রূপবন্ধ: সৌমেন খামরুইয়ের কাজ। সম্প্রতি এসসিএ গ্যালারিতে
সমগ্র জ্যামিতির অটুট স্থাপত্যের কবিতা ওঁর ছবি। টেম্পারার মগ্ন চৈতন্যে অন্তর্নিহিত ছিল তাঁর প্রিয় ঘরদোর সিঁড়ি দরজা গম্বুজ রেলিং চালাঘর গাছপালা বাগান পাহাড় ধোঁয়া নির্জন অন্ধকার স্পেস। সে সবই দীর্ঘ কাল লালন করে এসেছেন সৌমেন খামরুই। তুলোট কাগজে এই টেম্পারা কাব্যগাথার নিবিড় অন্তরালে ছিলেন এক জন রামকুমার, এক জন গণেশ হালুই। সেই সঙ্গে বিচ্ছিন্ন ভাবে মিশে ছিল প্রয়াত রামলাল ধরের কিছু নিসর্গনির্যাস। সৌমেনের ঘরদোর বাগান উঠোন ও চালাঘরসদৃশ নিসর্গ কিন্তু ইউরোপীয় ঘনকবাদকে প্রশ্রয় দেয়নি। জ্যামিতি এতে সমগ্র নিসর্গ বিশেষত প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সবটুকু শিল্পগুণকে আত্মস্থ করা এক নির্মিতি। গুরুমারা বিদ্যেকে নিজের মতো করে দ্বিমাত্রিক সরলীকরণে ফেলে স্পেসের নানা গঠনকে প্রাকৃতিক পরম্পরার উত্তরাধিকার দান। সম্প্রতি এসসিএ গ্যালারিতে সম্পন্ন হল তাঁর একক প্রদর্শনী—তুলোট কাগজে টেম্পারায় করা এক চিত্রসম্ভার।
মনুষ্য-অবয়বহীন অসংখ্য ঘরদোর গাছপালা জমি পাহাড় আকাশ স্তব্ধ একক নির্জন অস্তিত্বকে উদ্ভাসিত করে চলে গিয়েছে এক মহাকাব্যিক স্থাপত্যের অদ্ভুত সরলীকরণের পথে। সৌমেন চতুর্ভুজ, বর্গক্ষেত্রকে রেখার সমন্বয়ে নয়— নিরেট ফর্মের বন্ধনে একে অন্যের পরিপূরক করার চেষ্টা করেছেন। ফলে হরাইজ়ন্টাল স্থাপত্যময় দৃশ্য রূপে তাদের সমুন্নতির গুণ ও পরিপ্রেক্ষিতকে কৌতূহলের মধ্যে রেখে দেয়। নেগেটিভ স্পেসকে ব্যবহারের ক্ষেত্রে যেমন— সন্নিবেশিত কাঠামোর মধ্যেও ফর্ম ও জ্যামিতি মিলেমিশে একটা পরম্পরা তৈরি করছে। সিঁড়ি যেমন দূরে চলে গিয়েও থেমে যাচ্ছে লালচে প্রাচীরের দিকে, অন্ধকার দরজার পাশে জ্যামিতিক নানা বিন্যাস ঘনকবাদী বিশ্লেষণে একাকার হয়ে, টেম্পারার মেজাজে ও রঙের ঘষামাজা প্রতিচ্ছায়ার আলো-আঁধারিতে ঝলমল করে উঠছে।
সৌমেনের ছবি দেখতে দেখতে মনে পড়ে ভারতীয় অণুচিত্রের নয়ন ভোলানো কম্পোজ়িশন। ভার্টিক্যাল, হরাইজ়ন্টাল রেখার সুদৃশ্য অঙ্কনের মধ্যে স্থাপত্য-কাঠামোর রূপ, পাশেই একটু নীচে সম্রাট-বাদশাদের জীবন যাপনের টুকরো টুকরো ঘটনা। দেশীয় অণুচিত্রের এই অসামান্য, কখনও না ভোলা মুহূর্তগুলি অসাধারণ দক্ষতার তথা নিপুণ চিত্রময়তার নিদর্শন। রাজপুত-মুঘল চিত্রকলা থেকে প্রাপ্ত এই উত্তরাধিকার সৌমেনের ছবিকে বিবর্তিত করেছে। ফর্ম ও জ্যামিতিক বিন্যাস আধুনিকীকরণের পাশাপাশি সরলীকরণের সঙ্গে একাত্ম হয়েছিল তাঁর বর্ণ বিলেপনের প্রেক্ষাপটটি।
এই চিত্রময়তার নির্জন সৈকতে অনুজ্জ্বল টেম্পারা যেন আরও নিশ্চুপ হয়েও বড় বেশি অর্থবহ। সবুজ, কমলা, হলুদ ও লাল বর্ণকে তিনি যে ভাবে বিশ্লেষণ করেছেন, যে ভাবে কোথাও ঘষে তুলে দিয়েছেন তার অহংকার— সেই বোধকে সম্মান জানাতেই হয়। কোথাও পুরু আস্তরণের উপরে সম্পূর্ণ বিপরীত বর্ণের বাহুল্যেও যে ভাবে উপাখ্যান রচনা করেছেন, অনুশীলন না থাকলে যে এই মুনশিয়ানা সহজে আসে না, তা স্পষ্ট বোঝা যায়। এ সবই দারুণ আয়ত্ত করেছেন সৌমেন।
দ্বিমাত্রিক সমতলেও জ্যামিতিক স্থাপত্যের এই ভিন্ন স্টাইলাইজ়েশন ও টেকনিক তাঁর নিসর্গকে নিয়ে গিয়েছে এক মায়াময় জাদুজগতে! রূপবন্ধের হালকা বর্ণ রূপবন্ধের ভিতরে-বাইরে সন্নিবেশিত হয়ে, যেখানে এক প্যাটার্ন তৈরি করে অবলীলায়!
আর্থ কালারের প্রতি বরাবরই এক স্পৃহা ছিল। তাঁর ব্যবহারে এই ভূমিজ বর্ণ তাই এত নৈঃশব্দ্যেও কী অজস্র কথা বলে! রেখানির্ভর নয় তাঁর ছবি। ফর্মের বিন্যাস ও উপস্থাপনাই নানান রৈখিক চেতনার রূপে দেখা দেয় শুধু। শিল্পী নিজেই ছবির মধ্য দিয়ে বারবার আত্মানুসন্ধানে ব্রতী থাকেন নিঃসীম এই নির্জনতার প্রোথিত শিকড়ে! লোকশিল্পের আঙ্গিকেও গাছপালাকে রূপ দিয়েছেন তিনি। মিনিয়েচার ছবির সাব-কনশাস! টেম্পারার বর্ণতারল্যে আনা অনিন্দ্য রূপও মোহিত করে দেয়। স্পেসের সুদীর্ঘ শূন্যতাগুলি আপাতজমাট রূপবন্ধের পাশে একটি প্রগাঢ় অবসর তৈরি করে। এটুকুও বিভিন্ন উত্তাধিকারের ফলাফল। তবে দীর্ঘ কাল এই সব কাজ মনোটোনিকে প্রশ্রয় দেয় কখনও বা! আরও অন্য দিকে বাঁক নেবে তাঁর ভবিষ্যতের কাজ। আশা এমনই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy