ভাজা হচ্ছে শিঙাড়া। ছবি: তন্ময় সেন
চা, শিঙাড়া... কোনওটাই বাঙালির নয়। তবুও বাঙালির আড্ডা জুড়ে এই জুটির সহাবস্থান আদি ও অকৃত্রিম। অতিথি আপ্যায়ন থেকে শুরু করে, সান্ধ্য চায়ের আড্ডা বা কলেজ ক্যান্টিনের হুল্লোড়ে অথবা দূরপাল্লার ট্রেনে জানালার ধারে বসে শালপাতায়... শিঙাড়ার জায়গা দখল করতে পারেনি কেউ।
জন্ম হোক যথাতথা...
শিঙাড়ার জন্মসূত্র জানতে গেলে যেতে হবে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে। পারসি শব্দ সানবুসাগ থেকেই সামোসার উৎপত্তি। ইরানি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সানবুসাগ বা সাম্বুসা এসে পৌঁছয় ভারতে। তাঁরা সারা দিন ব্যবসার কাজে রাস্তায় ঘুরতেন। রাতে অাশ্রয় নিতেন সরাইখানায়। সেখানেই মাংসের পুর ভরে তৈরি হত শিঙাড়া। পরের দিনের পাথেয় হিসেবে। মাংসের পুর ভরা এই ভাজা পদ অনেকক্ষণ ভাল থাকত। সেই জন্যই তা রাস্তার খাবার হিসেবে সঙ্গে নেওয়া হত। ইরানি ঐতিহাসিক আবুল ফজ়ল বৈহাকির ‘তারিখ-এ-বৈহাগি’তেও এর উল্লেখ পাওয়া যায়। এ দেশে পৌঁছে স্বাদে-গন্ধে তার রূপ আরও খোলতাই হল যেন!
চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি মালওয়ার সুলতানের সভায় পরিবেশিত হত শিঙাড়া। পারসি ভাষায় লেখা মধ্যযুগের কুকবুক ‘নিমতনামা’য় উল্লেখ পাওয়া যায় প্রায় আট রকম শিঙাড়ার, যা পরিবেশিত হত সভায়। তাদের মধ্যে কোনওটায় থাকত পাঁঠার মাংসের পুর, কোনওটায় হরিণের মাংস। বাদাম, গোলাপজল, এলাচ, শুকনো দুধ দিয়েও মিষ্টি পুর ভরা শিঙাড়ার চল ছিল সে সময়ে।
পর্যটক ইবন বতুতার বিবরণেও পাওয়া যায় যে, মহম্মদ বিন তুঘলকের সভায় মাংস, পেস্তা, আখরোট, আমন্ডের পুর ভরা শিঙাড়া পরিবেশন করা হত। কুতাব নামে একটি পদেরও উল্লেখ পাওয়া যায় আইন-ই-আকবরিতে, তৎকালীন হিন্দোস্তানে যা পরিচিত ছিল সানবোশাহ নামে। তবে আলুর পুরে নধরকান্তি চেহারাটি তার তখনও রপ্ত হয়নি।
সাম্বুসা থেকে শিঙাড়া
এ দিকে আমিষ-নিরামিষের ভাগও যে তখন বাড়িতে কড়া হাতে শাসন করে আসছে বাঙালি। নতুন শিঙাড়ার উদ্ভাবনে বাঙালিকে রসদ জোগাল পর্তুগিজ়। ভারতে উপনিবেশ স্থাপন করল পর্তুগিজরা। তাদের সঙ্গেই এসে পড়ল বাটাটা বা বাতাতা। বাংলায় আলু। ব্যস! বাঙালির পাতে আলুই সিংহভাগ দখল করে বসল। আর হেঁশেলে নিরামিষ পদের বাহারে নতুন সংযোজন হল আলুর পুর ভরা শিঙাড়া। তবে পুরও বদলাতে থাকল। উত্তরে বরাহনগর থেকে গঙ্গাকে ডান হাতে রেখে হাঁটতে হাঁটতে দক্ষিণের দিকে এগোলে শিঙাড়ার স্বাদ ও গন্ধ বদলাতে শুরু করবে। মিষ্টি পুরে নোনতা হাওয়া লাগবে ক্রমশ। কলকাতা শহরে শিঙাড়া তৈরির কারিগরও কম নেই।
কলকাতার কারিগর
শিঙাড়া প্রসঙ্গে কলকাতার কয়েকটি দোকানের নাম উল্লেখ করতেই হয়। শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে বিটি রোডের দিকের রাস্তায় বাঁ হাতে পড়বে দ্বারিক গ্র্যান্ড সনস। এদের আর একটি শাখা আছে লালবাজারের কাছে। দোকানের বর্তমান মালিক সিদ্ধার্থ ঘোষ বললেন, ‘‘১৮৮৫ সালে শ্যামপুকুর স্ট্রিটে প্রথম দোকান স্থাপিত হয়। অনেক পরে এই শ্যামবাজার, এন্টালি মার্কেট ও লালবাজারের দোকান তৈরি হয়। হাতিবাগানেও একটা দোকান ছিল। যার দোতলা ও তিনতলায় বসে খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। কানন দেবী, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে শুরু করে লালগোলা, বর্ধমান রাজবাড়িতেও আমাদের দোকানের শিঙাড়া, মিষ্টি ডেলিভারি করা হত। আমাদের শিঙাড়ার পুরে আলুর সঙ্গেই কাজু বাদাম পাবেন। একটু মিষ্টি মিষ্টি হয়। শীতে ফুলকপিও দেওয়া হয়।’’
সেখান থেকে দক্ষিণের দিকে আর একটু এগোলেই এভি স্কুলের গলিতে ঢুকে সোজা এগিয়ে গেলে ডান হাতে পড়বে প্রায় ৬৫ বছরের পুরনো ভবতারিণী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। ছোট্ট এই দোকানটির শিঙাড়ার চাহিদা হার মানাবে বড়-বড় দোকানকেও। এই দোকানের শিঙাড়া পেতে হলে সন্ধে ছ’টার মধ্যে যেতে হবে। না হলেই ঝুড়ি ফাঁকা।
তবে দক্ষিণ কলকাতার বুকে শিঙাড়ার মোহজাল বিস্তার করেছে মৃত্যুঞ্জয় ঘোষ অ্যান্ড সনস। পরাধীন ভারতে তৈরি এ দোকানে শিঙাড়া খেতে খেতেই মালিকের মুখে শুনে নিতে পারবেন পুরনো দিনের অজস্র গল্পগাথা। কথায় আছে না, শিঙাড়া ছাড়া কি আড্ডা জমে? এ দোকানে আড্ডা ছাড়া শিঙাড়া জমবে না। ১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই দোকান এখনও রমরমিয়ে শিঙাড়া বিক্রি করে চলেছে। বর্তমান মালিক সোমনাথ ঘোষের কথায়, ‘‘আমার দাদু মৃত্যুঞ্জয় ঘোষ এই দোকানের প্রতিষ্ঠাতা। সেই তখন থেকে এখনও একই পুর। জিরে, ধনে গুঁড়ো দিয়ে মশলাও তৈরি করা হয় দোকানেই। কালীপুজোর পর থেকে পয়লা বৈশাখ পর্যন্ত ছোট ছোট ফুলকপিও পাবেন শিঙাড়ায়। আধুনিক খাবারের ভিড়েও এর চাহিদায় ভাটা পড়েনি। এখনও রোজ ৪০০-৫০০ শিঙাড়া বিক্রি হয়।’’
আর আছে তিওয়ারি ব্রাদার্স। উঁহু, বাঙালি শিঙাড়া নয়। তবে ঘিয়ে ভাজা হালকা ঝালের এই শিঙাড়া মুখে দেওয়ার অপেক্ষা শুধু। যেমন মুচমুচে, তেমনই দেশি ঘিয়ের গন্ধ। তিওয়ারি ব্রাদারস অবশ্য অনেক শাখাপ্রশাখা বিস্তার করেছে কলকাতার বুকে। বড়বাজারেই এঁদের দু’টি দোকান, তা ছাড়াও দেখা মিলবে কাঁকুড়গাছির মোড়ে, মিন্টো পার্ক ও নিউ আলিপুরে। বর্তমান মালিক রামনাথ তিওয়ারি বললেন, ‘‘বাঙালি শিঙাড়ার চেয়ে আমাদের শিঙাড়া একদম আলাদা। বাঙালি শিঙাড়া ইস্ট হলে আমরা ওয়েস্ট। আমাদের বৈশিষ্ট্য এর পুরে। এলাচ, দারুচিনি সহ আরও অনেক মশলা বেটে আলু চটকে, ধনেপাতা, কড়াইশুঁটি মিশিয়ে পুর তৈরি করা হয়। প্রায় ৭৫ বছর হল আমাদের দোকানের।’’
তবে শুধু কলকাতাতেই এর বিস্তার কেন্দ্রীভূত নয়। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন রাজ্যেই শিঙাড়ার দেখা মিলবে। বাঁকুড়ার কেঞ্জাকুড়ায় দ্বারকেশ্বর নদীর তীরেও শীতকালে সকলে জমায়েত হয় মুড়ি মেলায়। সেখানেও ডজন ডজন শিঙাড়া গুঁড়িয়ে মুড়িতে মেখে খাওয়ার চল।
দেশি ঘিয়ে ভাজা হোক বা সাদা তেলে, শিঙাড়ার আবেদনে সাড়া দেননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। তাই বাঙালির গ্যাস, অম্বল, চোঁয়া ঢেকুর যতই থাকুক, শিঙাড়া ছিল, আছে এবং থাকবে।
শিঙাড়া তৈরির সহজপাঠ
উপকরণ: ময়দা ২ কাপ, বড় আলু সিদ্ধ ১ টি, কড়াইশুঁটি আধ কাপ, মৌরি আধ চা চামচ, গোটা জিরে আধ চা চামচ, ভাজা জিরে গুঁড়ো আধ চা চামচ, কাঁচা লঙ্কা ২টি, আদা বাটা ২ চা চামচ, দারচিনি গুঁড়ো ১ চা চামচ, নুন-চিনি স্বাদ মতো।
প্রণালী: ময়দায় সামান্য নুন ও পর্যাপ্ত পরিমাণে তেল দিয়ে ময়ান দিন। ফুলকপি ছোট টুকরো করে ভাপিয়ে নিন। তেল গরম হলে গোটা জিরে, মৌরি ও আদা বাটা ফোড়ন দিন। এর মধ্যে সব মশলা, ফুলকপি, কড়াইশুঁটি ও আলু দিয়ে ভাল করে নেড়ে নিন। ময়দা থেকে লেচি কেটে বেলে নিন। মাঝখান থেকে দু’ভাগে কেটে তিনকোণা করে মুড়ে পুর ভরে মুখ বন্ধ করে দিন। মাঝারি আঁচে ডুবো তেলে প্রায় পনেরো কুড়ি মিনিট ধরে ভাজতে হবে শিঙাড়া।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy