মুদ্রিত: দেবভাষা আয়োজিত সনৎ করের একক চিত্রপ্রদর্শনী
সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে মানুষ তার করতলের ছাপ রেখে গিয়েছে। গুহাচিত্রের আনাচ-কানাচে সেই রূপের বহু নিদর্শন আমরা পেয়ে থাকি। করতল-ছাপের ঋণাত্মক ও ধ্বন্যাত্মক স্পেসের এই লুকোচুরি আদিম মানুষকে জুগিয়েছে বিস্ময় ও কৌতূহল। মানুষ সেই থেকে সৃষ্টির এই অমর আনন্দে মগ্ন হয়ে, ছাপাই ছবির মাধ্যমকে শিল্পের আঙিনায় অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়ে, করে চলেছে বহুবিধ পরীক্ষানিরীক্ষা। সময়ের সঙ্গে জন্ম নিয়েছে কাঠখোদাই, রাবিং, লিথোগ্রাফি, এচিং, ইনতাগ্লিও, ড্রাই পয়েন্ট ইত্যাদি। বিবিধ এই সব মাধ্যমের মধ্য দিয়ে শিল্পী তাঁর মনের ভাব প্রকাশ করতে সক্রিয় হয়েছে। চিনের হান সাম্রাজ্যের রাবিং থেকে শুরু করে পরবর্তী কালে জাপানের হোকুসাই, হিরোশিগে বা ইউ-কিয়োয়ে, কাঠ খোদাই কিংবা পাশ্চাত্যের ডিউরার, ক্যাথে কোলভিৎস, পাবলো পিকাসো-সহ বহু প্রখ্যাত শিল্পীই তাঁদের উৎকৃষ্ট মানের ছাপাই ছবির সম্ভার রেখে গিয়েছেন। ভারতবর্ষে ছাপাই ছবির যাত্রা তেমন প্রাচীন না হলেও, ঊনবিংশ শতকের কলকাতায় বটতলা প্রিন্ট এক ঐতিহাসিক দলিল বহন করে। পরে ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথের অনুপ্রেরণায় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে শিল্পচর্চার কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় বিচিত্রা সভা। সেখানে লিথোগ্রাফি মাধ্যমে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘অদ্ভুতলোক’ সঙ্কলিত ব্যঙ্গচিত্রগুলি সেগুলির উৎকর্ষ ও অভিনবত্বের নিরিখে আন্তর্জাতিক স্থান অধিগ্রহণ করে।
পাঁচ দশক যাবৎ তেমনই ছাপাই ছবির নিরলস চর্চায় ব্রতী সনৎ করের একক চিত্র প্রদর্শনী সম্প্রতি আয়োজিত হয়েছিল দেবভাষা গ্যালারিতে। ভারতীয় ছাপাই ছবির জগতে সনৎ কর এক পুরোধা শিল্পী। সোসাইটি অব কনটেম্পোরারি আর্টের সঙ্গে যুক্ত আছেন সোসাইটির জন্মলগ্ন থেকেই। কলাভবনের অবসরপ্রাপ্ত বর্ষীয়ান অধ্যাপক সনৎ করের বিভিন্ন দশকের শৈলীগত বিশিষ্টতা দিয়ে সাজানো হয়েছে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনীটি। মূলত ছাপাই ছবির বিভিন্ন মাধ্যম যেমন কাঠখোদাই, লিথোগ্রাফি, এচিং, ইনতাগ্লিও-সহ রঙিন টেম্পেরা ও কালো-সাদা ড্রয়িং দিয়ে মোট ৪৩টি ছবির সমন্বয়ে এই একক প্রদর্শনীটি আয়োজিত।
এক নজরে সমগ্র প্রদর্শনীর কাজগুলি এক সৃষ্টিশীল কর্মনিষ্ঠ শিল্পীর আবেগ, অনুভূতি ও বাস্তবতার টানাপড়েনের প্রতিফলন ঘটায়। শান্তিনিকেতনের অনাবিল প্রকৃতির মাঝে দীর্ঘ সময়ের জীবনযাপন ও সেই সঙ্গে সক্রিয় অধ্যাপনার নিয়মানুবর্তিতা তাঁর কাজের রং ও রেখায় প্রতীয়মান। স্বতঃস্ফূর্ত অথচ সীমিত, সংক্ষিপ্ত রেখার বিন্যাসে জীবনের বিভিন্ন স্তরের বিস্ময় ও বিশ্বাসকে শিল্পী তাঁর মাধ্যমগত করণকৌশলের দক্ষতায় অনবদ্য ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। দীর্ঘ চর্চার ফলেই আসে এই সরলীকরণের প্রত্যয়। সনৎ করের রেখার সরলীকরণ তারই স্বাক্ষর বহন করে। শুধুমাত্র একটি ঋজুরেখা ও তার উপরে স্থিত এক গোলাকৃতি রূপ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন বিমূর্ত এক ক্ষীণকায়া মানবী রূপ। আবার কোথাও বা পেলব, তরঙ্গায়িত রেখার মাধ্যমে ফুটে উঠেছে শায়িত এক ফিগার। ড্রয়িংগুলির ক্ষেত্রে আবার দেখা যায়, শুধুমাত্র কালো রঙের ক্যালিগ্রাফিক তুলি চালনার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে আবক্ষ কোনও নারীমূর্তি বা প্রতিকৃতি। কিন্তু সর্বত্রই এক প্রাঞ্জল বাঙ্ময় রেখার অনায়াস আনাগোনা। তবে মানবিক গঠন যত বিমূর্তই হোক না কেন, সনৎ করের ছবির বৈশিষ্ট্য হয়তো বা মুখাবয়বগুলির মধ্যে তাদের বিস্ফারিত নেত্রযুগল। কমবেশি প্রায় বহু ছবির ক্ষেত্রেই এই বিশেষত্বটি প্রযোজ্য।
জীবন মাত্রই বিস্ময়ে ব্যাপ্ত। যে কোনও সৃষ্টির মূল উৎসই হল সেই বিস্ময়— অজানা এক ক্রিয়াশক্তি যেন শিল্পীকে দিয়ে তাঁর মনের ভাবনা, কল্পনা ও অভিজ্ঞতার নির্যাসগুলিকে তাঁর অজান্তেই প্রকাশ ঘটিয়ে থাকেন। সনৎ করের কাজগুলিতে সেই অপরিমেয় বিস্ময় যেন চিত্রপট জুড়ে প্রকাশিত। তাঁর কাজের চরিত্রগুলির চোখের ড্রয়িং বা দৃষ্টির কৌতুকময় আবেদন যেন অনায়াসেই আমাদের মনে করিয়ে দেয় প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতার ভাস্কর্য ‘দ্য প্রিস্ট ফ্যামিলি’-র কথা, যেখানে গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষগুলির নির্ভেজাল আয়ত নেত্রদ্বয় যেন কোনও আধিভৌতিক জিগীষা ও দার্শনিক আলাপচারিতায় মগ্ন। শিল্পের এই বিশ্বজনীন ভাষা ও প্রবহমান ধারার যে সত্যতা,সনৎ করের ছবিগুলি যেন তারই প্রত্যক্ষ দর্শনস্বরূপ। সব মিলিয়ে তাঁর অর্ধ শতাব্দীর দীর্ঘ চর্চা ভারতীয় শিল্পের ইতিহাসেরবিরল সম্পদ।
সর্বোপরি এই প্রদর্শনীর অন্যতম আকর্ষক বিষয়টি হল, শিল্পীর ১৯৭৯ সালের ‘স্কেচবুক’-এর এক সুচারু প্রকাশনা।সীমিত সংখ্যায় প্রকাশিত এই সঙ্কলনটি পারিপাট্য, পরিচ্ছন্নতা, নান্দনিকতা ও সৌন্দর্যের জন্য সংগ্রহের দাবি রাখে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy