এসে বললেন, ‘শক্তি, কী হল! কেন ঘুমোতে পারছ না? এমন চিৎকার করে না। আমরা কেউ ঘুমোতে পারছি না! যাও, অন্য কথা ভাবো, ঠিক ঘুম চলে আসবে!’ ও মা, ঠিকই তো! দেখলাম, শক্তি একটু বাদে ঠিক ঘুমিয়ে পড়লেন।

শক্তির আর একটা ঘটনাও ভোলা মুশকিল। একবার, বোধহয় ওই বিজন সেতুর বাড়িতেই বাজারের থলে হাতে ওঁর মেয়ে বাবুইকে সঙ্গে নিয়ে হাজির। তার পর এটা-সেটা বলতে বলতে ‘এই একটু বাজারটা সেরে আসছি’ বলে উধাও! তার পর ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাবার। আর আসেনও না! তখন তো অত ফোনও ছিল না। থাকলেও বোধহয় শক্তির স্ত্রী মানে মীনাক্ষীর নম্বর আমাদের কাছে ছিল না। বাড়িতে আমি আর শাশুড়ি-মা। সুনীল একটু বাদে অফিসে বেরিয়ে গেল। আমাদের ছেলে পুপলু, শক্তির মেয়ের থেকে বোধহয় অল্প বড়। কিন্তু ওদের মধ্যেও তত ভাব নেই। বেচারি বাচ্চা মেয়ে তো একটু বাদে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল। খালি ‘বাড়ি যাব, বাড়ি যাব’! আমি আর মা ওকে সমানে খাওয়াতে চেষ্টা করছি। কিন্তু বেচারি তখন বাড়ি যাবে বলে অস্থির।

বুঝতে পারছিলাম, মীনাক্ষী কেন ওঁর ওপর এত রাগ করেন। শেষে বোধহয় অনেক পরে এসে বাবুইকে নিয়ে গেলেন। শক্তি নিজে এসেছিলেন, না কোনও জায়গা থেকে খবর পেয়ে মীনাক্ষী এসেছিলেন, তা এত দিন বাদে আর মনে নেই। তবে মনে আছে, পরে শক্তিকে বেশ বকেছিলাম। তাতে অবশ্য ওঁর বয়েই গিয়েছে।

আমাদের দু’টি পরিবারের বাচ্চাদের নিয়ে মেলামেশা ওদের ছোটবেলার পরে অবশ্য বড় একটা হয়নি। কিন্তু পার্ক সার্কাসের কাছে কর্নেল বিশ্বাস রোডে শক্তিদের বাড়িতে ওঁর জন্মদিন আমার খুব মনে আছে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তখন সুনীলের চেয়ে শক্তির বেশি ভাব। আর আমি তো সৌমিত্ররও ফ্যান! তো, শক্তির বাড়িতে গিয়ে দেখি, সৌমিত্র হারমোনিয়াম কোলে নিয়ে বসে
গান করছেন। এই দৃশ্যটা শক্তির সৌজন্যেই পাওয়া।

আর মীনাক্ষীকেও আমি খুবই অ্যাডমায়ার করি। উনিও কবিতার পত্রিকা করতেন, লিখতেন। ব্যক্তিত্বময়ী। পরের দিকে শক্তি-সুনীলের অফিসে নিয়মিত দেখা হলেও বাড়িতে আমাদের মেলামেশা কমে গিয়েছিল। কিন্তু প্রথম দিকে একদিন একসঙ্গে বেড়ানো আমার খুব মনে পড়ে। বোধহয় মধ্যপ্রদেশের কবি অশোক বাজপেয়ীর ডাকে শক্তি-সুনীল ভোপালে কবিতা পড়তে গিয়েছিলেন। আমি আর মীনাক্ষীও গিয়েছিলাম। বাচ্চারা তখন একটু বড় বোধহয়। পুপলুকে কলকাতায় মায়ের কাছে রেখে যাই। ভোপাল থেকে ওঁদের দেওয়া একটা গাড়িতে আমাদের চার জনের বেড়াতে যাওয়া হল পাঁচমারি।

দিল্লিতে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার অনুষ্ঠানে

তখন কিন্তু শক্তিকে ক’টা দিন খুব লক্ষ্মী ছেলে হয়ে থাকতে দেখেছি। সুনীল তো ড্রাইভারের পাশে বসতে ভালবাসত। গাড়িতে উঠেই একদম সামনে গিয়ে বসেছে। মীনাক্ষী গম্ভীর ভাবে শক্তিকে বললেন, তুমি ধারে বসবে না! শক্তিরও কোনও প্রতিবাদ নেই। মনে আছে, সুনীল সামনে আর পিছনে আমি আর মীনাক্ষী সাইডে বসেছি, শক্তি মাঝখানে। আমার বরং তখন মনে হচ্ছিল, ইস্, সুনীল যদি আমার একটু কথা শুনত...

এমনিতে সাইটসিয়িং-এ শক্তি-সুনীলের তত ঝোঁক ছিল না। নানা জায়গায় ঘোরা হচ্ছে। আমি আর মীনাক্ষীই এ দিক-সে দিক উঠছি নামছি। শক্তি আর সুনীল বড়জোর গাড়ি থেকে নেমে নিজেদের মধ্যে গভীর আলোচনায় মগ্ন। আর গাড়িতে বসে টুকটাক হাতবদল চলছে বোতলের। অত শাসনের মধ্যেও শক্তি-সুনীলের স্টক রেডি থাকত। বোতলে জল মেশানো। গাড়িতে বসেই সামনের সিট-পিছনের সিটের মধ্যে বোতলটা ঘুরছে। এর মধ্যেও মনে পড়ে, শক্তি আর সুনীলও এক বার কোনও একটা জায়গায় নেমেছিল। বোধহয় অনেক সিঁড়ি ভেঙে জলের মধ্যে একটা মন্দিের। পরের দিকে সুনীল আর অত সিঁড়ি ভাঙতে পারত না।

ওদের বন্ধুদের সেই প্রাণবন্ত অতীতটার কথা এখন খুব মনে হয়। শক্তিদের সঙ্গে দল বেঁধে আর কোথাও বেড়ানো খুব একটা হয়নি। হলেও বড়জোর দু’-একদিনের জন্য। শক্তি চলে যাওয়ার পরেও বেলেঘাটায় ওদের বাড়ি গিয়েছি। কী সুন্দর বাগানঘেরা জায়গা! মাঝে মীনাক্ষীর শরীরটা খারাপ হয়েছিল। তখন গিয়েছিলাম। গাছপালা, শক্তির নাতি-নাতনিদের নিয়ে জমজমাট সেই বাড়ি, সত্যিই খুব ভাল লেগেছিল।

আর শক্তিকে যতটুকু দেখেছি, ওঁর পাগলামি বোহেমিয়ানিজমের বাইরেও একটা অন্য মানুষ ছিলেন। শুনেছি, শক্তি বাজার খুব ভাল করতেন। এ দিক-ও দিক ঘুরতেন, বাড়ি ফিরতেন না, আবার কয়েক দিন মাঝেমধ্যে খুব ভাল হয়েও থাকতেন। চান করে মাথা আঁচড়ে বসে পরিপাটি ভাত খেতেন। এই শক্তির জন্য আমার খুব আফসোস হয়। সুনীলদের বন্ধুদের মধ্যে ও-ই তো সবার আগে চলে গেল।

কবিতার আমি কী-ই বা বুঝি, তবে মনে হয়, শক্তির কোথাও একটা ইনার ডিসিপ্লিন ছিল। নইলে এত ভাল লিখবে কী করে? সুনীলকে পরের দিকে দেখেছি, দিনের বেলা অফিসের দিনে মদ খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। শক্তি সে-সব আমল দিতেন না। উনি হয়তো নিজের টার্মসে বেঁচেছেন। আনন্দে থেকেছেন। তবে ওঁকে যাঁরা ভালবাসতেন, তাঁদের কথা ভাবলে মনে হয়, একটু রাশ টানলেই ভাল হতো। এখন দেখি অনেকেই বলেন, শক্তি তো প্রথমে গল্প লিখতেন, সুনীল কবিতা! ওঁরা নাকি চেয়েছিলেন, নিজেরা এক সঙ্গে সব না-করে আলাদা-আলাদা দিক ধরে রাখবেন। আমি অত বুঝি না! সুনীল-শক্তি যে যেমন ইচ্ছে লিখেছেন। শক্তি আরও গল্প লিখলে সেটাও খুব ভাল হতো বলেই আমার মনে হয়। কিন্তু আমি বলব, শক্তির কবিতার মধ্যেও কত ভ্যারাইটি ছিল। আমাকেও তো কত জন বলতেন শক্তির কবিতার কথা। লোকে সুনীলের মহিলা ফ্যানদের কথা এত বলে, আমার কিন্তু বাংলাদেশের এক মহিলার কথা মনে পড়ছে, শক্তির কবিতার অন্ধ ভক্ত। উনি আমায় বলেছিলেন, সুনীলদার কবিতা খুবই ভাল, কিন্তু শক্তিদার কবিতার তুলনা নেই।

শক্তি-সুনীলের সেই শেষ দিনের কথা বার বার মনে হয়! আমার স্থির বিশ্বাস, শক্তি যদি সত্যিই কৃত্তিবাসের দায়িত্ব নিতেন, সে এক অন্য রকম ‘কৃত্তিবাস’ হতো। তাই ওঁকে যাঁরা ভালবাসতেন তাঁদের কাছে তো বটেই, বাংলা সাহিত্যেও বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল শক্তির অত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়াটা। অন্তত আমার তাই মনে হয়।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy