বিন্দুতে সিন্ধু: শিল্পী সুষেণ ঘোষের একক প্রদর্শনীর শিল্পকর্ম
সম্প্রতি গ্যালারি ৮৮-তে নিঃসঙ্গতা-প্রিয় প্রয়াত শিল্পী সুষেণ ঘোষের চারুকলা ভাস্কর্য এবং গ্রাফিক্সের এক প্রাচুর্যপূর্ণ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। নাম, ‘লিরিক, স্টিল’।
সুষেণ ঘোষের জন্ম অসমের শিলচরে, ১৯৪০ সালে। সরকারি স্কলারশিপ পেয়ে তিনি কলাভবনে চলে আসেন ’৫৯ সালে। সেই সময়ই তিনি সুযোগ পান বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় এবং রামকিঙ্কর বেইজের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে কাজ শেখার। এ ছাড়াও সুযোগ হয়েছিল নন্দলাল বসুর কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করার। কলাভবন থেকে পাশ করার পরে ওখানেই ভাস্কর্য বিভাগে শিক্ষকতা শুরু করেন। তারপরেই ব্রিটিশ কাউন্সিল স্কলারশিপ লাভ এবং লন্ডন ইউনিভার্সিটির গোল্ডস্মিথ কলেজে হেনরি মুরের সাহচর্যে আসা। মুরের অর্ধ-বিমূর্ত ভাস্কর্যের প্রতি আকর্ষণ জন্মায় শিল্পীর। বিদেশে থাকাকালীন মাতিস, পল ক্লে, সেজান, মদিগ্লিয়ানির মতো ইউরোপিয়ান শিল্পীদের কাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়। তবে খুব শিগগিরই তিনি ফেরত আসেন শান্তিনিকেতনে। পরবর্তী চল্লিশ বছর শান্তিনিকেতনেই কাজ করেছেন।
এই প্রদর্শনীতে মোটামুটি ১৯৭৫ সাল থেকে শুরু করে ২০১৫ সাল পর্যন্ত করা বেশ কিছু পেন অ্যান্ড ইঙ্ক ড্রয়িং দেখা গেল। এর ভিতরে ‘বিষ্ণুপুর’ শিরোনামের ড্রয়িংগুলি এবং ‘কোনারক’-এর কিছু ফিগার ড্রয়িংয়ে যথেষ্ট সরলীকরণ চোখে পড়ে। বাইরের আতিশয্য বর্জন করে নির্যাস-প্রধান সব ড্রয়িং। কোনারকের ছবিগুলোতে নগ্ন নারী বাদ্যযন্ত্রীদের ড্রয়িংয়ে যৌনতার থেকে গতিশীলতাই প্রাধান্য পেয়েছে। বিষ্ণুপুরের ড্রয়িংয়েও যুদ্ধ, লড়াই, মানুষ, ঘোড়া, পালকি ইত্যাদি অনেক উপাদান আছে। তবে এগুলি পুরোপুরি লাইন ড্রয়িং। শিল্পী সুষেণ ঘোষ যেন গতিটুকুই ধরতে চেষ্টা করেছেন, মাত্র ক’টা লাইনে।
এ ছাড়াও এখানে কাগজের উপরে কিছু এচিং, লিথোগ্রাফ এবং সেরিগ্ৰাফ (সিল্ক স্ক্রিন)-এর ছাপাই ছবি দেখা গেল। তা ছাড়াও আছে দু’টি উডকাট। একটিতে মনুষ্য-পরিচালিত মুরগির লড়াই। বেশ প্রাণবন্ত রঙের ব্যবহার। অপর উডকাটটিতে গ্রামের এক দৃশ্য। এক অল্পবয়সি মহিলা আর একজন বয়স্ক মহিলার সঙ্গে জল তুলতে গিয়ে কুয়োর সামনে দাঁড়িয়ে গল্পগুজব করছে। ওদের অবয়বের সামান্যতম ভঙ্গিমায় যেন বোঝা যায় যে, আসলে ওরা পরচর্চারত।
শিল্পী সুষেণ ঘোষের এই শিল্পসম্ভার সম্ভবত যতটা গভীরতা নিয়ে এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে, এর আগে হয়তো সে রকম ভাবে কোথাও করা হয়নি। পাঁচ দশকের কাজে ড্রয়িং, ছাপাই ছবি এবং ভাস্কর্যের যে সব নমুনা প্রদর্শনীতে দেখা গেল, তাতে সুষেণ ঘোষের অনন্য প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়।
তাঁর এই বিশেষ বিমূর্তকরণে কোনও পশ্চিমী প্রভাব আসেনি। আবার আমাদের দেশী শিল্পেও ঠিক এই ধরনের কাজ হয়তো আগে হয়নি। অত্যন্ত সাবধানতা অবলম্বন করে নানা উপাদানের মিশ্রণে, যেমন বিজ্ঞান, বিশেষ করে জ্যামিতি-কবিতা-দর্শন এবং শব্দের ভাবের ভিতর দিয়ে নিজস্ব একটি স্বাক্ষর নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন শিল্পী। এই পুরো ব্যাপারটাই ধরা পড়ে বিশেষ করে তাঁর পেন অ্যান্ড ইঙ্ক ড্রয়িং এবং ভাস্কর্যগুলির মধ্যে।
তাঁর কিছু পেন অ্যান্ড ইঙ্ক ড্রয়িংয়ে জ্যামিতিক ব্যাপারটি ধরা পড়ে। পার্সপেক্টিভ বজায় রাখার জন্য দূরের লাইনগুলিকে সঙ্কুচিত বা ফোরশর্টনিং করে বেশ একটা ধাঁধায় ফেলা যায় দর্শককে। এই ভাবে নাটকীয়তা সৃষ্টি করা হয়েছে।
রামকিঙ্কর বেইজ তাঁকে একবার বলেছিলেন, যে কোনও জিনিস আঁকার আগেই, তার ভিতরের গতিশীলতাকে অনুভব করতে হবে। অণু-পরমাণুর চলমান ধর্মটা। ছবি আঁকার জন্য শুধু আকৃতি, অবয়ব বা রং ছাড়াও সুর, ছন্দ এবং তালও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সেখান থেকেই খুঁজে পান শিল্পী তাঁর ভাস্কর্যের এক নতুন ভাষা। তা নেহাতই স্থাপত্যধর্মী বা গঠনধর্মী নয়। গানের লয় তার নিজস্ব তালধর্মিতাকে কমিয়ে আনতে আনতে যখন একেবারে একটা বিন্দুতে এসে পরিণত হয়ে স্থির হয়ে যায়, তখন শিল্প সৃষ্টি হয়। শিল্পী সুষেণ ঘোষ যেন তাঁর ভাস্কর্যে এই কথাটাই বারবার বলতে চেয়েছেন।
তাঁর টেরাকোটায় ‘ফোর ফিগারস’ বলে যে ভাস্কর্যটি দেখা গেল, সেখানে কোনও ভাবালুতাকে প্রশ্রয় দেননি শিল্পী। চারজন মানুষ বসে আছে, হাতে হাত লাগিয়ে। যে কোনও দিক থেকে দেখলেই তারা একই রকমের দেখতে। পুরো ব্যাপারটাকেই একটা জ্যামিতিক রূপ দান করেছেন।
‘চেঞ্জ অব মুডস’ বলে আটটি অংশের একটি ইনস্টলেশন প্রদর্শনীতে আছে। ব্রোঞ্জের তৈরি। এখানে শিল্পী বলছেন যে, পূর্ণতা থেকে বেরিয়ে ক্রমে ছোট হতে হতে সব কিছুই বিন্দুতে মিলিয়ে যায়। আবার সেখান থেকে ঘুরে এলে সেই পূর্ণতা।
টেরাকোটার আর একটি ভাস্কর্য ‘স্প্লিট’। পুরো জিনিসটা কেটে কেটে পাশাপাশি রেখেছেন। কিন্তু একত্র করলে সেই পুরো আকৃতি মূর্ত হয়ে ওঠে ।
আর একটি ভাস্কর্যের নাম ‘কম্পোজ়িশন’। ব্রোঞ্জের তৈরি। প্রদক্ষিণ করে দেখতে হয়। এক দিক দিয়ে দেখলে ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসে। আবার উল্টো দিক দিয়ে বৃত্তাকারে ফিরে গেলে, বড় হতে হতে পূর্ণাকার প্রাপ্ত হয়। ভারী মজার।
‘সাকসেসিভ’ বলে যে ভাস্কর্যটি আছে, সেটিও ব্রোঞ্জের তৈরি। শিল্পী যেন বলছেন, পূর্ণতা থেকেই ধীরে ধীরে শূন্যতা এবং সেইখান থেকে আবার পূর্ণতাকে ফিরে পাওয়া। প্রদর্শনীতে আরও কিছু শিল্পকর্ম দেখা গেল, সেগুলির নাম ভিতর এবং বাহির, উপর এবং নীচ, আরোহ-অবরোহ... ইত্যাদি। সমস্ত শিল্পকর্মেই সুষেণ ঘোষ বস্তুর ভিতরের গতিময়তাকে যেন জয় করতে চেয়েছেন। যে রকম ভাবে তিনি গানের লয় এবং কবিতার ছন্দ ভালবাসতেন, সব কিছুর অন্তরে বিন্দুর কম্পন এবং শেষে স্তব্ধতার অনুভবও সেই ভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছে তাঁর প্রতিটি কাজে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy