Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

কবিতার কাছে হাঁটু মুড়ে বসা রং, রেখা আর তুলির ঝলক

বিভাবসুর কাজের তিনটি প্রধান গুণ ছবিগুলিকে নির্দিষ্ট করে দেয়। প্রথমত, ভীষণ রকম গ্রাফিক কোয়ালিটি-আচ্ছন্ন তাঁর কাজ।

রং-কোলাজ: উৎপলকুমার মণ্ডলের প্রদর্শনীর একটি কাজ।

রং-কোলাজ: উৎপলকুমার মণ্ডলের প্রদর্শনীর একটি কাজ।

অতনু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

‘আলো ছুটতে ছুটতে কোথায় যেতে চায় জানি না/ ফলে বোঝা যায় প্রতিটি যাত্রাই অগস্ত্যযাত্রা/ কোথাও যাত্রা শুরু হয় ঠিকই, কিন্তু শেষের কোনও স্থানবিন্দু হয় না’—নিজেরই লেখা কবিতা নিজের পেন্টিংয়ের সঙ্গে কোথাও আশ্চর্য ভাবে মিলে যায়। কবি কখনও শিল্পীকে ছাপিয়ে যান, শিল্প কখনও কাব্যকে। নিজস্ব সৃষ্টির অন্তরালে যিনি, ছদ্মনামে তিনি বিভাবসু, বাংলার এই তরুণ অধ্যাপক শিল্পশিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ না নিয়েও কাগজ ও রং নিয়ে সৃষ্টির যে অতল রহস্য থেকে অবিচ্ছিন্ন সব রূপ তুলে এনেছেন, তা বিস্ময়কর। সম্প্রতি বারাসতের চারুকলা আর্ট গ্যালারিতে উৎপলকুমার মণ্ডল ওরফে বিভাবসুর প্রথম একক প্রদর্শনীটি শেষ হল।

বিভাবসুর কাজের তিনটি প্রধান গুণ ছবিগুলিকে নির্দিষ্ট করে দেয়। প্রথমত, ভীষণ রকম গ্রাফিক কোয়ালিটি-আচ্ছন্ন তাঁর কাজ। দ্বিতীয়ত, একটি টেক্সটাইল কোয়ালিটি বারবার এসে গিয়েছে কাজে। শেষেরটায় নিজস্বতার একটা স্বাধীন ও উদ্দাম প্রকাশ, যেখানে পটে ইচ্ছেমতো বিচ্ছুরিত বর্ণের বিলাসিতায় চরম আধুনিকতার আখ্যান নির্মাণ।

রূপ আছে, তাকে যেমন সযত্ন কম্পোজ়িশনের প্রয়োজনে ব্যবহার করেছেন, আবার ওই আটপৌরে সাধারণ রূপকেও কখনও ভেঙে গড়ছেন বিমূর্ততার এক বৈচিত্রময় রহস্য। বর্ণ এখানে যেমন রবীন্দ্রচিত্রের স্টাইল ও টেকনিককে মনে পড়ায়, তেমনই রহস্যের মধ্যেও যেন অনুরণিত হয় শিল্পের আর এক স্বরলিপি, যা রেখার পটভূমিতে বর্ণের মৃদু ও উচ্ছ্বসিত উৎসবের মতো। এখানে কখনও আশ্চর্য ভাবেই এক নিরুদ্বেগ শান্ত নাটকীয়তা, আবার অন্য দিকে বৈপরীত্যের মধ্যে ঘটে যায় এক ধরনের রঙিন জাঁকজমক পর্ব। এই পর্বে একটি নিবিড় সাঙ্গীতিক মূর্ছনা তাঁর ছবিকে নিয়ে যায় রং-রেখার সেই জলসায়— রূপ যেখানে রূপক, আকার যেখানে অলৌকিক, আলো যেখানে আন্দোলিত আর অন্ধকার যেখানে অন্তরালের অলঙ্কার। এই ছবিগুলির বিমূর্ততায় তাঁর ব্রাশিং ও বর্ণচয়নের দক্ষতাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। বহুচর্চিত অধ্যয়ন-অনুশীলন পর্বেই বোঝা যায় বিস্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা।

টেক্সটাইল গ্রাফিকস কোয়ালিটির কাজগুলিতে নানা ভাবেই ডিজ়াইন ও অলঙ্কারধর্মিতার দিকে একটি লক্ষ্য ছিল। কখনও কাঁচা রঙের পটে তুলির পিছন দিক বা সরু কোনও বস্তুর মাধ্যমে কাগজের সাদাকে বার করে আনা রেখাঙ্কন ছবিকে প্রাণিত করেছে। কখনও প্রতিচ্ছায়াবাদের কথাও মনে পড়ে। জলরঙের মেদুরতার পাশে গাঢ় কালো মোটা ব্রাশিংয়ে একটি বিভ্রম তৈরি করেছেন। ‘৭৪ স্বপ্ন সিরিজ় ৪’ কাজটি নরম জলরং আর কালো তুলির কৃপণ রেখাঙ্কন। হুবহু যেন গণেশ হালুইয়ের নিসর্গ! প্রভাব থাকলে তাকে কাটাতে হবে। তবে অন্যান্য কাজগুলির নিজস্বতায় বৈচিত্রময়তাই প্রধান। ব্রাউন পেপার ও কালো কাগজে করা তিনটি কোলাজই দৃষ্টিনন্দন।

‘নন্দনকানন’ কাজটিতে ইউরোপীয় আধুনিকতা লক্ষ করা যায়, বিশেষত স্টাইল ও রঙের ব্যবহারে। কিন্তু আধুনিকতাকে যখন রূপে ও অরূপের দ্বন্দ্বে বিশ্লেষ করেছেন, সেখানে বেশ কয়েক বার রঙের মিশ্র অভিঘাত ছবিকে উৎকীর্ণ করছে। তেমনই রূপ যেন তরলীকৃত হয়ে মিশে যাচ্ছে পটভূমির অভ্যন্তরে তৈরি হওয়া আরও এক তরল অন্ধকারের গর্ভে। আকার ও কিছু রেখা এখানে এক বর্ণমালার নৈঃশব্দ্যকে প্রতিভাত করছে। আসলে তাঁর নানান পরীক্ষানিরীক্ষায় কাটা কাগজের ফর্মেশন ও পাঞ্চিং মেশিনের গর্ত হওয়া কাগজগুলির সমাহারে রং যেন তাদের শরীরে একটি ছন্দোময় দোলাচল তৈরি করছে। সরু সাদার বিভাজিত স্পেস ও মনুষ্যমুখের পার্শ্বরূপকে তা উসকে দিচ্ছে।

সামগ্রিক ভাবে মনে হবে ডিজ়াইনারের চিত্রকলা। অথবা রং-তুলি, কাটাছেঁড়া কাগজ নিয়ে তীব্র আকাঙ্ক্ষায় সারফেসে কোনও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় মগ্ন কিংবা জামাকাপড়ের প্রিন্ট নিয়ে ব্যস্ত এক শিল্পী। আসলে তিনি প্রকৃতই এক নিবিড় অনুশীলনরত চিত্রকর। গাছের পাতা ও রাসায়নিক পদার্থের মাধ্যমে যেমন কিছু কাজ করেছেন, কোথাও যেন নন্দলালের কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা, কান্দিনিস্কির বিমূর্ততা, রামকিঙ্করের জলরং-রেখার মগ্ন চৈতন্যের সেই মুগ্ধতা এবং অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব কিছুটা হলেও অনুভূত হয়। দ্রব্যগুণ সম্পর্কে সচেতন শিল্পী তাদেরও যত্নে লালন করেছেন তাঁর বিবিধ সৃষ্টিতে।

অন্য বিষয়গুলি:

Exhibition Utpal Kumar Basu Art
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy