নাটকের একটি দৃশ্য
গত ১৩ নভেম্বর তপন থিয়েটারে মঞ্চস্থ হল থিয়েটার ইন জি মাইনর নাট্যদলের নবতম প্রযোজনা— ‘কথোপকথন’। পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘কথোপকথন’-এর অন্তর্গত প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। এর পর দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম গ্ৰন্থগুলিও প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৫-এর মধ্যে। এই পাঁচটি গ্ৰন্থে বিধৃত রয়েছে শুভঙ্কর ও নন্দিনীর প্রেমের কবিতা। শুধু দ্বিতীয় কাব্যগ্ৰন্থে রয়েছে অমিতাভর কথা। একটি নাটকের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে এতগুলো কথা বলার মূল কারণ হল— কথোপকথন, যা মূলত কাব্য— তাকে নাটকের ছাঁচে ফেলে পুনর্নির্মাণ করা সহজ নয়। কাব্যে যা স্বাভাবিক, নাটকে তা নয়। কাব্যে যা সঙ্গত, নাটকে তা অতিশয় বলে মনে হতে পারে। সুতরাং কাব্যভূমি থেকে নাট্যভূমিতে যাত্রার পথ সুগম নয়। ‘কথোপকথন’ কাব্যগ্রন্থের বিভিন্ন পর্যায়ের কবিতা থেকে কিছু কবিতা বেছে নিয়ে, জুড়ে একটি ঋজু ও মেদহীন নাট্যরূপ সৃষ্টি করে বিশেষ মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন নিবেদিতা ভট্টাচার্য।
‘কথোপকথন’ নাটকটি কবিতা দিয়ে নির্মিত হলেও এটিকে কাব্যনাট্য বলা চলে না। এটি হল কাব্যিক নাট্য। স্বাভাবিক ভাবেই এ নাটকে কোনও আখ্যানভাগ নেই। রয়েছে কথা। শুভঙ্কর আর নন্দিনীর কথা। এই নাটকটির মধ্য দিয়ে একটি তিরতিরে বাতাস বয়ে যায়, প্রেমের। ঘটনা নেই, আছে কল্পনা। আছে ঘোর। সম্মোহন। আছে কথার স্রোতে বয়ে চলা।
মূল কথোপকথন কাব্যগ্রন্থে আমরা দেখতে পাই যে শুভঙ্কর আর নন্দিনীর বয়স ধীরে ধীরে বেড়েছে। এই নাটকেও আমরা তাই তরুণ শুভঙ্কর-নন্দিনী ও পরিণতবয়স্ক শুভঙ্কর-নন্দিনীর দেখা পাই। পার্থপ্রতিম রায় ও নিবেদিতা ভট্টাচার্য পরিণতবয়স্ক শুভঙ্কর-নন্দিনীর ভূমিকায় সুন্দর কাজ করেছেন। প্রেমের বাহ্যিক অভিব্যক্তির তলা দিয়ে বয়ে চলা প্রবল গভীর স্রোতকে তাঁরা ব্যক্ত করেছেন অনাড়ষ্ট ভঙ্গিমায়। পার্থপ্রতিমের শুভঙ্করের মধ্যে একটা বিষাদ রয়েছে, একটা হতাশা রয়েছে। নিবেদিতার নন্দিনীর মধ্যে একটা প্রাণবন্ত অথচ কোমল সংবেদনশীলতা রয়েছে। অপর দিকে তরুণ শুভঙ্করের ভূমিকায় রাজু বেরা চঞ্চল, টগবগে এবং যৌবনময়। পাশাপাশি তরুণী নন্দিনীর ভূমিকায় মেরি আচার্য অভিমানী ও আদুরে। এঁরা প্রত্যেকেই পরস্পরের পরিপূরক। এই নাটকের এটিও একটি বিশেষ গুণ। এ ছাড়া কবি পূর্ণেন্দু পত্রীর ভূমিকায় সায়ন্তন মৈত্র সাবলীল। তাঁর চরিত্রে স্বাভাবিক ভাবেই কোনও উচ্চাবচতা নেই, অথচ একটি প্রশান্ত কাব্যময়তা রয়েছে। সেটি সায়ন্তন সুষ্ঠু ভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন।
কথোপকথন নাটকে পার্থপ্রতিম রায়ের মঞ্চ পরিকল্পনা এবং অয়ন ঘোষ ও দেবব্রত মাইতির মঞ্চনির্মাণ রুচিশীল ও ছিমছাম। এই নাটকে গঙ্গার ধারে রাঙা সূর্যাস্তের দৃশ্যটি ভারী সুন্দর। দীপঙ্কর সেনের আলোর কাজ ভাল লেগেছে। এ ছাড়া গোটা নাটকটিকে ধারণ করেছিল পার্থপ্রতিম রায়ের আবহসঙ্গীত। তা নাটকের বহমান স্রোতের মধ্যে মিলেমিশে গিয়েছে। দেবজিৎ পালের রূপসজ্জা যথাযথ।
কথোপকথন নাটকটি হয়তো অনেক রকম ভাবেই দৃশ্যায়িত হতে পারত। কিন্তু নাট্যনির্দেশক পার্থপ্রতিম রায় এই নাটকটিকে পরিকল্পিত ভাবে একটি বিশেষ স্টাইলাইজ়ড রূপ দিতে সক্ষম হয়েছেন, যা এই নাট্য-উপস্থাপনাটিকে কাব্যময় করে তুলেছে।
নাটকটি দীর্ঘ নয়। স্বল্প দৈর্ঘ্যের বলেই তার সৌন্দর্য থেকে গিয়েছে। দীর্ঘ হলে এ নাটক হয়তো ততটাও উপভোগ্য হত না। নাট্যরূপকার নিবেদিতা ভট্টাচার্য ও পরিচালক পার্থপ্রতিম রায়কে এই পরিমিতির জন্যে সাধুবাদ জানাই।
কথোপকথন নাটকটি আশির দশকের কলকাতা থেকে ভেসে আসা ঝিমঝিমে বাতাসের মতো, যা পুরনো সময়ের সৌরভ ছড়িয়ে দেয়। এ নাটকের মধ্যে একটা নির্জনতা আছে। একটা শান্ত সন্ধ্যার ছায়া আছে। একটা হেমন্তকাল আছে।
অনুষ্ঠান
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy