Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Paintings

‘বিন্দু’ থেকে সিন্ধুতে উত্তরণ: চিত্রশিল্পের এস এইচ রাজা

কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি (কেসিসি) সৈয়দ হায়দর রাজার ২১টি বিভিন্ন মাধ্যমের চিত্রে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাল ‘রাজা ফেস্টিভ্যাল’ নামে।

বিমূর্ত: সৈয়দ হায়দর রাজার চিত্রকর্মের প্রদর্শনী

বিমূর্ত: সৈয়দ হায়দর রাজার চিত্রকর্মের প্রদর্শনী

অতনু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০২২ ০৭:৩০
Share: Save:

সৈয়দ হায়দর রাজা (১৯২২-২০১৬) ভারতবর্ষের এক মহান অবিসংবাদী চিত্রশিল্পী। বিগত সাতটি দশক তিনি ফ্রান্সে থেকেও ভারতীয় শিল্পকলার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে যোগাযোগ রেখেছিলেন। তাঁর শিল্পবৈশিষ্ট্যের দিকটি যথেষ্ট শ্লাঘাময় ও অর্থবহ। তাঁর কাজের অনন্য সব বাঁক ও মোড় বারবার তাঁর দর্শনগত ভাবনা, মনস্তত্ত্বের নিবিড় এক অনুসন্ধিৎসার কথা স্মরণ করায়। তাঁর ‘সৌরাষ্ট্র’ নামাঙ্কিত চিত্রকলাটি বিশ্বখ্যাত ‘ক্রিস্টি’র নিলামে ১৬.৪২ কোটি টাকায় বিক্রি হয়ে যায়। এক ধরনের এক্সপ্রেশনিস্টিক ল্যান্ডস্কেপ পেন্টিংয়ের অনিন্দ্য ধারণাকে রাজা তাঁর স্টাইলে প্রথম দিকে রূপাপোপিত করেন। পরবর্তী সময়ে বিমূর্তায়নের প্রাথমিক গণ্ডি পার হয়ে, নিজের এক অসাধারণ চিত্রভাষা তৈরি করেন। আরও বেশি বিবর্তিত হতে হতে, তাঁর চিত্রে ঘোরতর বিমূর্ততা লক্ষ করা যায়। ছবিতে ভারতীয় শাস্ত্র ও তন্ত্রের এক নিবিড় সমন্বয় অন্তর্ভুক্ত হয়। যেখানে কিছু প্রতীক, চিহ্ন, রূপক হিসেবেও কখনও তাঁর বিমূর্ত চিত্রে আত্মপ্রকাশ করেছিল।

কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি (কেসিসি) সৈয়দ হায়দর রাজার ২১টি বিভিন্ন মাধ্যমের চিত্রে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাল ‘রাজা ফেস্টিভ্যাল’ নামে। এখানে ছোট্ট প্রশ্ন থেকেই গেল যে, এর ১৪টি ছবিই ‘প্রিন্ট অন ক্যানভাস’। তাঁর নিজস্ব রং-তুলির টানটোনের সেই অরিজিনালিটি কিন্তু দেখা গেল না। তবে ৭টি সেরিগ্রাফ আছে কাগজে। রাজা ১৯৬২-তে আমেরিকার বার্কলের ক্যালিফর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতে ভিজ়িটিং লেকচারার হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার বছর ১৫ আগেই ‘বম্বে প্রোগ্রেসিভ আর্টিস্টস গ্রুপ’ প্রতিষ্ঠা করেন। পাশে পেয়েছিলেন এফ এন সুজা, কে এইচ আরা প্রমুখকে।

প্রদর্শনীর চিত্রকর্মগুলি ১৯৫৯ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যকার। রাজার ছবিতে কালার, কালার-হারমনি, ফর্ম, ডিজ়াইন, এক্সপ্রেশন অব টোটালিটি, অ্যারেঞ্জমেন্ট, অ্যাবস্ট্রাকশন, কোয়ালিটি অব ডায়মেনশনাল ট্রিটমেন্ট, জিয়োমেট্রি, কালার ব্যালান্স ও এক্সপেরিমেন্টাল ভেরিয়েশন ইত্যাদি প্রতিটি ছবির প্রাণ। আলাদাভাবে প্রত্যক্ষ করলে বোঝা যায়, কোন ধরনের বিমূর্ততা তাঁর এক্সপ্রেশনিস্টিক স্টাইল থেকে ধীরে ধীরে একটা নির্দিষ্ট ভাবনায় পরিচালিত হচ্ছে। রূপের সংকেত থেকে প্রতীকী তাৎপর্য রূপক হিসেবে প্রতিভাত হয়েও কতটা সাংকেতিক আবহে মিশে যাচ্ছে, রাজা তাঁর কাজগুলিতে নির্দিষ্টভাবে তা-ও বুঝিয়েছেন। তাঁর ওই বাস্তবসম্মত এক পরিমিত অ্যারেঞ্জমেন্টও যেন তখন মনে হয় কম্পোজ়িশনের ক্ষেত্রে তা কতটা সায়েন্টিফিক। শিল্পী নিজেকে সংযত রেখে, ভাঙাগড়ার খেলায় যে-সব ‘পয়েন্ট অফ ইন্টারেস্ট’-এর স্থানগুলিকে দর্শকের চোখে নিবিষ্ট করেছেন, সেখানেও কাব্যময় এক আধুনিকতাকে প্রত্যক্ষ করা যায়। যা তাঁর ভালবাসাময় প্রশ্রয়। সে তাঁর কাগজে করা সেরিগ্রাফগুলিতেই হোক বা চিত্রিত ক্যানভাসেই হোক।

বর্ণোচ্ছ্বাসের বাহুল্যহীন বাহুল্যের একটা সীমানাকে তিনি প্রত্যক্ষ করান। যেখানে পটভূমির প্রধান রূপ, যা তন্ত্রময় বা শাস্ত্রীয় অনুপুঙ্খের সঙ্গে এক রকম ভাবে বর্তুলাকার ছন্দের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলে ওই বর্ণবৈচিত্রের ভারসাম্য। আবার ছোট ভার্টিকাল বা হরাইজ়ন্টাল লাইনের সাদা-লাল বর্ণের উপরিভাগে অপেক্ষাকৃত দৃঢ় ও আয়তক্ষেত্রসদৃশ সাদা অংশটি গোটা ছবিটিকে চিহ্নিত করছে আর একটি নির্দিষ্ট প্রতীক হিসেবে। ‘ব্ল্যাক সান’ সেই হিসেবে রচনাগত ভাবে তাই কিছু প্রশ্ন তুলেও দেয়।

কালার হারমনি ও কালার ব্যালান্স যখন একটি জ্যামিতিক পরিসরে নিজেদের অস্তিত্বকে নিবিড় ভাবে প্রতিপন্ন করে, ‘আরম্ভ’ নামের সেই ক্যানভাস তখন দর্শকের চোখ দীর্ঘক্ষণের জন্য অধিকার করে নেয়। এখানে ঘন রক্তবর্ণ ঘোর কালোর সঙ্গে জ্যামিতিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়েও, অন্য দু’-তিনটি অপেক্ষাকৃত আপাত হালকা ও গাঢ় বর্ণের এক ধরনের ম্যাজিকে রূপান্তরিত হয়ে যায়। অসাধারণ একটি কাজ। যেমন ‘জার্মিনেশন ব্ল্যু’। এখানে জ্যামিতি, নীল গাঢ় কালচে বর্ণ ও নিম্নমুখী একটি কৌণিক গতির মধ্যে ছন্দোময় অ্যারেঞ্জমেন্টটি এক ভিগনেটিক মোহময় আবহ তৈরি করেছে। আর সবটাই হরাইজ়ন্টাল সরু ব্রাশিং, বাঁ দিক থেকে ডানদিকে পরপর নিম্নমুখী ফর্মেশনে আশ্চর্য আলোর সূত্রটিকে মহিমান্বিত করছে। রাজা তাঁর এই আশ্চর্য সব কম্পোজ়িশনগুলিতে নিজের বাস্তবতার ‘আর্ট অব মিরাকল’কেই যেন প্রতীকায়িত করেছেন। যেমন ‘অঙ্কুরণ’ অনন্যসাধারণ একটি কাজ।

তাঁর ‘তৃষ্ণা-২’, ‘ওয়েসিস’, বিমূর্ত ‘রাজস্থান’, ‘স্বস্তি’, ‘দ্য ভিলেজ’, ‘সাতপুরা’, ‘সৌরাষ্ট্র’, ‘বিন্দু’, ‘রঙরস’ কাজগুলি যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য। এই রাজাও কি কোথাও কোথাও মনে পড়িয়ে দেন না বিমূর্ত নিসর্গের রামকুমার গায়তোন্ডেকে? অবশ্যই দেন।

রাজা বিশ্বব্যাপী ঘুরেছেন (১৯৫০-১৯৫৩) প্যারিস ফ্রান্স সরকারি বৃত্তিতে। দু’টি প্রজন্মকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। ভারতীয় দর্শন-সংস্কৃতির মধ্যে আবদ্ধ তাঁর কাজ। ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান ‘লেজিয়ঁ দ’নর’-এ ভূষিত হয়েছিলেন। পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ, কালিদাস সম্মান (মধ্যপ্রদেশ), পদ্মশ্রী, ললিতকলা পুরস্কার ও অন্যান্য বহু পুরস্কারে সম্মানিত শিল্পী প্রয়াত হন ৯৪ বছর বয়সে।

অন্য বিষয়গুলি:

Paintings Art
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy