Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪

জল ও রঙের সহাবস্থানে সুন্দর-অসুন্দরের চিত্রময়তা

এ সমস্ত কথাই মনে হল সদ্য অ্যাকাডেমিতে শেষ হওয়া ‘এফেক্ট’ নামে চার শিল্পীর ৪০টি জলরঙের একটি প্রদর্শনী দেখে।

জলছবি: ‘এফেক্ট’ প্রদর্শনীর কাজ। অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে

জলছবি: ‘এফেক্ট’ প্রদর্শনীর কাজ। অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে

অতনু বসু
শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

জলরং। মাধ্যমটির মাদকতা ও মায়াচ্ছন্নতা আজও বরেণ্য ও স্মরণীয় শিল্পীদের বহু কাজের জড়োয়া গয়না। অনেক রকম পর্যায়কে নিবিড় ধারাবাহিক অনুশীলনের পরেও জলরং অবলীলায় দৃষ্টিনন্দন হয়ে ওঠে না। মাধ্যমটিকে জানতে হয় নানা ভাবে। কাগজের গুণাগুণ, টেক্সচার, ওজন, জলধারণ ক্ষমতা, রঙের ঘনত্ব ও তারল্য, ব্যবহারিক প্রয়োগ, ব্রাশিং, রঙের মিশ্রণ পদ্ধতি ও পটে তাকে বিস্তৃতি দেওয়া—এমন আরও কিছু সূক্ষ্মতা ও সময়ের তারতম্যের প্রভেদ সম্পর্কে জ্ঞান থাকা জরুরি। যে কারণে জলরং মাধ্যমটিকে ভাল লাগলেও অনেকেই এড়িয়ে যান তার প্রয়োগ-ব্যর্থতার কারণে। খুব কম শিল্পীই শুধু মাত্র জলরং নিয়ে চর্চা করেন।

এ সমস্ত কথাই মনে হল সদ্য অ্যাকাডেমিতে শেষ হওয়া ‘এফেক্ট’ নামে চার শিল্পীর ৪০টি জলরঙের একটি প্রদর্শনী দেখে।

নিজস্ব স্টাইল, টেকনিককে সকলে বিস্তৃত ভাবে দেখাতে চাইলেও অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থতা প্রকট হয়েছে। কারণ অধ্যবসায়, অনুশীলন কারও কাজে মাত্রাতিরিক্ত কম, তেমনই স্পেসের যথাযথ ব্যবহার ও আলোছায়ার মাত্রাভেদের বাস্তবতাকে কেউ কেউ বুঝতেই পারেননি। দৃশ্যগ্রাহ্য বস্তু ও প্রকৃতির কতটা অংশকে কার্যত শিল্পী তাঁর পটে গ্রহণ করছেন, সেখানে ফর্ম ও শূন্যতার পরিসরকে কী ভাবে রাখবেন, তা বোঝেননি। কারণ স্পট নির্বাচন ও নির্দিষ্ট একটি ফ্রেম ধরে কাজ করা আর প্রাকৃতিক অবস্থার রূপ-বর্ণ-আলো-আঁধারের বোধটিকে মস্তিষ্কে রেখে কাজ করা— দু’টি পুরো আলাদা। বাস্তব, না-বাস্তবের রঙিন সমীক্ষা কারও কারও কাজে চমৎকৃত করলেও, কেউ দুর্বলতাকেই প্রকট করেছেন। তা সত্ত্বেও জলরঙের প্রদর্শনীর কথা ভেবে তাঁরা যে এগিয়েছেন, এটিই ভাল কথা।

কবিরুল হক ছাব্বিশ-সাতাশ বছর আগের জলরং দিয়েছেন। বোঝা যায়, আড়াই দশক মাধ্যমটিকে নিয়ে নাড়াচাড়া করেননি। ‘দ্য ফার্স্ট লাইট’-এ ড্রয়িংয়ের যে অনুপুঙ্খময়তা ও আলো-অন্ধকারের নাটকীয় বিন্যাস প্রয়োজন ছিল, সে দিকেই হাঁটেননি। সংক্ষিপ্ত রং ছাড়া, ডিটেলিং এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা ধরা পড়েছে। গেট, সিঁড়ি, দেওয়াল... রং চাপিয়ে সেরেছেন। দূরত্ব থাকলেও মুনশিয়ানা নেই। ‘ব্রিক ফিল্ড টু’ খুবই শিশুসুলভ। ‘ওয়ান’-এ যতটা খেটেছেন, সেখানেও ফাঁকি ধরা পড়ে।

দক্ষতার সঙ্গে জলরংকে ব্যবহার করেছেন পঞ্চানন দাস। মিশ্র রঙে কতটা জলের তারল্য প্রয়োজন এবং কোথায়, চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন। আলোর প্রয়োজনীয় জায়গাগুলিতে রং ও জলের ব্যবহারিক মুনশিয়ানায় তাই রাস্তাঘাট, জনমানব, ট্রাম, রিকশাওয়ালা, দীর্ঘ বাড়ির দেওয়াল এবং আলো-অন্ধকারের দ্যোতনাকে শিল্পী দৃষ্টিনন্দন ভাবেই দেখিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে দূরত্বের আবছায়া দৃশ্যরূপ অথবা বৃষ্টিস্নাত ভেজা শহরের চিত্রে জলরঙের এক অনিন্দ্য আবহ তৈরি করেছেন। কিন্তু দু’-একটি ক্ষেত্রে কেন যে গাঢ় অন্ধকারে থাকা স্থাপত্যের বিপরীতে আলোর বিচ্ছুরণ, অথচ রিকশায় মানবী ও রিকশাওয়ালার শরীরে আলো পড়েনি। রিয়্যালিজ়মের বাস্তবতা ও ড্রয়িংয়ের বোধ যথেষ্ট দখলে থাকা সত্ত্বেও এমনটা কেন হল? নিঃসন্দেহে পঞ্চাননের হাতে জলরঙের জৌলুস জাগ্রত। তবে ফ্রেমে সব জায়গাকেই প্রাধান্য দিতে হবে, এমন নয়। তাঁর ‘সিটি স্ট্রিট’ সিরিজ়ের ওয়ান, থ্রি, ফোর, সিক্স মনোরঞ্জক।

ধীরাজ চক্রবর্তীর জলরঙে না আছে ড্রয়িং, না পরিপ্রেক্ষিত। প্রদর্শনীতে এত দায়সারা কাজ না দিলেই হত। রীতিমতো অনুপযুক্ত, অসম্পূর্ণ। আলো অন্ধকারকে ধরার চেষ্টাটাই সব নয়, যদি না অন্যান্য অংশ ততটা প্রখরতা পায়।

ভ্রমণেচ্ছু সমীরণ সরকার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানের রিয়্যালিস্টিক জলরঙে তাঁর নিজস্ব টেকনিককে প্রাণবন্ত করেছেন। বহু মানুষের জটলা, দু’ পাশে সু-উচ্চ বাড়িঘর, স্থাপত্য, অসাধারণ আলোর বিন্যাস, আপাত-আঁধারের মাঝে দূরের কাঠমান্ডু, ন্যারো লেনে সামনে এগোনো গুচ্ছ মানুষ, পেছনে প্যাগোডা, কখনও কুয়াশা-ধোঁয়াশাচ্ছন্ন ‘হিমালয় মনসুন’ বা ‘মিস্টিক হিমালয়’, ‘কাঠমান্ডু টেম্পল’, ‘রুরাল বেঙ্গল ভিলেজ’ ওয়ান এবং টু, ‘স্টর্ম’ কাজগুলিতে জলরঙের মনোমোহিনী রূপ প্রত্যক্ষ করিয়েছেন। তাঁর রং চাপানো ও তাকে দখলে রাখা চমৎকার।

‘মর্নিং কলকাতা স্ট্রিট’ প্রদর্শনীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ। দু’পাশের বিশাল অট্টালিকাকে প্রায় অন্ধকারে রেখে ঝকঝকে রৌদ্রস্নাত মাঝের রাস্তায় প্রচুর গাড়ির জ্যাম ও দূরে আলো পড়া স্থাপত্যময় অট্টালিকা এমন দূরত্বের কারণেই প্রায় অপসৃয়মাণ— অনন্যসাধারণ ছবি!

অন্য বিষয়গুলি:

Painting Exhibition Academy of Fine Arts
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy