অবয়বী: দেবভাষা আয়োজিত এক প্রদর্শনীতে হরেন্দ্রনারায়ণ দাসের চিত্রকর্ম।
হরেন্দ্রনারায়ণ দাস। ২০২২-এর পয়লা ফেব্রুয়ারি তাঁর জন্মশতবর্ষ। দিনটিকে মনে রেখে দু’মাস আগেই কলকাতায় বাংলার ছাপচিত্রের ইতিহাসে নক্ষত্রপ্রতিম হরেন দাসের ১১৫টি কাজের দেবভাষা আয়োজিত এক অবিস্মরণীয় প্রদর্শনী হয়ে গেল। তিনি ছাপচিত্রের দৃষ্টান্তমূলক অন্তরীক্ষ দর্শন করিয়েছিলেন মানুষকে। ধাতু-তক্ষণ (এচিং), প্রস্তর (লিথোগ্রাফ), দারু (উডকাট), লিনোলিয়াম, মেজেটিন্ট, এনগ্রেভিং, এচিং অ্যাকোয়াটিন্ট, ড্রাই পয়েন্টের মাধ্যমগত বিষয়গুলির রঙিন ও সাদাকালো কাজের সে এক অবিশ্বাস্য সমুদ্রমন্থন। তাঁর শিক্ষা, অনুশীলন, নিপুণ নিরীক্ষা ও বিভিন্ন শৈলী, বিশেষত প্রাচ্যশিল্পের উইকিও-ই ছাপচিত্রের রঙিন ছবিগুলির প্রভাব থেকে যা যা আহরণ করেছিলেন, পরবর্তী সময়ে অনেক ধরনের পরীক্ষার ধরন এক জায়গায় পৌঁছে নিজস্বতার প্রখর নৈপুণ্যের সৌন্দর্যকে মেলে দিয়েছিলেন সেই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে। যে রিয়্যালিজ়মের দৃষ্টিনন্দন মাধুর্যের অন্তরালে থেকে গিয়েছিল গ্রামীণ এক সরল জীবন। প্রান্তিক ও সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন যাপনের আর্তনাদহীন ও পরিশ্রমের, এমনকি ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষের স্মৃতিচিহ্নিত সব অধ্যায়। চারু-কারুশিল্পের সৃষ্টিকর্তাদের অজস্র সব কাজের গুণমান, অনুষঙ্গগুলি তাঁর অবচেতনে কখন যে গেঁথে গিয়েছিল, কে জানে!
যন্ত্রণা, অমানুষিক কষ্ট, অত্যাচার দেখেছেন। অজ পাড়াগাঁর সুন্দর নির্ভেজাল প্রত্যূষ দেখেছেন। সে জীবনের সুখ-আনন্দটুকুও মিশে আছে তাঁর বহু ছাপচিত্রে। রাজনৈতিক বার্তাও কি নেই! অবশ্যই তা অনুধাবনযোগ্য। আসলে হরেন দাস আলোর প্রখরতা থেকে আঁধারের আশ্চর্য সব অন্বেষণে অবগাহন করতে করতে সাদা-কালোর পরস্পর বৈপরীত্যের মায়াময় এক আকাশেরই সন্ধান করছিলেন যেন! যে আকাশে মানুষ অবশেষে খুঁজে নিয়েছিল এক প্রশান্ত সুখ। সে প্রশান্তি ধীরে আচ্ছন্ন করেছিল তাঁর রঙিন ছাপচিত্রগুলির অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপটটিকেও। কখনও প্রায় অনুজ্জ্বল, মেদুর, অত্যল্প চাপা বর্ণের অস্তিত্বহীন অস্তিত্বের মধ্যেও যেন লুকিয়ে থাকা কিছু বর্ণ, যা আলো ছোঁয়া আর এক রকম বিষাদগ্রস্ততার রঙে বিষণ্ণপ্রায়। যে বিষণ্ণতা ওই ছবিগুলির মহার্ঘ অলঙ্কার। যেখানে একই সঙ্গে যেন বিষাদ ও সুন্দর সমার্থক হয়ে উঠছে। টেকনিকের এই সৌন্দর্যই বিষাদের অস্তিত্বকে শুধু বর্ণের অভিপ্রায়ে চিহ্নিত করছে। ছাপচিত্রে তাঁর এই স্টাইলাইজ়েশন কখনওই বিস্মৃত হওয়ার নয়। এ সব ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ভাবে বর্ণকে নির্বাচন করে কী ভাবে কতটা ও কোন প্রেক্ষাপটে ব্যবহার করতে হবে, সে সম্পর্কে তাঁর এই গভীরতর নৈপুণ্যের রেশ লেগে আছে প্রত্যেকটি কাজে।
প্রদোষকালের অন্তর্লীন আলোর আরও অনেক আগেই বিহানবেলার এক নির্জনতম আলোর প্রায় মুছে যাওয়া সার্চলাইটে কিছু আর্তনাদহীন নীরব আর্তনাদ যেন জানান দিচ্ছে, সে অনুপস্থিত নয়। গ্রাম্য ঘরবাড়ি, স্থাপত্য-কাঠামো, দরজা, উঠোন, দ্বার থেকে বাইরের উন্মুক্ত প্রকৃতির কোনও অংশেও এই সহজ সত্যকে তিনি অবয়বী ও প্রয়োজনীয় অনবয়বী দৃশ্যান্তরে রূপান্তরিত করেছেন। চূড়ান্ত রিয়্যালিজমের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছেন ছাপচিত্রের এই মাধ্যমগত অনুপুঙ্খময়তার এক-একটি চিত্রপটের দৃশ্যায়নকে। হরেন দাস ঠিক এ ভাবেই মাধ্যম, বর্ণ, আলো-আঁধারের ব্রহ্মাণ্ডের অ্যালবামে গ্রাফিক্স-প্রিন্ট মেকিংয়ের বিবিধ গ্রহ-নক্ষত্রের সাতকাহন সৃষ্টি করেছেন। যেন মহাজাগতিক রশ্মির মতো কিছু কিছু টোন সময়ের আলোকে, এমনকি অন্ধকারকে উপেক্ষা করেও সেই নির্দিষ্ট ছাপচিত্রগুলির মায়াবী ম্যাজিক। শুধু আলো-আঁধার ও বর্ণই যেন দিয়ে দিচ্ছে সময়টির সঠিক বিবরণ। প্রতিটি মাধ্যমকেই ওই টোন ও ভিগনেট ভাষা দিয়েছে।
এচিং, কালার লিনো, লিনো, উডকাট, কালার লিথো, কালার উডকাট, ড্রাই পয়েন্ট, সফট গ্রাউন্ড এচিং, কালার এচিং, মেজেটিন্টে করা প্রান্তিক মানুষ, দৈনন্দিন জীবনযাপন, কুলি-কামিন, শ্রমিক-কৃষক, মেহনতি মানুষের এক অপূর্ব জীবনালেখ্য তাঁর কাজে বারবার উচ্চকিত। জন্তু, পক্ষিকুল, কবুতর, জেলে, মাঝি, মা ও সন্তান, মোষের স্নান, গ্রাম্য হাট, দশমহাবিদ্যা, কেদারনাথ, নিসর্গ, লোক-উৎসব, জালে মাছ ধরা, কালী, সূর্যালোকিত পথ, ভাই, আলো ও ছায়া, ছুরি ধার করা, মধ্যদিনের বিশ্রাম পর্ব, শান্ত জীবন, পশু ও মানবের শান্তির সহাবস্থান, মেলার পথে, যুদ্ধ, লেনিন, ভিক্ষুক, ভাত রান্না, প্রাতরাশ, বাঁশির ডাক, অস্বস্তিকর যাত্রা প্রভৃতি কাজগুলিতে তিনি উল্লিখিত মাধ্যমগুলির গভীর-গভীর-গভীরতর জায়গায় প্রবেশ করে যে কৌশল ও টেকনিকের শেষ দেখে ছেড়েছেন, তা তাঁর প্রশ্নাতীত দক্ষতার এক মহান চালচিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy