চলুন, টাইম মেশিনে চড়ে এক বার ফিরে যাওয়া যাক সেই দিনটায়।
২ নভেম্বর ১৯৫১, যে দিন কালীঘাট থেকে দক্ষিণেশ্বর— পুজো চড়ছে সকাল থেকেই। চায়ের দোকানে, রকের আড্ডায়, রেডিয়োর সামনে জমতে শুরু করেছে ভিড়। যেখানে আনন্দ থেকে উৎকণ্ঠা— আবেগের রামধনু খেলা করছে। প্রশ্ন উঠছে, তিনি কি পারবেন?
দিল্লি টেস্টে প্রথম দিন তিনি নামেননি। পরের দিন সবাইকে হতাশ করে পঙ্কজ রায় আউট হয়ে গিয়েছিলেন মাত্র ১২ রান করে। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে অভিষেক টেস্টে। হাহাকার উঠেছিল বঙ্গসমাজে— বাঙালিকে কি আর সুযোগ দেওয়া হবে? সে দিন বাঙালি ভালবেসে ফেলেছিল জর্জ ডাকওয়ার্থ নামের এক প্রাক্তন ইংরেজ ক্রিকেটারকে। ওই সময় তিনি বলেছিলেন, ছেলেটাকে সুযোগ দেওয়া উচিত, ওর মধ্যে মশলা আছে।
সুযোগ পেয়েছিলেন পঙ্কজ রায়। মুম্বইয়ে দ্বিতীয় টেস্টেই বঙ্গসমাজে আবেগের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে প্রথম বাঙালি টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে সেঞ্চুরি করেন তিনি। বৃদ্ধরা সে দিন কেঁদেছিলেন, তরুণরা গর্জন করে উঠেছিল— গর্ব করার মতো কাউকে আমরা পেয়ে গিয়েছি। সিরিজ়ের শেষ টেস্ট, তৎকালীন মাদ্রাজে আবার সেঞ্চুরি পঙ্কজ রায়ের। এবং বাঙালির শতরানের দৌলতে সেই প্রথম ইংল্যান্ডকে হারায় ভারত। পায় প্রথম টেস্ট জয়।
পরের ১০ বছরে পঙ্কজ রায় নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রাক সুনীল গাওস্কর যুগে ভারতের অন্যতম সেরা ওপেনার হিসেবে।
খেলেছেন ৪৩টি টেস্ট। পাঁচটি সেঞ্চুরি, গড় ৩২.৫৬, সর্বোচ্চ ১৭৩, মোট রান ২৪৪২। কিন্তু এই শুষ্ক পরিসংখ্যান দিয়ে কি পঙ্কজ রায়কে মাপা সম্ভব? এই ওপেনিং ব্যাটসম্যানের মূল্যায়ন করতে গেলে তলিয়ে যেতে হবে স্মৃতির সমুদ্রে। ডুব দিয়ে তুলে আনতে হবে এক বাঙালির লড়াইয়ের হারিয়ে যাওয়া গুপ্তধন। কলকাতা ময়দানে তাঁর এক সময়কার পরিচিত, ভক্ত, সতীর্থ, সন্তান, সকলের সঙ্গে কথা বলে উঠে আসছে সেই লড়াইয়েরই ছবি।
এসেছেন, তিনি এসেছেন...
ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসে পঙ্কজ রায় এক জন প্রহেলিকা হিসেবেই জায়গা করে নিয়েছেন। কখনও তিনি ভক্তদের আনন্দ দিয়েছেন, কখনও কষ্ট। কখনও ব্যর্থতার তীব্র স্রোতে ভেসে গিয়েছেন, কখনও বা সাফল্যের কঠিন শৃঙ্গে আরোহণ করেছেন। পঙ্কজ রায় সম্পর্কে মুস্তাক আলি একটা কথা বলতেন— ‘‘পঙ্কজ ইজ় আইদার নাম্বার ওয়ান, অর হি ইজ় নো ওয়ান ইন দ্য টিম।’’ অর্থাৎ হয় দলের এক নম্বর খেলোয়াড়, না হলে তিনি কোনও খেলোয়াড়ই নন!
বাঙালি ক্রিকেট মননে ঝড় তুলে আবির্ভাব হয়েছিল পঙ্কজ রায়ের। প্রবীর সেন, সুঁটে বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্মল চট্টোপাধ্যায়, কার্তিক বসুরা তখন ছিলেন। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেটের রাজপথে তাঁরা হাঁটতে পারেননি। যে পথে হেঁটেছিলেন পঙ্কজ রায়। আবির্ভাবেই রঞ্জি ট্রফিতে সেঞ্চুরি। কম্বাইন্ড ইউনিভার্সিটির হয়ে সফররত ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের ভয়ঙ্কর পেসারদের সামলে রান পাওয়া। স্বয়ং বিজয় মার্চেন্টের প্রশংসা আদায় করে নেওয়া। বাঙালি বুঝে গিয়েছিল, এ বার হয়তো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দাপিয়ে বেড়ানোর মতো একটা ছেলের সন্ধান পাওয়া গেল। শোনা যায়, পঙ্কজ রায়ের মধ্যে নিজের উত্তরসূরিকে দেখেছিলেন মার্চেন্ট। তিনিই নাকি উপদেশ দিয়েছিলেন, টেস্টে ওপেন করতে। এবং পঙ্কজ রায়ের প্রথম টেস্টেই তাঁকে নিয়ে ওপেন করেন মার্চেন্ট।
লড়াই মাঠে, মাঠের বাইরেও
এমন একটা সময়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রেখেছিলেন পঙ্কজবাবু, যখন বাঙালিকে কেউ আমলই দিত না। ওরা আবার ক্রিকেট খেলতে পারে নাকি— এমনই ধারণা ছিল মুম্বই, দিল্লির ক্রিকেট মহলের। পঙ্কজ-পুত্র এবং প্রাক্তন টেস্ট ক্রিকেটার প্রণব রায় বা পঙ্কজবাবুর সঙ্গে স্পোর্টিং ইউনিয়নের হয়ে ওপেন করা শিবাজি রায় এবং আরও কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় অবহেলার করুণ কাহিনি।
একটি বিদেশ সফরের ঘটনা। পঙ্কজ রায় তখন দামি ‘শেফার’ পেন ব্যবহার করতেন, যার ক্যাপটা ছিল সোনার। ওই সময়ের এক বিখ্যাত ক্রিকেটার সেই পেনটা চেয়ে নিয়েছিলেন। আর ফেরত দেননি। পরে এক বার পঙ্কজবাবু তাঁর প্রিয় পেনটা ফেরত চান। পেন ফেরত এলেও ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল অন্য জায়গায়। পরবর্তী কালে নির্বাচক প্রধান হয়ে যাওয়া ওই ক্রিকেটার বেশ কয়েক বার বিনা কারণে ভারতীয় দল থেকে পঙ্কজ রায়ের নামটা কেটে বাদ দিয়েছিলেন!
১৯৫৬ সালে মাদ্রাজে নিউজ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে বিনু মাঁকড়ের সঙ্গে ৪১৩ রানের ওপেনিং জুটি গড়ার পথে পঙ্কজ রায় থেমে গিয়েছিলেন ১৭৩ রানে। মাঁকড় ডাবল সেঞ্চুরি করেছিলেন। কিন্তু কেন সে দিন বঙ্গ ওপেনারের ব্যাট থেকে দ্বিশত রান আসেনি, তারও একটা কাহিনি আছে। দুই ওপেনারই তখন শাসন করছেন নিউজ়িল্যান্ডের বোলিং। ওই সময়ে ভারতীয় ড্রেসিংরুম থেকে একটা বার্তা আসে পঙ্কজবাবুর কাছে। তাতে লেখা ছিল, ‘হিট আউট। উই আর ডিক্লেয়ারিং সুন।’’ শোনা যায়, মুম্বইয়ের এক বিখ্যাত ক্রিকেটার এই নির্দেশ পাঠানোর পিছনে ছিলেন। ডিক্লেয়ার আসন্ন জেনে পঙ্কজবাবু মারতে গিয়ে আউট হন। এর পরে তাঁকে অবাক করে দিয়ে তিন নম্বরে নেমে পলি উমরিগর করেন ৭৯! প্রণব রায় বলছিলেন, ‘‘তখন মিডিয়া এত শক্তিশালী ছিল না। অনেক ভাবেই বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছিল বাবাকে। আর বোম্বে-দিল্লি লবি তো সেই সময়ে ভারতীয় ক্রিকেটে ছড়ি ঘোরাত।’’
সেই নিউজ়িল্যান্ড সিরিজ়ের কিছু আগে পঙ্কজবাবু আবিষ্কার করেন, তাঁর দেখতে সমস্যা হচ্ছে। বন্ধু চিকিৎসক পরীক্ষা করে দেখেন, চোখের পাওয়ার বেড়েছে। তাঁর পরামর্শেই শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে চশমা নেন পঙ্কজবাবু। যা নিয়ে হাসাহাসি শুরু হয় ভারতীয় ক্রিকেট মহলের একটা অংশে। কয়েক জন নামকরা ক্রিকেটার বলতে থাকেন, এ বার পঙ্কজ গেল। পঙ্কজবাবু কোথাও যাননি। ওই অবস্থায় নেমে নিউজ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে নিজের সর্বোচ্চ টেস্ট স্কোর এবং ওপেনিং জুটিতে বিশ্বরেকর্ড করেন।
বেদনায় ভরা মধুর স্মৃতি
বেতের চেয়ারে বসা শরীরটা একটু সোজা হয়ে উঠেছিল প্রশ্নটা শুনে। চশমার আড়ালেও দুটো চোখে ধরা পড়েছিল বিষণ্ণতার ছোঁয়া।
সময়টা ২০০০ সালের নভেম্বরের শুরুর দিকে। আর ক’দিন পরেই ঢাকায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে অভিষেক হবে দ্বিতীয় বাঙালির— সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের। তার আগে ভারতকে টেস্টে নেতৃত্ব দেওয়া প্রথম বাঙালি কি ভাবছেন?
উত্তর খুঁজতে গিয়েছিলাম কুমোরটুলি পার্কের কাছে অভয় মিত্র স্ট্রিটের সেই বাড়িতে। বেহালার গঙ্গোপাধ্যায় পরিবারের বাড়ির আগে বঙ্গ ক্রিকেটের তীর্থস্থান ছিল পুরনো কলকাতার ওই বসতবাড়িটাই— রায় বাড়ি। যে বাড়ির ছেলে ১৯৫৯ সালে লর্ডসে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্টে ভারতের হয়ে টস করতে নেমেছিলেন।
নিশ্চয়ই সুখস্মৃতিতে সমৃদ্ধ ওই সময়টা? পঙ্কজ রায় একটু হাসলেন। যে হাসিতে হাজার ওয়াটের আলো নেই, রয়েছে কিছুটা বিষণ্ণতার ছোঁয়া। পঙ্কজবাবু বলেছিলেন, ‘‘ভারতীয় ক্রিকেটে বাঙালির রাস্তায় কিন্তু কখনও গোলাপ বিছানো ছিল না। বরং বেশি করে সামলাতে হয়েছে কাঁটার আক্রমণ।’’
ইংল্যান্ডের ওই সফরের আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের ভয়াল পেস আক্রমণ সামলে রান করেছিলেন পঙ্কজবাবু। মনে করা হচ্ছিল,তাঁর হাতেই হয়তো ভারতীয় দলের নেতৃত্ব তুলে দেওয়া হবে। কিন্তু দেখা যায় দত্তাজিরাও গায়কোয়াড়কে অধিনায়ক বেছে নেওয়া হয়। যিনি ক্রিকেট জীবনের শেষে ১১টির বেশি টেস্ট খেলতে পারেননি। পঙ্কজবাবুকে করা হয় সহ-অধিনায়ক।
এর নেপথ্যে লুকিয়ে আছে অনেক বঞ্চনার ইতিহাস। ১৯৫৯ সালে ইংল্যান্ড সফরের ঠিক আগে টাকার বিচারে পাউন্ডের দাম বেড়ে যায়। অর্থাৎ ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের খরচও বৃদ্ধি পায়। শোনা যায়, ওই সময়ে বাড়তি খরচের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন তৎকালীন বরোদার মহারাজ। কেউ কেউ বলেন, তাঁর নাকি দুটো শর্ত ছিল। এক, তাঁকে দলের ম্যানেজার করতে হবে। দুই, বরোদারই ক্রিকেটার গায়কোয়াড়কে করতে হবে অধিনায়ক। গায়কোয়াড় তখন গোটা ছয়-সাতেক টেস্ট খেলেছিলেন। ভাবতেও পারেননি, অধিনায়ক হয়ে যাবেন। সে কথা গায়কোয়াড় বলেওছিলেন পঙ্কজবাবুকে। কিন্তু রাজপরিবারের একটা যোগসূত্র থাকায় গায়কোয়াড়ের মাথাতেই অধিনায়কের মুকুট পরিয়ে দেওয়া হয়। লর্ডস টেস্টের আগে অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিনি মাঠেই নামতে পারেননি। নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ আসে পঙ্কজ রায়ের কাছে।
২০০১ সালে, ৭২ বছর বয়সে পঙ্কজ রায়ের মৃত্যুর পরে ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এ তাঁকে নিয়ে একটা লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। যেখানে ‘উইজ়ডেন’-কে উদ্ধৃত করে লেখা হয়, ‘‘গায়কোয়াড়ের বদলে পঙ্কজ যখন ভারতকে নেতৃত্ব দেন, তখন দলকে অনেক ছন্দোবদ্ধ দেখিয়েছিল। দলের সিনিয়র সদস্যদের সঙ্গে অনেক বার আলোচনা করতে দেখা গিয়েছিল পঙ্কজকে, যা নিঃসন্দেহে ভারতকে সাহায্য করেছিল।’’
সেই লর্ডস টেস্টে ভারত একটা সময়ে ভাল জায়গাতেই ছিল। প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ডের একশো রানে সাত উইকেটও পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু দলীয় রাজনীতির শিকার হতে হয় অধিনায়ক পঙ্কজ রায়কে। এখনও কেউ কেউ আক্ষেপ করেন, ওই সময়ে ইচ্ছাকৃত ক্যাচ না ফেললে ভারত হয়তো টেস্টটা হারত না।
বাংলার এক লৌহমানব
পঙ্কজ রায়ের ক্রিকেট পরিসংখ্যানে চোখ বোলানোর আগে তিনি কাদের বিরুদ্ধে ব্যাট করেছেন, সেটা দেখে নেওয়া উচিত। কয়েক জনের নাম বললেই ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। ইংল্যান্ডের ব্রায়ান স্ট্যাথাম, ফ্রেডি ট্রুম্যান। ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের ওয়েসলি হল, রয় গিলক্রিস্ট, চার্লি গ্রিফিথ। অস্ট্রেলিয়ার রে লিন্ডওয়াল।
তখন স্পিডোমিটার ছিল না। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, বেশির ভাগ বলের গতিই নব্বই মাইলের উপরে থাকত। শিবাজিবাবু বলছিলেন, ‘‘পঙ্কজদা খুব ফরসা ছিলেন। কয়েক বার দেখেছি, ব্যাট করে ড্রেসিংরুমে আসার পরে যখন উনি জার্সিটা খুলেছেন, গায়ে লাল-লাল দাগ হয়ে গিয়েছে। ক্যারিবিয়ান পেসারদের মধ্যে তখন যে-ই বল করত, ঘণ্টায় নব্বই মাইলের উপরে গতি থাকত। বুক চিতিয়ে সেই গতি সামলেছেন পঙ্কজদা।’’ বাংলার রঞ্জিজয়ী অধিনায়ক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ, ‘‘তখন কাটা গ্লাভস পরে খেলতে হত ব্যাটসম্যানদের। এখনকার মতো আধুনিক গ্লাভস নয়। আঙুলের উপরে শুধু একটা কাপড়ের আস্তরণ লাগানো থাকত। ওই সময় ব্যাটসম্যানদের হাতে বল লাগলে আর দেখতে হত না।’’
গত দশ বছর ধরে যাঁরা ক্রিকেটের খবর রাখেন, তাঁরা ভালই জানেন, এই সময়ে কত ব্যাটসম্যানের মাথায় বল লেগেছে। সেই তালিকায় আছেন বিশ্বের অন্যতম সেরা দুই ব্যাটসম্যান, বিরাট কোহালি, স্টিভ স্মিথও। বাউন্সারের আঘাতে অস্ট্রেলিয়ার ফিল হিউজের মর্মান্তিক মৃত্যুর পরে আইসিসি ‘কনকাসন সাবস্টিটিউট’ নিয়ম চালু করেছে। মাথায় বল লাগলে সেই ব্যাটসম্যান এখন উঠে যেতে পারেন, তাঁর জায়গায় নামতে পারেন নতুন কেউ। পঙ্কজ রায়ের জমানায় বল মাথায় লাগলে কী হত? ভারতীয় দলে তাঁর একদা সতীর্থ চাঁদু বোর্দের সাফ মন্তব্য, ‘‘আর নামার উপায় থাকত না। সোজা হাসপাতাল, সেখান থেকে কী হত, বলা যায় না।’’
রক্ত চাই রক্ত
আইসিসির কড়া নজরদারিতে এখন ফাস্ট বোলারদের হাতে হাতকড়া পড়ে গিয়েছে। ওভার পিছু বাউন্সারের সংখ্যা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। ডন ব্র্যাডম্যানের বিরুদ্ধে ডগলাস জার্ডিনের সেই শরীর লক্ষ করে ধেয়ে আসা ‘বডিলাইন থিয়োরি’ অবলুপ্ত। পিচ এখন ঢাকা থাকে। উইকেট ভিজে যাওয়ার আশঙ্কা নেই। কিন্তু পঙ্কজ রায়ের আমলে সেই আশঙ্কা ছিল। আর ছিল রয় গিলক্রিস্ট নামের ফাস্ট বোলার।
১৯৬২-৬৩ মরসুমে ভারতীয় বোর্ডের আমন্ত্রণে চার ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ফাস্ট বোলার এ দেশে এসেছিলেন চারটি রাজ্যের হয়ে খেলার জন্য। বিসিসিআইয়ের লক্ষ্য ছিল, আগুনে গতির বিরুদ্ধে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের তৈরি করে দেওয়া। আর গিলক্রিস্টের লক্ষ্য ছিল, যত বেশি সম্ভব ব্যাটসম্যানকে হাসপাতালে পাঠানো।
ষাটের দশকে বাংলার যে সব ক্রিকেটার গিলক্রিস্টকে দেখেছেন, তাঁরা একটা ব্যাপারে একমত ছিলেন। উইকেট নেওয়ার চেয়ে ব্যাটসম্যানকে হাসপাতালে পাঠানোর দিকেই এই ক্যারিবিয়ান পেসারের বেশি নজর থাকত।
আর পঙ্কজ রায়কে একটু বেশিই ‘ভালবাসতেন’ এহেন গিলক্রিস্ট। তার একটা কারণ অবশ্য ছিল। হল-গিলক্রিস্টকে সামলে টেস্ট ক্রিকেটে বেশ কিছু ভাল ইনিংস খেলেছিলেন এই অকুতোভয় ওপেনার। যে রাগটা মনে মনে পুষে রেখেছিলেন গিলক্রিস্ট।
হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে রঞ্জি ট্রফির কোয়ার্টার ফাইনাল। ১৯৬৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। পঙ্কজবাবুর ক্রিকেট জীবন তখন সায়াহ্নে। ভারতীয় দলে সুযোগ হচ্ছে না। কেউ সে রকম আমল দিচ্ছে না। ওই সময়ে নিজের ক্রিকেট জীবনের অন্যতম দুটো সেরা ইনিংস ইডেনের বুকে খেলেছিলেন তিনি।
ওই ম্যাচের প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বললে জানা যায়, কতটা আগ্রাসন নিয়ে সে দিন খেলতে নেমেছিলেন গিলক্রিস্ট। ম্যাচ শুরুর আগে লাল বলটা নাচাতে নাচাতে কয়েক জনকে নাকি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘আই নো দ্য বল ইজ় হার্ড। বাট ইজ় ইট হার্ড এনাফ টু কিল পঙ্কজ?’’ মোদ্দা কথায় গিলক্রিস্টের প্রশ্ন ছিল, ‘‘জানি, বলটা শক্ত। কিন্তু পঙ্কজকে মারার মতো শক্ত কি?’’ এ হেন গিলক্রিস্টকে সামলে সে দিন পঙ্কজ রায় ওপেন করতে নেমে প্রথম ইনিংসে ১১২ এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ১১৮ করেছিলেন। বাংলাও জিতেছিল ১৮৪ রানে। ওই দুটো সেঞ্চুরির পরেও অবশ্য আর জাতীয় দলে সুযোগ হয়নি তাঁর। কিন্তু নিঃসন্দেহে ক্রিকেট রূপকথায় জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন বাংলার লৌহমানব।
উত্থান-পতনের ইতিহাস
পঙ্কজ রায়ের ক্রিকেট জীবন অনেকটা ফুঁসতে থাকা সমুদ্রের বুকে লড়তে থাকা জাহাজের মতো। কখনও উঠছে, কখনও পড়ছে। তিনি যখন ছন্দে থাকতেন, বিষাক্ত ফাস্ট বোলারদের সামলে দিতেন। হল-গিলক্রিস্টদের বিরুদ্ধে হুক শটটা কাজে লাগাতেন। যে শট খেলতে শুধু ক্রিকেটীয় দক্ষতা থাকলেই চলত না, বুকের পাটাও লাগত। বল ফস্কালে সোজা মাথায়। এবং তার পরে কী হবে, কেউ ভাবতে চাইত না।
আবার খারাপ ফর্ম চললে এক সিরিজ়ে পাঁচটা শূন্য করার রেকর্ডও আছে তাঁর। কখনও তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, ফাস্ট বোলিংয়ের বিরুদ্ধে লেগসাইডে সরে গিয়ে আত্মরক্ষা করার। শোনা যায়, ১৯৫৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ় সিরিজ়ে মুম্বই টেস্টের আগে আমদাবাদে একটা ম্যাচ ছিল। যেখানে হল-গিলক্রিস্টদের বিরুদ্ধে খেলতে নেমে নাকি উইকেট ছেড়ে বারবার সরে যাচ্ছিলেন পঙ্কজ রায়। যা দেখে ক্ষুব্ধ হন স্বয়ং বিজয় মার্চেন্ট। পরে পঙ্কজবাবু ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, টেস্টের আগে কোনও ঝুঁকি নিতে চাননি তিনি। পরের মুম্বই টেস্টেই বঙ্গ ওপেনার খেলেছিলেন সম্ভবত তাঁর টেস্ট জীবনের সেরা ইনিংস। সেই ভয়ঙ্কর হল-গিলক্রিস্টকে সামলেই ম্যাচ বাঁচানো ৯০।
টেস্ট জীবনে ঘরের মাঠে অভিষেকে দুরন্ত পারফরম্যান্সের পরে ইংল্যান্ডে গিয়ে হতাশ করেন পঙ্কজ। ১৯৫২ সালের সেই সফরে পাঁচটি শূন্য করেন তিনি। যা শুধু তাঁকেই নয়, ক্ষতবিক্ষত করেছিল তাঁর ভক্তদেরও। কিন্তু পঙ্কজ ফিরে এসেছিলেন পরের ওয়েস্ট ইন্ডিজ় সফরে। সাবাইনা পার্কে তাঁর দু’ইনিংসে করা ৮৫ এবং ১৫০ রানের ইনিংস ছিল বীরত্বের রসে ভরা। যা ভারতকে টেস্ট বাঁচাতে সাহায্য করেছিল।
এর পরে আসে ১৯৫৬ সালের সেই বিখ্যাত নিউজ়িল্যান্ড সিরিজ়। বিনু মাঁকড় আর পঙ্কজ রায়ের ওপেনিং জুটিতে ওঠে ৪১৩ রান। যে বিশ্বরেকর্ড অক্ষত ছিল ৫৩ বছর। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে ৪১৫ রান করে যে রেকর্ড ভাঙেন দক্ষিণ আফ্রিকার গ্রেম স্মিথ এবং নিল ম্যাকেঞ্জি।
১৯৫৯ সালে ইংল্যান্ড সফরে দেশকে প্রথম বার নেতৃত্ব দিলেও ওই সফর দুঃস্বপ্নের হয়েছিল ভারতের কাছে। দেশে ফিরে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ৯৯ এবং ৫৭ রানের ইনিংস পাওয়া গিয়েছিল তাঁর ব্যাট থেকে। এর পরে ১৯৬০ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্রেবোর্ন স্টেডিয়ামে ২৩ রানের ইনিংস দিয়ে শেষ হয় পঙ্কজ রায়ের টেস্ট জীবন।
পঙ্কজ হয়ে ওঠার নেপথ্যে
বোলিং মেশিনের কথা তখন শোনা যেত না। ভিডিয়ো অ্যানালিস্ট বলে কিছু হতে পারে, এমনটা ভাবাই যেত না। নেটে থ্রো-ডাউন বিশেষজ্ঞ কোনও দিন দেখা যাবে, পঞ্চাশ বা ষাটের দশকের কল্পবিজ্ঞানের লেখকরাও তা ভাবেননি! তা হলে কী ভাবে দুনিয়া কাঁপানো সব ফাস্ট বোলারের বিরুদ্ধে তৈরি হতেন পঙ্কজবাবুরা?
অধ্যবসায়, সাহস, শেখার আগ্রহ আর প্রতিভা— এই ছিল তখনকার ক্রিকেটারদের অস্ত্র। স্পোর্টিং ইউনিয়নের নেটে অনুশীলন করতেন বঙ্গ ক্রিকেটের ওই সময়কার সুপারস্টার। সেই অনুশীলন ছোট থেকেই দেখেছেন বাংলার প্রাক্তন ক্রিকেটার শিবাজি রায়। সঙ্গীও হয়েছিলেন পরের দিকে। তাঁর অভিজ্ঞতার ঝাঁপি খুঁজলে উঠে আসে লোহা পিটিয়ে লৌহমানব হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনি।
ভোরবেলা কুমোরটুলি থেকে নিজের বিএমডব্লিউ বাইকে চেপে ময়দানে আসতেন। একা রেড রোডে কয়েক পাক দৌড়ে স্পোর্টিং ইউনিয়ন তাঁবুতে চলে আসতেন পঙ্কজবাবু। নিজেই জোগাড় করে ফেলতেন ময়দানের কয়েক জন পেস বোলারকে। তার পরে তাঁদের হাতে বল তুলে দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলত ব্যাটিং অনুশীলন। কঠোর অনুশীলন শেষে বোলারদের খাবারের ব্যবস্থা করে দিতেন পঙ্কজবাবু। শোনা যায়, একই রকম অধ্যবসায় ছিল তাঁর ফিল্ডিং অনুশীলনেও। একনিষ্ঠ ভাবে স্টাম্পে বল ছুড়ে চলত তাঁর ফিল্ডিং প্র্যাক্টিস। মনে রাখতে হবে, তখন ফিল্ডিংয়ের জন্য বিশেষ নম্বর ছিল না ভারতীয় দলে। কিন্তু সেখানেও কোনও রকম আপস করেননি তিনি।
পঙ্কজবাবুর শেখার আগ্রহ নিয়ে একটা ঘটনার কথা বলছিলেন পুত্র প্রণব। সেটা সেই ইডেনে গিলক্রিস্টের হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক ম্যাচ। বাংলার ইনিংস চলছে। চা বিরতির সময়ে অপরাজিত পঙ্কজ রায় ব্যাট হাতে ড্রেসিংরুমের দিকে আসছেন। হঠাৎ দেখা হয়ে যায় তাঁর ছাত্রজীবনের এক মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে। ক্রিকেটে নিবেদিত প্রাণ সেই মাস্টারমশাই বোঝাতে লাগলেন, আরও কী ভাবে উন্নতি করতে পারেন তাঁর ‘ছাত্র।’ পুরো চা বিরতির সময়টা দাঁড়িয়ে মাস্টারমশাইয়ের কথা শুনলেন তিনি। তার পরে ড্রেসিংরুমে না ঢুকেই আবার ফিরে গেলেন মাঠে। প্রণব বলছিলেন, ‘‘এতটাই শেখার আগ্রহ ছিল বাবার। যে যা বলতেন, সব কিছু গ্রহণ করার চেষ্টা করতেন।’’
ক্রিকেটের বাইরের জগৎ
পঙ্কজ রায় মানে কিন্তু শুধুই ক্রিকেটার নয়। যাঁরা তাঁকে চিনতেন, তাঁরা সবাই একবাক্যে একটা কথাই বলেন— পঙ্কজদা ছিলেন অলরাউন্ড স্পোর্টসম্যান। তিনি আইএফএ দলের হয়ে তৎকালীন বর্মার বিরুদ্ধে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। কলকাতায় প্রথম ডিভিশন ফুটবল চুটিয়ে খেলেছেন। রাইফেল শুটিংয়ে সর্বভারতীয় র্যাঙ্কিংয়ে তিন নম্বরে উঠেছিলেন। দারুণ টেবল টেনিস খেলোয়াড় এবং সাঁতারু ছিলেন। ভাল শিকারও করতেন। একটাই আক্ষেপ ছিল পঙ্কজবাবুর। কোনও দিন বাঘ শিকার করতে পারেননি! সেই আক্ষেপ অবশ্য মিটিয়ে নিয়েছিলেন ক্রিকেটের বাইশ গজে!
কলকাতা ফুটবল লিগে প্রথম ডিভিশনে স্পোর্টিং ইউনিয়নের হয়ে খেলার সময়ে এক বার ধর্মসঙ্কটে পড়ে যান পঙ্কজবাবু। রায়বাড়ি ইস্টবেঙ্গলের পাগল সমর্থক। আর সে দিন পঙ্কজবাবুদের স্পোর্টিং ইউনিয়নের খেলা পড়ে গিয়েছে ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গেই। স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে প্রণব বলছিলেন, ‘‘আমার ঠাকুর্দার মতো বড় ইস্টবেঙ্গল সমর্থক বোধ হয় কেউ ছিলেন না। উনি ফতোয়া দিলেন, পঙ্কজ আজ ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে মাঠে নামবে না।’’ কিন্তু পঙ্কজবাবু তো আর ঘরে বসে থাকার ছেলে নন। তিনি ক্লাবে চলে গেলেন। মাঠে নামলেন এবং ভয়ঙ্কর একটা কাণ্ডও করে বসলেন। মানে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে গোল করে দিলেন! ব্যস, যায় কোথায়। বাবার হুঙ্কার, ছেলে বাড়ি ফিরলে পিঠের চামড়া তুলবেন। তার পরে কী হল? প্রণব রায়ের কথায়, ‘‘ঠাকুমা এবং মা মিলে কোনও মতে সে দিন পিছনের দরজা দিয়ে বাবাকে বাড়িতে ঢোকাতে পেরেছিলেন।’’
মনে কি থাকবে তাঁকে
বাঙালির কাছে আজ ১৯৫১ সালের ২ নভেম্বর দিনটার বিশেষ কোনও তাৎপর্য নেই। হয়তো ২০০১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি দিনটাও ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে স্মৃতির গহ্বরে। যে দিন পঙ্কজ রায় চলে গিয়েছিলেন পৃথিবী ছেড়ে।
শূন্য থেকে পূর্ণ। আবার পূর্ণ থেকে শূন্য। এই বৃত্তের মধ্যেই আটকে আছেন পঙ্কজ রায়। বাংলার প্রথম ক্রিকেট-যোদ্ধা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy