এককথায় যাকে পোস্টকার্ড সাইজ় বলে থাকি আমরা, সেই রকম ৫৪টি সদ্য আঁকা ছবি নিয়ে সম্প্রতি পরিবেশিত হল বর্ষীয়ান শিল্পী গণেশ হালুইয়ের এক অন্য মাত্রার প্রদর্শনী, ‘দেবভাষা’ প্রদর্শশালায়। প্রদর্শিত সব ক’টি ছবির আয়তন ছয় ইঞ্চি বাই চার ইঞ্চি। অতি সযত্ন বাঁধাই ও সাজানোর মধ্য দিয়ে দেবভাষার দুই কর্মকর্তা সৌরভ দে ও দেবজ্যোতি মুখোপাধ্যায় এই প্রদর্শনীটির আয়োজন করেছিলেন। আকারে ক্ষুদ্র হলেও, ছবির নিজস্ব মাহাত্ম্যে প্রদর্শনীটি যেন এক রত্নখচিত মালার মতো দর্শককে মুগ্ধ করে।
এমন করে সাজানোর নেপথ্যে জানা গেল এক অতীব সুচিন্তিত ভাবনা। শিল্পী গণেশ হালুই যেহেতু ১৯৫৪ সালে গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে ছাত্র হিসেবে ভর্তি হয়েছিলেন, তাই ছবির সংখ্যা সুপরিকল্পিত ভাবেই ৫৪টি। তবে প্রদর্শনীতে রাখা শিল্পীর সব কাজই ২০২২ ও ২০২৩ সালের মধ্যের সময়কালে আঁকা হয়েছে।
অনন্ত এই প্রকৃতি এক জটিল নকশার মধ্য দিয়ে সৃষ্ট। তাই চিত্রের পরিভাষায়, ডিডাকশন একটি উল্লেখ্য দিক। অর্থাৎ নানা প্রকার রূপের মধ্য থেকে অপ্রয়োজনীয় অথবা অতিরিক্তকে বর্জন করে, শুধুমাত্র কোনও রূপের নির্যাসকে নিয়ে যখন কাজ হয়, তখন তা বিমূর্ত আকার প্রাপ্ত হয়। এ ক্ষেত্রেও সেই প্রকার বিমূর্ত আলঙ্কারিক উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে এই ৫৪টি কাজ। আমরা জানি, শিল্পী গণেশ হালুই মূলত নিসর্গ নিয়ে কাজ করেন এবং নিসর্গের বাহ্যিক রূপসমূহকে আত্মস্থ করে তাদের অসাধারণ বিমূর্তকরণ ও অলঙ্করণের মধ্য দিয়ে তাকে প্রকাশ করেন। তাই এ ক্ষেত্রেও তেমনই বহু ‘সাইন অ্যান্ড সিম্বল’-এর মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর ছবিগুলি গঠন করেছেন।
কাজগুলির মধ্যে লাল, নীল, কমলা, সবুজ, হলুদ, খয়েরি, কালো রঙের প্রাধান্য লক্ষণীয়। কোথাও হয়তো কমলা রঙের অর্ধগোলাকৃতি সাইন অস্তমিত সূর্যের কল্পনা জোগায়। আবার কোথাও দীঘল ঘন নীল তুলির টান, কোনও সমুদ্র বা জলাশয়ের প্রতীক হিসেবে দেখা দেয়। ধানখেত, প্রাচীর, সিঁড়ি, গুল্মরাশি, ধানের ছড়া, পাখি, গাছ, নৌকা, কুটির, দিগন্ত... এমন নানাবিধ রূপের আভাস এই ক্ষুদ্র পরিসরের মাঝে ধরা দিয়েছে, যা নাকি ক্ষুদ্রের মধ্যেও ব্যাপ্তির এক বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। অন্য দিকে, সংক্ষিপ্ত স্পেসে রং ও রেখার দৃঢ় বুনট ছবিগুলির মধ্যে এক কাব্যময়তা সৃষ্টি করে, যা হয়তো বা জাপানি হাইকু কবিতার সমতুল্য। আপাতদৃষ্টিতে খেলার ছলে আঁকিবুকি কাটা মনে হলেও, প্রতিটি রেখা ও রঙের বিন্যাসে আছে দৃঢ়তার প্রতিফলন। প্রতিটি ছবিই তাই স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং ক্ষুদ্রের মাঝে বিস্তারের আভাস নিয়ে সম্পাদিত। তথাকথিত পার্সপেক্টিভ বর্জিত কাজগুলির মধ্যে তাই অলঙ্করণের গুণাগুণ বিশেষ ভাবে আকর্ষক। ছাত্রাবস্থায় শিল্পীর অ্যাপ্লায়েড আর্টসের প্রশিক্ষণই হয়তো বা তাঁকে এই ডিজ়াইনকেন্দ্রিক দেখা ও তা নিয়ে নানাবিধ পরীক্ষানিরীক্ষা করার প্রেরণা দিয়ে থাকে।
ক্ষুদ্র পটের মাঝে অপরূপ এই বিন্যাসের জন্য প্রয়োজন হয় দীর্ঘ চর্চা ও মনন। শিল্পী গণেশ হালুইয়ের কাজে আজও অটুট ও গতিময়। চিত্রের ক্ষুদ্র পট যে কখনও প্রকাশের অন্তরায় হতে পারে না, এই ছবিগুলি তারই উৎকৃষ্টপরিচয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy