ছকভাঙা: সোসাইটি অব কনটেম্পোরারি আর্টিস্টসের দলীয় প্রদর্শনীর কাজ
প্রতিষ্ঠা ১৯৬০-এর ১২ অগস্ট। সেই হিসেবে ষাট বছর পূর্তির আয়োজনের প্রাক্কালে ঊনষাটেই তাঁদের ষাটের আগমনী বার্তার সম্মানে নিজস্ব গ্যালারিতে সোসাইটি অব কনটেম্পোরারি আর্টিস্টসের দলীয় প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন আকার প্রকার কর্তৃপক্ষ।
এক সময়ে ভারতের নক্ষত্রপ্রতিম শিল্পীরা ছিলেন এই দলের সদস্য। পূর্বসূরিদের সমস্ত স্মৃতিকে আগলে, তাঁদের কাজের বিভিন্ন সুদৃশ্য অ্যালবাম, গ্রন্থ, বিদেশি ক্যাটালগের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া প্রকাশনা, প্রয়াতদের স্মরণে ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’র মতো অসাধারণ পাবলিকেশন— ভারতে অন্তত আর কোনও শিল্পী গোষ্ঠী এ ভাবে প্রকাশ করেনি। আকার প্রকারে তিন দিন ও সোসাইটির নিজস্ব গ্যালারিতে বাকি দিনগুলিতে আয়োজিত প্রদর্শনীটি সদ্য শেষ হল।
বর্তমান প্রদর্শনীতে বাইশ জনের ৭৮টি শিল্পকর্ম ছিল। প্রবীণ দীপক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৩৪ বছর আগের রঙিন ইন্টাগ্লিয়ো-টি বেশ চমৎকার। সাদাকালো জলরঙে নিসর্গকে অত্যন্ত সরলীকরণের মাধ্যমে ব্রাশের দ্রুত ও সন্তর্পণ টানটোনে আধুনিকতার এক কাব্যিক অধ্যায় তৈরি করেছেন গণেশ হালুই। সনৎ করের তিনটি রেখাধর্মী লিথো ও এচিং প্রাণবন্ত। বোর্ডে অ্যাক্রিলিক ও ক্রেয়নে মনু পারেখ দেখিয়েছেন বিমূর্ততার স্পন্দনকে এক ছন্দোবদ্ধ সমীকরণের মধ্যে, যা কবিতার মতোই। তাঁর দর্শন ও মনস্তত্ত্বের গভীরে ওই রক্তিম অনুষঙ্গের মতো নির্দিষ্ট অন্বেষণে কুসুমসূত্রকে পরিস্ফুট করে। কামসূত্র ও জন্মক্ষণের এও এক উপলব্ধি। যা একই সঙ্গে প্রতীকী।
নিরঞ্জন প্রধানের ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যে ষাঁড়ের রূপারোপ এবং আশ্চর্য দীর্ঘায়িত ছন্দোময় ফর্মেশন অনন্য। জড়ানো দু’টি হাতও বেশ সংবেদন আনে। মানিক তালুকদারের চারটি ভাস্কর্যই নিজস্ব এক স্টাইলকে প্রতিপন্ন করছে। সবই ব্রোঞ্জ। বরাবরই পাথর ও ব্রোঞ্জকে সম্মিলন করে সুনীলকুমার দাস ভাস্কর্য গড়েন। এ বার তিনি সুচারু আধুনিকতায় ভলিউম ও রচনার গুণকে প্রাধান্য দিয়েছেন। লালুপ্রসাদ সাউ বোর্ডে টেম্পারায় চিরাচরিত স্টাইলে রঙিন বাবু-বিবিকে উপস্থাপন করেছেন। ড্রয়িংয়ের তুলনায় পঙ্কজ পানোয়ারের পলিয়েস্টার রেজ়িনের ভাস্কর্যটি শাখাপ্রশাখার এলোমেলো বিস্তার।
কালো পটভূমির চারটি মুখোশসদৃশ মুখ জুড়ে ক্ষতচিহ্ন, ছড়ানো ছিটোনো কালো, মানচিত্রের ড্রয়িং, আলো-আঁধারি আখ্যানে এমন ভাবেই ড্রাগাসক্তদের নিয়ে একটি সিরিজ় করেছেন আদিত্য বসাক। ভিন্ন একক অভিব্যক্তি, রূপকধর্মী স্টাইল ভাবনাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে।
মনোজ মিত্র অসাধারণ জলরঙে দু’টি মার্জার-মুহূর্তের খেলা ও অপেক্ষা দেখিয়েছেন। স্টাইল-টেকনিকের প্রতিচ্ছায়ায় বিভ্রমের মায়াজাল টেক্সচারের সন্নিবদ্ধ মগ্নতার কথা বলে। অন্য দু’টি তুলনায় দুর্বল।
অতিরঞ্জিত ডিজ়াইনধর্মী সচিত্রকরণের মতো কাজ মনোজ দত্তের। আক্রান্ত বাংলা ভাষার বর্ণপরিচয়ের সমস্যা নিয়ে বিমল কুণ্ডু ভাস্কর্যে বেশ অন্য রকম কাজ করেছেন। মুখে প্রথম স্বরবর্ণটি নিয়ে মসৃণ মুখের বিদ্যাসাগরের মূর্তির দিকে উঠে যাচ্ছে এক অজগর। ‘সরি, ভেরি সরি, এক্সট্রিমলি সরি’ একটি সিরিজ় যেন। অন্যগুলি যথাযথ। চুলের বাহুল্য ও বীভৎসতায় নগ্ন মানবী, পশু ইত্যাদিকে নিয়ে এক ধরনের সদবাস্তববাদকে প্রশ্রয় দিয়েছেন শ্রীকান্ত পাল। খয়েরি বর্ণের ড্রাই পয়েন্টে তাঁর সূক্ষ্ম কাজগুলি যেন কৌতূহলময় কাহিনিকে ব্যক্ত করছে। শরীরী বিভঙ্গ ও চুলের বঙ্কিম ছন্দের ছড়ানো বিপন্নতা রোমাঞ্চকর।
কয়েকটি মোটা বইয়ের উপরে একটি উন্মোচিত খোলা বই, পাশে দাঁড় করানো বই— জলরঙের এই কাজটিতে প্রদীপ মিত্র আলো ও অন্ধকারকে যে ভাবে দেখিয়েছেন, ব্রিটিশ জলরং ঘরানাই মনে পড়ে। অন্য কাজগুলিও দৃষ্টান্তমূলক। রং চাপানো ও ট্রিটমেন্ট অসাধারণ।
টেম্পারায় নারীর চার রকম মুহূর্তকে দড়ির মতো পাকানো ব্যারিকেডের অন্ধকার গুহাসদৃশ আবহে দুরন্ত রোম্যান্টিকতা তৈরি করেছেন অতীন বসাক। আপাত হালকা বর্ণের রোম্যান্টিক কল্পজগতের নারীরা নিত্য দেখা ‘অর্ধেক আকাশ’। বড় ভাল কাজ।
সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য দ্বন্দ্বে অখিলচন্দ্র দাসের অনবদ্য ভাস্কর্যগুলি বড় মোহময়। অতনু ভট্টাচার্যের কালো চওড়া ব্রাশের ক্যালিগ্রাফি-গুণান্বিত ড্রয়িংগুলির ফোর্স ও ভঙ্গি চমৎকৃত করে।
রচনা, টেকনিক ও উপস্থাপনায় রাজেন মণ্ডল প্রখর বুদ্ধিমত্তার ছাপ রেখেছেন।
তিন নবীন সদস্যের মধ্যে ভোলানাথ রুদ্রের জলরঙে অতি পরিচ্ছন্ন ফিনিশিংয়ের ফলে কাঠিন্য এসেছে। সৌমেন খামরুইয়ের টেম্পারায় জ্যামিতিক নিসর্গে একঘেয়েমির আভাস। ডেভিড মালাকারের ডিটেলের গুণ, মিশ্র মাধ্যমের দক্ষতা ও রচনার ভারসাম্য এক গভীরতা আনে।
অতনু বসু
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy